বাসি_ফুলের_সুবাস #পর্ব_২

0
369

#বাসি_ফুলের_সুবাস
#পর্ব_২
#মাসুরা_খাতুন

খালাম্মার গম্ভীর মুখ দেখে আমার ভিষণ ভয় হতে লাগল। আমার পা দূুটোও যেন জমে যাচ্ছিল ওখানেই, সামনে এগোনের সাহস পাচ্ছিলাম না।খালাম্মার সামনে যাওয়া টা আমার যু*দ্ধে যাওয়ার মতো ব্যাপার মনে হচ্ছে। রেমি আপুর কাছে গিয়ে ও তো আমি বেশি দেরি করিনি,বড়জোড় আধাঘন্টা হবে।আসলে পরের বাড়িতে থাকতে গেলে সবসময় আতং*কে থাকতে হয়,দোষ না করেও অনেক সময় দোষের ভাগীদার হতে হয়।তাই তো সব সময় চেষ্টা করি দোষ না করতে।খালু খুবই গম্ভীর মানুষ, আহির ভাইয়া খালুর ধাঁচেরই হয়েছেন।এতো বছরে খালুর সাথে আমার কথা হয়েছে সব থেকে কম।আমি খুব ভয় পাই উনাকে।যতোদূর চেষ্টা করি সামনে না যাওয়ার, তারপর ও যদি সামনে পড়ে যাই, তবে যথাসম্ভব মাথাটা নীচু করে চলে আসি।মনে হয় এই বুঝি রেগে গর্জন করে উঠবেন উনি।মানুষ টা হাসেন খুবই কম।শুধু আহির ভাইয়া আর আবির ভাইয়ার সাথে হাসতে দেখেছি উনাকে। খালাম্মার সাথে ও উনার হাসাহাসি কম।উনি যতোক্ষণ বাসায় থাকেন খালাম্মা ও চুপচাপ থাকেন।বাড়িটা একদম ভূতের বাড়ি মনে হয়।

ভয়ে ভয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি,

“কি হয়েছে খালাম্মা, তোমার মন খারাপ কেন?”

“হয়েছে, হয়েছে তোর ঘুড়ে বেড়ানো? একটা ও আমার কথা কেউ শোনেনা,এ বাড়িতে দাম কি আছে আমার? যে যার মতো চলছে,কার কি আসে যায় আমার সাথে? কাউকে কিছু বলবো না।যে যার মতো চলুক।”

আস্তে আস্তে উনার কাছে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম।

“কি হয়েছে খালাম্মা? তুৃমি এতো রেগে আছো কেন? তুমি না চাইলে আমি আর কোথাও যাব না।তুমি যা বলবে তায় শুনবো।”

“না শুনতে হবে না, কারও আমার কথা শুনতে হবে না। কেউ নই আমি এ বাড়ির। যে যার মতো চলছে,আমার কলিজা একেবারে জ্বা*লিয়ে ছাড়ল। বাপ টা যেমন একরোখা, ছেলে গুলোও তেমনই একরোখা। ”

এতোক্ষণে বুঝলাম রাগটা আমার ওপর নয়,নিশ্চয়ই আবির ভাইয়া কিছু করেছে।

“ভাইয়া আসে নি খালাম্মা? ”

“তা আসবে কেন? সে তো আগে বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেছে। তার কি বাড়িতে কেউ আছে? এই শোন,খাবার গুলো সব ফ্রিজে তুলে রাখবি,যখন বাসায় আসবে আসুক।না খেয়ে থাকবে রাতে,ওর খেতে হবে না।একদম খাবার গরম করে দিবি না ওকে।”

“ভাইয়া কখন আসবে খালাম্মা? ফোন করেছিল?”

“হ্যাঁ,সে তার এক গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুর সাথে দেখা করে রাতে বাড়িতে ফিরবে।”

“তুমি রাগ করো না তো খালাম্মা। সে যখন আসবে আসুক।তুৃমি শান্ত হও।আমি তোমার মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছি, তুমি আরাম করো।”

হাতে হালকা তেল নিয়ে খালাম্মার মাথায় বিলি কে*টে দিতে থাকলাম।

রাতের খাবার গরম করে আমি আর খালা মিলে খেয়ে নিলাম, আর খালু রাতের খাবার টা ঠিক আটটায় খান।তাই উনাকে খাইয়ে আমরা একটু দেরি করে খেয়ে নিই।এবার যে যার ঘরে গিয়ে ঘুমাতে গেলাম।

