#বাসি_ফুলের_সুবাস
#পর্ব_১৬,১৭
#মাসুরা_খাতুন
১৬
সেদিন রাফিয়া আপুর সাথে কথা বলে আমি শুধু মানসিক ভাবেই শান্তি পাই নি,পেয়েছি নিজের পরিচয়! পেয়েছি নিজের র*ক্তের সম্পর্কের সন্ধান! হ্যাঁ,রাফিয়া আপুই আমার আপন বোন! আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ পনেরো বছর আগেই যাকে আমি হারিয়ে পরের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম।আসলে সেদিন রাফিয়া আপু কে আমার অতীত বলতেই আপু কিছু টা অবাক হয়ে আরও অনেক কিছু জানতে চায়।পরে আপু বলে তার ও বোন রাবেয়া বছর ছয়েকের হবে একরাতে তার কাছ থেকে হারিয়ে যায়। আর হারিয়েছিলো ও ঠিক সেই এলাকাতেই,যেখানে আবির ভাইয়াদের বাড়ি।তারপর আপু আমার বাম হাঁটুর কাছটা দেখতে চায়।সালোয়ার টা কিছু টা ওপরে উঠিয়ে আমার বাম হাঁটুতে গভীর হওয়া একটা দাগ দেখেই আপু আমায় জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে শুরু করে আপু,আর কাঁদতে কাঁদতে বলে আমিই নাকি তার হারিয়ে যাওয়া বোন রাবু! আসলে আমি নিয়ে নিজেও জানিনা,আমার হাঁটুতে কা*টা দাগটা কিসের! তারপর একপর্যায়ে কান্না থামিয়ে বলেন নদীর চরে ছাগলকে নাকি খাওয়াতে গিয়েছিলাম আমি আর আপু।তখন হোঁ*চট খেয়ে হটাৎ পড়ে গিয়ে একটা ভাঙা শামুকের খোল লেগে আমার হাঁটুতে অনেক টা কে*টে যায়।অনেক র*ক্ত পড়ায় আপু ভয় পেয়ে গিয়েছিল, আমায় কোন রকমে কোলে করে নাকি আপু বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল । হাঁটুর কা*টায় টানা কয়েকদিন নাকি আমি বিছানায় পড়ে ছিলাম। তারপর থেকেই আমার হাঁটু তে এ দাগ! রাফিয়া আপুর মুখে নিজের পরিচয় শুনে আমার ও কেমন কান্না পেয়ে গেলো।যে পরিচয় টা না থাকায় আমি এতোটা অবহেলিত, এতোটা অসহায়,আজ সে পরিচয় টা আমার সামনে।এবার আমিও আপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম, আর প্রাণ উজাড় করে কাঁদলাম। তারপর আপুকে বললাম, “আপু আমাদের মা বাবা? উনারা কোথায়? আমাদের মা বাবা নেই? তুমি নিয়ে চলো আমাকে,আমি একবার শুধু নয়ন ভরে আমার জন্মদাতা বাবা মাকে দেখব আপু।যে পরিচয় না থাকায় আমি মানুষের এতো কথা শুনেছি, আমি এবার তাদের কাছে গিয়ে দেখতে চাই কাদের র*ক্ত আমার শরীরে বইছে।নিয়ে চলো আমায় আপু,একবার নিয়ে চলো।”
আমার কান্নার বিপরীতে আপু যেন একটু ভয় পেলো।কিছুটা নড়েচড়ে উঠে আপু আমায় বললেন আমরা কিছুতেই আমাদের গ্রামে যেতে পারবো না।আপুও নাকি দীর্ঘ চৌদ্দ বছর থেকে গ্রামে যায় নি।কিন্তু কেন? সেই কারণ জিজ্ঞেস করলে আপু আমায় যে কাহিনী শুনালো তাতে আমার পৃথিবী যেন কেঁ*পে উঠল! এ কেমন অবিচার হয়েছে আমার পরিবারের সাথে!
