#বিনি সুতোর টান,পর্ব-২১
#শারমিন আঁচল নিপা
অবশেষে সমস্ত সাহসের সন্নিবেশ ঘটিয়ে আমি ওর ঘরে প্রবেশ করলাম। নীল তখন চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। আমি হালকা কাশি দিয়ে বললাম
“আসব কী রুমে?”
নীল চায়ে চুমুক দিতে দিতে জবাব দিল
“আসুন।”
আমি রুমে প্রবেশ করলাম। এখনও নীলের চোখ আমার দিকে পড়ল না। সে চা খাওয়ায় বেশ ব্যস্ত। চা তে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে খেতে বলল
“কিছু বলবেন কী?”
আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম
“না এমনি এসেছিলাম। আপনি কী ভীষণ ব্যস্ত?”
“ব্যস্ত কেন হব?”
“মনে হচ্ছে অনেক ব্যস্ত। একবারও এদিকে তাকাচ্ছেন না। আপন মনে খেয়ে যাচ্ছেন।”
“তাকানোর তো কোনো প্রয়োজন মনে করছি না। কিছু বলার থাকলে বলবেন। আমার কান তো খাড়া আছে আপনার কথা শুনবার জন্য। ”
“তবুও আই কন্টাক্ট বলে একটা কথা আছে। আমার দিকে তাকিয়ে যদি কেউ কথা না বলে আমার ভালো লাগে না। আর এলিসন কোথায় তাকে তো দেখছি না।”
“এলিসন ঘুমাচ্ছে। তার আর কী কাজ খাওয়া পটি করা ঘুমানো।”
কথাটা শেষ করেই নীল আমার দিকে তাকাল। আমিও নীলের দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে আকৃষ্ট ভঙ্গিতে তাকালাম। নীলের চোখ গুলো একটু বড়ো হলো। পলকহীনভাবে সে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
“শাড়িটা চেনা চেনা লাগছে।”
“আপনার মায়ের শাড়ি।”
“বুঝতে পেরেছি এটা মায়ের বুদ্ধি তাই না?”
নীলের কথা শুনে চমকে উঠলাম। মৃদু গলায় বললাম
“মায়ের বুদ্ধি মানে?”
“মানে মা চাচ্ছেন আপনার সাথে আমার কিছু হোক। আর সেজন্য আপনাকে এত গুছিয়ে আমার কাছে পাঠিয়েছে। আর আপনিও বেশ নাছোরবান্দা মায়ের কথায় তাল দিচ্ছেন।”
নীলের কথা শুনে আমি বোকা বনে গেলাম। বুঝতে পারলাম নীল বেশ বিচক্ষণ মানুষ নাহয় এত বড়ো নীল নকশা ও টের পেত না। আমি আমতা আমতা করে বললাম
“সবাই চাচ্ছে আপনি বিয়ে করুন। করছেন না কেন? আর আমি আপনাকে ভালোবাসি। সরাসরি বলে দিলাম। আমি চাই আপনাকে বিয়ে করতে। লোকে কী বলল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার বয়সও কম না। ২০ বছর বয়সী একটা মেয়ে এতটাও আবেগী হয় না। বয়সের পার্থক্য কখনও সম্পর্ক নির্ধারণ করে না। আপনি আমি খুশি থাকলেই হলো। আমি আপনার ব্যাপারে সবটা জেনেই আপনাকে আরও ভালোবেসে ফেলেছি। মিহি আপুর জায়গাটা আমি কখনও নিতে পারব না। আমি জানি উনার সাথে আপনার যোগাযোগ ও নেই৷ উনি উনার মতো জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছে। আপনি কেন পিছিয়ে থাকবেন? এদিকে আমি আপনার একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে আছি আর আপনি বুঝতেছে না। এটা কী ঠিক? আমাকে ভালোবাসতে পারেন আর না পারেন আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা করেন। যদি বুঝতে গিয়ে আমাকে আপনার ভালো লাগে আপনার সাথে আমাকে সংযুক্ত করবেন নাহয় আমাকে ছেড়ে দিবেন। জোর করে কিছুই আমি চাচ্ছি না। তবে সময় নিতে গিয়ে নিজের জীবনের সুন্দর সময় গুলো হারাবেন না।”
