বাসি_ফুলের_সুবাস #পর্ব_৩

0
236

#বাসি_ফুলের_সুবাস
#পর্ব_৩
#মাসুরা_খাতুন

অগ্রহায়ণ মাসের সকাল।চারদিক কুয়াশায় ভেজা,গাছের পাতা গুলো থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে রাতের কুয়াশা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই খালাম্মা ভাইয়ার ঘরে উঁকি দেন।কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা ভাইয়াকে দেখে এসে খালাম্মা আমায় জিজ্ঞেস করেন,

“ঐ বাঁদর টা কখন এসেছে রে? কিছু খেয়েছে রাতে? “মায়েদের মন বুঝি এমনই হয়,মুখে যতোই কঠোরতা দেখাক,মনে মনে সন্তানের জন্য চিন্তায় ঠিকই অস্থির থাকে।

“ভাইয়া রাত বারোটার দিকে এসেছে খালাম্মা, আর আমি খাবার গরম করে দিয়েছিলাম,উনি খেয়েই ঘুমিয়েছেন।”

একটি পুরনো কাপড় দিয়ে আসবাব গুলো মুছছিলাম আমি।এমন সময় আবির ভাইয়া ঘুৃম থেকে উঠেই সোজা আমায় হাত ধরে সোফায় বসালেন।ভাইয়ার এমন হটাৎ কান্ডে অবাক হলাম আমি,

“এই রাবু,সারাদিন তুই এতো কি কাজ করিস বলতো? আতাউর রহমান সাহেবের কি সত্যিই টাকার এতো অভাব পড়েছে, একটা কাজের লোক রাখতে পারে না? আয় এখানে বস।”

“ভাইয়া কি করছ টা কি?এ আর কি এমন কাজ বলতো? আর বাড়ির কাজ করলে সমস্যা টা কি?”

“তুই এ বাড়ির কাজের লোক নয় রাবু।সখ করে একটু আধটু কাজ করা আর নিয়ম বেঁধে কাজ করানো আলাদা হিসেব।সে সময় যদি আমি এখনকার মতো বড় হতাম,তবে তোর পড়াশোনা কিছুতেই বন্ধ করতে দিতাম না।”

“থাক না ভাইয়া,ওসব বাদ দাও তো।আমি এমনিই ভালো আছি।আর তুমি তো আমায় পড়া শিখিয়েছো।আর হ্যাঁ,আমি কিন্তু তোমার আলমারি থেকে একটা বই এনেছি পড়ার জন্য। ”

“কি বই এনেছিস?”

“তেইশ নম্বর তৈলচিত্র। ”

“আরে এই বই কেন নিয়েছিস? ওটা বড়দের বই।”

“তুমি আমায় ছোট বলছো?আমিও তো বড়।”

“উমমম হাতে পায়ে বড় হয়েছিস অবশ্য, কিন্তু মাথার দিক দিয়ে বড্ড কাঁচা। এখনও যেই মেয়ে ভূত ভূত করে চিল্লায় সে নাকি বড়!”

“দেখ ভাইয়া,ওটা দূর্ঘ*টনা ছিল,তাই বলে খোটা দেবে না কিন্তু। আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। ”

“হয়েছিস তো আরেক জনের মতো ঝগড়ুটে। এই রাবু,উনার খবর কি রে? কি করে আজকাল? আমাদের বাড়িতে আসে না নাকি?”

“ফ্রী তে আমি কোন খবর দিতে পারিনা,আগে হাতের কাজ সারো তারপর দেখছি।”চোখ অন্য দিকে দিয়ে বললাম আমি।

আবির ভাইয়া আমার মাথায় চাটি মেরে বললেন,

“ইস! হয়েছিস তো একটা ঘর শত্রু বিভীষণ! তাহলে তোর জন্য আনা চকলেট গুলো একায় শেষ করতে হবে আমার।”

“এই না না,আমি বলছি বলছি সব।”রেমি আপু সারা মাস ধরে কোথায় কি করেছে,কার সাথে মিশেছে কার সাথে মেশেনি সব বললাম।

এমন সময় রেহেনা বেগম অর্থাৎ খালাম্মা বাইরে থেকে বাড়িতে আসলেন। আমায় এভাবে সোফায় বসে থাকা দেখে বিরক্তি নিয়ে দু চারটে কথা শোনাতে গিয়ে আবির ভাইয়াকে দেখে আর মুখ ফুটে বলতে পারলেন না।তবে উনার বিরক্তি নিয়ে তাকানো চাহনি বুঝতে পেরে আমি নিজে থেকেই রান্নাঘরে চলে গেলাম। উনারা মা ছেলে নিজেদের মতো করে কথা বললেন।

