#বিনি সুতোর টান,পর্ব-২,৩
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২
কী বলব বুঝে উঠার আগেই ম্যাজিস্ট্রেড সাহেবের কাজ দেখে হতবাক হতভম্ব হয়ে গেলাম। তিনি আমার দিকে তেড়ে আসলেন৷ আমার বাহুডোর আচমকা চেপে ধরে আমাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন
“ফুলটা নষ্ট করলেন কেন? কী সমস্যা আপনার? মাথার কী তার সবগুলো ছুটে গেছে? একটার পর একটা অকাজ করে যাচ্ছেন। জানেন না বাগানের একটু ক্ষতি হলে আমার মাথায় আগুন চড়ে যায়। এ ছাদে অন্য ভাড়াটিয়াদের উঠার অনুমতি নেই। আপনি বাবার বন্ধুর মেয়ে বলেই উঠার সুযোগ পেয়েছেন। উঠেছেন ভালো কথা ফুল কেন ছিড়লেন? বার বার নিষেধ করার পরও ফুল কেন ধরলেন? চুপ করে আছেন কেন? কথা কি কানে যাচ্ছে না? জবাব দিন”
উনার রাগের উদ্দীপ্ত তড়কদশা দেখে আমার দিল কাঁপতে লাগল। বুক ধুকধুক করতে লাগল। মনে হতে লাগল আমার শরীরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ধুকধুকানির শব্দ বেশ জোরালোভাবে শুনা যাচ্ছিল। কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দিলাম
“আপনি শান্ত হোন। আর আমাকে ছাড়ুন। একজন ছেলে হয়ে একটা মেয়ের উপর এভাবে হামলে কেন পড়েছেন? মানলাম ফুলটা ছেড়া উচিত হয়নি। তবে আমি ইচ্ছা করে এ অকাজ করিনি৷ হাতে কাঁটা ফুড়ে এমনটা হয়েছে। আগে করে যাওয়া সকল ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত। আপনি শুধু শুধু আমার উপর রেগে যাচ্ছেন। এমনভাবে বাহুডোর চেপে ধরেছেন ব্যথা লাগছে। জিম করেন নাকি বুঝতে পারছি না। হয়তো জিম করেন তাই শরীরে এত শক্তির উপক্রমবিকাশ ঘটেছে।”
কথাটা বলে একটু জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। কথাগুলো বলতে গিয়েও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। তিনি হাতটা ছেড়ে তেমন কোনো কথা না বলে স্থান ত্যাগ করলেন। আমি উনার পেছনের দিকে তাকিয়ে গতিবেগ নির্ণয় করতে ব্যস্ত। নিজের দুহাত দিয়ে বিপরীত দুহাতের বাহু দুটো ধরে হালকা মালিশ করে মন থেকে বলতে লাগলাম আলহামদুলিল্লাহ যমদূতের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। যেভাবে হাতে ধরেছিল মনে হচ্ছিল আমার গলাটায় চেপে ধরেছে। তবে ফুলটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা মোটেও ঠিক হয়নি। এমন কাজ করার আগে ভাবা উচিত ছিল। তবে করার পর ভাবাটাও উচিত হচ্ছে না। কিন্তু গেলেন কোথায় তিনি? আবার কী ছাদে ফিরে আসবেন? আরেকটু কী আপেক্ষা করব? রাগ করলেও কেন জানি না উনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। এটা কী তবে আমার বোকা আবেগ। এ আবেগে পাত্তা দেওয়া কী ঠিক হবে? বাবার বন্ধুর ছেলে বিষয়টা উনার মুখ থেকে আবিষ্কার করেছি কেবল। আনমনে ভাবতে লাগলাম অনেককিছু। সূর্যটা ততক্ষণে আরও হেলে পড়েছে। ছাদের একপাশে রাখা দোলনায় গিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক কল্পনার সমাবেশ ঘটাচ্ছিলাম। মানুষ কল্পনাতে বেশ সুখী। সে তার জীবনের সকল সুখের অধ্যায় কল্পনাতে বিচরণ ঘটায়। আমিও তার ব্যতিক্রম না। নিজের অজান্তে উনাকে নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। উনার চোখ, উনার চাহনি,উনার কথা বলার ধরণ সবকিছুই কল্পনাতে রপ্ত করতে লাগলাম। যতই গম্ভীর হোক না কেন লোকটাকে বেশ ভালো লাগে আমার। এ ভালোলাগা যেন আরও বেড়ে চলছে লোকটার পারস্পরিক সংস্পর্শতায়।
তিনি আবার ছাদে আসলেন। আমার দিকে একটা টব আর মাটির বস্তা এগিয়ে দিয়ে বললেন
