#বিনি সুতোর টান,পর্ব-২২
#শারমিন আঁচল নিপা
কারণ নীল ঠিক আমার পাশে বসে আছে। আমার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। আমি কিছুটা স্তম্ভিত সুরে উনাকে বললাম
“কী দেখছেন?”
তিনি মৃদু গলায় জবাব দিলেন
“ঘুমন্ত মানুষগুলো দেখতে বড্ড সুন্দর হয়। অনুমতি ছাড়া রুমে প্রবেশ করার জন্য মাফ চেয়ে নিচ্ছি। তবে আপনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছিল তাই চলে এসেছি। এসে লক্ষ্য করলাম ঘুমুচ্ছেন। তাই আর ডাকেনি আপনাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর বুঝতে পারলাম এ মোহনীয়তায় আমি ডুবে যাব। আর ডুবে গেলে তটে উঠতে পারব না। তাই হালকা আওয়াজ তুলে ডাকলাম। ”
নীলের কথাটা শুনে আমি একদম চুপ হয়ে গেলাম। আবেগের মাতাল নেশায় ডুবে গেলাম। চোখ দুটো রঙিন স্বপ্ন বুননে ব্যস্ত। আমি নীলের দিকে তাকালাম। লাজুক দুটো চোখ যেন আমার সমস্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। মনের অজান্তেই বলে উঠলাম
“আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”
প্রতি উত্তরে নীল বলে উঠল
“ভালোবাসা বিষয়টা এতবার উপস্থাপন করতে হয় না। মুখে এত বলে ভালোবাসা প্রকাশ করা যায় না। আপনার কাজেই আমি বুঝতে পারব আপনি আমায় কত ভালোবাসেন। আচ্ছা আমি কী আপনার হাতটা ধরতে পারি।”
নীলের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম আমি। চোখ বন্ধ করে বললাম
“ধরুন।”
নীল আমার হাতটা ধরে একটা নীল সুতো পরিয়ে দিল৷ আমি কিছুটা অবাক হয়ে নীলের দিকে তাকালাম। সে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন
“এ সুতোটা আমি খুব যত্ন করে রেখেছিলাম মিহির জন্য। কারণ এ সুতোটা সাধারণ কোনো সুতো না। আমার ইচ্ছা ছিল মিহিকে বিয়েতে একটা ইউনিক কিছু গিফট করব। আর সে ভাবনা থেকেই নীল রেশমি সুতোয় স্বর্ণের আস্তরণ দিয়ে সুতোটা বানিয়েছিলাম ওর হাতে বেঁধে দেওয়ার জন্য। মিহি আমার জীবনে নেই। মিহির পর কাউকে নিয়ে চিন্তাও করতে পারেনি। কিন্তু আপনার প্রতি আমার অদ্ভুত একটা টান কাজ করছে। আমি জানি না এ টানের শেষ অধ্যায় কী। মাও অনেক পছন্দ করে ফেলেছে সেটা অনুধাবন করতে পারছি। সবকিছু বিবেচনা করে আমি আপনাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রথমে ভেবেছিলাম সময় নিব এখন মনে হচ্ছে আপনাকে আমার মনের কথাটা বলা দরকার। আমার মনের আবেগটা বুঝানো দরকার। আগে আপনার পা টা ঠিক হোক। তারপর মা আর বাবা আপনার বাবার সাথে কথা বলবে। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে তিনি যদি আমার মতো বুড়োর সাথে আপনার বিয়ে দিতে না চায় তখন তো বিষয়টা জটিল হয়ে যাবে।”
