বিকেলে ভোরের ফুল : পর্ব –২ #

0
229

# বিকেলে ভোরের ফুল : পর্ব –২ #

ভিসা পেয়েই দেবুকে জানালাম…. ছয়মাসের ভিসা পেয়েছি, ও আমাকে জানালো কোনো চিন্তা না করতে, সাংবাদিক মানুষ, পরিচিত জন কম নেই সুতরাং সব ব‍্যবস্থা করা ওর জন্য কোনো ব‍্যাপারই না।
আমাদের বিয়ের ও সব প্রস্তুতি শেষ, যা আইনি ব‍্যবস্থা করা দরকার সবই দেবু করেছে এখন শুধু আমার যাওয়ার অপেক্ষা।

প্লেনে জানালার পাশে আমার সীট, বাইরে মেঘের দিকে চেয়ে ভাবছি….. সত্যিই তাহলে আমি দেবুর কাছে যাচ্ছি…. আসার কদিন আগেও আমাদের চেহারা সুরত নিয়ে তামাশা হলো…. সে বললো…
— তোমার প্রোফাইল পিক তো মারাত্মক সুন্দর
—- ওটা অনেক আগের ছবি, তোমারটাও কি?
—- জ্বী ম‍্যাডাম, এখনকার চেহারার সাথে কোনো মিল পাবে না, ছবি নিয়ে গবেষণা করার দরকার নেই….. সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনায়….. এভাবে ভাবলেই তো হয়….
আরো কিছুক্ষণ অন্য কথা বলার পর এইবার গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে আমি কথা বললাম…
— দেবু সবই তো হলো কিন্তু আসল ব‍্যাপারে কিছু চিন্তা করেছো?
— ( অবাক প্রশ্ন ওর ) আসল ব‍্যাপার… মানে? কোনটা?
—- না… তোমার আমার ধর্ম…..
বাঁধা দিয়ে দেবু বললো….. সেভাবে চিন্তা তো করিনি, কারণ ধর্ম মানুষের অন্তরের বিশ্বাস, শ্রদ্ধা…
মানুষকে সত‍্য সুন্দরের পথ দেখায়, কখনো বাঁধা নয়…. আশা আশ্বাস দেয়….. আমরা সৃষ্টির সেরা মানুষ…. এই আমাদের একমাত্র পরিচয়, তুমি তোমার মত থাকবে, আমি আমার মত…. ধর্ম ভয় নয় মানুষের ভরসাস্থল, শান্তির বাণী শুনিয়ে সাহায্য করে…. এত লম্বা লেকচার দিলাম তোমাকে এটা বোঝাতে যে প্রেম ও যুদ্ধে সবই জায়েজ… ঠিক আছে পাগলী আমার?
না, আমি আর কিছু বলতে পারিনি…. পরম শান্তিতে নীরব হয়ে ছিলাম…. আমার দেবের মত সুন্দর উদার মানসিকতার সাথী পেয়ে আমি ধন‍্য।

ঘোষণা শোনা গেলো…. কিছুক্ষণের মধ্যেই দমদম বিমানবন্দরে প্লেন পৌঁছে যাচ্ছে, যাত্রীরা সীট বেল্ট ইত্যাদি ইত্যাদি….. ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে সচকিত হয়ে গেলাম…. আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার দেবুকে দেখতে পাবো…. শিহরণ অনুভব করলাম।

কাস্টমসে আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমার মাল সামান ট্রলিতে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম…
আমি বোরকা পরেছি, শুধু চোখ দুটো ছাড়া আমার পুরো শরীর মুখ ঢাকা….
এতদিন মনপ্রাণ উজাড় করে যার সাথে কথা বলেছি আর আজ সশরীরে ওকে দেখবো ভাবতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছি….
এদিক ওদিক দেখছি….. যাত্রীদের বেরিয়ে যাবার পথেই তো দাঁড়িয়ে আছি…. কোথায় দেবু?
হঠাৎ মনে হলো…. ও আসবে তো? নাকি আমার শারীরিক বণর্না শুনেই পিছিয়ে গেছে…. না না, দেবুকে আমার এমন নিষ্ঠুর পাষাণ মনে হয়নি, আমাকে এতদুর নিয়ে এসে সরে পড়বে? তাছাড়া আমাদের ভালোবাসা তো শরীরকে কেন্দ্র করে নয়।

