# বিকেলে ভোরের ফুল : পর্ব — ৩ #
হাসি কথায় গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম, কলেজ স্ট্রীট, এখানেই দেবুর বাসা…. তিনতলা বাড়ি, সুন্দর, বাড়ির দুদিকে নারকেল গাছ, একটা আম গাছও আছে… দেবু জানালো খুব মিষ্টি ভালো জাতের আম হয়…. বাড়ির সামনে ফুলের বাগান, গোলাপই বেশী….. গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছি, দেবু আমাকে সকৌতুকে বললো…. হ্যাঁ, রাজকন্যা, এটাই গরীবের কুঁড়েঘর।
—- থাক আর বিনয় করতে হবে না, আর আমি সম্রাট শাজাহানের বেগম নই যে আমার তাজমহল লাগবে
হাসলো খুব দেবু তারপর, উচ্চ কন্ঠে ডাক দিলো…
— সজলদা কই তুমি, জলদি এসো….
গাড়ির শব্দ পেয়েই ওপর থেকে মধ্য বয়সী একজন পুরুষ নেমেই আসছিলো…. দেবুর হাক শুনে পড়িমড়ি করে ছুটে এলো…. মধ্য বয়সী তবে যথেষ্ট শক্ত সমর্থ…. পরণে ধুতি ও ফতুয়া…. এক গাল হেসে বললো…. বৌদিমণি এসে গিয়েচেন? আমি
তো গাড়ির শব্দ শুনেই বুঝেচিলুম যে বাংলাদেশ এয়েচে …..
এমন হাসি পেলো কথা শুনে আর মানুষটার সম্বোধনেও লজ্জা পেলাম, মুখে হাত চেপে হেসে ফেললাম….
দেবুও হাসলো তারপর বললো…. শিরিন, এই আমার গার্জেন…. আমাকে এবং বাড়ি দেখেশুনে রাখার দায়িত্ব সজলদার, বহু পুরনো এবং মজার মানুষ, কই আর সব কোথায়? বাংলাদেশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি…
কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ এই সময় বাড়ির ভেতর থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো, একজন বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে সাদরে বাড়ির দিকে যেতে যেতে বললো…. তোমার বাবা কান্ডজ্ঞান দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি, মেয়েটা জার্নি করে এসেছে, ভেতরে নিয়ে যাবে, না… এখানেই দাঁড় করিয়ে রেখেছো…. চল মা ভেতরে চলো…
—- মাসিমা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, ব্যাচেলর মানুষ… ফট করে আস্ত একটা মেয়েকে নিয়ে তো বাড়িতে ঢুকতে পারি না, লোকে কি বলবে।
যেন ভারী মজার কথা বলেছে দেবনাথ, সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো…. একজন খুব মিষ্টি দেখতে কমবয়সী বৌ হাসতে হাসতে বললো…. ঈস, দাদার ঢং দেখে আর বাঁচিনা…. ( আমার দিকে তাকিয়ে )
—- জানো বৌদি? আজ কদিন দাদার নাওয়া খাওয়া নেই, কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে… একটা বুড়ীকে আনছি, টেনশন হবে না? এদিকে দেখো যেয়ে, অর্ধেক কোলকাতা শহর বোধকরি জেনে গেছে তার বুড়ীর কথা, এখন দেখছি বুড়ী কোথায়? এযে পরী!!!
মিটিমিটি হাসছে দেবনাথ, আমাকে ঐ মাসিমার ঘরে নিয়ে বসানো হলো…. পরিচিত হলাম সবার সাথে… সবাই দেবুর ভাড়াটে, কিন্তু আপনজনের চেয়েও বেশী…. দেবু ব্যস্ত হয়ে বললো….
— আমি একটু ওপরে যাচ্ছি, শিরিন এখানেই থাক, বেশী দেরী করা যাবে না, রেজিস্ট্রার এর অফিসে সময় দেওয়া আছে।
—- বাঃ বৌকে সাজাতে হবে না?