“বসে বসে টবের মাটি প্রস্তুত করুন।”
আমি কিছুটা বিস্মিত উনার কথা শুনে। হুট করে মাটি প্রস্তুতের কথা কেন বলছেন? আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
“আমি এসব পারি না। ”
“আপনাকে পারতেই হবে। ফুল ছিঁড়ার মতো অন্যায় করেছেন শাস্তি তো পেতেই হবে। এখনই একটা ফুলের গাছ রোপণ করবেন। তাহলে বুঝতে পারবেন শখের জিনিসের মূল্য কত বেশি।”
“আমি এসব পারব না। আমার এসব করে অভ্যাস নেই।”
“আপনি কি চান আমি সরাসরি আপনার বাবার কাছে নালিশ করি। আপনি যা করেছেন সেটা বলার পর আপনার অবস্থা কী হবে আপনি বুঝতে পারছেন তো? এখন আপনার ইচ্ছা আপনি কী করবেন।”
বুঝতে পারছিলাম তিনি আমাকে বেশ থ্রেট দিচ্ছেন। তবে আমি একটু চুপচাপ হয়ে কথার উত্তর দিলাম
“আমি যদি ছাদ থেকে চলে যেতাম আপনি কীভাবে আমাকে দিয়ে কাজ করাতেন। ছাদে বসে ছিলাম বলেই তো এত জুলুম করতে পারছেন।”
তিনি এবার হালকা হাসলেন। উনার হাসি এবার আমার চক্ষুগোচর হলো। হাসিটা বেশ স্নিগ্ধ। হয়তো যার প্রতি অনেক ভালো লাগা কাজ করে তার সবকিছুই ভালো লাগে। তাই হয়তো উনার হাসিটা আমার মনে এতটা নড়া দিচ্ছে। তিনি কিছুক্ষণ হেসে জবাব দিয়ে বললেন
“জীবনে অনেক আসামি দেখেছি। আসামিদের কীভাবে কপোকাত করতে হয় আমার বেশ ভালোই জানা।”
“আপনার কথার মানে বুঝতে পারছি না। ”
“আপনি কী ভেবেছিলেন আমি ছাদের দরজা খুলে গিয়েছিলাম। আমি তো ছাদের দরজা লক করে স্টোর রুমে গিয়েছিলাম। আপনার শাস্তি এখন টবে মাটি প্রস্তুত করা। সুতরাং কাজে নেমে পড়ুন। ”
আমি অসহায় চিত্তে তার দিকে তাকালাম। বুকের ভেতরটা হাহকার করছে। আমাকে এখন এ গোবর মিশানো মাটি ধরতে হবে। আমি মুখটা বাঁকা করে বললাম
“আজকের মতো ক্ষমা করে দিলে হয় না।”
“নাহ”
অগত্যা কোনো সুযোগ না পেয়ে মাটিগুলো বস্তা থেকে বের করে টবে দিতে লাগলাম। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। আমি শুধু লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে কাজ করতে লাগলাম। একটা সময় টবটা প্রস্তুত হয়ে গেল। এবার তিনি একটা গাছ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
“এটা রোপণ করুন। গাছপালা হচ্ছো পরিবেশের প্রাণ। আপনি তাদের যত ভালোবাসবেন তারা আপনাকে তত স্বস্তি দিবে। কখনও নমনীয় কোনো জিনিস স্পর্শ করবেন না এতে করে সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে।”
আমি গাছটা হাতে নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার বাঁকা ঠোঁটের নড়াচড়া অনুভব করছিলাম। ভালোলাগার মানুষের সব কিছুই ভালো লাগে। তার ভালো দিকও ভালো লাগবে তার খারাপ দিকও ভালো লাগবে। তিনি কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে মুখটাকে বাকিয়ে বলল
“গাছটা হাতে নিয়ে হা করে কী দেখছেন? আপনাকে বললাম গাছটা রোপণ করতে আর আপনি কি’না হাতে নিয়ে বসে আছেন। ”
উনার কথা শুনে আমি যেন সম্ভিত ফিরে পেলাম। হালকা গলায় জবাব দিলাম
“জি লাগাচ্ছি।”
বলেই গাছটা লাগাতে নিলাম। তিনি তখন আমার হাতটা ধরে আস্তে গলায় বলল
“গাছটা লাগানোর সময় এভাবে লাগাতে হয়। নাহয় গাছ ভালো হয় না। আপনার তো দেখি এসব ব্যপারে কোনো আইডিয়া নেই।”
“আইডিয়া থাকবে কী করে আমি তো কখনও ঐভাবে গাছ লাগাইনি। যাইহোক গাছ লাগানো তো শেষ হলো এবার আমার হাতটা ছাড়ুন। এ গোবর লোপ্টে যাওয়া হাত ধুইতে হবে। খুব অস্বস্থি হচ্ছে।”
