বাসি_ফুলের_সুবাস #পর্ব_৮,০৯

0
221

#বাসি_ফুলের_সুবাস
#পর্ব_৮,০৯
#মাসুরা_খাতুন
০৮

আমাকে এনে একটা ঘরে বসতে দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষণ ধরে একা একাই বসে আছি আমি।এ বাড়িতে মানুষজন বলতে তেমন কাউকে দেখছিনা,শুধু একটা অল্প বয়সী মহিলা মাঝে মাঝে যাওয়া আসা করছেন দরজার পাশ দিয়ে। এসেই উনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। উনি নাকি সম্পর্কে আমার জা হন।আর একটা মহিলা ছিল,উনি ননদ হোন বলে পরিচয় হয়েছে। পাড়ার ও কিছু কিছু মহিলা বাচ্চারা এসে দেখে যাচ্ছে আমায়।টেনশনে, কান্না করায় গলা টাও কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, কিন্তু কাউকে বলতেও পারছিনা পানি খাব।

অবশেষে সব মানুষজন দেখে বাড়ি যেতে শুরু করলে আমার ননদ যিনি উনি আসলেন আমার কাছে।

“কি নতুন বউ ঘুম পায় তোমার? চুপ মাইরা আছো ক্যা?”

“না আপা,আমার আসলে খুব পিপাসা পেয়েছে, একটু পানি খাবো।”

“ওমা,এ দেহি শুদ্দু কইরা কথা কয়! মাইষের বাড়ি কাম কইরা এতো সুন্দুর ভাসা কই শিখলা?”

“আআসলে আপা ও বাড়ির সবাই পড়াশোনা জানেন,শিক্ষিত।আর আমি ছোট বেলা থেকেই ওখানে থাকি,তাই তো।”

ছোট ছোট করে উত্তর দিলাম।

“বাহ্ ভালোই তো! তা খালি কথা কইতেই জানো? নাকি পড়তেও?”

“আপা আমি স্কুলে যাই নি,তবে৷ সব বই পড়তে পারি।ও বাড়ির ভাইয়া আর আপু আমায় শিখিয়েছেন।”

“ওও মা মা! ও আল্লাহ, আমগো খইল্লার শিখখিত বউ! ও বড় বউ হুইন্না যাও।এ বউ দেহি পড়তেও পারে। ”

উনার এমন হম্বিতম্বিতে আমি কিছু টা লজ্জা ও পেলাম। চিকন গড়নের রোগা টাইপের মানুষ টা মনে হয় খুব পান খান।দাঁত গুলো অনেক টা কালচে করে ফেলেছে। চেহারাও ভাঙা ভাঙা,বয়স কিছু টা খালাম্মার বয়সেরই।

উনার ডাকাডাকি তে ভাবি মানে আমার জা ও ভেতরে এলেন।মুখটায় খানিকটা বিরক্তি এনে প্রশ্ন করলেন,

“কি হয়ছে আপা,এমন চিৎকার পাইরা ডাকেন ক্যান? ”

“এই দেহো,আমগো খলিল্ল্যার বউ পড়ালেহা জানে,বই পড়তে পারে।”খুব উৎসাহ নিয়ে উনি বললেন ।

সাথে সাথেই ভাবি কেমন যেন মুখটা ভাজ করে বললেন,

“উহ্!আছিলো তো পরের বাড়ির কামের মানুষ! তয় দুটা পড়তে পারছে তায় এতো চিল্লানি কিয়ের?শিখছে হয়তো এট্টু অ আ কারও থাইক্কা।”

“হুনো বউ,নিজে পারো না দেইখ্যা অন্য রেও ছোড কইরো না।যাও তো বাপু তুমি,নিজের কাজে যাও।”

ইনিও মুখ টা যথাসম্ভব বেঁকিয়ে বললেন উনাকে।আমি শুধু অবাক হয়ে উনাদের কান্ড দেখছি।ভাবি কপট রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন।