সামনের রাস্তায় একটা প্রাইভেট গাড়ি দাঁড় করানো আছে…. ওটার গায়ে হেলান দিয়ে বেশ আয়েসি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘকায় এক পুরুষ…. পরণে কালো প‍্যান্ট, হলুদ শার্ট…. মাথার ঘন কালো চুল বাতাসে এলোমেলো হয়ে আছে, যতবার দেখছি লোকটাকে…. দেখি সেও তাকিয়ে আছে আমার দিকে…. বুকটা ধ্বক করে উঠলো…. দেবু? তা কি করে হয়!! ওতো বেঁটে, টাক মাথা, ভুড়িও আছে, অথচ সুঠাম দেহের এই লোকটা তো অসাধারণ সুদর্শন….

একটু এগিয়ে লোকটার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালাম, কিন্তু মনের খটকা গেলো না…. চেনা চেনা লাগছে… কোথায় দেখেছি? কিন্তু আমি তো এই প্রথম কোলকাতায় এলাম…. এই মানুষকে চেনা লাগবে কেন? অন‍্যমনস্ক হয়ে ভাবছি…
হঠাৎ কানের কাছে আচমকা কে বলে উঠলো….
—- ম‍্যাডাম কি বেঁটে, টাক মাথা কাউকে খুঁজছেন?
হ্নদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠলো…. এই কন্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি ভুল হবার নয়…. শয়নে স্বপনে জাগরণে যাকে ধ‍্যান করেছি…. মাদকতাময় গভীর স্বর শুনেছি দিবারাত্রি….. এতো সেই…. দেবনাথ, দেবু..আমার দেব….

পাশ ফিরে দেখেই দারুণ চমকে উঠলাম…. সবর্নাশ এ আমি কাকে দেখছি!!! এতো সেই গাড়ির গায়ে দাঁড়ানো সুপুরুষটি…. এবার চিনতে পারলাম…. মেসেঞ্জারে দেবুর যে ছবি দেওয়া আছে…. সেই আদি ও অকৃত্রিম দেবনাথ।
এজন্যই চেনা চেনা লাগছিলো, ছবি আর বাস্তবে দেখা, অনেক তফাত, সেজন্যই চিনতে পারিনি এবং নিজের সম্পর্কে দুষ্টুটা ভুল বণর্না দিয়েছিলো….
ঘুরে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালাম….
দেবনাথ হা হা হা করে হাসছে…. এবার আমার পালা…. বোরখাটা টান দিয়ে খুলে ফেললাম….
দেবু হাসি থামিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো, তারপর ফিসফিসিয়ে গাঢ় স্বরে বললো
— শিরিন!! তুমিই শিরিন!!! ৬৮ মাইনাস…. ঈশ্বর এযে রূপসী অপ্সরী…. স্বপ্ন দেখছি!!!
— কেমন চমকে দিলাম ৬০ প্লাস? বেঁটে, টাক মাথা ভুড়ি, তাই না? ফাজিল কোথাকার…

অপ্রত্যাশিত কিছু পাওয়ার আনন্দে এবং খুশীতে কেঁদে ফেললাম … আমার কান্না দেখে বিচলিত হয়ে দেবু পরিবেশ ভুলে হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিয়ে প্রাণপণে চেপে ধরলো, পৃথিবীর সব কোলাহল যেন নিমিষেই থেমে গেলো…. আমি আর আমার প্রিয়তম ছাড়া আর কেউ নেই…. এই মধুর মিলনের বোধহয় কোনো তুলনা হয় না, ভাষায় বণর্না করাও অসম্ভব।

নিজেকে সামলে নিয়ে ছাড়াবার চেষ্টা করে বললাম
— দেবু ছাড়ো সবাই দেখছে
—- দেখুক…. আমরা কি অমূল্য রতন আজ পেয়েছি পৃথিবীর সবাই দেখুক…. জানুক
—- এতদিন যখন সংযত হয়ে থাকতে পেরেছো, এখন কেন পারবে না? তাছাড়া নানারকম চিন্তার ধকল গেছে, ক্লান্ত লাগছে,
শুনেই ব‍্যস্ত হয়ে দেবু আমার সামান ও আমাকে নিয়ে গাড়ির কাছে এলো।

গাড়ি চালাচ্ছে আর ক্ষণে ক্ষণে আমাকে দেখছে দেবু…. মিটি মিটি হাসছে, আমি কপট রাগে বললাম
— এই যে মশাই, সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালান, দুর্ঘটনা হলে?
— শিরি আমার শিরি, তোমাকে দেখে যে মন ভরছে না, নিশ্চিন্ত থাকো আমি আনাড়ী চালক নই…
— সে তো হলো, এখন বলো তো এমন ধোঁকা দিলে কেন? তুমি যে এমন নায়কের মত দেখতে, কল্পণাও করিনি…. টাক না? ভুড়ি,হুম, ওঃ দাঁতের কথা তো মনেই নেই…. পড়ে গেছে না নড়বড় করছে এখনো?

