বিনি সুতোর টান,পর্ব-১১,১২

0
1988

#বিনি সুতোর টান,পর্ব-১১,১২
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১১

সে নম্র গলায় কাহিনি বলা শুরু করল

গ্রীষ্মের দাবদাহ। কড়া রোদ ছিল সেদিন। মাথার উপর সূর্যটা যেন খাড়া হয়ে তাক হয়ে আছে। কাহিনির শুরু হয় ১৮ বছর আগে। তখন আমি সবে ভার্সিটিতে ভর্তি হই। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে প্রথম দিন ঢুকেই ক্যাম্পাস চশে বেড়ানোর এক ভূত চাপে মাথায়। আমার ফ্রেন্ডকে নিয়ে ক্যাম্পাসে হাঁটতে লাগলাম। ক্যাম্পাসের পুকুর পাড়ে এসে কিছুটা থমকে দাঁড়ালাম। এক অল্পবয়সী মেয়ে বসে আছে। চুলগুলো খোলা। বারবার বাতাসে সামনে আসা চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে নিচ্ছিল মেয়েটা। মেয়েটার দিকে আমার চোখটা আবদ্ধ হয়ে গেল। আর কোথাও চোখ সরাবার ইয়ত্তা পাচ্ছি না। এক মনে মেয়েটাকে দেখতে লাগলাম। যতই চেষ্টা করছিলাম মেয়েটার দিক থেকে চোখ সরাতে ততই ব্যর্থ হচ্ছিলাম। এর মধ্যেই ফ্রেন্ডের গার্লফ্রেন্ড প্রেরণা হাজির। আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে প্রেরণা বলে উঠল

“ভাইয়া কেমন আছেন? আপনাদের কখন থেকে খুঁজছি। আর আপনারা টই টই করে হাঁটছেন।”

আমি নিজের আবেগ নিবারণ করলাম। প্রেরণা তুষারের গার্লফ্রেন্ড। সে আমাকে ভাইয়ের মতোই ভাবে৷ সম্মানও করে। আর আমরা দুজন বেশ ফ্রিও ছিলাম। আমি প্রেরণাকে হাসতে হাসতে উত্তর দিলাম

“আমাকে খুঁজছিলে নাকি তুষারকে? তুষারকে খুঁজে হয়রান আর এখন নাম দিচ্ছ আমার নাম। বাহ ভালোই তো প্রেরণা।”

প্রেরণা এক গাল হাসলো। হাসতে হাসতে জবাব দিল

“আরে ভাইয়া সত্যিই আজকে আপনাকে খুঁজছিলাম। আমার খালাত বোন মিহির সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিতে ওকে এনেছিলাম। তাই তুষারকে না আপনাকে খুঁজছিলাম।”

এবার আমি আরেকটু হাসলাম। হেসে জবাব দিলাম।

” তোমাদের মাঝে আমি হাড্ডির মতো থাকি তাই খালাত বোন নিয়ে এসেছো? যাতে করে আমি তোমার খালাত বোনের সাথে আড্ডা দিতে পারি আর তোমরা নিজেরা নিজেদের সময় দিতে পারো। বলো আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে আনোনি বরং নিজেদের প্রয়োজনে এনেছো। সবি তো বুঝি আমি কচি খোকা তো না।”

“আরে ভাইয়া ঐরকম কিছু না। আমার ইচ্ছা মিহির সাথে আপনাকে বিয়ে দিব তাই এনেছি। ও কিন্তু ভীষণ সুন্দরী।”

“হয়েছে থামো। এসব প্রেম আমাকে দিয়ে হবে না। আর তুমি জানো আমাকে সৌন্দর্য টানে না। ”

“হয়েছে থামুন এবার।”

“ওকে থামলাম। যাকে নিয়ে এত কথা সে কোথায়?”

