বিনি সুতোর টান,পর্ব-২৭

3
2374

#বিনি সুতোর টান,পর্ব-২৭
#শারমিন আঁচল নিপা

ভোর পেরিয়ে দিন পেরোলো। সন্ধ্যা আকাশে সূর্য ডুবে রাত্রির সূচণা হলো। দুনিয়াটা যেমন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে ঠিক তেমনি আমার স্বপ্নগুলোও অন্ধকারে তলিয়ে গেল৷ ঘরটা পুরো থমথমা। বাবা তেমন কথা বলছে না আমার সাথে। আজকে বাবা রান্নার সময়ও ডাকেনি। ডেকে বলেননি দেখ তো মা তরকারিতে সব ঠিক আছে কি’না। হয়তো বাবা আমার মুখোমুখি হতে চাচ্ছেন না তাই ডাকেননি। সারাদিন অনেক কসরত করেও খেতে পারলাম না। যা খেতে নিচ্ছি তাই যেন গলা দিয়ে উল্টে আসছে। চুপচাপ রুমে বসে আছি। হঠাৎ আওয়াজ আসলো কানে। পাশ ফিরে তাকালাম, লক্ষ্য করলাম নিরা ঘরে প্রবেশ করেছে। ড্রয়ার থেকে কিছু একটা নিয়ে হন্ত দন্ত হয়ে বের হতে নিল। আমি নিরার পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করলাম

“কোথাও যাচ্ছিস নাকি? এভাবে তাড়াহুড়ো করছিস যে।”

নিরা গায়ের উড়নাটা ঠিক করতে করতে জবাব দিল

“নীল ভাইয়ার কাছে যাচ্ছি। আমার জরুরি কথা আছে। ফোনে তো আর সব ব্যক্তিগত কথা বলা যায় না। তাই সামনাসামনি বলব।”

“নীলকে ভাইয়া ডাকছিস কেন? কিছুদিন পর বিয়ে উনার সাথে উনাকে ভাইয়া ডাকলে হবে পাগলি?”

নিরা কিছুটা হাসলো। তারপর জবাব দিল

“সময় মতো সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু সময় লাগবে। তুমি চিন্তা করো না। আমি বিষয়টা বুঝে নিব। আর তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি ছিলে বলেই এ অসাধ্য সাধন হয়েছে। তুমি যদি আজকে এমনটা না করতে তাহলে নীল ভাইয়া আমাকে নিয়ে ভাবত না। আর আমাকে নিয়ে না ভাবলে এত সুন্দর সমাধানও হত না। তাই তোমাকে আমি ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না৷ তুমি যা করেছো সত্যিই বড় বোনের মতো কাজ করেছো। তোমার মতো বোন যেন সবার ঘরে ঘরে হয়। আপু তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”

কথাটা বলেই নিরা আমাকে জড়িয়ে ধরল। নিরার খুশি দেখে একটু হলেও মনটা শান্ত লাগছে। তবে ভালোবাসার মানুষককে তুলে দেওয়ার কষ্টটা অনেকটা মন দ্বিখন্ডিত হয়ে যাওয়ার মতো। তবুও নিরার আনন্দ দেখে নিজেকে সামলে নিলাম। নিরাকে জড়িয়ে ধরে বললাম

“তুই খুশি তো?”

নিরা আমার গালে চুম্বন দিয়ে উত্তর দিল

“আমি অনেক খুশি। এবার গেলাম ওদের বাসায়। এসে কথা বলব। আমাদের কিছু কথা বাকি।”

“নীলেই তোকে যেতে বলেছে?”

“হ্যাঁ উনিই তো কল দিয়ে বলল আমার সাথে উনার জরুরি কথা আছে বিয়ে নিয়ে। উনি চায় আমাদের বিয়েটা আমার মন মতো হোক। আমি যেভাবে চাইব সেভাবে। এর মধ্যে উনি শপিং ও সেরে ফেলতে চায়। আপু শপিং করার সময় আমি কিন্তু তোমাকে সাথে নিয়ে যাব। তুমি না করবে না। তুমি আমার এত বড়ো উপকার করেছো আমি জীবনেও ভুলব না। আমার বিয়ের সব দায়িত্ব তোমার আজকে থেকে।”

নিরার কথাগুলো যত শুনছিলাম ততই আমার কলিজাটা ছাড়াখাড় হয়ে যাচ্ছিল। নিজেকে তবুও সামলে উত্তর দিলাম

“বড়ো বোন হয়ে যতটুকু দায়িত্ব পালন করা দরকার আমি করব। তুই যেখানে যাচ্ছিস যা।”

নিরা আর কথা বাড়াল না। হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল। নিরার খুশিতে শীতল লাগলেও নীলকে হারানোর যন্ত্রণায় আমার কলিজা কাঁপতে লাগল। আমি ঘরের দরজাটা লাগিয়ে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম। বুক চিড়ে যত কষ্ট সবটা কষ্ট যেন কান্না করে নামালাম।

অশান্ত মনটা নিয়ে বসে আছি। বারবার মনে হচ্ছে আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি তবে, তলিয়ে দেখে বুঝতে পারছি এটা বাস্তবতা। নিজেকে বেসামলা ছন্নছাড়া লাগছে। রাতটা কোনোভাবেই যেন পার হচ্ছে না। যতই রাত হচ্ছে ততই যেন ব্যথার তীব্রতা গুরতরও হচ্ছে। ব্যথাকাতুর যন্ত্রণা নিয়েই শুয়ে রইলাম।

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ পেলাম। দরজাটা খুলতেই বাবা আমার রুমে প্রবেশ করল। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর আমার পাশে এসে বসল। হালকা গলায় বলল

“তোকে কী আমি অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি মা?”