কথা গুলো নীলকে বলে চুপ হয়ে গেলাম। কীভাবে আমি এত কথা নীলকে বললাম বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে কথা গুলো বলে বেশ হালকা লাগছে। নীল চুপ হয়ে আছে। নীলের উত্তরের অপেক্ষায় আছি৷ কিঞ্চিৎ চুপ থেকে নীল উত্তর দিল
“আপনাকে আমার ভালো লাগে না বিষয়টা ভুল। আপনার প্রতি যথেষ্ঠ টান আমার আছে৷ সে টান থেকেই আপনার জন্য এতকিছু করা। এ পর্যন্ত আপনার জন্য আমি যা করেছি এতকিছু হয়তো মিহির সাথে বিচ্ছেদের পর কোনো মেয়ের জন্য করিনি। তবে আমি দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছি এ অসমম বয়স নিয়ে। আপনার আমার বয়সের ফারাক বেশি৷ আজকে আমাকে আপনার ভালো লাগছে কালকে নাও ভালো লাগতে পারে। ”
নীলকে থামিয়ে দিয়ে আমি হুইল চেয়ারটা নিয়ে নীলের কাছে গেলাম। সাহস করে নীলের হাত দুটো চেপে ধরলাম। নীলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম
“আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি। আপনার বসয় নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। আপনার যদি আমাকে যাচাই করার ইচ্ছা থাকে যাচাই করে নিন। অতীতে আর কত ডুবে থাকবেন?”
নীল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো কথায় সে বলছে না। তার হাত দুটো হালকা কাঁপছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে অনায়েসে এবার বলে উঠল
“আপনাকে আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। আপনি বেশ অগুছালো মেয়ে। আমার অগুছালো কিছু পছন্দ না। আপনাকে পছন্দ করি বলেই নুরাকে নিয়ে এসেছিলাম আপনাকে একটু গুছিয়ে দেওয়ার জন্য। অবশ্য আপনি অগুছালো এটা আপনার দোষ না। কারণ যে বয়সে আপনার গুছিয়ে চলার সময় ছিল সে সময়টায় আপনার মা আপনার পাশে ছিল না। তবে এখন যথেষ্ঠ বড়ো হয়েছেন নিজেকে একটু পরিপাটি করুন। আমার সাথে মিশুন। আমাকে বুঝুন তারপর নাহয় বিয়ের কথা ভাববেন। আগেই যদি আবেগে পড়ে বিয়ে করে নেন পরে অনুসূচনা করেও লাভ হবে না। আমাদের উচিত আগে কথা বলে নিজেদের মধ্যকার আন্ডারস্ট্যান্ডিং টা ঠিক করে নেওয়া।”
আমি নীলের আরো সন্নিকটে গেলাম। নীলের চোখ আর আমার চোখের দূরত্ব এখন একদম কম। হালকা গলায় বললাম
“আপনার জন্য আমি সব পারব। সময় নিন সমস্যা নেই। যা করা লাগে করব তবুও আপনাকে আমি ছাড়তে পারব না। কেন জানি না আপনাকে ছাড়ার কথা চিন্তা করলে আমার খারাপ লাগে। বিরহ যেন আমাকে গ্রাস করে ধরে। যন্ত্রণা বিরাজ করে বুক পিন্জরে। অদ্ভুতময় অশান্তি ঘিরে ধরে আমায়। শূন্য শূন্য লাগে। অসহায় লাগে ভীষণ। ”
নীল তার হাতের আঙ্গুল দিয়ে আমার ঠোঁট দুটো চেপে ধরে বলল
“বিরহের বীণা শুনতে মোটেও ভালো লাগছে না। আপনাকে অবলোকন করতে ভীষণ ভালো লাগছে। অনেক সুন্দর লাগছে৷ চোখের কাজল আমার অনেক প্রিয়। কালো চোখ আমার পছন্দ হলেও আপনার চোখগুলো আমার পছন্দের বাইরে নয়। বরং নতুন করে আপনার চোখের নেশায় পড়ছি। নেশায় তলিয়ে গেলে ছেড়ে যাবেন না তো?”