রান্না ঘরের পাশে ছোট্ট একখানা ঘর আমার জন্য বরাদ্দ। আসবাব বলতে একটা ছোটো কাঠের চৌকি, একটা আলনা আর টেবিল একটা চেয়ার।যতোটুকু আছে তায় দিয়ে পরিপাটি করে গোছানো আমার ঘর।মাঝে মাঝে এটাকে আমার নিজের রাজ্য বলে মনে হয়।এখানে কারো হুকুম চলে না,আমার ছাড়া। এই একটা জায়গায় যা একান্ত আমার।যখন খুশি,যেমন ইচ্ছা তেমন ভাবে থাকতে পারি এই একটা ছোট চার দেওয়ালের রাজ্যে।

রাত ঠিক কয়টা বাজে জানি না,আমার ঘরে ঘড়িও নেই, বা আমার কাছে কোন ফোন ও নেই। তাইতো বাইরের অন্ধকার কে মেপে আমি সময় বুঝি। হটাৎ কারো ফিসফিস করে আমার নাম ধরে ডাকায় জাগনা পাই আমি।কিন্তু কোন কিছু বুঝতে না পেরে আবারও ঘুমোতে চেষ্টা করলে আবারও সেই ডাক “রাবু, এই রাবু।” নিজের নাম কারো গলায় স্পষ্ট শুনতে পাওয়ায় এবার আমি আরও সজাগ হই।কিন্তু অন্ধকারে কিছু না দেখে বাইরে থেকে আসা মৃদু আলোয় জানালায় তাকিয়ে দেখি একটা সাদা কাপড় পড়া অবয়ব আমার জানালায় দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডাকছে।তৎক্ষনাৎ মনে পড়ে রেমি আপুর বলা তেনাদের কথা! আজই আমি উনাদের অবিশ্বাস করেছি! উনারা আবার উপেনের মতো আমারও গলা কা*টতে চলে আসেন নি তো! প্রচন্ড ভয়ে শিউ*রে উঠি,দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে চিল্লিয়ে বলতে থাকি,

“আমায় মাফ করে দিন,আমি আর জীবনেও আপনাদের অবিশ্বাস করবো না,প্রাণ গেলেও না,কচু পাতার দিব্যি,সরিষা ফুলের দিব্যি,রেমি আপুর আচারের দিব্যি।আমি রেমি আপুর বোন হই,আমায় মারবেন না দয়া করে।আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হু ওয়াল,,,,”

একনাগাড়ে কথা গুলো বলেই আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করে দেই।

“এই মেয়ে এক থাপ্পড় খাবি।কিসব হাবি জাবি দিব্যি করছিস।আরে চুপ কর বইন।আমি তোর আবির ভাইয়া। ”

এবারে দোয়া দরূদ রেখে আবারও তাকালাম আমি,সেই সাদা কাপড় দেখে মনে হলো উনারা নাকি অনেক সময় অনেকের রূপ নিয়ে আসে।আমাকে মা* রার এটা ধান্দা নই তো?

“আমি তো বলছি,আর কোন দিন আপনাদের অবিশ্বাস করবো না,আমায় ছেড়ে দিন।আবির ভাইয়া বন্ধুর বাড়িতে, আপনি উনার রূপ ধরে এসেছেন। ”

“এবার কিন্তু সত্যি সত্যি দরজা ভেঙে ঘরে গিয়ে তোর ঘাড় মটকা*বো।এই রাবু,আমি আবির।আব্বা জেগে যাবে,তুই দরজা টা খোল তাড়াতাড়ি। ”

“ততাহলে সাদা কাপড় কেন?”

“আরে পাগলি এটা তোর না মার ওড়না। বাইরে পেলাম তাই গায়ে জড়ালাম। বাইরে কুয়াশা পড়ছে খুব ঠান্ডা লেগেছে তায়।”

এতোক্ষণে বুঝলাম সাদা কাপড়ের রহস্য! এটা তো আমারই ওড়না। ছাদে শুকোতে দেওয়া ছিল,তুলে এনে বাইরে রাখা ছিল।তড়িঘড়ি আমি দরজা টা খুলে দিলাম।ভাইয়া আমার রুমে আসলেন।

“আমি দুঃখিত ভাইয়া,বুঝতে পারিনি এটা তুমি।আসলে,,”

ঘরে ঢুকেই ভাইয়া আমার কম্বল টা গায়ে জড়িয়ে পড়লেন

“বুঝতে পারিস নি মানে টা কি? একটুর জন্য আতাউর রহমান সাহেবের কাছে ধরা খেতাম, তোর চিল্লানির জন্য। ”

“আমি বুঝতে পারিনি তো।আর তুমি?আর এমন সাদা ওড়না জড়িয়েছো! ”

“আরে শহরে থাকতে বুঝতে পারিনি গ্রামে এতো ঠান্ডা পড়েছে, তাই তো শুধু টিশার্ট পড়েই বেরিয়েছি।আর এখন একেবারে ঠান্ডায় জমে গেছি।”

ভাইয়া আমায় কম্বল টা একেবারে পুরো শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে।আমার প্রথমে লজ্জায় লাগলো,উনি আমার মতো কাজের লোকের ব্যবহার করা কমদামী কম্বল টা গায়ে দেওয়ায়।সব মানুষ কেন আবির ভাইয়া হয়না? কতো মিশুক মানুষ টা।দেখতে যেমন অসম্ভব সুন্দর, তেমন অসম্ভব অমায়িক তার ব্যবহার।

“এই তুই বারবার ঐ পেত্নী টার নাম নিচ্ছিলিস কেন রে? ওই নিশ্চয়ই তোর মাথায় এসব ভূত প্রেত ঢুকিয়েছে?”

