বাসি_ফুলের_সুবাস #পর্ব_১৯ (শেষ পর্ব)

0
474

#বাসি_ফুলের_সুবাস
#পর্ব_১৯ (শেষ পর্ব)
#মাসুরা_খাতুন

আমার শর্তগুলো শুনে কবীর কিছু টা রাগ করলো।মুখটা ভারী করে বলল,

“এতোদিন পর তোমার এসব শর্ত দিয়ে আমায় বিয়ে করতে হবে রাবু? এতোদিনে এই চিনলে আমাকে? যেই ছেলেটা তোমার জন্য দু’বছর ধরে অপেক্ষা করছে, যে ছেলেটা শুধু তোমার মুখপানে তাকিয়ে ছিলো,শুধু তুমি কবে হ্যাঁ বলবে এই অপেক্ষায়! আর তাকে আজ এসে তুমি নতুম করে শর্ত দিচ্ছো? আরে,আমি তো আগে থেকেই তোমাকে বলেছি, রাশেদের জন্য যা করার তুমি করবে,ওর জন্য একটা সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার তুমি দেবে আমি কখনও না বলেছি তোমায়? আমি তো এটাও বলেছিলাম যে তুমি যদি চাও তো,রাশেদের দায়িত্ব নিতেও আমি রাজি।তুমি যা চাইবে তাই হবে রাবু।”

কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে আসলো আমার! ছেলেটির সমর্থন দেখে,ওর ভালোমানুষিতা দেখে, ওর সুন্দর চিন্তাভাবনা দেখে।আমি কিছু বলতে পারলাম না,শুধু অবাক নয়নে একবার চোখ তুলে দেখলাম এ বিশাল মনের মানুষটিকে।

সেও মনে হয় আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো।তাই কিছু টা হেসে বলল,

“তোমায় এসব নিয়ে কিচ্ছু চিন্তা করতে হবে না।আমি আমাদের বিয়ের আগেই তোমাকে ব্যাংকে নিয়ে যাবো।তুমি যেভাবে ইচ্ছা ওভাবেই টাকা রেখো।চাইলে একেবারে রাশেদ সাবালক হওয়া পর্যন্ত মেয়াদ দিয়ে রাখতে পারো।বুঝলে?”

“আমি সত্যিই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ,সত্যিই আপনার মতো মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার! সারাজীবন এমন ভালো থাকবেন তো? কখনও খারাপ হবেন না? অনেক কষ্ট সহ্য করা জীবন আমার,আর কষ্ট পেতে চাই না।একটু ভালো থাকতে চাই, রাখবেন তো ভালো আমায়?”

“রাখবো,সারাজীবন তোমাকে ভালো রাখবো রাবু।কখনও আর কোন কষ্ট পেতে দেব না।একটু ভরসা করো আমায়। ”

“হুম করি।করি বলেই তো এতোটা কষ্ট সহ্য করে এসে একমাত্র ভরসা হিসেবে আপনার হাত ধরতে চাচ্ছি। আর রাশেদ কে আমি এখানে আনতে চাইনা।যখন চেয়েছিলাম তখন ছেলেটাকে কাছে পাই নি।আর এখন ও ওখানেই ভালো আছে।আসলে, জীবনে বাবার পরিচয় টাও ভিষন দরকার, বাবার ছায়া পেলেও দ্বিগুন শক্তি পাওয়া যায়। আর আমি নিজে পরিচয়হীন হয়ে দেখেছি, তাই আমি চাই আমার রাশেদ ওর বাবার পরিচয় নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচুক। আর ওর বাবাও এখন ভালো হয়ে গেছে, উনার স্ত্রী ও রাশেদকে ভালোবাসে।রাশেদের জন্য ওটায় এখন সবচেয়ে যোগ্য আর সম্মানের স্থান। ”

“তুমি যা ভালো বোঝ।তবে তোমার যখন ইচ্ছে গিয়ে রাশেদ কে দেখে এসো।”

অবশেষে আমাদের বিয়ে হয়। গ্রাম থেকে আব্বা, ভাবি, ভাই ও আসে এখানে। রেমি আপু ও ভাইয়া কে নিয়ে আসে আমার বিয়েতে।

আরও একজন এসেছিল,আবীর ভাইয়া! কোথা থেকে যেন ভাইয়া খবর পায় আমি রেমি আপুর কাছে আসি।আমাদের বিয়ের কিছু দিন আগে ভাইয়া সোজা চলে আসে রেমি আপুর বাসায়। ওখান থেকে আমার ঠিকানা নিয়ে আমার বাড়িতে। খুব বকেছিলো আমায়,কেন আমি তাকে কিছু জানাই নি? কেন এতোদিন কোন যোগাযোগ করিনি? অনেক কষ্টে ভাইয়াকে মানাতে হয়েছিল। সেদিন ভাইয়া ও বাড়িতে থেকে চলে আসার পরে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল আমায়।বড়ভাবি না না রকম বিশ্রী সম্পর্ক জুড়িয়ে দিয়েছিলেন ভাইয়ার সাথে।রাশেদের বাবাও গায়ে হাত তুলেছিলো বড়ভাবির মুখ থেকে শোনা বিশ্রী কথায়।রাগে অভিমানে আমি ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই।কখনও আর যোগাযোগ করিনি, এমন কি আমার ঢাকা আসার ও খবর কেউ জানতো না ও বাড়ির। ভাইয়া নাকি একদিন গিয়েছিল ও বাড়িতে, আর গিয়ে শোনে আমার ও বাড়ি থেকে ছাড়াছাড়ির ব্যাপারে।কিন্তু আমার কোন খোঁজ না পাওয়ায় নাকি চিন্তা করতো।কোথাও খুঁজতেও পারেনি,কোথায় ই বা খুঁজবে? আমার তো কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য ছিলো না,যেখানে খোঁজ করবে! অবশেষে একদিন নাকি রেমি আপুর মা খালাম্মা কে ফোনে রেমি আপুর সাথে কথা বলার সময় আমার ব্যাপারে বলতে শুনেছে। আর ওখান থেকেই ঠিকানা নিয়ে চলে আসে। ভাইয়াকে আমি সবটা বলি।আমার নিজের পরিচয় পাওয়া, কবীরের সম্পর্কে।সবটা শুনে ভাইয়া ও খুব খুশি হয়! এতোদিনে আমি সুখ খুঁজে পেয়েছি বলে।