তিনি আমার কথা শুনে আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। আমি ছাদের কোণে ট্যাপটা ছেড়ে দিয়ে হাত দুটো ভালো করে ধুয়ে নিলাম। তিনি ততক্ষণে গাছটার টব এক কোণে রেখে ছাদের অন্য পাশের ট্যাপটা ছেড়ে হাত দুটো ধুয়ে নিলেন।
এ সময় বাইরে থেকে আযানের ধ্বনি আসলো কানে। আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে হালকা ডেকে বললাম
“আযান পড়েছে আমার শাস্তি শেষ হলে বলুন। বাসায় যাব। ”
” আপনি বাসায় যেতে পারেন। আপাতত অনেক অপরাধের শাস্তি থাকা সত্ত্বেও মওকুফ করা হলো।”
আমি উনার কথা শুনে দৌঁড়ে বাসায় যেতে নিলাম। উনি আমার পিছু ডেকে বললেন
” এই যে একটু শুনে যান।”
আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে সুমিষ্ট সুরে বললাম
“বলুন কী বলবেন?”
“আজান পড়ছে মাথায় ঘোমটা দিয়ে যান। আজান পরলে মাথায় ঘোমটা ছাড়া থাকতে হয় না। আমার মা আমাকে সবসময় এরকম বলেন।”
উনার কথাটা শুনে বুকের ভেতরটায় যেন এক অদ্ভুত অনুভূতির সঞ্চার হলো। অনুভূতির বিকাশটা না ঘটিয়েই নিজেকে একটু সংযত করে মাথায় উড়না দিয়ে ঘুমটা টেনে উনার দিকে তাকালাম। উনি আমার সামনে আসলেন। আমার একদম কাছে। আমার সন্নিকটে এসে হালকা সুরে কিছু বলার আগেই ঘটে গেল বিপত্তি।
চলবে?
#বিনি সুতোর টান
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩
আমার সন্নিকটে এসে হালকা সুরে কিছু বলার আগেই ঘটে গেল বিপত্তি। আমার ছোটো বোন এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল
“কী ব্যাপার আপু তুমি মাথায় ঘোমটা দিয়ে কী বিড়বিড় করছো। তোমাকে বাবা খুঁজছে আর তুমি এখানে সে কখন এসেছো এখনও বাসায় যাচ্ছ না। বাবা দ্রূত যেতে বলেছে।”
আমি নিরার কথা শুনে চুপসে গেলাম। পাশ ফিরে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম উনি এখনও গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত। তাহলে এতক্ষণ আমার সাথে যা ঘটেছিল তা কেবল আমার কল্পনা৷ আমি নিজের অবস্থান দেখেই নিজেই লজ্জা পাচ্ছিলাম। কতটা আবেগের সাগরে হাবুডুবু খেলে এ বয়সে এসে এমন মসিবতে পড়ি। এবার উনি কাছে এসে বললেন
“চলুন বাসায় যাওয়া যাক। ছাদে তালা দিয়ে যাব এখন। নাহয় রাতে চুর ছাদ দিয়ে এসে বাসায় উঠবে। ”
আমি কোনো কথা না বলে বোকার মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছি। ভাবতে লাগলাম এটাও কী আমার কল্পবার বিচরণ নাকি বাস্তবতা। কল্পনা এবং বাস্তবতার ফারাক বুঝার চেষ্টা করলাম। উনিও আমার ভাবগতি দেখে বুঝতেছিল না কী বলবে। নিরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল
“আপু এভাবে বোকার মতো তাকিয়ে আছো কেন? বাসায় যাবে না? ভাইয়া ছাদের তালা দিবেন এখন। চলো তো তুমি। কী হয়েছে হুট করে নড়তেছোও না।”
নিরার কথা শুনে নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রূত স্থান পরিত্যাগ করতে গিয়েছিলাম। আর সেটার ফলশ্রূতিতে পা ফসকে ছাদ থেকে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ি। হিরোর সামনে সিনেমায় কত রোমান্টিক ঘটনা ঘটে আর আমার সাথে এটা কী ঘটল সেটাই ভাবছি কেবল। নীচে পড়ে সং এর মতো বসে আছি। কোনো কথা বলছি না। আর তিনিও বাংলা সিনেমার হিরোর মতো আমাকে ধরতে আসলেন না। যথারীতি নিজের কাজটা শেষ করে ছাদের দরজাটায় তালা লাগিয়ে তারপর আমার কাছে এসে বললেন
“একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন তো? সাবধানে চললে তো এমনভাবে পড়তেন না। উঠতে পারবেন নাকি ধরতে হবে?”