প্রেরণা হাত দিয়ে পুকুর পাড়ে বসা মেয়েটাকে ইঙ্গিত করল। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। গরমের উত্তাপেও একটা শীতলতা অনুভূত হলো আমার শরীরে। এক পলকে আবারও মেয়েটার দিকে তাকালাম। ভালোবাসার মানে আমি তখন জানতাম না তবে তার প্রতি প্রবল দুর্বলতা আমার কাজ করতে লাগল। মনে হতে লাগল তাকে আমি চিনি অনেকদিন যাবত। তাকে নিয়ে আমার স্বপ্নের সংসার কল্পনা করতে লাগলাম। কেন জানি না মনের অজান্তেই তাকে দেখে এ ভাবনা গুলো চলে এসেছিল।

কথাটা বলেই নীল থেমে গেল। আমি নীলের কথায় যেন নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম। নীল যে দুর্বলতা ১৮ বছর আগে টের পেয়েছিল সে একই দুর্বলতা যেন আমার মধ্যে ১৮ বছর পর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আমি নীলের দিকে তাকিয়ে আছি। নীল কী যেন ভাবছে চুপ হয়ে। আমি নীলকে হালকা ডেকে বললাম

“আপনি কি কিছু ভাবছেন? হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন কেন?”

নীল হালকা হেসে জবাব দিল

“সে দিনের ছবিটা চোখে ভাসছে। মিহিকে এক মনে দেখছি কল্পনায়। কতদিন তাকে কল্পনাও করি না। তবে প্রথম দেখার মিহিকে, কল্পনা এতদিন না করলেও এখনও ভুলিনি। মিহির চোখ, কান, নাক, চুল, হাসি সব আমার চোখে ভাসছে। মনে হচ্ছে জলজ্যান্ত হয়ে সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ভুলা হয়তো এ জীবনে সম্ভব না।”

আমার কেন জানি না কথাটা শুনে বেশ হিংসে হচ্ছে মিহিকে। কেন এমন হচ্ছে জানি না। তবুও নিজেকে সামলে বললাম

“তারপর কী হয়েছে বলুন।”

নীল আবারও বলা শুরু করল

প্রেরণা মিহিকে ডাক দিল। মিহি পুকুর পাড় থেকে উঠে আমাদের দিকে আসতে লাগল। যতই সে আমার দিকে এগুচ্ছে ততই যেন আমার ভেতরের স্পন্দন, স্পন্দিত হতে লাগল দ্বিগুণ হারে। যতই আমার সন্নিকটে আসছিল ততই আমার শরীরটা কাঁপতে লাগল। কেন এত অনুভূতির সমাবেশ ঘটেছিল তখন না বুঝলেও এখন টের পাই। কাউকে প্রথম দেখায় এমন অনুভূতির বিচরণ ঘটাকে লাভ এ ফার্স্ট সাইট বলে। মিহি এবার আমার সামনে দাঁড়ানো। মেয়েটা অসম্ভব সুন্দরী ছিল। অন্য কারও কাছে সে কতটা সুন্দরী জানি না তবে আমার কাছে সে ছিল সুন্দরের রাণী। হয়তো মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকে তার চোখে অনেক সুন্দর লাগে। মিহির উচ্চতা ৫ ফিট ৫ হবে। ওজন খুব একটা বেশি না। একদম স্লিম ফিট। গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। চোখের মণি দুটো কালো। আমার কালো মনির প্রতি একটা দুর্বলতা কাজ করে আর কালো লম্বা চুলের প্রতি। তাকে বেশ কতক্ষণ তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নিলাম আমি। মুখ দিয়ে আমার কোনো কথায় বের হচ্ছে না। মিহি আমার কাছে এসে ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বলল

“ভাইয়া আসছালামুআলাইকুম। ”

আমি ওর দিকে দৃষ্টি রেখেই উত্তর দিলাম

“ওয়ালাইকুমুচ্ছালাম।”

“কেমন আছেন?”

“আমি ভালো আছি তুমি?”