হাসতে লাগলো দেবু, সুন্দর সাজানো ঝকঝকে দাঁত, পুরুষের সজীব প্রাণবন্ত মোহনীয় হাসি…..

এক হাতে আমাকে টেনে কাছে এনে আমার কাঁধ চেপে প্রায় বুকে মিশিয়ে নিলো…. অন্য হাতে সাবলীল ভাবে গাড়ি চালাতে লাগলো….. কারো কারো কন্ঠস্বর শুনতে অসম্ভব ভালো লাগে…দেবুর স্বর অমনই আকর্ষণীয়…. ওর গায়ের পুরুষালি গন্ধ, আফটার শেভ লোশনের সুগন্ধ…. সবটা মিলিয়ে আমাকে উন্মাদনায় ভরিয়ে দিলো…. চোখ বন্ধ করে এই স্বর্গীয় সুখ অনুভব করছি হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়ায় সোজা হয়ে বসে বললাম….
— আচ্ছা দেবু… আমি তো তোমাকে দেখেও চিনতে পারিনি, তুমি কি করে আমার আপাদমস্তক ঢাকা থাকা সত্ত্বেও চিনতে পারলে? বিশেষ, আমিও তো আমার সঠিক বণর্না দেইনি?
—- (মুচকি হেসে ) খুব সোজা…. প্রায় সব যাত্রীকেই চলে যেতে দেখলাম, তোমাকেই শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো, এছাড়া তুমি বোরকা পরে ছিলে, ভাবলাম হয়তো পর্দার আড়ালে থাকা তোমার অভ‍্যাস, তোমরা তো অনেকেই বোরকা পড়
—- বোরকা যে কেউ পড়তে পারে, ধরো ওটা আমি না হয়ে যদি অন্য কেউ হোতো?
— কি আর হোতো, না হয় দুচারটে চপ্পলের ঘা খেতাম।
ওর বলার ভঙ্গি আর মুখটা করুন হয়ে যেতে, হাসি চাপতে পারলাম না…. খিলখিল করে হেসে উঠলাম
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দেবু গাঢ় স্বরে বললো….
—- শিরি তোমাকে না দেখেই তো পাগল হয়েছিলাম এখন দেখার পর উন্মাদ হতে চলেছি…. এমন মধুর মিষ্টি হাসি…. মনে হচ্ছে খেয়ে ফেলি…

আল্লাহ্ এত সুখও আমার কপালে ছিলো, প্রেমিক পুরুষের এই অসামান্য ভালোবাসা আমাকে অভিভূত করে ফেললো, লজ্জায় রাঙা মুখে বললাম
—- থাক, আর তোষামোদ করতে হবে না, নিজে বুঝি কম?

বাইরে চেয়ে দেখলাম সব শহরেরই প্রায় এক দশা…. যানজট…. দেবু এটা ওটা দেখিয়ে বলছে…. এখানে যা যা দর্শনীয় স্থান আছে সব দেখাবো, খুব বেড়াবো
আমরা, অপেক্ষা করো,আগে হালাল করে নেই তোমাকে,
— সে আবার কি?
— আহা বুঝলে না, বিয়ে.. বৈধ স্বামীর অধিকার, তারপর…..

জীবনে পূণ্য করেছিলাম নিশ্চয়ই তাই এমন সুখের সায়রে ভেসে চলেছি, আমার চাওয়ার আর কিছু নেই…. একটা মেয়ের জীবনে যা সবচেয়ে বেশী দরকার…. ভালো, সৎ একটা সঙ্গী, প্রেমিক পুরুষ…. আমি সেটা পেয়ে গেছি…. ভাগ‍্যবতী আমি, দেবনাথ আমার শুধুই আমার…. আমার…..

চলবে….
নাজনীন রাহমান ****

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here