আমি মুচকি হেসে চিল মুডে নীলকে জবাব দিলাম
“মে হো না। আমি আছি কী করতে? আমি বাবাকে ম্যানেজ করব। আর সুতোটা কেন দিয়েছেন বললেন না এখনও পরিষ্কার করে।”
“আপনার বিষয়টা নিয়ে আমি একটা সুন্দর চিন্তা করেছি তাই সুতোটা আপনাকে দিয়ে আমাদের যুগলবন্দি হওয়ার একটা স্মৃতিচিন্হের প্রতীক দাঁড় করালাম। কখনও যদি আমি হারিয়ে যাই এটা যেন মনে করিয়ে দেয় আপনার জীবনে নীল নামক কেউ ছিল। এ সুতোটায় গাঁথা টান যেন আপনাকে আমার কাছে নিয়ে আসে। আপনার কথায় যাকে বলে বিনি সুতোর টান।”
নীল কথাটা বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সে তাকানোতে আবারও ব্যাগরা দিল মাজেদা খালার গলা। খালা এত জোরে জোরে কথা বলছে যেন মনে হচ্ছে ছোটখাট একটা ভূমিকম্প হচ্ছে। নীল আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে বসলো। মাজেদা খালার কথা কানে আসতেছে। খালা চিল্লানি দিয়ে মাকে নালিশ করতেছে
“জানেন আফা আমার বুইড়াডা আজকে কী করছে। আমি এত কষ্ট কইরা টাকা জমাইছি আর সে টাকা রাখছিলাম টিনের কৌটার ভিতর। বুউড়া সে টাকা নিয়া বাজি ধইরা হাইরা আইছে৷ এই বুইড়া আমার হাড় মাংসা জ্বালাইয়া খাইতাছে।”
মা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলতে লাগলেন
“তোর মতিগতি বুঝি না বাপু। এই বলিস তোর স্বামী তোকে ভালোবাসে আবার এই এসে নালিশ করিস। সমস্যাটা কী? ”
মাজেদা খালার কণ্ঠ একটু মৃদু হয়ে গেল। তিনি উত্তর দিলেন
“আরে আফা ভালো তো বাসেই। বুইড়া কত বড়ো আমার। আমারে তো একদম ছোট বাচ্চাগো মতো ভালোবাসে। এই যে এত বছর হইলো বাচ্চা অয় না একটা দিনও আমারে কিছু কয় নাই। কত কইলাম আরেকটা বিয়া করেন তাও করে না। ভালো তো বাসেই তবে বুইড়ার বিমরতি ধরে মাঝে মাঝে।”
মা এবার মাজেদা খালার কথা শুনে বিরক্তি টেনে বললেন
“হয়ছে এবার কাজ কর। তোর কথা শুরু হলে আর থামতে চায় না। ”
মাজেদা খালার কথা শুনে নীল খলখল করে হাসতে লাগল। এ প্রথম আমি নীলকে এভাবে হাসতে দেখেছি। আমি উনার হাসি দেখে কপাল কুঁচকে বললাম
“কী ব্যাপার হাসতেছেন কেন?”
“আরে আমাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পারছি। ভবিষ্যৎ এ মাজেদা খালার মতো আপনিও মাকে আমার ব্যাপারে নালিশ করতে গেলে আমাকে বুইড়া বলে সম্বোধন করবেন। ঐ বিষয়টা চিন্তা করে হাসি পাচ্ছে।”
নীলের কথা শুনে আমি বেশ লজ্জা পেলাম। লজ্জা মাখা গলায় বললাম
“আমি আপনাকে কখনও বুইড়া বলব না। বললে চ্যাংড়া বলব।”
নীল কিছুটা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল
“চ্যাংড়া আবার কেমন শব্দ?”
“চ্যাংড়া মানে জোয়ান,তাগড়া যুবক। আপনি আমার চোখে ঐরকম কিছুই। তা চ্যাংড়া মহাশয় আপনি আমায় ভালোবাসেন তো?”