“তুমি কিচ্ছু মনে কইরো না বোন।শিকখিত যা দেইখ্যা গা জ্ব*লে।ও আল্লাহ আমি তো ভুইল্লায় গেছি তুমি পানি খাবা।”

“আমি কিছু মনে করিনি আপা।আপনি শান্ত হোন।”

উনি আমার জন্য পানি আনতে গেলেন।এর মাঝে আমার স্বামী ঘরের মধ্যে এলেন।লোকটা কে আসা দেখতেই নিজেকে আরও কিছু টা মুড়িয়ে নিলাম আমি। ঘোমটা টা আর একটু টেনে চুপচাপ মাথা নিচু করলাম, কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল আমার।লোকটি ঘরে এসেই গায়ের পাঞ্জাবী টা খুলে বিছানায় রাখলেন।তারপর একটা শার্ট গায়ে চড়ালেন। বোতাম গুলো দিতে দিতেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“কি খাওয়া দাওয়া কি হয়ছে? নাকি হয়নায়?”

আমি মাথাটা নিচু রেখেই বললাম,

“জ্বি হয়নি।”

এর মাঝেই আমার ননদ ঘরে ঢুকলেন, উনার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“এ কিরে খলিল,তুই জামা ফিন্দোস ক্যা?এহন আবার কই যাবি?”

উনি হাতে মোবাইল টা নিতে নিতে বললেন,

“হেরে খাওন দাও।আমার আইতে রাইত অইবো।এই হুনো,খাইয়া ঘুমায় পড়ো,দরজাটা খুইল্লা রাইখো।আমার রাত হইতে পারে। “বলেই উনি বেরিয়ে গেলেন।

আপা আমার জন্য ভাত নিয়ে এলেন। পাতলা বয়লার মুরগির ঝোল,আর ডাল আলু ভাজি।খুব ক্ষুধা লেগেছিলো আমার।সারাদিন থেকে না খাওয়া, চিন্তায় সারাদিনে দুই লোকমা ভাতও মুখে তুলি নি।তাই তো এতোক্ষণে এসে এই খাবার টায় আমার অমৃতের মতো লাগল।আপার সামনেই খাওয়া শুরু করলাম। খানিকটা খেয়ে হুঁশ হলো আমার,

“আপা,আমি একাই খাচ্ছি, আপনি খাবেন না?আর ভাবি কেও দেখছিনা?”

“অই তো খাইয়া মাইয়ারে লইয়া ঘরে গেছে। আর আমি খামু নে।তুমি খাও।”

“উঁহু। তা হবেনা আপা।আপনি আবার একা খাবেন কেন? আমার সাথেই খেয়ে নিন।দুজনে একসাথেই খাই”

“ওম্মারে মা,, মাইয়া দেহি খুব মুখ চালাইতে জান? আপার খাওয়ার দিকে খুব নজর! তাই লে খাই।”খানিকটা চেঁচিয়ে স্বরে বললেও উনার কথার মাঝে আনন্দ খুঁজে পেলাম। তারপর উনিও একটা প্লেট নিয়ে আমার সাথে খেতে বসলেন।

খাওয়া দাওয়া শেষে উনি নোংরা প্লেট গুলো বাইরে রেখে এসে উনার ভাইয়ের জন্য এক থালায় ভাত আর বাটিতে তরকারি এনে টেবিলে ঢেকে রাখলেন।

“হুনো বউ,সোয়ামী হলো মনিবের মতো,হ্যারে অবহেলা কইরোনা কিন্তু! হেই সাথে থাকলে দুনিয়া জিত্তা লওয়া যায়।বুঝছো? তাই যতো রাইতেই আসুক,উইঠা সালাম করবা, খাবার বাইড়া দিবা।বইসা থাইক্কা খাওয়াবা।দেহো,আবার পইড়া পইড়া ঘুমাইয়োনা যেন? ”

“আচ্ছা ঠিক আছে আপা।আমি উঠেই উনাকে খাবার দেব।”

“ওই আসা পর্যন্ত কি আমারে থাকতে হইবো? না একা থাকতে পারবা?”