আমি তখনও চুপ কোনো কথায় বলছি না। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া কর্মগুলোর কী নাম দিব বুঝতে পারছি না। আর আমার সাথেই কেন বারবার এমন হয় বুঝতে পারছি না।
উঠার চেষ্টা করেও উঠতে পারছি না। নিরা কিছু বলছে না। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। আমি বার কয়েক উঠার চেষ্টা করলাম। কোনোভাবে উঠতে পারলাম না। অবশেষে তিনি হাতটা বাড়িয়ে আমার হাত দুটো ধরে তুললেন। উঠার পর বুঝতে পারলাম আমার পা টা মচকে গিয়েছে। তাই পড়ে নিতে লাগলাম। তিনি আমাকে সাথে সাথে ধরে নিলেন। পাশে থাকা নিরাকে বলল আমার অপর দিক ধরতে। নিরাও উনার কথা মতো কাজ করল। দুজন আমাকে ধরে নীচে নামাল। তিনি আমাকে নিয়ে বাসায় ঢুকলেন। বাবা উনাকে আমাকে নিয়ে এভাবে ঢুকতে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে বললেন
“নীল কোনো সমস্যা হয়েছে কী? আঁচলের কী হলো?”
এতক্ষণে উনার নামটা আমার জানা হলো। উনার নাম নীল। ভালোই মিলে গেল তো দুজনের নাম। নীল+আঁচল =নীলাচল। আমাদের গল্পের নাম হয়ে যাক নীল আঁচল। তিনি হালকা গলায় বললেন
“আংকেল তেমন কিছু না। এত উদ্বিগ্ন হবেন না। আপনি একটু তেল গরম করে ওর পায়ে মালিশ করে দিন। সিঁড়ি দিয়ে পড়ে পা একটু মচকে গিয়েছে কেবল। তেমন কিছুই হবে না। কয়েকদিন বিশ্রাম করলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
কথাটা বলেই আমাকে সোফাতে বসালেন তিনি। বাবা হন্তদন্ত হয়ে উনাকে বললেন
“নীল বাবা তুমি বসো। আমি চা করে নিয়ে আসি আর তেল গরম করেও।”
“আংকেল এমন কিছু করতে হবে না। নামাজের সময় হয়েছে আমি নামাজে যাব। আপনি ওর যত্ন নিন। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।”
কথাটা বলে বাবার কাছে বিদায় নিয়ে তিনি বাসা থেকে বের হলেন। বাবা ততক্ষণে তেল গরম করে আমার কাছে এসে বললেন
“একটু কী স্থিরতা নাই তোর? ছাদে গিয়ে কী এমন করেছিলে যে পা মচকাতে হলো। দেখেশুনে চলাফেরা করবি তো। অনার্সে পড়িস এখনও বাচ্চামি গেল না। মন চায় ঠাটিয়ে চড় মারি। তোর মা বেঁচে থাকলে কী পরিমাণ মার তুই খেতি আল্লাহ জানে। আমি কিছু করি না তো তাই আস্কারা পেয়ে গেছিস বেশি।”
আমি গালটা ফুলিয়ে বাবার কথা শ্রবণ করছিলাম। বাবার বকাগুলো আমার মাথায় ঢুকতেছিল না। কারণ মাথায় কেবল নীল সাহেবের চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। বাবা পা টা মালিশ করে আমাকে রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল।
আমি শুয়ে শুয়ে কেবল উনার চোখের চাহনির কল্পনায় বিভোর। এ কল্পনার শেষ যোগসূত্র কোন জায়গায় আমার জানা নেই। উনাকে নিয়ে ভাবতে বেশ ভালোই লাগছে। ভাবনার আকাশে এখন রঙিন ঘুড়ি উড়ছে। ভাবনার অতল সাগরে ডুবে যখন গিয়েছিলাম ঠিক তখনই মাজেদা খালার কর্কশ কণ্ঠ কানে ধেয়ে আসলো। তিনি বেশ জোরালো কণ্ঠে বলে উঠলেন
” ও মায়া গো। আমার আঁচল মায়ার একি হলো!”