“এভাবে বলো না ভাইয়া, আপুর সাথে সত্যিই তেনাদের যোগাযোগ আছে, আপু কেমন করে যেন অনেক কিছু আগাম বলে দিতে জানে।জানো,আপু না প্রেমবৃক্ষ থেকে ডাল এনে লাটাই বানিয়েছে,এবার ঘুড়ি ওড়ানো তে কেউ আপুকে হারাতে পারবে না।”

“তুই আবার কবে থেকে ওই পেত্নীর চামচা হয়ে গেলি? আর কি বৃক্ষ? ”

“প্রেমবৃক্ষ ভাইয়া প্রেমবৃক্ষ। সূদুর তিব্বত থেকে আনা এ গাছের ডাল। তেনারাই তো এনে দিয়েছেন আপু কে।”

“ওহ্,তাহলে খুব বাড় বেড়েছে দেখছি। তোর মাথাটা একেবারে খেয়ে ছেড়েছে।কাল দেখাব মজা।ওর তেনাদের সাথে যোগাযোগের আমি বারোটা বাজাবো।এখন রাবু কি খাবার আছে প্লিজ একটু গরম করে দে,খিদেয় পেট চো চো করছে।”

“তুমি অপেক্ষা করো ভাইয়া,আমি এক্ষুনি খাবার গরম করে দিচ্ছি। যদিও উপর মহল থেকে নিষেধ আছে তোমায় খাবার দেওয়ার, তবুও আমার আবার নরম মন! না করতে পারিনা।”

“বাহ্,সঙ্গ দোষে খুব লোহা ভাসে দেখছি? অনেক কথা শিখেছিস তোর গুনধর আপার থেকে।”

“তুমি থামতো,আমি খাবার গরম করি।”

ফ্রিজ থেকে দুপুরে রান্না করা তরকারি গুলো বের করে গরম করলাম। আজ আবির ভাইয়ার পছন্দের খাবার গুলো রান্না করা হয়েছিল। সরষে ইলিশ ভাইয়ার দারুণ পছন্দ। তাই তো এটা খালাম্মা নিজের হাতে রান্না করেছেন।ভাইয়ার মনে হয় সত্যিই অনেক ক্ষুধা ছিল,গপাগপ একটার পর একটা খাবার খেতে লাগলেন।

“কি হতো বলতো ভাইয়া তাড়াতাড়ি বাসায় আসলে? খালাম্মা কতো সখ করে তোমার জন্য রান্না করেছেন,উনি একটু দাঁড়িয়ে থেকে তোমার খাওয়া দেখতেন।”

“আরে আমার বন্ধু ইমন আছে না? ওর বাবার একটা অপারেশন হয়েছে আজ,ওখানে বি পজিটিভ র*ক্তের দরকার।আর আমার গ্রুপ ও বি পজিটিভ । ইমিডিয়েটলি র*ক্ত লাগবে।তো, তোর খালাম্মা আর খালু তো কিছুতেই এসেই আমায় বেরোতে দিতো না কোথাও।কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করতো,তাই তো এ পদক্ষেপ। শোন,কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়ম ভাঙা ভালো।জীবনে যতোবার পরিকল্পিত নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজের বিবেকের অনুযায়ী কাজ করবি,ততোবার নিজেকে সফল মানুষ মনে হবে।শুধু নিয়ম মতো সুন্দর পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করলেই আদর্শ মানুষ হওয়া যায়, ,এটা তোর আহির ভাইয়া আর খালুজানের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমার বৈশিষ্ট্য হলো অনিয়ম করে, বেয়াড়াগিরি জীবন যাপন করেও যদি মানুষের উপকার করা যায়,তবে তাই জীবনের সার্থকতা। বুঝলি। ”

খুব সুন্দর কথা বলতে পারেন ভাইয়া।শুধু বলতে নয় , উনি মানুষ টায় এমনই।খাওয়া দাওয়া শেষে ভাইয়া নিজের ঘরে গেলো,আর আমি সব কিছু গুছিয়ে রেখে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। তবে মনে মনে খুব আনন্দ হচ্ছে আবির ভাইয়া এসেছে। এই মানুষ টা বাড়িতে থাকলেই আমার মন কেমন ভালো হয়ে যায়,,

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here