“আপা আপনি গিয়ে ঘুমান।আমি একা থাকতে পারি।আপনি চিন্তা করবেন না।”

“আইচ্ছা।দরজা খান লাগায় দাও।” বলেই উনি যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আবার ফিরে এলেন।আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,

“হুনো,সোয়ামী হইলো ব্যাডা মানুষ, হেরা দশ ঘাট মারতে পারবো,তাও হেগো কোন দোষ নাই।তয় তুমি বউ,তুমি তোমার রূপ যৌবন সব কিছু দিয়া সোয়ামী রে বাইন্ধা রাখার চেষ্টা করবা।যাতে কোন মাইয়া মাইষের দিকে নজর দিতে না পারে।”

আপার বলা কথা গুলোয় ভিষণ লজ্জা লাগলো আমার।মাথা নিচু করে শুধু সম্মতি দিলাম। উনি চলে গেলে দরজা টা লাগিয়ে দিলাম আমি।মাথায় দেওয়া ওড়নাটা খুলে উনার পাঞ্জাবী টাও আলনায় রাখলাম। বাড়িটা টিনের,ঘরের মধ্যে একটা চৌকি,টেবিল চেয়ার আর আলনা।কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্র ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।এলোমেলো ঘরটা দেখেই বোঝা যায় এটার খুব একটা যত্ন হয়না।মাটির মেঝের ও করুন অবস্থা, জায়গায় জায়গায় চোটে মাটি উঠে গেছে।আলনা কাপড় গুলো ও অগোছালো। আমি কখনোই জিনিসপত্র অগোছালো রাখতে পারিনা।তাই বসে না থেকে আলনায় কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখলাম। অপ্রয়োজনীয় নষ্ট ভাঙাচোরা জিনিস গুলো এক জায়গায় করে রেখে দিলাম। বিয়েতে নিয়ে যাওয়া বাক্স টা খুলে দেখলাম একবার।ওখানে ও কিছু জিনিসপত্র আছে,বিয়ের বাজার।বিয়ে বাড়িতে বিয়ের বাজার দেখতে সব থেকে ভালো লাগতো।কত রঙ বেরঙের আলতা,লিপস্টিক, চুড়ি থাকতো। আর রেমি আপুর বিয়ে তে বাবা,যেন রাজবাড়ির বাজার।কতো জিনিসপত্র যে ছিলো তার হিসেব নেই। গহনার বাক্স গুলো দেখে প্রথমে আমি ভেবেছিলাম এগুলো মনে হয় নকল গয়না হবে।এতো মোটা হার সোনার হয়? পরে শুনলাম আপুর গায়ে সব গুলো গয়নাই সোনার! সেদিন রাজরানীর মতো লাগছিল আপুকে।কিন্তু আমি ওগুলো দেখে আফসোস করিনা।কারন ওগুলোর সাথে আমার তুলনা করলে চলেনা।ওরা মালিক,আর আমি কাজের লোক।ওদের বিয়ের সাথে আমাদের তুলনা করা বোকামি, তা আমি জানি। আমার জন্য এখান থেকে যা দেওয়া হয়েছে তায় যথেষ্ট।

বাক্স টা খুললাম আমি।ভেতরে একটা সুতি শাড়ি।শাড়িটা সরিয়ে নিচে দেখি কয়েকটা লাল কাচের চুড়ি,একটা হালকা লিপস্টিক। লাল ফিতে আর চিরুনী। আর কিছু হালকা জিনিস ও আছে। আমি জিনিসগুলো সুন্দর করে ওখানেই গুছিয়ে রেখে বাক্সটা চেয়ারে রেখে আসলাম। আমার যা আছে এগুলোই আমার সব।নিজের কম জিনিস নিয়ে ও সন্তুষ্ট থাকতে পারি আমি।