— না না কোনো দরকার নেই, যেমন আছে তেমনি থাক, ওসব পরে,আগে ঝামেলা শেষ করে আসি।
বলেই দেবু চলে গেলো, আমি হাত মুখ ধুয়ে সালোয়ার কামিজ ছেড়ে একটা শাড়ী পরলাম, আমার চুল দেখে মেয়েরা মুগ্ধ, লম্বা কালো চুলের গোছা…. একটা মেয়ে আমার চুলে বেণী করে হালকা সাজিয়ে দিলো, মাসিমা এক গ্লাস শরবত এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন…. খাও মা, আমাদের নিয়ম তো… বিয়ের আগে কনেকে একটু ফল মিষ্টি ছাড়া আর কিছু খেতে নেই… এত দুর থেকে এসেছো, শরবতটুকু খাও ভালো লাগবে।
সত্যিই ভালো লাগলো, প্লেনে সামান্য কিছু খাবার দিয়েছিলো, তারপর তো আর কিছু খাওয়া হয়নি, খিদে পিপাসা পেয়েছিলো কিন্তু লজ্জায় কিছু বলতে পারিনি…. শরবত খেলাম…. আখের গুড়, লেবুর রস ও চমৎকার কি মশলা দিয়ে তৈরী…. খেয়ে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো, মিষ্টিও দিয়েছিলো, খেতে ইচ্ছে করলো না।
দেবুও কাপড় পাল্টেছে, সাদা একটা পাঞ্জাবী পড়েছে, কালো প্যান্ট…. চুলগুলো ভেজা ভেজা, বুঝলাম ভালো মত ফ্রেশ হয়ে এসেছে… অসাধারণ লাগছে দেখতে…. আমাকে দেখেও সে মুগ্ধ হয়ে পলকহীন তাকিয়ে রইলো তারপর দুজন বয়স্ক পুরুষ ও আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো…. জানলাম এনারা আমাদের বিয়ের সাক্ষী হবেন, দেবুর দুজন বন্ধুও নাকি অপেক্ষা করছে রেজিস্ট্রারের অফিসে।
বিয়ে হয়ে গেলো আমাদের, বন্ধুরা গোলাপ — রজনীগন্ধা দিয়ে বানানো দুটো মোটা মালা নিয়ে এসেছিলো, মালা বদল করলাম, তারপর সবাইকে নিয়ে দেবু পার্কস্ট্রীটের নামকরা একটা চীনে রেস্তোরাঁয় এলো…. আগেই বুকিং দেওয়া ছিলো, ওর সব কিছুই খুব সুশৃঙ্খল গোছানো, খুব ভালো লাগলো ওর দায়িত্ববোধ দেখে।
ওখানে আর সব ভাড়াটেরাও ছিলো…. খুবই আনন্দ হাসি তামাশার আবহে খাওয়া শেষ হলো।
বাড়ি এসে এইবার মেয়েরা আমাকে সাজাতে বসলো…. ঝকমকে বেনারসী ( গায়ের মাপ না জানায় আমার আনা ব্লাউজ দিয়ে পরলাম ), এক সেট গয়না…. এসবই দেবু কিনে রেখেছিলো….
মেয়েরা ঠাট্টা করতে লাগলো…. দেবুদা এই পযর্ন্ত কোনো মেয়ের দিকে ফিরে তাকায়নি…. সে কি জানতো একটা হুরপরী তার জন্য কোন সুদূরে অপেক্ষা করেছিলো।
দেবু তিন তালার ছাদে ছোট একটা ফ্ল্যাট তৈরী করেছে…. সেখানেই আমাকে সবাই নিয়ে এলো, দুই রুমের ফ্ল্যাট সুন্দর সাজানো, পরিচ্ছন্ন…. খাটের ওপর সুদৃশ্য বেডকভার বিছানো, মেয়েরা তার ওপর গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রেখেছে, আমাদের মালা দুটোও রাখা…. সবাই যথারীতি রসিকতা ঠাট্টা করে চলে গেলো…. যাওয়ার সময় বলে গেলো…. বৌদি আমরা কিন্তু আড়ি পাতবো না, নিশ্চিন্তে প্রেমালাপ করতে পারবে।
আমি খাটের কিনারে বসলাম, দেবু গেলো দুষ্টুগুলো গেছে কিনা দেখে ছাদের দরজা বন্ধ করতে।
আমার হ্নদয়ের অনুভূতি বণর্না করতে পারবো না, সব কেমন স্বপ্নের মত লাগছে…. জীবনে এত সুখ – খুশী আমার জন্য ছিলো….?
দেবু ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আমার পাশে এসে বসলো… কেউ কথা বলছি না…. আমার ঘোমটা সরিয়ে মুখটা তুলে ধরে বললো…. সত্যিই তোমাকে তাহলে আমার করে পেলাম….
এরপর বলিষ্ঠ পুরুষের আলিঙ্গনে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।
অনেক কসরত করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম…. দেবু লক্ষ্মীটি তুমি একটু বাইরে যাবে?
—- কেন?
— দরকার আছে, যাও লক্ষ্মী….
কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওকে হাত ধরে টেনে তুলে দরজার দিকে ঠেলতে লাগলাম, কিছুতেই সে নড়বে না…. আমাকে আগে বলো কেন বাইরে যেতে বলছো…
মুখে কিছু না বলে ওর হাত ধরে টানতে লাগলাম, লম্বা চওড়া শক্তিশালী মানুষ… আমি কি পারি ওকে নড়াতে? শেষে হাল ছেড়ে বললাম…. দেখো আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি, ভালো মানুষের মত কথা শোনো, অল্প কিছু সময়ের জন্য গেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
— না তা হয়তো হবে না, যাচ্ছি সোনা মানিক আমার, রাগ কোরো না,তবে দেরী হলে কিন্তু আমি কুরুক্ষেত্র করে ছাড়বো, হ্যাঁ….
মুচকি হেসে ইশারা করলাম বাইরে যেতে তারপর বললাম…. আমি না ডাকলে ভেতরে আসবে না।
দরজা আলগোছে ভিড়িয়ে দিয়ে যা করতে চাইছি শুরু করলাম।
খানিক পরেই ওর অধৈর্য টোকা পড়লো দরজায়…
— হলো তোমার? আমি আসি?
— না না না, আর একটু সবুর করো।
ঘরের বাতি নিভিয়ে ওকে ডাকলাম…. কই গো, এসো এবার।
অন্ধকার দেখে বিরক্ত হয়ে বললো… আঃ কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না.. কই তুমি?
—- আরে বাতি জ্বালাও তবে তো দেখতে পাবে।
ঘরের উজ্জ্বল আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠলো….. আমি ঠিক ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম… হঠাৎ অন্ধকার থেকে আলো হওয়ায় প্রথমে কিছুই বুঝলো না দেবু তারপর ভালো করে দেখে চমকে উঠে বিস্ময়কর ধ্বনি বের হলো কন্ঠ থেকে…. এ কী… শিরিন? শিরি? তু- মি !!
চলবে…..
নাজনীন রাহমান ****