“ভালো।”

কথাটা বলেই সে চুপ হয়ে গেল। এদিকে তুষার আর প্রেরণা আমাদের রেখে তারা হাঁটতে লাগল আপন মনে। আমি আর মিহি পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলাম। মিহি কোনো কথায় বলছে না। আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে আবার একটু একটু হাসছে। মেয়েটার কান্ড দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। আমি মিহিকে জিজ্ঞেস করলাম

“কিসে পড়ো তুমি?”

মিহি চুপ গলায় উত্তর দিল

“ক্লাস নাইনে উঠেছি।”

মিহির কথা শুনে বুঝলাম ওর বয়সটা বেশ কাঁচা। আমি কিছুটা হেসে বললাম

“তা কোন গ্রূপ?”

“সায়েন্সে।”

“কোন স্কুলে পড়ো তুমি?”

“ভিকারুন্নেসা স্কুলে। আচ্ছা ভাইয়া আপনি কিসে পড়েন?”

“আমি ‘ল’ তে৷ গাঁধা স্টুডেন্ট তাই বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি।”

আমার কথা শুনে মিহি খিলখিল করে হাসতে লাগল। হাসিটার বেশ অনেকক্ষণ স্থায়িত্ব রাখল। তারপর হাসির এক পর্যায়ে বলল

“এমনি এমনি ডি ইউ তে চান্স পেয়েছেন নাকি? আপনি পারেন ও বটে। প্রেরণা আপু ঠিকেই বলে আপনি বেশ মজার মানুষ। “,

” তা তোমার প্রেরণা আপু আর কী বলেছে?”

“আমি কেন সব আপনাকে বলব। যা বলেছে আমার মন চাইলে এমনি বলব আর মন না চাইলে আপনি জিজ্ঞেস করলেও বলব না। ”

“আচ্ছা তোমার মর্জি।”

বেশ অনেকক্ষণ টুকটাক কথা হলো মিহির সাথে। বলা চলে বাচ্চা একটা মেয়ে। বেশ দূরন্ত চঞ্চল। কটমট করে কথা বলে। সুন্দর করে কথার রিয়েক্ট করে। বেশ ভালোই লাগছিল তার সাথে কথা বলতে। তবে ভালো লাগার সময় টা বেশ দ্রূত ফুরিয়ে যায়। তাই আমাদের সময়টা কখন যে ফুরিয়ে গেল টের পেলাম না। প্রেরণা আর তুষারের ডাকে মনে হলো প্রায় দু ঘন্টা আমরা পার করে ফেলেছি।

সেদিন কথা শেষে বাসায় আসি। বাসায় এসে সারাদিন তার কথা ভাবতে থাকি। এখনকার মতো তখন এত এনড্রয়েড ফোন ছিল না। হাতে নোকিয়ার একটা বাটন ফোন ছিল আর বাসায় টেলিফোন। তবে মিহির মতো মেয়ের কোনো ফোন থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। একে তো বয়স কম তার উপর ওকে এ বয়সে কেউ পার্সোনাল ফোন দিবে না। তাই তার সাথে যোগাযোগ করার মতো কোনো উপায়ও ছিল না। তবে মেয়েটার ছবি আমি মন থেকে সরাতে পারছিলাম না। এভাবেই সেদিন সারা রাত কেটে গেল। পরদিন আমার সাথে আশ্চর্য জনক একটা ঘটনা ঘটল যা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

কথাটা বলে নীল থেমে গেল। আমি নীলকে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলাম

“কী ঘটেছিল বলেন।”

নীল নম্র গলায় পুনরায় বলতে লাগল কাহিনি ।

চলবে?