যতোটুকু পারা যায় সব কিছু গুছিয়ে আমি বিছানায় গেলাম। হারিকেনের আলো কমিয়ে এক পাশে শুয়ে পড়লাম।

অনেক টা সময় পর দরজায় কারও ধা*ক্কা দেওয়ার শব্দ পেলাম। তাৎক্ষণিক একটু ভয় ও হলো আমার। হাজার হোক এটা নতুন জায়গা,আর আমি মনে হয় একটু ঘুমিয়ে ও গিয়েছিলাম।দরজা খোলার আগেই বললাম,

“কে? কে ওপারে? ”

“আরে মাইয়া,আমি। এতো প্রশ্ন করো কিল্লাই?”

দরজা খুলে দিলাম সাথে সাথে। উনি ঘরে আসতেই আমায় আবারও আগের মতো জড়তায় ঘিরে ধরল। চুপচাপ দরজা খুলে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। উনি তখন শার্ট খুলছিলেন।কথাটা আমিই বললাম,

“খাবেন না আপনি? আপা খাবার দিয়ে গেছে তো!”

“আরে নাহ্।খামু না,খিদা নাই।ঘুমামু,আহো,তুমিও শুইয়া পড়।”

আমি চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। উনি ও আমার দিকে হয়েই শুয়ে বললেন,

“কি নাম জানি শুনছিলাম তোমার?”

“জ্বি রাবেয়া। সবাই রাবু বলে ডাকে।”

“ওও আইচ্ছা। তো,দূরে আছো ক্যান? আহো রাবু,আমার বুকের মধ্যি আহো।তুমি না আমার বউ?”

প্রচন্ড লজ্জা লাগছিল উনার কথা শুনে। জীবনের প্রথম কোন পুরুষ মানুষের সাথে এক ঘরে আমি আছি,কোন পুরুষ মানুষের মুখে এসব কথা শুনছি।লজ্জায় আমি কুঁকড়ে গেলাম। আর তখনই উনি ধমক দিয়ে বললেন,

“এই মাইয়া,কইলাম না,বুকের মধ্যি আহো।কথা কইলে হুনো না ক্যান? মাইয়া মাইষের বেশি পাকনামি কিন্তু আমার ভালো লাগে না।”

হটাৎ উনার এমন ধমকে লজ্জা ছেড়ে ভয় পেলাম আমি।লোকটা এই অল্প কারণেই এতো রাগে কেন? উনি কি বোঝেন না,আমি একটা মেয়ে।

এবার ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম উনার দিকে, আর উনিও আমায় টেনে নিয়ে দুহাত দিয়ে বাহুবন্ধনে পিষ্ট করলেন আমায়।কোন রকম সৌজন্যতা ছাড়াই নিজের স্বামী হওয়ার অধিকার আদায় করলেন।উনত্রিশ, ত্রিশ বছরের একটা পুরুষের কাছে আমি পনেরো ষোল বছরের একটা মেয়ে স্ত্রী হওয়ার দায়িত্ব পালন করলাম। বেদনায় দু একবার আমার চোখ থেকে লবনাক্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়লেও হারিকেনের মৃদু আলোয় দেখতে পেলেন না উনি,অথবা দেখতেই চাইলেন না। একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন উনি,আমিও উনার থেকে কিছুটা সরে এসে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে ঘুমিয়ে পড়লাম,,,,,,,