“আপনাকে আমি তলিয়ে যেতে দিবই না। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে আপনাকে আগলে রাখব। এক অদ্ভুত সুতোয় আপনাকে আমি বেঁধে রাখব। সে সুতোর রন্ধে রন্ধে থাকবে মায়াময় টান। আর এ টানের একটা সুন্দরতম নাম হলো বিনি সুতোর টান। যে সুতোর এক প্রান্তে আপনি অন্য প্রান্তে আমি। যে প্রান্তেই যাই না কেন আপনাকে নিয়েই যাব। আপনাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। কথাটা আমার বলতে একটুও লজ্জা লাগছে না বরং গর্ব করে বলতে পারছি আপনাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আপনার ভালোবাসার মগ্নতায় সবসময় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চাই।”,
আরও কিছু বলতে যাব এর মধ্যেই মাজেদা খালার কণ্ঠসুর ভেসে আসলো। মাজেদা খালার এমন উপস্থিতিতে দুজনেই একটু বিভ্রত হলাম। লজ্জাও পেলাম। এত কাছাকাছি অবস্থায় তিনি দেখেছেন এখন কী মনে করেন কে জানে। মাজেদা খালাও দুটানায় পড়ে গেল কী করবে। পরিস্থিতি এখন থমথমে। মাজেদা খালা চুপ হয়ে হয়ে স্থান পরিত্যাগ করতে নিলেন। নীল পিছু ডেকে বললেন
” খালা কিছু বলবেন? এসেছিলেন কী জন্য?”
মাজেদা খালা একটু স্থিত গলায় বলল
“বাবা ভুলে গেছি। কী জন্য এসেছিলাম মনে করতে পারছি না। আমার চোখে কেমন জানি সর্ষে ফুল ভাসতাছে। আমি কেন আসলাম আমার মাথায় ঢুকতাছে না বাবা। আমি গেলাম।”
কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন। আমিও বেশিক্ষণ আর সেখানে রইলাম না। নীলের রুম থেকে নিজের রুমে আসলাম। এসেই মায়ের সম্মুখীন হলাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
“কী ব্যাপার ঘটনা কি। সব খুলে বলো।”
“মা আমার লজ্জা লাগে। রোমান্টিক কাহিনি কী বলা যায় নাকি? আর রোমান্স কোথায় করতে পারলাম মাজেদা খালা এসে সব বিগড়ে দিল।”
“মাজেদা সবটা সময় ঝামেলা পাঁকায়। একে নিয়ে যে কোথায় যাই। তুমি আগে বলো কী রোমান্স করেছো।”
“ইশ লজ্জা লাগে না আপনার এসব জানতে চান। আমি আপনার ছেলের বউ। ছেলের বউয়ের কাছে এগুলো শুনতে চাচ্ছেন। আপনি আসলেই মা দিনকে দিন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছেন।”
মা হেসে বলল
“হুর মেয়ে আমি তোমার শ্বাশুড়ি না বন্ধবী। শুনো লজ্জা পেলে এখন বলতে হবে না পরে এসে আমি শুনব প্রস্তুতি নিয়ে রাখো। আর এখন গিয়ে মাজেদাকে শায়েস্তা করতে হবে।”
বলেই মা হনহন করে রুম থেকে বের হলেন। এদিকে আমি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে নীলকে ভাবতে লাগলাম। ভাবতে ভাবতে আচমকা ঘুমিয়েও গেলাম। ঘুম ভাঙলো নীলের কণ্ঠসুরে। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে নীলকে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলাম।
কারণ-
চলবে?