নদীর চরের কাছে আমাদের গ্রাম। একদম নদীর ধারের বাড়িটিই আমাদের। আমাদের বাবা নদীতে মাছ ধরতেন আর বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতেন।মা ও বাড়িতে কিছু হঁাস মুরগী, ছাগল পালন করে যা আয় করতেন তা সংসারে লাগাতেন। রাফিয়া আপু আর এক ভাই ছিলো আমার।রাফিয়া আপু সবার বড়,তারপর ভাই, তারপর আমি। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে আপুর চেহারা নিয়ে। গরীবের ঘরে সুন্দর হয়ে জন্মানোটাও দোষের। আপু যখন ক্লাস নাইনে ওঠে তখনই বাঁধে প্রধান অশান্তি। আমাদের এলাকায় চেয়ারম্যানের বখা*টে ছেলের নজর যায় আপুর দিকে।সে নানা ভাবে বিরক্ত করা শুরু করে আপু কে। চেয়ারম্যানের ছেলে খুবই নোংরা চরিত্রের ছিলো,বাবা পরপর কয়েকবারের চেয়ারম্যান হওয়ায় এলাকায় খুবই প্রভাবশালী ছিলো।তাই তো ছেলে কাউকে তোয়াক্কা করতো না,আর নদীর চর এলাকায় বাড়ি হওয়ায় প্রশাসন, আর আইনী সুযোগ সুবিধা ও সেভাবে ছিলো না।চেয়ারম্যানের ছেলে ঝন্টু আর ওর বন্ধু বান্ধবের অ*ত্যাচার দিন দিন বাড়তে লাগল।আগে শুধু দূর থেকে অসভ্যতামি করলেও একপর্যায়ে তা আপুর গায়ে হাত দেওয়াতে পৌঁছালো। আপু কাঁদতে কাঁদতে এসে মা কে জানালে আব্বা চেয়ারম্যানের কাছে তার ছেলের বিরুদ্ধে নালিশ করেন।আর এতে আরও বেশি রে*গে যায় ঝন্টু।রাগের বশে পরিকল্পনা করে পরদিন সন্ধ্যাতেই আপুকে তুলে নিয়ে রে*প করবে।ওদের প্ল্যান প্রায় কমপ্লিট। শুধু পরদিনে আপু স্কুলে আসার অপেক্ষা। কিন্তু আপুর কপাল ভালো ছিলো, ঝন্টুর সাথে থাকা ওরই বন্ধু আপুকে পছন্দ করতো।ঝন্টুর সামনে কিছু বলার সুযোগ না পেয়ে শেষমেশ ঐ ছেলেটি সন্ধ্যায় কোন রকমে আমাদের মায়ের কাছে আসে।আর ঝন্টুর প্ল্যান সম্পর্কে সবকিছু বলে দেয়।ও এটাও বলে যে এ গ্রামে থাকলে আজ না হোক কাল ঝন্টু আপুর সর্ব*নাশ করেই ছাড়বে।তাই খুব তাড়াতাড়ি যেন আপুকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়।সাথে আমারও এ গ্রামে থাকা উচিত হবে না বলে জানায় ও। আম্মা ভিষণ আ*তংকগ্রস্থ হয়ে পড়ে।তারমধ্যে আবার আকাশ নিকষ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। প্রকৃতি ও যেন আজ আমাদের সাথে ভ*য়াবহব খেলায় মেতেছে! এমন খারাপ আবহাওয়ায় বিপদে পড়লে কাউকে ডাকলেও তো ঘর থেকে বের হবে না। আম্মা একপর্যায়ে দিশেহারা হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতেই আমাদের গ্রামের বাইরে পাঠিয়ে দেবে।আমাদের ঘর বাঁশের আর টিনের বেড়া দিয়ে বানানো।এমন ঘরে যোকোন দিক থেকেই ধা*ক্কা দিয়ে ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করা যাবে।