বিকেলে ভোরের ফুল : শেষ পর্ব

0
426

# বিকেলে ভোরের ফুল : শেষ পর্ব #

আমি শিরিন রশীদ …. বাংলাদেশের একজন অতি সাধারণ মেয়ে, আজ আমার বিয়ে হয়েছে এমন একজন মানুষের সাথে, যাকে সাত জনম তপস‍্যা করলে তবেই হয়তো পাওয়া সম্ভব।
রূপকথার রাজপুত্র সাত সাগর পার হয়ে রাজকন‍্যাকে নিতে আসে আর আমি সমুদ্র না হোক ভিনদেশে চলে এসেছি আমার রাজপুত্রের কাছে…. এসেই বুঝেছি আমার নারী জন্ম সার্থক।
****************************
দেবনাথ আমাকে দেখে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো…. ভারী বেনারসী খুলে লাল পাড় গরদের শাড়ী পরেছি লাল ব্লাউজ দিয়ে, বেণীতে জড়িয়েছি যুঁই ফুলের মালা, দেবুই এনেছিল, শাড়ীটা পরেছি এক প‍্যাচ দিয়ে আটপৌরে ভাবে, মাথায় দিয়েছি ঘোমটা…. পায়ে আলতা পরাই ছিলো..আর নূপুর, দুহাতে লাল কাচের চুড়ির সাথে সাদা শাখার বালা….
ডান হাত মুঠো করে রেখেছি, দেবুকে ডাকলাম…
— দাঁড়িয়ে রইলে যে, কাছে এসো
মন্ত্রমুগ্ধের মত আস্তে আস্তে সামনে এলো, হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরতে যেতেই একটু পিছিয়ে যেয়ে মুঠো করা হাতটা মেলে ধরলাম…. হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো দেবু….. আমার হাতে রাখা ছোট্ট একটা রূপোর সিঁদুর কৌটো…..টুকটুকে লাল সিঁদুরে ভরা…. এই সব আমি সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম, আমার অনেক দিনের সাধ মিটাতে,

—- এটা কি শিরিন?
— চিনতে পারছো না? সিঁদুর…. পরিয়ে দাও।
—- তোমাকে সিঁদুর পরাবো? মানে?
—- আমি তোমার স্ত্রী, এই আমার পরিচয়, সিঁথিতে তোমার দেওয়া চিহ্ন থাকবে, এতে অবাক হচ্ছো কেন?
—- এটাতো আমাদের ধর্মে….. বাঁধা দিয়ে বললাম,
— আমাদের তোমাদের বলে এখন কিছু নেই দেবু… আমরা ভালোবেসেছি, বিয়ে করেছি, তুমি আমি আলাদা কিছু নই, তুমিই বলেছো প্রেম ও যুদ্ধে সবই জায়েজ, কই দাও….
আর কথা না বলে খুশীতে উজ্জ্বল মুখে দু’ আঙুলে সিঁদুর তুলে আমার সিঁথিতে পরিয়ে দিলো, তারপর কপালেও অতি যত্নে একটা টিপও দিয়ে দিলো…..
কিছুটা সিঁদুরের গুঁড়ো ঝরে পড়লো আমার নাকে,
আবেশে আমার চোখ বুঁজে এলো, দু’হাতে আমার মুখটা তুলে মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলো দেবু তারপর বললো…. শিরি, হিন্দু সধবারা সিঁদুর কেন পরে জানো?
চোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম ওর চোখের দিকে…..
এটাই কি শুভ দৃষ্টি? *******
খুব ধীরে নরম সুরে বললাম…..
— স্বামীর দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনায়
—- আর নাকে মুখে এই মঙ্গল চিহ্নের গুঁড়ো পড়লে কি হয়?
আবেগে হ্নদয় উথালপাথাল, বিবশ কন্ঠে বললাম…
— সেই ভাগ‍্যবতী, স্বামী সোহাগিনী হয়
—- শিরি আমার শিরি…. তোমাকে যতই দেখছি আর তোমার কথা শুনছি, আমার অবাক লাগছে, এত কিছু কিভাবে জানো তুমি? তোমার এই সাজ, আমাকে দিয়ে সিঁদুর পরানো… সব আমার জন্য? আমাকে খুশী করার জন্য… ভাগ‍্যবান আমি যে তোমার মত স্ত্রী রত্ন পেয়েছি….
আর আমি কি পেয়েছি, সেটা বলতে চাই না, আমার হ্নদয়ের নিভৃতে সেই কথা তোলা থাক।
এরপর মালা বদলের পালা… মানুষের সামনে তো আমি স্বচ্ছন্দ ছিলাম না তাই পুনরায় দুজন দুজনকে মনের পুরো আবেগ দিয়ে পরালাম,তারপর আমি উচ্চারণ করলাম…. তোমার হ্নদয় আমার হোক, আমার হ্নদয় তোমার হোক…. দেবুও একই কথা বললো এবং বিস্ময় প্রকাশ করলো এটাও আমি জানলাম কিভাবে!! মুচকি হেসে জবাব দিলাম যে আসার আগে প্রচুর হোম ওয়ার্ক করেছি।
আর কথা না বাড়িয়ে আমাকে সবল হাতে কাছে টেনে নিলো, তারপর…..