চলবে,,,,,,,,

#বাসি_ফুলের_সুবাস

#পর্ব_৯

#মাসুরা_খাতুন

আমার জীবনের নতুন পর্যায়।এখানে না আছে কোন পরিচিত কেউ আর না কোন আপনজন।আমার স্বামী সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে গেছে, আমার সঙ্গে কথা বলতে মাত্র দু একটা। সকাল বেলা উঠে মাত্রই দরজায় দাঁড়িয়েছি আমি,এমন সময় একটা ছোট্ট মেয়ে এসে আমার গা ঘেষে দাঁড়ালো, বাড়ির নতুন সদস্য হিসেবে নতুন বউ যেন ওর খুব পছন্দ! তা ওর আহ্লাদী মুখভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়। গতকাল রাতে ও যখন আমি কেবল এসেছি তখনও তিন বৎসরের মেয়ে টি দৌড়িয়ে আসছিল, আমার জা নার্গিস আখতার কড়া মেজাজে ওর গতি রোধ করেছিল।খাওয়ানোর নাম করে বাচ্চা মেয়ে টাকে সাথে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।তাই তো নতুন বউয়ের মুখ ওর আর রাতে দেখা হয়নি।আজ সকালে ও তাই তাড়াতাড়ি ওঠে ঘুম থেকে, আর ওর মা যখন বাইরে কাজে ব্যস্ত দেখে,তখন সেই সুযোগে দৌড়িয়ে এসে একপ্রকার ঝাঁ*পিয়েই পরে আমার গায়ের কাছে। একবাক্যে চেয়ে থাকে আমার মুখপানে।কি জানি, ছোট বাচ্চা মেয়ে টাও হয়তো আমার তলিয়ে যাওয়া দু চোখের মাঝে কষ্টের গভীরতা মাপছে! আমি একহাত দিয়ে আলতো করে বাচ্চাটার গাল ছুঁইয়ে দিলাম।চুল গুলো চোখের ওপর থেকে সরিয়ে প্রশ্ন করলাম,

“ওমা পুতুল! তোমার নাম কি?”আমার বলার ধরন দেখে ফিক করে হাসলো বাচ্চাটা।হাসির সাথে সাথেই প্রকাশ পেল ওর যে সামনের দুটো দাঁত নেই!

“আমার নাম তো মিম।তুমি আমারে পুতুল কও ক্যান? আর তুমি বুঝি আমার চাচিআম্মা? ”

“তুমি যে পুতুলের মতোই সুন্দর, তাই তো পুতুল বলি। আর আমি কিন্তু তোমায় পুতুল বলেই ডাকব।কেমন?”

“ঠিক আছে ডাইকো।কি হলো তুমি আমার কে হও কইলা না তো?”

“হ্যাঁ মামুনি,আমি তোমার চাচিআম্মা।তুমি কিন্তু রোজ আমার কাছে আসবে।”

“কিন্তু মায় যে কইলো তুমি নাকি ডা*ইনি? তোমার বেশি কাছে যাইতে তো মা না করছে।”

“আচ্ছা মামুনি,তোমার কি আমায় ডাই*নি মনে হয়? “খানিকটা খারাপ লাগলো আমার।ভাবীর সাথে তো আমার তেমন কথাই হয়নি,অথচ ভাবি বাচ্চা মেয়ে টাকে এসব শেখাচ্ছে?আলতো করে মিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।

”উহুু,তুমি তো বেশ ভালো। আচ্ছা চাচিআম্মা , তোমারে না অনেক সাজুগুজু করার জিনিস দিছে ওগুলা দিয়ে কি আমারে সাজতে দিবা?”

বাচ্চা মেয়ে টার এমন আবদারে হালকা হাসলাম আমি।

“তোমার সাজতে ভালো লাগে? ”

“খুউব ভাল্লাগে। ”

“তাহলে তোমায় সাজিয়ে দিতে পারি, তবে একটা শর্তে, আমাকে একটা চুৃুমু দিতে হবে মিষ্টি করে। কি? দেবে তো?”