তাতে আবার ঘরে কোন শক্ত সামর্থ্য পুরুষ মানুষ ও নেই। আব্বা গ্রামের আরও কিছু লোকজনের সাথে মৌসুমি ধান কা*টতে অন্য এলাকায় গেছে।প্রতিবছরই আব্বা এমন কাজে যায়,আর পনেরো ষোল দিন কাজ করে অনেক টা ধান পায়।ঐ ধান দিয়েই আমাদের ভাতের চাহিদা মেটে। দশ বছরের একট ছেলে আর ঘরে দুটো মেয়ে কে নিয়ে আম্মা এই ঝড় বৃষ্টির রাতে দিশাহারা হয়ে যান।আর গ্রামে চেয়ারম্যানেরা ও প্রভাবশালী। ঝন্টু একবার যেই মেয়ের দিকে নজর দেয় তার সর্ব*নাশ করেই ছাড়ে। আম্মা ঘরে ভাইকে একা রেখে ঘরে যেটুকু টাকা ছিলো তা সাথে নিয়ে যখন একটু অন্ধকার অন্ধকার হয় তখনই আমাদের দুবোন কে নিয়ে বের হয়।আমি তখন ছ বছরের। অতো কিছু বুঝতাম না।শুধু মা আর বোনের সাথে অন্ধকারে হাঁটছিলাম। জানো*য়ারের কাছে বাচ্চা কি? আর যুবতিই বা কি? তাই তো আম্মা নাকি কোন ঝুঁকি নিতে চান নি।তারপর আম্মা আমাদের নিয়ে সোজা স্টেশনে আসেন।রাত আটটায় ট্রেন আসবে ঢাকার।আম্মার এক দূরসম্পর্কের খালা ঢাকায় থাকেন,তারই ঠিকানা দেয় আপুকে।আপু যেন আমাকে নিয়ে ঐ খালার কাছে যায়, আর একটা কাজ নিয়ে তাও ইজ্জত বাঁচিয়ে জীবন টা নিয়ে বেঁচে থাকে।আর আম্মা কয়দিন পর ঢাকায় গিয়ে আমাদের দেখে আসবেন বলে দেয়।আপু ক্লাস নাইনের ছিলো, তাই খুব একটা ছোট নয়।আম্মা ট্রেনের টিকিট কে*টে দিয়ে আমাদের স্টেশনে বসিয়ে রেখে বাড়ির উদ্দেশ্য চলে আসে।কারণ এমনিতেই চর এলাকা,তাতে আবার আকাশের পরিস্থিতি ও খুব খারাপ। ঘরে দশ বছরের ভাইকে একা রেখে এসেছে। শয়তান গুলো যদি আপুর ক্ষ*তি করার জন্য আসে,আর ঘরে কাউকে না পেয়ে ছোট ভাইটা কেই মে*রে রেখে যায়! তাই তো আম্মা খুব তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে গ্রামের পথ ধরে। আর তখনই স্টেশনে বসে থাকতে থাকতে আপু আমায় বসিয়ে রেখে স্টেশনের বাথরুমে যায়।আর ফিরে এসে দেখে আমি নেই।আপু নাকি সেদিন অনেক খুঁজেছিল আমায়।একমাত্র সম্বল ছোট বোন টাকে হারিয়ে আপু কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।সবদিক টা কাঁদতে কাঁদতে খুঁজতে শুরু করে। অবশেষে ট্রেন চলে আসে,আর আপু ও আমায় হারিয়ে একায় ট্রেনে উঠে পড়ে।আর তারপর থেকেই কি যেন করে আমি আবির ভাইয়াদের বাড়িতে আশ্রয় পেলাম। আর হয়ে গেলাম পরিচয়হীন।
আপুর কাছে এতোটা শুনে আমি কান্নায় নিজেকে সামলাতে পারলাম না।দুবোন মিলে অনেক টা কাঁদলাম। তারপর আপু কে বললাম,
“আপু,আম্মার কি হয়েছিলো আপু? আর আব্বা আর আমাদের ছোট ভাই টায় বা কোথায় আপু? বলো আপু, বলো আমায়? তুমি কি আর গ্রামে গিয়েছিলে?”