#বিনি সুতোর টান
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১২

নীল নম্র গলায় পুনরায় কাহিনি বলতে লাগলেন।

সকালে উঠেই মোবাইলে কল আসলো। অচেনা একটা নম্বর। যদিও মোবাইল নম্বর না, ল্যান্ড নম্বর ছিল। আমি কলটা ধরলাম অনিশ্চয়তা নিয়ে। মিষ্টি একটা কণ্ঠ কানে আসলো

“হ্যালো আসছালামুআলাইকুম ভাইয়া। আমি মিহি।”

কিছুটা অবাক হলাম তার কথা শুনে। বুঝতে পারছিলাম নম্বরটা প্রেরণার কাছ থেকে নিয়েছে সে। আমি কিছুটা চুপ হয়ে সালামের উত্তর নিলাম

“ওয়ালাইকুমুচ্ছালাম। তুমি আমার নম্বর পেলে কোথায় থেকে?”

মিহি হালকা হাসলো। তার হাসিটা যেন আমার আমার বুকে এসে কম্পন তুলল। কী যে মোহনীয় হাসির শব্দ। মনে হয়েছিল কোনো মায়া বলয় থেকে কোনো মেয়ে হাসছে আর আমাকে তার কাছে যেতে আহ্বান করছে। তার হাসি যতক্ষণ বিস্তৃত ছিল ততক্ষণ আমি যেন মোহনীয়তায় ডুবে ছিলাম। হাসিটা থামিয়ে বলল

“প্রেরণা আপুর কাছ থেকে নিয়েছি। আমি এখন স্কুলে যাব পরে কথা হবে।”

কথাটা বলেই কলটা কেটে দিল মিহি। কলটা কাটার পর বেশ শূন্য লাগছিল নিজেকে। মনের অজান্তেই মিহির মুখের প্রতিচ্ছবি কল্পনায় আঁকছিলাম। এ অনুভূতিগুলো এখনও বেশ মনে পড়ে। মনে হয় অনিভূতির জায়গাটা স্মৃতি হয়ে থাকলেও এখনও সেটায় ভাটা পড়েনি।

কথাটা বলে নীল কিছুক্ষণ হাসলো। হেসে হেসে বলতে লাগল মেয়েটা বেশ পাগলও ছিল বটে। তবে ওর কথায় অনেক মাধুর্য ছিল। নীলের কথা শুনে কেমন জানি লাগছিল। মেয়েটার প্রতি এক অদ্ভুত রাগ জন্মাতে লাগল। যাকে নীল এত ভালোবাসে সে মেয়েটা নীলের মতো মানুষ পেয়েও তাকে হারিয়ে ফেলল। রাগের পাশাপাশি আফসোস ও হচ্ছে মেয়েটার জন্য। আমি নীলকে মনের অজান্তেই বলে উঠলাম

“আপু কি অনেক সুন্দর ছিল?”

নীল একটু হাসলো। হাসিটা বেশ স্নিগ্ধ আভাস ছড়াচ্ছে। বেশ হেসে জবাব দিল

“আমার চোখে সে অনেক সুন্দরী ছিল। সত্যিই তাকে আমি অনেক ভালোবাসতাম। সুতরাং ভালোনাসার মানুষের চোখে কেউ কখনও অসুন্দর হতে পারে না। জানেন মিহির সবচেয়ে বেশও দৃষ্টি কাড়ত তার চুল গুলো। ওর লম্বা লম্বা চুল ছিল। আমার লম্বা চুলের প্রতি একটু দুর্বলতা আছে। একটু দুর্বলতা বললে ভুল হবে অনেক বেশি দু্র্বলতা আছে।”