বিকেল বেলা ভাইয়া আমার হাতে হুমায়ূন আহমেদের ” আজ হিমুর বিয়ে ” বই টি দিয়ে বললেন আপু কে দিয়ে আসতে।এদের কিছুই আমি বুঝি না বাবা! দিনে সাতবার দেখা হয়,অথচ উনার জন্য আনা বই আমার হাত দিয়েই পাঠাতে হয়।কেন উনি নিজেই তো দিতে পারেন।প্রতিবার ভাইয়া আসার সময় আপুর জন্য একটা করে বই আনবেন, আর সেটা ডাকপিয়ন যেমন চিঠি বিলায়,আমায় তেমন বুকপিয়ন হয়ে বই বিলোতে হয়।এই দুটি মানুষ আমার সবথেকে পছন্দের, এদের কাছে গেলে নিজেকে সত্যিই কাজের লোক মনে হয়না,মনে হয় এরা আমার একদম রক্তের সম্পর্কের কেউ,খুব আপন।

সন্ধ্যায় ভাইয়া চুপিচুপি রান্নাঘরে আমার কাছে গেলেন।আমি তখন রাতের জন্য রুটি বানাচ্ছিলাম।পেছন থেকে গিয়ে ভাইয়া আমার মাথায় টোকা দিলেন।আমি চমকে পেছনে তাকাতেই দেখি উনি হাতে সাদা কিছু কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

“ভাইয়া তুমি? বাব্বা,আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।”

“কি ভেবেছিস,তোর গুনধর আপুর তেনারা?”

মুখে ভেংচি কে*টে বললেন ভাইয়া।

“আহ্! আবারও মজা নিচ্ছ? এই সাদা কাপড় গুলো দিয়ে কি করবে?”

“আগে বল মা কোথায়?”

“খালাম্মা তো মাগরিবের নামাজ পড়ে ঘরেই আছেন।কেন কি করবে? কিছু দরকার হলে আমা বলো?”

ভাইয়া কিছু টা মুখ ভার করে ফেললেন,

“কেন রে রাবু,মা কি পারেনা,একা একা তোকে রান্না করতে না দিয়ে এখানে এসে একটু তোর কাছে বসতে।এই নিয়ম গুলোই আমার ভালো লাগে না।”

“কি বলতে এসেছো তাই বলো,আমার এগুলোতে অভ্যেস আছে।”

“এগুলো জোর করে চাপিয়ে দেওয়া অভ্যাস তা আমি জানি। আচ্ছা শোন,আজ তোর ফাজিল রেমি আপুর বারোটা বাজাবো। ”

“ওমা,তুমি আবার কি বলছো এগুলো। কি অঘটন যে ঘটাবে,”

“ধুর,এতো ভয় পাস কেন? আজ ওকে ওর তেনাদের সাথে দেখা করাবো।”

“নাউজুবিল্লাহ, কি সব বলছো ভাইয়া তুমি। ”

“হুম আজকের রাতের মিশন এটায়।আজ ওর ফাউলগিরি ছুটাবো।তুই খালি দেখবি,ওর কেমন তেনারা আছেন।”

“ভাইয়া,তুমি এসব করতে যেওনা ভাইয়া।যদি তোমার কিছু হয়ে যায়? ভূত প্রেত সত্যি আছে ভাইয়া।এসব নিয়ে মজা করতে নেই। ”

“ওটায় আজ তোকে দেখাবো।আর তোকে কে বলল যে আমি একাই যাচ্ছি? তুই ও যাচ্ছিস আমার সাথে।রাতে আমি ইশারা করতেই দরজা খুলে বাইরে আসবি।আজ ওর খবর আছে। ”

“ভাইয়া,এসব করতে গিয়ে যদি আমাদের কোন ক্ষতি হয়ে যায়? আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।”

“আরে ধুর! ওসব ভূত প্রেত কিছুই নেই। এগুলো সব ঐ ফাজিলের মনগড়া কাহিনী। তুই তৈরী থাকিস,আজ তোকে দেখাবো। ”

বলেই ভাইয়া চলে গেলেন। একা দাঁড়িয়ে ভাবছি আমি,এখন কি করবো? আপু কে বলবো,নাকি ভাইয়ার সঙ্গ দেব।

রাতে সত্যি সত্যি ভাইয়া এসে আমায় ডাকলো,আমিও দরজা খুলে বাইরে গেলাম। ভাইয়া আমায় একটা সাদা বড় পাঞ্জাবি দিয়ে বলল পড়ে নিতে,আর ভাইয়া ও একটা পড়ে নিলো।দুজনেরই মুখে একটা অদ্ভুত ধরনের মুখোশ পড়লাম,আর আমার চুলগুলো ভাইয়া খুলে এলোমেলো করে দিলো।এমনিতেই আমার চুল অনেক লম্বা, কোমড়ের নীচে অব্দি। এবার যেন সত্যি সত্যিই ভূতেদের মতো লাগল আমায়।ভাইয়া কেও কম লাগছিল না।আসলে মনে মনে আমারও ইচ্ছে ছিলো আপুর তোনারা কি সত্যিই আছেন না কি এটা জানার।মনে মনে আমিও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারতাম না,কিন্তু তারপর ও মুখে স্বীকার করার সাহস পেতাম না।পাছে,সত্যিই উনারা থেকে থাকেন! আর আমার ঘাড় মট*কান এই ভয়ে।আর আজ ভাইয়া যখন বলল তখন আমিও ভাবলাম একটু দেখি আপু কে পরীক্ষা করে,কেমন যোগাযোগ উনার।