“নারে বোন,আমি আর গ্রামে যায় নি।কিন্তু আমাদের বদলে আমাদের আম্মাকে দিতে হয়েছিল কঠিন মা*সুল।আমি ঢাকায় যাওয়ার পর অনেক কষ্টে আম্মার সেই খালার ঠিকানা খুঁজে পাই।তোকে হারিয়ে আমি একেবারেই ভেঙে পড়ছিলাম।উনার বাসায়ই কিছু দিন থাকি।কিন্তু আম্মা আসেনা।একবার চিন্তা করি গোপনে একবার গ্রামে গিয়ে দেখবো কি হলো,কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে আম্মা যদি তার আদরের ছোট মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করে তখন আমি কি উত্তর দেবো? আমি কি করে বলবো আমি আমার ছোট্ট বোন টাকে হারিয়ে ফেলেছি।এই সংকোচে আর গ্রামে যাই না।কিন্তু উনার বাড়িতে ও বেশি দিন থাকতে পারছিলাম না।এই ঢাকা শহরে স্থায়ী অতিথি কারও পছন্দের নয়।আমি বুঝতে পারছিলাম ওখানে আমাকে সবাই বাড়তি ঝামেলা মনে করছে।তখন আমি সিদ্ধান্ত নিি আমি আর ওখানে থাকবো না।পরে ঐ নানী কে বলে আমি উনার বাসা ছাড়ি।কাজ নেয় গার্মেন্টসে।আর আমার ঠিকানা টাও ঐ নানী কে দিয়ে আসি।যদি কখনও আম্মা আসে আর আমার খোঁজ করেন তবে যেন খুঁজে পায়।কিন্তু দিন যায়, মাস যায় বছর যায় আম্মা আসে না।শেষে সিদ্ধান্ত নেয় যা হবার হবে আমি গ্রামে যাব,একটু খানি খবর নিয়ে আসবো কেমন আছে আমার পরিবার। বেরিয়ে যায় বাড়ির উদ্দেশ্যে।কিন্তু ঢাকা থেকে গ্রামের ঐ স্টেশনে গিয়ে নামতেই দেখা হয় এলাকার এক ভাইয়ের সাথে। উনি আমায় দেখে চমকে যান।আমি এতোদিন কোথায় ছিলাম জানতে চান, আর তোর খোজ করেন।আমি ঐ ভাই কে বলি আমি তোকে হারিয়ে ফেলেছি। ভাই আমায় বলে আমি যেন এক্ষুনি ওখান থেকেই ঢাকায় ফিরে যায়।আমার গ্রামে যাওয়া ঠিক হবে না।তখন আমি বলি, অন্তত আমার আম্মা আব্বা কেমন আছে সেই খবর টা তো দেন? তখন ভাই আমায় সব খুলে বলে।সেদিন রাতে আম্মা আমাদের রেখে যাওয়ার পর রাতে ভিষণ ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়।নদীর পাড় ভাঙতে শুরু করে। আম্মা সারারাত ভাইটাকে নিয়ে জেগে থাকেন।শেষ রাতের দিকে সত্যিই ঝন্টু ওর দলবল নিয়ে আসে।ঘরের বেড়া ভেঙে ঘরে ঢোকে। কিন্তু আমাকে না পেয়ে আম্মার ওপর অত্যাচার করে।আমাদের কোথায় রেখেছে জানতে চাইলে আম্মা বলে না।তখন আম্মার চুল ধরে বাইরে নদীর পাড়ে নিয়ে যায়।ওখানেই কু*পিয়ে হ*ত্যা করে আমাদের আম্মা কে।লা*শ পড়ে থাকে নদীর চরে। ছোট ভাই তখনও ঘুমোচ্ছিল।আসলে ঝড়ের তান্ড*বে সারারাত ও জেগে ছিলো।ছোট মানুষ তাই ঘুমিয়ে গেছে আর বাইরে এতোকিছু হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।সকাল বেলা সকলে আম্মার ক্ষ*ত বিক্ষ-ত দে*হ নদীর চরে পায়।খবর পেয়ে আব্বা কাজ থেকে চলে আসে।কিন্তু আম।আম্মার খু*নের কোন বিচার হয় না।চেয়ারম্যান হু*মকি দেয়, যদি কে*স কাবারি করে তো ছোট ভাইটাকে ও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে।আব্বা গরীব মানুষ,ভয়ে আর সাহস পায় না কিছু করার।”