নীলের কথা শুনে আমি কিছুটা আশাহত হলাম। নিজের মাথায় হাত দিয়ে লক্ষ্য করলাম আমার চুল ঘাড় পার হয়েছে সবে। তেমন লম্বাও না আবার ঘনও না। নীল পছন্দ করে এমন কোনো বিষয় আমার মধ্যে নেই। কিছুক্ষণ চুপ রইলাম। বিরহের বিপনিতা মনে বইতে লাগল। কী এক অদ্ভুত ছটফটানি। যদিও আমার চুল দশম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় অনেক লম্বা ছিল কিন্তু হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ে খারাপ লাগত। কেন জানি না সে সময় টা মায়ের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছিলাম না। যদিও মা মরেছিল অনেক আগে তবে আমার সে সময়টায় মাকে বেশি মনে পড়ত। মাকে ছাড়া বিষন্ন লাগত। তাই অসহ যন্ত্রণার আঘাত ভুলতে না পেরে কোমায় চলে গিয়েছিলাম ২৬ দিনের মতো। সেখান থেকে চিকিৎসার সুবাদে আমার লম্বা চুলগুলো কেটে ঘাড় সমান করা হয়। আর বেশি পাওয়ারের ঔষধ খেয়ে আমার ঘন চুলগুলো পাতলা হয়ে গিয়েছে। জীবনের একটা বড়ো কষ্ট হলো এ চুল হারানোর যন্ত্রণা। আজকে যেন সে কষ্টটা পুনরায় জিবীত হলো নীলের কথায়। ধুর! আমি আবার কী নিয়ে পড়লাম? অসম ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে না জানা কথা এটা নিয়ে এত ভাবছিই বা কেন? আমি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে নীলকে বললাম

“পরে কী হয়েছে বলেন। কাহিনি বলে বলে চুপ হয়ে যান কেন? গড়গড় করে বলতে থাকেন।”

নীল হালকা হাসলো। এ হাসি তার সুখের হাসি না তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। এক রাশ হাসিতে যেন বিরহ ডুবে আছে।

“পুরনো স্মৃতি যখন মনে এসে হানা দেয় তখন সেখানে কিছুক্ষণের জন্য ডুব দিই। ডুবে গিয়ে হয় সুখ খুঁজে নিই নাহয় যন্ত্রণা। কখনও কাউকে তীব্র ভালোবাসলে তার স্মৃতিচারণ করলেও আপনার বুকে একটু হলেও নাড়া দিবে। মিহির কথা মনে পড়ছে। ভীষণভাবে মনে পড়ছে।”

“আপনি এখনও তাকে ভালোবাসেন?”

“ভালোবাসি। হয়তো সবসময় মনে গেঁথে থাকবে।”

“পরে কী হয়েছে বলেন।”

এভাবেই মিহি প্রায় প্রতিদিন সকালে আমাকে কল দিত। কল দিয়ে বলত স্কুলে যাচ্ছি আমি। প্রায় দুমাস এটুকুর মধ্যেই দুজন সীমাবদ্ধ ছিলাম। দুমাস পর মিহি একদিন রাতে কল দিল। আমি কলটা ধরতেই সে হাসতে হাসতে বলল

“আজকে আমার জন্মদিন উইশ করবেন না?”

আমি তার কথায় তাকে উইশ করলাম। সেদিন আমাদের কথা হয় সারারাত। এতক্ষণ কথা হয়েছে একটুও বিরক্ত লাগেনি। তবে সময় যে কীভাবে পার হয়ে গিয়েছিল নিজেও টের পাইনি। মনে হয়েছিল এইতো সবে কথা শুরু করেছিলাম। তবে ফজরের আজান জানান দিল সকাল হয়ে গিয়েছে। সে সময়ের মতো ফোনটা রেখে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। পরদিন সকালে সোজা একটি দোকানে গিয়ে মিহির জন্য কিছু গিফট কিনলাম। একটা ট্যাডি বিয়ার,কতগুলো চকলেট,ওর জন্য একটা চুলের ক্লিপ, একটা লিপস্টিক, এক প্যাকেট বেলুন। এগুলো কিনে রেপিং করে নিলাম। আমি জানতাম মিহি আমাকে সকালে কল দিয়ে বলবে সে স্কুলে যাচ্ছে। তাই মিহির স্কুলে যাওয়ার সময়টা আমার মুখস্ত। আমি সে সময়ের আগেই ওর স্কুলে পৌঁছালাম। মিহি ঠিক তখন আমাকে কল দিয়ে বলল সে স্কুলে যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় পঁচিশ মিনিট দাঁড়ানোর পর লক্ষ্য করলাম মিহি রিকশা থেকে নামছে। রিকশা দিয়ে সে একাই এসেছে। রিকশা থেকে নেমে আমাকে দেখে চমকে গেল। আমার কাছে এসে বড়ো চোখে তাকিয়ে বলল

“আপনি এখানে?”