বলে মেয়েটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসতেই টুপ করে একটা চুমু আমার নাকের ডগায় বসিয়ে দিয়ে খিলখিল করে হাসলো মিম।আমিও বিনিময়ে কয়েকটা চুমু দিলাম বাচ্চা মেয়েটাকে।তারপর কেবলই ওকে সাথে নিয়ে আমার ঘরের দিকে পা বারাচ্ছিলাম,এমন সময়ই বড় ভাবি অর্থাৎ মিমের মা কোথা থেকে যেন এসে একদম ছিনিয়ে নিল মিমকে আমার থেকে । উনার এহেন কান্ডে আমি একেবারে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।

“এই মাইয়া,এহানে কি তোর? যেইনা আমি পাকঘরে আসছি আর ওমনি পালায় আইছিস? খাঁড়া, আজ তোর পিঠে চেলা কাঠ ভাঙমু।”

ভাবির হটাৎ এমন আচরণ মিম ভয়ে প্রায় কান্না করার জোগাড়। আমার ও খুব খারাপ লাগছে, আমার কাছে আসায় বাচ্চা মেয়ে টি এমন বকা খাবে! আমি বুঝতে পারছিনা ভাবি আমায় সহ্য করতে পারছেনা কেন? শেষমেস আমিই কথা বললাম,

“ভাবি মিম তো ছোট মানুষ, ওকে এমন বকছেন কেন? একটু আমার কাছে এসেছে শুধু। মেয়ে টা ভয় পাচ্ছে। ”

“এই মাইয়া,একদিন হয়নি আইছো, তাতেই চোটপাট করা শুরু করছো? আমার মাইয়ারে আমি মা*রমু,কা*টমু যা খুশি তাই করমু তাতে তুমি কথা কওয়ার কে?”

“ভাবি আপনি রাগ করছেন কেন শুধু শুধু? আমি খারাপ কি বললাম। শুধু এতোটুকুই বলেছি যে বাচ্চা মেয়ে ভয় পাচ্ছে, ও তো একটু আমায় দেখতে আসছে,আপনার যা খুশি আমায় বলেন। মেয়ে টাকে অন্তত কিছু বলেন না।”

“থাক,আর কথা কইতে হবেনা।আমার মাইয়ার ভালো মন্দ আমিই বুঝুম,তোমারে ভাবতে হইবো না।কি মুখ গো বাবা! তাই তো কই,মাইষের বাড়িত হারাদিন কাজ করা মাইয়া,এগোর মুখে তো খই ফুটবোই।ছোডকাল থাইকা মুখে মুখে কথা কওনের অভ্যাস যে। ”

ভাবির এমন কথায় আমার ও কলিজায় লাগলো,চোখ ভরে নোনাপানি ধরা দিল।এমন সময় আমার ননদ এসে উপস্থিত হলেন।এসেই কোন কিছু না জেনে না শুনেই ভাবির কথায় উত্তর দিতে লাগলেন।

“কি হয়ছে বড় বউ,তুমি ওরে কি কইলা? যেই না আমি এট্টু বাড়িতে গেছি গাইটারে খড় দিতে,আর ওমনি ছোড বউয়ের সাথে লাইগা গেছো? খুব তো ওকে একলা পাইয়া কথা শুনাচ্ছিলা,ওহন কও কি কি কবা?

“হ,খালি তো আমারই দোষ দেখবেন,আপনার ছোড বউতো তুলসীপাতার ধোয়া,তার কোন দোষ নাই।প্রথ্থম দিনেই মুখে মুখে কথা কয়। ছোড ঘরের মাইয়া হইলে যা হয়।”

মুখ ভেংচিয়ে বললেন উনি।

“আহারে আমার সাতরাজার ধন,ধনীর দুলালী! হেই ছোড ঘরের আর তুমি বুঝি জমিদার বংশ? তোমার মায় তো যা কইরা খায় তা আইজকাও মাইনষেরে কইতে পারিনা।মাইয়া জাতির কলংক, তার মাইয়ার আবার বড় বড় কথা। ”