আমি নম্র গলায় উত্তর দিলাম

“কেন বাবা এমন বলছো কেন?”

“এই যে নীলের সাথে নিরার বিয়েতে মত দিয়েছি। আমার যে আর কোনো উপায় ছিল না মা।”

বাবা কথা গুলো বলে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। বাবার চোখের জল দেখে আমারও বেশ কাঁদতে মন চাইলো। তবুও কান্নাটাকে কোনোরকম আটকে দিয়ে উত্তর দিলাম

“আমি তোমাদের সিদ্ধান্তে খুশি। আমার ভাগ্যে যা ছিল হচ্ছে। এতে আমার কোনো অভিযোগ নেই।”

বাবা আমার কথা শুনে তেমন কোনো উত্তর দিলেন না। রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। বাবার মনেও যে এক ভয়ার্ত আশঙ্কা কাজ করছে বেশ ভালোই বুঝা যাচ্ছে।

এদিকে নিরাও চলে আসলো কিছুক্ষণের মধ্যে। বেশ হাসি খুশি লাগছে তাকে। আমার রুমে এসে হালকা গলায় বলল

“আপু বিয়ের তো আর বেশিদিন বাকি নেই। মাত্র তিনদিন। কালকে আমি আর নীল শপিং করতে যাব বিয়ের। তুমি কিন্তু আমাদের সাথে যাবে। তোমার পছন্দেই সব কিনব৷”

আমি স্তব্ধতা নিয়ে উত্তর দিলাম

“তোরা দুজনেই যা। আমি গেলে সেখানে বিষয়টা খারাপ দেখা যায়। আর নীল ও বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিবে না। আমার মনে হয় তোর আর নীলের পছন্দে শপিং করাটায় বেটার হবে। আমাকে নিলে বিষয়টা আরও গুবলেট হবে। ”

নিরা এবার আমার হাতটা চেপে ধরে বলল

“আপু নীলও চায় তুমিই আমাদের বিয়ের সব পছন্দ করে দাও। প্লিজ আপু না করো না। এজন্যই তো ও যেতে বলল আমাকে। বলল তুমি আমাদের জন্য এত করেছো তাই তোমার পছন্দেই আমাদের বিয়ের মার্কেট হবে। সে তো আরও বলেছে এখন ছোটোখাট করে বিয়েটা করলেও পরে বড়ো প্রোগ্রাম করবে। অনেক ধুমধাম করে বিয়েটা করবে। আপু আমার যে কি খুশি লাগছে না কী বলব! আপু তুমি খুশি না?”

আমি নরম গলায় উত্তর দিলাম

“আমিও খুশি।”

“যাইহোক আপু আমি আমার রুমে গিয়ে লিস্ট করি কী কী কিনব। আর তুমি ঘুমিয়ে পড়ো কালকে সকালে শপিং এ যাব তুমিও আমাদের সাথে যাবে। ”

কথাগুলো বেশ উৎফুল্লতার সাথে বলে নিরা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি নিজেকে সামলে নিলাম। কষ্ট হলেও সেটা বুঝতে দিলাম না কাউকে। রাতের গভীরতা যত বাড়ছে ততই আমার কষ্টের প্রখরতা বাড়ছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। মানুষের জীবন কখন কোনদিকে মোড় নেয় সত্যিই বলা যায় না। মানুষ চাইলেও তার ভাগ্যকে পাল্টাতে পারে না। নিজের ভেতরের যন্ত্রণাটা যেন জানান দিচ্ছে এ কষ্টের অধ্যায় কখনও শেষ হবে না। আধার ঘুচিয়ে আলো কখনও নামবে না। কখনও যন্ত্রণা কাঁতর এ অনুভূতি কেউ বুঝবে না। শুধু সয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

যন্ত্রণায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম মনে নেই। সকালটা শুরু হয় নিরার ডাকে। ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারলাম বেশ বেলা হয়ে গেছে। কখন যে ১১ টা বেজে গেল খেয়াল নেই। নিরা আমার হাত দুটো ধরে টেনে তুলে বলল

“আপু জলদি রেডি হও। নীল নীচে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিয়ের শপিং করার জন্য। আমাকে আর তোমাকে দ্রূত বের হতে বলল।”

আমি ঘুমের ঘোরে নিরার কথা শুনে আঁৎকে উঠলাম। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম নীলের সাথে নিরার বিয়ে আমার না। তাই বুকটা আবারও ছেদ করে উঠল। অনেকটা বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু বরাবর যেভাবে একটা রেখা এসে ছেদ করে ঠিক সেভাবে আমার মনের কেন্দ্রে যেন তলোয়ার এসে ছেদ করল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে তৈরী হলাম দ্রূত। নীচে নামতেই নীলের সম্মুখীন হলাম। নীলকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে। কালো সাদা চেক একটা শার্ট পরেছে। কালো প্যান্ট। হাতে ঘড়ি। চুলগুলো বেশ পরিপাটি করে আঁচরানো। চোখ যেন তার সৌন্দর্যেই আটকে গেল। কিন্তু বেশিক্ষণ তার দিকে চোখ আবদ্ধ রাখার সাহস পেলাম না। চোখটা নীচে নামিয়ে ফেললাম। এর মধ্যেই নীল বলে উঠল।

চলবে?

3 COMMENTS

  1. গল্পটা সত্যিই অসাধারণ
    বলে বোঝানো যাবে না এই গল্পটা পড়ে যে আমি কতবার কান্না করেছি
    আমার অনুরোধ একটাই হ্যাপি এন্ডিং যেনো হয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here