দুজনেই বেরিয়ে পড়লাম আপুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।আপুর রুমের বাইরের দিকের জানালায় গিয়ে দাঁড়ালো ভাইয়া,আর আমায় বলল বেলকনি গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে,কারণ আপুর রুমের সাথেই বেলকোণি টা। ঘরের হলদেটে আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পরীর মতো একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে । ভাইয়া একটা লম্বা লা*ঠি দিয়ে আপুর রুমের ভেতরের স্টিলের ফুলদানি টা ফেলে দিলো। ফুলদানি টা পড়ে যাওয়ায় ঝনঝন করে শব্দ হলো পুরো ঘরে।আপু কিছু টা নড়েচড়ে উঠে জেগে গেল তীক্ষ্ণ শব্দে। এবার ভাইয়া জানালা থেকে আপুর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন,গলা টা অস্বাভাবিক মোটা করে।

“রেমি,এ্যাই রেমি, আমরা তোর কাছে থাকতে এসেছি রে।ওঠ,আমাদের ভেতরে নে।এই রেমি,”

ভাইয়ার গলা পেয়ে আপু একটু সজাগ হয়ে চারপাশ দেখতে লাগলো। এবার ভাইয়া জানালার কাছে থেকে আবারও বলতে শুরু করেন,

“জানিস কোথাও একটা ভালো জায়গা পাচ্ছি না,আর তুই তো আমাদের ভালো বাসিস,তাই তো এবার থেকে তোর কাছেই থাকবো।কি হলো রে ওঠ,দরজাটা খোল।”

এবার আপু ভাইয়াকে দেখতে পায়,আর ভয়ে চিল্লিয়ে ওঠে।

“ককে ততুমি? কিকি বলছো এগুলো?”

“ওমা,আমায় চিনতে পারলিনা? আমি তোর তেনারা,কতো যোগাযোগ তোর সাথে আমাদের! সারাদিন তো আমার কথায় বলিস।”

“দদেখ,কোন যোগাযোগ নেই আআমার সাথে তোমাদের কোন যোগাযোগ নেই, আমি এমনি বলেছি।প্লিজ তোমরা চলে যাও”

এবার আপু আমায় ও দেখতে পায়।এলোমেলো খোলা চুলে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিতা আমায় দেখে আরোও বেশি ভয় পায়,জোরে করে চিল্লাতেই দরজায় আপুর আব্বু আম্মু ধাক্কাতে থাকে।আমি আর ভাইয়া তখন চলে আসি।

ভাইয়া তো খুব হাসে,হাসতে হাসতে শেষ। আমায় বলে,

“কিরে,বলেছিলাম না ওগুলো ওর আজগুবি বানানো গল্প। ওসব তেনারা ফেনারা কিচ্ছু নেই। ”

“হ্যাঁ,তাতো বুঝলাম ভাইয়া,কিন্তু আমাদের মনে হয় এতোটা করা উচিত হয় নি।আপু সত্যিই ভয় পেয়ে গেছে। খুব রাগ করবেন জানলে।”

“আর ধর! কিচ্ছু রাগ করবে না।ও দেখিস ঠিক সাত দিন ঘর থেকে বের হবে না,আর তেনাদের নাম তো মুখেই নেবেনা।”

কিন্তু ভাইয়ার কথা ভুল হলো,আপু পরের দিনই ধমধম করে ভাইয়ার ঘরে গেলেন,আর পিঠে অনবরত কিল ঘুষি মা*রতে লাগলেন।আসলে সেদিন ভাইয়ার পকেট থেকে ভাইয়ার রুমাল টা পড়ে গেছিল,আর আপু তা পায়।দেখেই চিনতে পারে এটা ভাইয়ার।আর বুঝতে পারে এলোমেলো চুলের মেয়ে ভূত টি আমি।তাই তো সেবার আপু অনেক দিন আমার সাথে ও কথা বন্ধ করে দিয়েছিলো।কতো কানে ধরে, হাসানোর চেষ্টা করে আপুর সাথে মিল হয়েছি।কারণ এই মানুষটার সাথে তো মিল হতেই হতো,সারাদিনের পরিশ্রম, কড়া কথা, চোখ রাঙানির শেষে এই মানুষ টার কাছেই তো আমি এক পেয়ালা ভালোবাসা পাই যা খুব খুব দামী আমার মতো অনাথের কাছে।,,,,,,,,,,,

চলবে,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here