“থামো আপু থামো! আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।এতোটা অত্যা*চার,এতোটা নির্ম*মতা হয়েছিল আমার পরিবারের সাথে? আমার আম্মাকে এভাবে ব*লি হতে হয়েছিল পশুদের। এ কেমন অতীত তুমি আমায় শোনাচ্ছ আপু? তারচেয়ে নিজের অতীত না জেনেই ছিলাম ওটায় ভালো ছিলো।অন্তত প্রিয় মানুষ গুলোর এতোটা যন্ত্র*ণা শুনে বুকের ভেতর এতো কষ্ট হতো না।আপু আব্বা? আব্বার কি হয়েছিল? আর আমাদের ভাই? ”
“আব্বা আর ছোট ভাই এখনও গ্রামেই আছে।আমি সেদিন স্টেশন থেকেই ফেরত এসেছিলাম।আম্মা নিজের প্রাণ দিয়ে আমাদের বাঁচিয়েছে তাই একা একা ওখানে যাওয়া আমার উচিত মনে হয় নি।ঐ ভাইয়ের কাছে থেকে জেনেছি আব্বা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন।ভাই কে আর আব্বাকে দেখাশোনা করার জন্য ও একজন লোকের খুব দরকার ছিল। এখন আমাদের ভাই বড় হয়েছে আর শুনলাম গত বছর নাকি বিয়ে ও করেছে। আব্বা এখন ও বেঁচে আছেন।ভাই ই দেখাশোনা করে আব্বার।”
“আপু,আমি এতো কাছে ছিলাম তাও নিজের বাবা ভাইকে চিনতে পারিনি।মাত্র কয়েক গ্রাম পরেই তো থাকতো আমার বাবা ভাই।অথচ আমি দিনের পর দিন পরিচয়হীন,অনাথ,কখনও আবার বেজ*ন্মার তকমা পেয়ে এসেছি? আপু চলো,আমরা এখন যাবো আমাদের গ্রামে।নিজেদের বাবা ভাইকে দেখে আসবো।যাবে তো আপু? ”
“হ্যাঁ রে।এখন তুই এসেছিস এখন আমরা অবশ্যই যাব,কিন্তু কিছু দিন পর।আর কয়েকদিন পরই নির্বাচন, এবার ঝন্টুদের হার নাকি নিশ্চিত। নির্বাচন টা হয়ে যেতে দে,তারপর আমরা দুবোন গিয়ে আম্মার কবর আর আব্বা ভাইকে দেখে আসবো।এখন যাওয়া ঠিক হবে না।কারণ ভুলে যাস না আমাদের মায়ের প্রাণের বিনিময় আমরা দুবোন বেঁচে আছি।তাই এতো তাড়াতাড়ি শয়তান টার কাছে হেরে গেলে চলবে না।”,,,,,,,,
চলবে,,,,,,,,
#বাসি_ফুলের_সুবাস
#পর্ব_১৭
#মাসুরা_খাতুন
রাফিয়া আপু কে পেয়ে যেন আমি বেঁচে থাকার আরও শক্তি পেলাম।কে বলেছে আমার পরিচয় নেই? এই যে আমার পরিচয়, আমার বড়বোন,আমার পরিবার! একদিন রেমি আপুর বাসায় ও রাফিয়া আপু কে নিয়ে গেলাম। রেমি আপু ও খুব খুশি হলো এতোদিনে আমার মনের আক্ষেপ টা মেটায়।রাফিয়া আপুও বারবার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলো রেমি আপুর কাছে, আমাকে এতো সাহায্য করার জন্য, আমায় এতো ভালোবাসার জন্য।