বাসর ঘরে আমি অপেক্ষা করি ঐ মুদি দোকানদার টার জন্য। কিছু ক্ষণ পরপরই চলে আসে ও।শুরু হয় আমাদের নতুন জীবন। সব কষ্ট, না পাওয়া,ব্যথা কে ভুলে আমি নিজের নতুন জীবন শুরু করি।প্রথম প্রথম অবশ্য খারাপ লাগতো।জীবনে দ্বিতীয় পুরুষের ছোঁয়া যে একটা মেয়ের জন্য কতোটা কষ্টের তা শুধু সেই জানে।হ্যাঁ কবীর খুবই ভালো মানুষ, সে তুলনায় খলিল ছিলো একদম জিরো।কবীরের ব্যক্তিত্বের সাথে খলিল কে তুলনা করাও ভুল।কিন্তু প্রথম প্রথম স্পর্শ গুলো কেমন কষ্টদায়ক লাগতো।জীবনে দ্বিতীয় পুরুষের ছোঁয়ায় প্রথম পুরুষের ছোঁয়া মনে পড়ার মতো জঘন্য অনুভূতি আর কিছু হতে পারে না। কবীর ও মনে হয় বুঝতে পারে আমার ভ*য়ানক দ্বিধাবোধ গুলো।সেও আশ্বাস দেয়,আমাকে বোঝায়,আমার মনোভাব কে গুরুত্ব দেয়।এটা ঠিক আমি হয়তো কখনও রাশেদের বাবাকে তার নোংরা ব্যবহারের জন্য মন থেকে গ্রহণ করতে পারিনি।কিন্তু তারপর ও সে ছিলো প্রথম অনুভূতি, প্রথম পুরুষ জীবনে।

আমার ভাগ্য আমি কবীরের মতো মানুষকে পেয়েছি। সে তার ভালোবাসা, যত্ন আর সহোযোগিতা দিয়ে আমার সব দ্বিধা কা*টিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। জীবনের সব কষ্ট গুলো একে একে মুছে গিয়ে জীবন কে নতুন ভাবে চিনিয়েছে। নিজের একটা সুন্দর গোছানো সংসার দিয়েছে।

আজ আমার আরও দুটো ছেলে হয়েছে। কবীরের ছোট্ট দোকানটাও এখন অনেক টা বড়! আমার ছেলে গুলোর যতো দায়িত্ব সব আমার বড় ভাসুর আর ভাবিই পালন করে।উনারা আজও নিসন্তান। কিন্তু আমার দু ছেলে উনাদের কাছে সন্তানের থেকে কম কিছু নয়। কে বলেছে জা মানেই খারাপ! অ*ত্যাচারী! এটা যে একদম ভুল কথা তা আমি উনাদের সাহচর্য পেয়েই বুঝেছি। ভিষণ ভালো মানুষ আমার জা।আমার ছেলে দুটোই যেন সব উনার কাছে।আর আমার পরপর দুটো ছেলে হওয়ায় উনি ভিষণ খুশি। সবাই আমাকে অনেক প্রাধান্য দেয়।আমিও ভাবিকে আপন বোনের চেয়ে কম দেখিনা।ইচ্ছে করেই ছেলে দুটোকে উনাদের ঘরে রেখে আসি।বলে আসি,তোমাদের ছেলের এতো ঝামেলা আমি সইতে পারবো না।যা করার করো।

উনিও ভিষণ খুশি হোন ছেলেকে পেয়ে। আমি চাই না কখনও মানুষ দুটো সন্তান না থাকার অনুভূতি নিয়ে বাঁচুক। বরং আমার ছেলেরাই যেন উনাদের সন্তানের স্বাধ পূরণ করে।রাশেদ ও অনেক টা বড় হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে এ বাড়িতে আসে বেড়াতে।কয়দিন থেকেই চলে যায়। ওর ও একটা বোন হয়েছে।

কিছু মানুষ সারাজীবন সব থেকেই মনের দিক থেকে অসুখী থেকে যায়।যেমন হয়েছে আবীর ভাইয়া।টাকাপয়সা, বাড়ি গাড়ি সব আছে কিন্তু মানুসিক শান্তি এখনও নেই উনার।কিছু মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃ*ত বৈশিষ্ট্যের হয়। যেমনটা পায়েল ভাবি! রেমি আপু নেই, আমি নেই তারপর ও সে ভাইয়াকে নিয়ে সুখি থাকতে পারে না। আসলে অতি লোভ,হিং*সা আর সন্দেহ কখনও মানুষ কে সুখি হতে দেয় না।এ গুলোতে আস*ক্ত মানুষ না নিজে সুখি হয়,আর না পাশের মানুষ টিকে সুখী রাখে।

অবশেষে আমার দুঃখে ভরা জীবনে সুখ আসে। কখনও ভাবি নি আমি এতো সুখী হবো কখনও।আমার ভাগ্যে এতো সুখ লেখা আছে। কবীর হয়তো আল্লাহর তরফ থেকে দেওয়া আমার জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।সে তার কথা রেখেছে! সত্যিই আজ ভালো আছি আমি।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here