ঠিক তেমন ভাবেই আমার ননদ ও মুখ ভেংচিয়ে উত্তর দিলেন বড় ভাবি কে।মাঝখানে আমি পড়ে গেলাম বিপদে। দুজনের ভাব দেখেই মনে হচ্ছে এটা এখন থামবার নয়, এ দুপুর গড়ানো পর্যন্ত এমন নির্বিঘ্নে চলতে থাকবে।কেউ কারোও চাইতে একবিন্দু ও ছাড় দিতে রাজি নয়।

“দ্যাহো বুবু,খবরদার কইতাছি,আমার মা তুইলা কথা কইবা না।তায় লে কিন্তু খুব খারাপ হইবো।”

অবশেষে আমিই উনাদের থামাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ব্যাপারটা এখন আসল কাহিনী বাদ দিয়ে অতীতে আরও ঘটনার দিকে চলে গেলো।কে আগে কি করেছে, কার কতো দোষ, সব কিছু একজন অপরজনকে বলতে লাগলো, এখানে আমি আর মিম শুধু অসহায় হয়ে চেয়ে রইলাম।

আপা রাতের খাবার টা আজকেও আমার সাথে খেয়ে দরজা লাগাতে বলে বাড়িতে চলে গেলেন। আমি ও দরজা লাগিয়ে দিয়ে শুয়েছিলাম। এমন সময় ভিষণ ইচ্ছে হলো ঐ মানুষ টার জন্য সাজতে,যার দেখা ভোর সকালের পর থেকে আর পাইনি।গতকাল সবাই যে যার মতো আমায় সাজিয়েছিল,কেমন যেন লাগছিল আমায় দেখতে।আজ একটু নিজের ইচ্ছে মতো সাজগোজ করে মানুষটিকে অবাক করে দেবো।তাই তো কাপড়ের ব্যাগ টা তাকের ওপর থেকে নামিয়ে একটা একটা জিনিস দিয়ে সাজতে লাগলাম। নিজের এতোদিনের জমানো ইচ্ছে গুলো দিয়ে একে একে মনের মতো রাঙাতে লাগলাম নিজেকে। রেশমি কাচের টকটকে লাল চুড়ি গুলো হাত ভরে পরে চোখে গাঢ় কাজল লাগালাম। হাত টা একটু নড়চড় করতেই চুড়ি গুলো যখন ঝুনঝুন করে বাজছিল তখন এক অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছিল মনের মধ্যে। চুলগুলো সিথি করে বেণী করলাম। বেণীর মাথায় টকটকে লাল রঙের ফিতে দিয়ে ফুল বানালাম। মুখে হালকা পাউডার মেখে লাল লিপস্টিক দিলাম। বাহ্! এতোদিনে যেন নিজের মনে এতোদিন কল্পনা করা আমিকে দেখতে পেলাম। খুব সুন্দর লাগছিল আমাকে,ছোট্ট আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেরই লজ্জা লাগতে শুরু করলো।সবকিছু আবার আগের জায়গায় রেখে মানুষটির অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু অনেক রাত হয়ে গেলেও উনার দেখা না পেয়ে আমার চোখে ও ঘুম ধরলো,কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেক রাতে দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দে হকচকিয়ে উঠলাম আমি।বুঝতে পারলাম উনি এসেছেন, ভিষণ লজ্জা লাগতে শুরু করলো। চট করে আয়না টা নিয়ে আরেকবার নিজেকে দেখে নিলাম সবকিছু ঠিক আছে কিনা।তারপর গিয়ে দরজা খুললাম, দরজা খুলে উনাকে দেখেই আমি লজ্জায় অন্য দিক ফিরলাম। ছি ছি! কি সাজাটায় না আমি সেজেছি! এখন ভিষন লজ্জা লাগছে উনার সামনাসামনি হতে।আমি দরজা খুলেই সাথে সাথেই চলে আসছিলাম, এমন সময় উনি হটাৎ করে আমার হাত টা শক্ত করে ধরলেন। প্রচন্ড জোরে কব্জি বরাবর ধরে আরেক হাতে আমার চুলের বেণীর গোড়ায় ধরলেন । প্রচন্ড ব্যথায় কুঁকড়ে গেলাম আমি।হাত ভরা কাচের চুড়ি থাকায়, আর উনি চুড়ির ওপর দিয়েই শক্ত করে ধরায় চুড়ি ভেঙে বিঁধে গেলো আমার হাতের মধ্যে। সাধ করে পরা চুড়ির টকটকে লাল রঙ,আমার শরীরের টকটকে লাল র*ক্তের সাথে মিশে গেলো।কাচ হাতে বিঁধে যাওয়ায় প্রচন্ড ব্যথায় আমার মুখ দিয়ে অস্ফুটেই বেরিয়ে এলো “আহ্উ!”