ঐদিকে গ্রামে আমি রাশেদের বাবার কাছে থেকে বিশ হাজার টাকা পেয়েছিলাম তা ওখানেই খালাম্মার কাছে রেখে এসেছিলাম।খালাম্মা ঐ টাকা দিয়ে কিছু ছাগল কিনে অন্যকে দিয়েছিলেন পালতে।প্রায় একবছর হতে চলল,সেই টাকা এখন প্রায় পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি হয়ে গেছে। এর মধ্যে আমি একবার গ্রামে গিয়েছিলাম রাশেদ কে দেখতে। ছেলেটাকে না দেখে আর থাকতে পারছিলাম না। আমি সরাসরি আমার ননদের বাড়িতে যাই,কারণ ও বাড়িতে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার ননদ অর্থাৎ খোদেজা আপা প্রায় কেঁদে ফেলেন আমায় দেখে।লজ্জায়,আর কষ্টে উনি যেন আমার দিকে তাকাতে পারছিলেন না।ভাইয়ের করা অ*ন্যায়ের জন্য মানুষ টা আমার চোখে যেন চোখই রাখতে পারছেন না।বারবার আমার সাথে হওয়া অন্যা*য়ের জন্য ক্ষমা চাচ্ছিলেন।আমি আপা কে বোঝালাম।আমি উনাকে বললাম , যেন উনি ওই বিষয় টা নিয়ে অনুশোচনা না করেন,কারণ আমার সাথে অন্যা*য় হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এখন আমি ভালো আছি। অনেক সম্মান নিয়ে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে আছি।আর এখানে থাকলে চোখের সামনে এতো অন্যা*য় দেখে আমি প্রতিদিন একটু একটু করে ম*রে যাচ্ছিলাম আপা।হ্যাঁ এটা ঠিক আমি আমার সন্তান কে কাছে পাইনি এটা একজন মা হিসেবে ভিষণ কষ্টের।কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাটাও ভিষণ দরকার আপা।আর আমি নিজেকে চিনতে পেরেছি, নিজের জীবন টার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি, নিজেকে মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করেছি। তাই আমার কোন অভি*যোগ নেই আপা,আপনি ও আমার কাছে নিজেকে অপ*রাধী মনে করবেন না।আপনি যে বড্ড ভালো মানুষ!
আপা আমার কথায় যেন নিজের স্বস্তি টা পেয়েছিলো।তারপর আমি উনাকে বলি রাশেদ কে একটি বারের জন্য নিয়ে আসতে,আমি আমার ছেলেটি একবার দেখতে চাই।উনি গিয়ে এনেছিলেন রাশেদ কে। এই কয়েক মাসেই রাশেদ আমার অনেক টা বড় হয়ে গেছিল।প্রথম আমায় দেখে আমার সন্তানই চিনতে পারছিলো না।কাছে ঘেঁষছিল না আমার।আমার ভিষণ কান্না পেল,বুকের ভেতর চাপিয়ে রাখা কষ্ট গুলো উজাড় করে আমি কাঁদি।আজ আমার সন্তান, আমার বুকের মানিক আমায় চিনতে পারছে না।এর থেকে কষ্টের,এর থেকে ব্যর্থতার একজন মা হিসেবে আর কি হতে পারে! অনেক টা সময় পর
রাশেদ আমার সাথে স্বাভাবিক হয়।আমি রাশেদের জন্য কিছু পোশাক আর চকলেট নিয়ে গিয়েছিলাম,ওগুলো ওকে দিই। ছেলেটা আমার ভিষণ খুশি হয় নতুন পোশাক আর চকলেট পেয়ে!