আকাশে চাঁদ তারা, ঘরে ফুলের সুরভি সবই ছিলো কিন্তু আমরা সেসব কিছুই দেখলাম না…. রূপকথার রাজ‍্যে স্বপনপুরীতে দুজনে হারিয়ে গেলাম।

দিনগুলো সোনালী স্বপ্নের মত কেটে যেতে লাগলো, অনেক বেড়ালাম, কত কিছু দেখলাম, দেবুর বাসা যেখানে… একটু দুরেই বইয়ের দোকান, ফুটপাত, দোকানে শুধু বই আর বই…. দেব সাহিত্য কুটিরের শো রুমেও গেলাম, বেশ পুরনো দালান, কিন্তু বই দেখে আমার পাগল হবার দশা, বরাবরই আমি বইয়ের পোকা….এতদিন পূজা বার্ষিকীগুলো দুর থেকে পড়েছি, বাংলাদেশে আর তেমন পাওয়াও যায় না, এখন বইগুলো সচক্ষে দেখে তো মাথা খারাপ হয়ে গেলো, কোনটা রেখে কোনটা নেই, আমার অবস্থা দেখে দেবু হেসে বললো
— তোমার যা ইচ্ছে নাও, লজ্জা কোরো না ….
একই অবস্থা হলো চুড়ির দোকানে যেয়ে, না পারি ছাড়তে, না পছন্দ করতে…. দেবুই শেষে ওর পছন্দসই গাদা খানিক চুড়ি কিনলো।

খাবারের বেলায়ও তাই হলো…. মাসিমা বৌদিরা প্রতিদিনই এবেলা ওবেলা নানা পদ রান্না করে খাওয়াচ্ছে…. শুক্তো, মোচার ঘন্ট, এঁচোড় , ডিমের ডালনা, লুচি আলুর দমতো থাকবেই…. এরমধ্যে বাইরেও খাওয়া হচ্ছে…. কস্তুরী নামে একটা রেস্টুরেন্টে চিতল মাছের মুইঠ‍্যা ও চিকেন ভর্তা যা খেলাম…. জীবনেও ভুলবো না….
একদিন দেখি সজলদা মুখটা ব‍্যাজার করে বসে আছে, কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই করুণ সুরে বললো….. আমার রান্না তো বৌদিমনিকে খাওয়াতেই পারচিনে…. এইবার মা জননীরা ক্ষ‍্যামা দেন, আমি ভালো মন্দ কিচু করি, নইলে তো মরেও শান্তি পাবো না ….
আহা বেচারা সজলদা…. এরপর আর নয়, তার রান্না খাবো তবে অন্য কথা… শুনে খুব খুশী সে।

দেবু তো আছেই…. আর সবার আন্তরিকতা ও ভালোবাসা আমাকে অভিভূত করে রাখলো।

এর মধ্যে দেবুর ছোট বোনের সাথেও ফোনে কথা হলো… তার দাদার সুমতি দেখে অত্যন্ত আনন্দিত,সেতো ধরেই নিয়েছিলো, তার দাদা সন‍্যাসী হয়ে হিমালয়ে চলে যাবে।