“তোমার বার্থ ডে এর গিফট নিয়ে এসেছি।”

আমি গিফট গুলো এগিয়ে দিলাম তার দিকে। সে গিফট গুলো হাতে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু কেটে বললল

“ভাইয়া ধন্যবাদ।”

ওর কান্ড দেখে আমি পুরো হতবাক। কোনো মেয়ের এমন স্পর্শ আমাকে প্রথম নাড়া দিয়েছিল। আমার এখনও মনে আছে সে যে গালে চুমু দিয়েছিল আমি সে গালটা দুদিন শুধু হাতে ধরে রেখে ওকে কল্পনা করতাম। কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল আমি জানি। এ অনুভূতির প্রকাশ করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেয় নি। এখনও মনে হলে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগে মনে। সে সময়গুলো সত্যিই অনেক মধুর ছিল।

দিন যেতে লাগল আমাদের সম্পর্কের পরিধি বাড়তে লাগল। কথা বাড়তে লাগল। ওর কোনো পার্সোনাল ফোন ছিল না আমি কল দিতাম ওর বাবার ফোনে। ও ওর বাবার ফোন লুকিয়ে ব্যবহার করত। তখন কলরেট ও ছিল অনেক।৷ ফোনের টাকা জোগাড় করার জন্য বাবার পকেট কাটতাম নাহয় এই সেই বলে টাকা নিয়ে ফোনে ঢুকাতাম। কখনও যদি ব্যালেন্স হয়ে যেত কিন্তু কথা শেষ হয়নি এখনও তখন ফোনে টাকা ঢুকানোর জন্য রাত তিনটে তে ও লুকিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম। এক ধরণের অদ্ভুত পাগলামি কাজ করত। কথা বলার তীব্র নেশা কাজ করত।

এভাবে পার হলো ছয় মাস। এবার আমি সারাক্ষণেই দাঁড়িয়ে থাকতাম ভিকারুন্নেসা স্কুলের সামনে। কখন মিহি বের হবে ওকে একটু দেখতে পারব কথা বলতে পারব এসবেই আমার মনে বাজত শুধু। ওর ক্লাস শেষে ও বের হত আর আমরা দেখা করতাম। কোথাও কিছুক্ষণ বসতাম। তখন তো এবাইলেবল রেস্টুরেন্ট ছিল না। দূরে দূরে ছিল সব। খুঁজে খুঁজে রেস্টুরেন্ট বের করে বসতাম। আড্ডা দিতাম। খুব বেশি আড্ডা দিতে পারতাম না কারণ মিহির বাসায় যাওয়ার তাড়া ছিল। তবে প্রতিদিন এক ঘন্টা করে আমাদের কথা হত দেখা হত। সে এক ঘন্টা সময় আমার কাছে মনে হত ১ সেকেন্ডের মতো।

কেটে গেল আরও কিছু দিন। সবসময়ের মতো সেদিনও মিহির সাথে আমি দেখা করতে যাই। তবে সেদিন মিহি করে বসে একটা বিরাট কান্ড। যা মনে হলে এখনও আমি আতঙ্কে চুপসে যাই। আমি কতটা পাগল তার জন্য ছিলাম তাই সবটা মেনে নিয়েছি।

নীল আবারও থেমে গেল। আমি নীলকে পুনরায় প্রশ্ন করলাম

“কেন কী করেছিল?”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here