বলেই আহাজারি। উনার এই এক দোষ। যতটা না ঘটবে তার চেয়ে বেশি রিয়েক্ট করবেন। উনি যেভাবে কাঁদছেন মনে হচ্ছে আমি মারা গিয়েছি। আর আমার মৃত লাশটা পড়ে আছে বিছানায়। উনার আহাজারির শব্দ ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগল। একটা সময় বিরক্ত হয়ে বললাম
“থামেন তো মাজেদা খালা। আমি কী মারা গিয়েছি নাকি এভাবে কাঁদতেছেন কেন?”
“ওমাগো তোমার এ অবস্থায় আমি নিজেরে সামলামু কেমনে। কী কও আমি কানমু না তয় কে কানব। তুমিও না খালা আবেগের মূল্য দাও না। বাদ দাও মায়া। কী খাবা বলো।”
“খালা দয়াকরে কিছু রান্না করে খাওয়াতে যাবেন না। বাবায় রান্না করে রাখবেন। আর এ অসময়ে আপনি এসেছেন। সারাদিন কোথায় ছিলেন? ”
এবার খালা লজ্জায় যেন লাল হয়ে যেতে লাগল। বেশ লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে বলল
“তোমার খালুর সাথে ঘুরছিলাম একটু। আজকে তো আমাদের ইমাজের ডে। ”
আমি খালার দিকে চোখ কপালে তুলে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে বললাম
“ইমাজের ডে মানে?”
“ইমাজের ডে মানে বুঝেন না খালা। আপনি না শিক্ষিত মাইয়া। যদিও অনেক শিক্ষিত মানুষ ও তেমন ইংজেরি পারে না। ইমাজের ডে মানে আমাগো বিয়ের বছর। এই দিন আমাগো বিয়ে হয়ছিল।”
খালার কথা শুনে আমি হাসব নাকি স্তব্ধ হয়ে থাকব বুঝতে পারছিলাম না। এতক্ষণ তিনি ম্যারেজ ডে কে ইমাজের ডে বলছিলেন। হায়রে মানুষের কত কথা। আর বলা হচ্ছে আমি ইংরেজি পারি না। আমি খালার কথাটা টেনে নিয়ে বললাম
“সত্যিই খালা আপনার মতো ইংজেরি এখনও শিখতে পারি নাই। এখন বাসার কাজ গুলো করেন। আর কথা বাড়ায়েন না। আপনি তো কথার একটু স্রোত পেলেই জলোচ্ছাস বইয়ে দেন।”
আমার কথাটা বোধহয় খালার পছন্দ হয়নি। আর কিছুক্ষণ বকবক করলে হয়তো উনার ভালো লাগত। তিনি মুখটা গুমরা করে ঘর থেকে বের হলেন। উনি বের হওয়ার মিনেট পাঁচেক পর মনে হচ্ছিল দরজায় কেউ কড়া নেড়ে বলছে
“ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যাবে?”
আমি বিরক্ত গলায় বললাম
“কে আসতে চাচ্ছেন আসুন।”
ভেতরে প্রবেশ করলেন নীল সাহেব। সাথে একজন ভদ্রলোককে নিয়ে। তিনি আমার পশে এসে বসে বললেন
“আপনার জন্য ডাক্তার নিয়ে এসেছি। তখন মনে হচ্ছিল আপনার পায়ে অনেক ব্যথা পেয়েছেন। তাই নামাজ শেষ করে ডাক্তার নিয়ে আসলাম। আংকেলও বের হচ্ছিলেন ডাক্তার নিয়ে আসতে। ভালোই হলো এর আগে নিয়ে আসতে পেরেছি ডাক্তার। ”
আমি উনার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। মানুষটাকে দেখে মনে হয় না মানুষটার মনে এত মায়া। উনার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এবার উনিও আমার দিকে তাকালেন। দীর্ঘক্ষণ পলকহীন ভাবে উনাকে দেখতে লাগলাম। দেখার তরী ভাসিয়ে যখনই গভীরে যেতে নিলাম। ঠিক তখনই কারও তীব্র উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। বেশ রাগী চোখে পাশ ফিরে তাকিয়ে আরও কিছুটা বিস্মিত হলাম।
চলবে?