“মা*গী,তোর এতো সাহস বড় বউয়ের সাথে চোটপাট করিস,ভাবির মুখের উপর কথা কইস? তোরে আইজ আমি বুঝায় দিবো এর পরিনাম।”

বলেই উনি আমার চুল গুলো আরও শক্ত করে ধরলেন, তারপর আমায় ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলেন।

“আপনি বিশ্বাস করুন,আমি বড় ভাবিকে খারাপ কিচ্ছু বলিনি।আল্লাহর দোহাই আপনাকে,আপনি একবার বাচ্চা মেয়ে মিম আর আপাকে জিগ্যেস করে দেখুন। “কাঁদতে কাঁদতে বললাম আমি।কিন্তু উনি আমার কোন কথায় শুনলেন না,পায়ে থাকা শক্ত চটি টা দিয়ে একের পর এক আঘাত করতেই থাকলেন আমার শরীরে, আর মুখে অকথ্য গালিগালাজ। একা ঘরে নিরুপায় আমি শুধু সহ্য করে গেলাম আর কাঁদলাম। এছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না।উনার মনের মতো শা*স্তি দেওয়া হলে চটি টা নিচে রেখে ঝাপিয়ে পড়লেন আমার ব্যথায় জর্জরিত শরীরটার ওপর।ততোক্ষণে আমি ভিষণ ব্যথায় ক্লান্ত, আলাদা করে উনাকে বাধা দেওয়ার শক্তি আমার নেই। উনিও প্রচন্ড হিং*স্র ভাবে মনের রাগ নিয়ে নিজের পৌরুষত্ব ফলালেন আমার ওপর।বড় ভাবির সাথে ঝগড়া হয়েছে এটা এতো রাতে উনিই বা জানলেন কি করে,আর পুরো ঘটনা না শুনে উনি এতো রাগলেনই বা কি করে বুঝলাম না।আর উনি এতো রাতে আসছেনই বা কোথা থেকে, সব প্রশ্নই আমার কাছে অধরা।উনি ক্লান্ত হয়ে পাশে শুয়ে পড়লেন।এ জগতে কেউ প্রহার করে ক্লান্ত হয়,আবার কেউ সহ্য করে।এতোক্ষণে আস্তে আস্তে উঠলাম আমি।উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা যেন হারিয়ে গেছে, কোন রকমে উঠে বসে হাত টা সামনে এনে দেখলাম এখনও কিছু ভাঙা চুড়ির টুকরো বিঁধেয় আছে। চোখ বন্ধ করে ওগুলো টান দিয়ে দিয়ে তুলে ফেললাম, খুব জ্বা*লা করছিল কে*টে যাওয়া জায়গা গুলোতে।ভাঙা টুকরো তুলতেই গলগল করে র*ক্ত বেরিয়ে এলো। প্রচন্ড আ*ক্রোশে আমিও আর আটকালাম না,বেরিয়ে যেতে দিলাম এ পাপের জীবনের র*ক্ত।পাপেরই তো বটে! এমন পরিচয় ছাড়া পরের বাড়িতে মানুষ হওয়া, এমন অবহেলার জীবন পাপ নয়?,,,

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here