রাতে ছাদের খোলা জায়গায় মাদুর পেতে বসি… দেবু আমার কোলে মাথা রেখে শোয়, ওর ঘন চুলে হাত বুলিয়ে দেই…. কত কথা বলি দুজনে…. পরস্পরের কাছে মন উজার করে গল্প করি…. সবই ঠিক ছিলো, শুধু একদিন আচমকা দেবু আমার ফোনটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললো….
— আজ থেকে সমস্ত গ্রুপ বন্ধ, লেখিকা শিরিন অবসর গ্রহণ করেছে আর গল্প লিখবে না সে।
— ( অবাক হয়ে ) মানে? চাকরী না হয় করতে দেবে না কিন্তু গল্প লেখা বন্ধ কেন?
— কেন আবার? লেখা দিতে যেয়ে এবার যদি কোনো দেবাশীষ এসে পড়ে শিরিনের কাছে, বিপদে পড়ে যাবো আমি, তাই সব খতম।

দেবু খুব রসিক মানুষ, কথাও বলে এমন মুখ ভঙ্গি করে যে না হেসে থাকা যায় না…. কিন্তু এখন হাসলাম না…. কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম…. এমন আকথা কুকথা যদি বলো তাহলে এক্ষুনি আমি চলে যাবো, আদর সোহাগ করি দেখে সাপের পাঁচ পা দেখেছো না?
— সর্বনাশ খুকী, কোথায় যাবে? পথ চেনো? শেষে ছেলে ধরা নিয়ে যাবে যে, এই কান ধরছি আর বলবো না…..
বলেই ফাজিলটা আমার কান চেপে ধরলো, এরপর না হেসে পারা যায়?

আর একদিন…. খুব রোমান্টিক মূহুর্তে বলে উঠলো
—- শিরি আমাদের কিন্তু অগ্নিপরীক্ষা হয়ে গেছে এবং আমরা ভালোভাবে পাশও করেছি,
— সেটা আবার কি?
— বুঝলে না? আমরা তো কেউ কারো আসল রূপ দেখিনি, না দেখেই প্রেমে দিওয়ানা, তো…. এটা প্রকৃত অকৃত্রিম ভালোবাসা না হলে সম্ভব হয় কি করে?
ভেবে দেখলাম ঠিকই তো….. আমরা ধরেই নিয়েছি
দুজনেই অযোগ্য বাতিল জিনিস নিয়ে মাতামাতি করছি, তাও কেউ পিছিয়ে যাইনি।
দেবু কিন্তু কখনো রাগ করে না আমার ওপর কিন্তু পান থেকে চুন খসলে ব‍্যস দারুণ অভিমান করবে, সেই মান ভাঙাতে আমার দম প্রায় বেরিয়ে যায়….
একদিন বিরক্ত হয়ে বললাম….. এই নমুনার সাথে সংসার করছি…. আমার খবর আছে ****

আমি সুখী হয়েছি….. সুখ নামে ছটফটে পাখিটা আমার হাতের মুঠোয় বন্দী… জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই….. আমি পরিপূর্ণ সুখী একজন নারী, প্রার্থনা করি জনম জনমে যেন আমি দেবনাথকেই পাই জীবন সঙ্গী হিসেবে।।
*************************
গল্পটা এখানেই শেষ হলে খুব ভালো হোতো কিন্তু না, বাস্তব আর কল্পনার জগত সম্পূর্ণ ভিন্ন….. সত্যিকার জীবনে এমন হয় না…. গল্প বাস্তব নয়, বাস্তব গল্প নয়…….

দেবুর সাথে দীর্ঘদিন কথা বলার পর যখন আমি জানতে পারলাম যে ও আমাকে ভালোবাসে, ঠুনকো, মোহ নয়…. অকৃত্রিম প্রেম,ভালোবাসা, আমি ও যে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি, সেটা অস্বীকার করতে পারবো না, তখন আমার চেতনা হলো….. এটা আমি কি করলাম? আমি যে কত অসহায় – নিরুপায়…. দেবনাথকে কি আমি বোঝাতে পারবো? নিশ্চয়ই শোনার পর বলবে…..
— আমাকে নিয়ে কেন এই খেলা খেললে?
অপরাধী মন আমার ছটফট করতে লাগলো, দেবুকে কিছু বলতেও পারছি না, ওকে ভুলতেও পারছি না।

এরপর দেবুর ফোন এলো যে ও আর অপেক্ষা করতে চায় না, আমি না গেলে ও এসে নিয়ে যাবে আমাকে এবং একটা ভিডিও পাঠালো সেই সাথে
… স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম…. দেবু ওর বন্ধুকে বলছে..