তারপর আপাকে জিজ্ঞেস করি সেই মানুষ টির কথা,যে আমার রাশেদের বাবা! উনি এখন কেমন আছেন জানতে চাইলে আপা যা বললেন তা শুনে সত্যিই আমার ভালো লাগলো।
আমি চলে যাওয়ার মাস খানেক পরেই বড়ভাবির স্বামী বিদেশ থেকে আসেন।আর আসার পর থেকেই উনি বড়ভাবিকে ভিষণ চোখে চোখে রাখেন।হয় তো এলাকার লোকের কাছ থেকে উনিও কিছু শুনেছিলেন।বড় ভাবির সব স্বাধীনতা কে*ড়ে নিয়ে তাকে যথেষ্ট নজরব*ন্দী করে রাখেন। এ দিকে রাশেদের বাবাও নাকি একদিন ঘরে একা একা শুয়ে ছিলেন। ঐ সময় বাইরে এক উঠোনে মহিলাদের তালি*ম হচ্ছিল। সেখানে নামাজ, রোজা,মৃ*ত্যুর পরের জীবন নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। একা একা শুয়ে থেকে উনি ওগুলো শুনেন।মহান রবের দয়ায় উনার ভেতরে ভ*য় জন্ম নেয়,মৃ*ত্যুর ভ*য়! একা একায় উনি নিজের জীবনে করা পা*প গুলো মনে করে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন।নিজের আপন বড়ভাবির সাথে অ*বৈধ সম্পর্ক রেখে উনি নিজের স্ত্রীর সাথে যেই অন্যা*য় গুলো করেছেন সবগুলো মনে পড়ে তার।মৃ*ত্যুর পরে পরকালে কি জবাব দেবেন এই ভ*য়ে কাঁদতে শুরু করেন। উনার কান্নার আওয়াজ পেয়ে বাইরেথেকে দু তিনজন মহিলা এসে উনাকে বোঝান।তওবা করে ভালো হয়ে যেতে বলেন।আল্লাহ ক্ষমাশীল।পা*প করে পরে সেই পা*প টা বুঝতে পেরে অনুশোচনা করে তওবা করে চোখের পানি ঝরালে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করে দেন।উনিও নিজের ভুল বুঝতে পেরে কান্নাকা*টি করেন। সেদিনের পর থেকে উনি সম্পূর্ণ বদলে যান।নিয়মিত নামাজ পড়া,ইত্তেফাক এ যাওয়া শুরু করেন।গ্রামের মানুষজন ও উনার এমন বদলে যাওয়া দেখে খুশি হোন।পরে গ্রামবাসী সবাই মিলে টাকা তুলে উনাকে ট্রলি ভ্যান কিনে দেন।বর্তমানে উনি একদম ভালো হয়ে গেছেন।রাশেদ কেও খুব ভালোবাসেন,আর বড়ভাবির সাথে ও সবরকম সম্পর্ক বন্ধ করে দেন।গতমাসে নাকি একটা সামান্য বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়ে দেখে বিয়ে ও করেছেন।সবটা শুনে সত্যিই ভালো লাগলো।আল্লাহ মহান।এক মুহুর্তে সব কিছুর সমীকরণ আলাদা করে দিতে পারেন।শেষ পর্যন্ত মানুষ টা সঠিক পড়ে এসেছে শুনে সত্যিই ভালো লাগলো।অতঃপর আমি আবার ঢাকায় চলে আসি।রাশেদকে নিয়ে ও আমি এখন অনেক টা চিন্তামুক্ত।কারণ আপা বললেন , উনার দ্বিতীয় স্ত্রী ও নাকি রাশেদ কে খুব ভালোবাসে,খুব যত্ন করে। বুদ্ধিসুদ্ধি একটু কম হওয়ায় হিং*সে করে সতি*নের ছেলেকে অবহেলা করার মতো জ*টিলতা উনার ভেতরে নেই। আর রাশেদ ও উনাদের কাছে ভালো আছে।কিছু টা চিন্তা মুক্ত হয়েই এবারে আমি ঢাকায় ফিরেছি।