“আমি মুখে বলা পছন্দ করি না। আমার কাজেই সব বুঝতে পারবে ভালোবাসি কি’না। এবার আমি উঠলাম কাজ আছে। একটু স্টাডি করত হবে।”
“এখন আবার কিসের স্টাডি? আপনি একটু বসেন না।”
“যে পেশায় আছি সবসময় স্টাডি করতে হয়। আপনার মতো ফাঁকিবাজ তো না। শুয়ে বিশ্রাম নিন। আর আপনার বাবা বোন এসেছিল, ঘুমুচ্ছিলেন তাই ডাকেনি। আপনার জন্য আপনার পছন্দের লাড্ডু নিয়ে এসেছে। ”
লড্ডুর কথা শুনতেই আমি এক লাফে উঠতে নিলাম খুশিতে। নীল আমার বাহু দুটো শক্ত করে ধরে বলে উঠল
“নিজেকে একটু সামলান। পা টা ভাঙার পরও শান্তি হয়নি। ডাক্তার এত নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছে। যেভাবে উঠছিলেন মনে হচ্ছে আপনার পায়ে কিছুই হয়নি। এত লাফিয়ে উঠার কিছু হয়নি। মাজেদা খালাকে দিয়ে লাড্ডু পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”
কথাটা বলেই নীল আমার বাহু দুটো ছেড়ে রুম থেকে বের হলো। আমি হাতের সুতোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। নীল সুতোটা হাতে বেশ সুন্দর লাগছে। সুতোর দিকে তাকিয়ে লাড্ডুর কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। মা হাতে লাড্ডু নিয়ে এসে বললেন
“কী রে মা লাড্ডু খাওয়ার জন্য নাকি অস্থির হয়ে গেছো। নীল বলল লাড্ডু দিয়ে যেতে। ছেলেটাকে অনেকদিন পর ফুরফুরা লাগছে। তা কী কথা হলো শুনি।”
আমি লজ্জায় মাথা অবনত করে ফেললাম। লাজুক গলায় বললাম
“আপনি একটু বেশিই দুষ্ট সব কথা কী বলা যায় নাকি৷ ”
“আমি কী তোমার শ্বাশুড়ি নাকি আমি তোমার বান্ধবী। বলো এবার কী করেছে আমার ছেলে।”
“কী আর করবে হাতটা ধরেছে।”
কথাটা শুনে মা আরও আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল
“হাতেই ধরেছে নাকি আরও কিছু দিয়েছে।”
আমি মায়ের কথার অর্থটা প্রথমে বুঝতে পারিনি। তাই উত্তরে বললাম
“হ্যাঁ দিয়েছে তো।”
মাও কম যায় না হুট করে বলে বসলো
“বিয়ের আগেই ঠোঁট ছুয়ে দিল।”
মায়ের কথা শুনে আমি মুখটাকে বাঁকিয়ে বললাম
“এই যে মহিলা আপনার ছেলে এত খারাপ নাকি বিয়ের আগে ঐসব কিছু দিবে। আমাকে একটা সুতো দিয়ে গেছে। আর বলে গেছে আমার পা ভালো হলে বিয়ের বিষয় নিয়ে কথা বলবে।”
মা আমার কথা শুনে মুখটাকে চুপসে বলল
“তোমার দ্বারা কিছুই হবে না। পানসে প্রেম করো। ”
“হয়েছে আর কিছু হওয়া লাগবে না। আপনি তো বেশ দুষ্টামি করেন। আমার লাড্ডু দিন আগে, লাড্ডু খাই। তারপর ঐসব দেওয়া নেওয়ার কথা ভাবা যাবে।”
মা আমার মুখে লাড্ডু গুজে দিয়ে বলল
“মন ভরে খাও। আমি গেলাম।”
কথাটা বলে মা চলে গেলেন। আমি লাড্ডু খাচ্ছি আর হাতের সুতোটা দেখছি। সবকিছুই আমার নিকট স্বপ্ন মনে হচ্ছে। যদি এটা স্বপ্ন হয় তাহলে যেন এ স্বপ্ন কখনও শেষ না হয় আর যদি এটা বাস্তব হয় তাহলে যেন সবকিছু এমন সুন্দর থাকে।
সময়ের পথ চলছে আপন গতিতে। নীলের সাথে আমার কথোপকথন সক্ষতা, ভালোবাসার মিলবন্ধন বেশ এগুচ্ছে। দেখতে দেখতে কিছুদিন পারও হয়ে গেল। পায়ের প্লাস্টার আরও কিছুদিন পর খোলা হবে।
সেদিন বিকেলে বসে আমি চা আর বিস্কুট খাচ্ছিলাম। নীল তখন অফিসে। মা রান্না ঘরে, বাবা বাইরে গেছেন। নিরা হুট করেই আমার রুমে এসে হাঁপাতে লাগল। আমি জিজ্ঞেস করলাম
“কী হয়েছে।”
নিরা আমার কথা শুনে আচমকা কেঁদে দিল। কিছু বুঝে উঠার আগেই মনে হলো কোনো অঘটন ঘটে গেছে।
চলবে?