— শিরি ওর ঠিকানা দিলেই আমি বাংলাদেশে যাবো
তুই তৈরী থাক…. আমার ভিসাটা করে দিবি….
ভিডিও তে কি দেখলাম??
সর্বনাশ…. দেবনাথ তরুণ সতেজ একটা মানুষ, বয়সও কম, চল্লিশ ও হবে কিনা সন্দেহ….. এই প্রথম দেখলাম ওকে…. দিশেহারা হয়ে গেলাম… কি করি এখন?
ওকে যে সত্যিই আমি ভালোবাসি, ওর জীবনটা নষ্ট করার অধিকার নেই আমার…. ও অন্য কাউকে নিয়ে নতুন ভাবে শুরু করুক, মনে প্রাণে আমি চাই….. চাই…. কিন্তু কেন?

আমার কোনো উপায় নেই, দেবনাথের সাথে আমার মিলন কোনো ভাবেই সম্ভব নয়, কারণ…? কারণ…?
কয়েক বছর আগে আমি রাস্তায় পা পিছলে পড়ে যেয়ে বাম পায়ের গোড়ালীতে আঘাত পেয়েছিলাম, তখন তেমন গুরুত্ব দেইনি, পরবর্তীতে সেই চোট আমাকে প্রায় পঙ্গু করে দেয়….. সময়ে ডাক্তার না দেখাবার ফলে কোনো ভাবেই আমি আর পুরো সুস্থ হলাম না…. বাম পায়ে একদম জোর নেই, স্বাভাবিক ভাবে হাটতেও পারি না….. তাছাড়া দেবু আমার থেকে বয়সে বেশ ছোট…. আমার কোনো যোগ‍্যতা নেই ওর ভালোবাসা পাওয়ার….

আমি ভুল করেছি… মাশুল আমাকেই দিতে হবে….
একজন পঙ্গু, প্রতিবন্ধী,বয়স্ক নারী এমন সজীব তাজা তরুণের জীবন সাথী হতে পারে না….

আমি রাত জেগে আমার মনের যত আবেগ, দেবুকে কল্পনা করে যত বাসনা…. সব দিয়ে একটা সফল প্রেম কাহিনী লিখলাম…. আমি জানি দেবু ঠিক অমনিই মানুষ, যেরকমটা ভেবেছি…. তাই ও যে মূহুর্তে জানতে পারবে, আমার অপারগতা অসহায়তা…. নিশ্চিত… সে ছুটে আসবে আমার কাছে…. কোনো বাঁধাই মানবে না…

আমি তা হতে দিতে পারি না, কত প্রেমই তো সুন্দর সফল পরিণতি পায় না এবং অসফল ব‍্যর্থ মানুষ বেঁচেও থাকে…. আমি দেবনাথের ভালোবাসা পেয়েছি…. সেই অমূল্য স্মৃতি নিয়েই জীবনের শেষ পযর্ন্ত কাটিয়ে দেবো….. ওগো কেন এলে তুমি আমার জীবনে…. কেন… কেন??

প্রথমেই ফেসবুক বন্ধ করে দিলাম…. তারপর ফোনের সিম কার্ড বদলে নতুন সিম নিলাম…
দেবু জানে আমি কোন শহরে থাকি, সুতরাং ফোন নাম্বারের সূত্র ধরে আমার ঠিকানা বের করা ওর জন্য জলের মত সহজ….
তারপর…. তারপর?
আমি এখন আর লিখি না…. ফোনটা হাতে নিয়ে পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি….. নিশীথ রাতের প্রহর পল পল কেটে যায়…. আমার চোখের বেদনার অশ্রু অঝোরে ঝরে পড়ে…. এই অশ্রু আমার দেব কখনো দেখতে পাবে না…. কখনো জানতে পারবে না…. বিকেলের শুকনো এক ফুলের কষ্টের হাহাকার….. মর্মবেদনা।

** আমি যে কে তোমার…. তুমি তা বুঝে নাও
আমি চিরদিন তোমারই তো থাকবো…
তুমি আমার…. আমি তোমার….. **

দেব আমার দেব ক্ষমা করে দিও আমাকে …..

সমাপ্ত….. নাজনীন রাহমান ****

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here