কিন্তু এখানে এসে দেখি আরেক পাগলামি! উনি মানে সেই দোকানদার সাহেব! একদিন আমায় এ রাস্তা দিয়ে যেতে না দেখেই সোজা আমার বাসায় চলে আসছে।আমার কোন সমস্যা হলো নাকি,শরীর খারাপ নাকি এগুলো জানার বড় গুরুদায়িত্ব উনার ওপর চেপেছে। তাই তো সক্কাল সক্কাল চলে এসেছেন।আমিও সবে মাত্র সকালেই এসে বাসায় ফিরলাম। ওখান থেকে রাতের ট্রেনেই এসেছি, লক্ষ্য সকালে ঢাকায় পৌঁছে ফ্যাক্টরিতে যাবো।কিন্তু এতো সকালে বাড়িতে ঢুকেই উনাকে দেখে চমকে যাই।রাফিয়া আপুর সাথে খুব সুন্দর করে গল্প করছেন।ভাগ্যিস, আমার খোঁজে এসে সরাসরি রাফিয়া আপুকেই জিজ্ঞেস করেছে।নয়তো অন্য কাউকে আমার খোঁজ জানতে চাইলে না জানি কি ভাবতো!
“কি ব্যাপার আপনি এখানে? ”
“কেন,থাকবো না মানে? এই মেয়ে গ্রামে যে যাবো আমায় একটা কথা বলে যাবে না? আমি কতো চিন্তা করছিলাম,কেন আসছো তাই।”
“কেন আপনি আমার জন্য চিন্তা করবেন কেন? আর আপনাকেই বা বলতে যাবো কেন? ”
“চিন্তা হবে না বুঝি? হুট করেই যদি দেখি রাস্তা দিয়ে রোজ যাওয়া মানুষ টা আজ যাচ্ছে না। চিন্তা হবে বুঝি?”
“ওওও তাহলে আপনি ঐ রাস্তা দিয়ে যাওয়া প্রত্যেকটা মানুষেরই এমন খোঁজ নেন তাইনা? কে কবে গেলো না, কার কি হয়েছে? এগুলোই খোঁজ নেন।কতো দায়িত্ব আপনার! ”
“নাআআ,সসবার খোঁজ নেব কেন? সবাই আর তুৃমি কি এক? ”
“এক নই? ”
“না”
“এই রাবু,এবার তোরা ঝ*গড়া থামাবি! কাজে যেতে হবে আমার,দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”
“হ্যাঁ হ্যাঁ আপু চলেন,আমিও এগিয়ে দিচ্ছি আপনাদের। ”
“এই কেন? আপনি এগিয়ে দেবেন কেন? আমরা একায় যেতে পারি।”
কবীর ফিসফিস করে বলল,
“বড় আপাকে এইটুকু সম্মান করতে হবে না! হাজার হোক,বড় আপা! ”
“মানে? আমার আপাকে আপনি আপা বলছেন কেন? ”
“ওমা,আজ বাদে কাল তো বড়আপা বলতেই হবো,তাই এখন থেকেই বলে অভ্যাস করে নিচ্ছি।”
‘হুহ্! কতো স্বপ্ন! বললেই হলো? ”
তারপর রাফিয়া আপু আর রেমি আপু মিলে ছেলেটার খোঁজ নেয়, কিন্তু ভালো ছাড়া কেউ খারাপ বলে না। ওরা সিদ্ধান্ত নেয় সত্যিই এবার আমায় দ্বিতীয় বার বিয়ে দিবেন। কিন্তু আমি জিদ ধরে বসি,রাশেদের জন্য কিছু না করে আমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে বসবো না,,,,
চলবে,,,,,,,