#বিনি সুতোর টান,পর্ব-২৮
#শারমিন আঁচল নিপা
এর মধ্যেই নীল বলে উঠল
“নিরা তুমি সামনের সিটে বসো আর আঁচলকে পেছনের সিটে বসতে দাও। আর কী কী কিনবে লিস্ট করেছো তো? পরে যেন কিছু বাকি না থাকে। যা লাগবে তোমার, সব কিনবে। তোমার খুশিতে আমার খুশি। বিয়ে তো আর বারবার করব না একবারেই করব। তোমার সব চাওয়া পূরণ করেই করব।”
নীলের কথাগুলো কানে আসতেই বুকে ব্যথা অনুভব হতে লাগল। নিজেকে সামলে নিতে চাইলেও পারছিলাম না। অসহনীয় যন্ত্রণা যেন গ্রাস করছে। আপনাআপনি চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সেদিকে নীল বা নিরার অবলোকন করার সময় নেই। গড়িয়ে পড়া জলটা উড়নার এক কোণ দিয়ে মুছে নিলাম। নিরা সামনের সিটে বসলো। নীল পেছনের সিট টা খুলে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ রসিক গলায় বলল
“আপনি তো এখন থেকে আমার বড়ো বোন। সম্পর্কে নিরার বড়ো মানে আমারও বড়ো। সে সূত্রে আপনাকে আপু ডাকা আমার দায়িত্ব। আপু আপনি পেছনে বসেন। ভালোই হয়েছে আপনি এসেছেন। বিয়ের শপিং এ একজন মুরব্বি থাকলে সবকিছু বুঝতে ভালো হয়। নিরা তো বাচ্চা মানুষ সব গুছিয়ে কিনতে পারবে না তাই ওকে বলেছিলাম আপনাকে নিয়ে আসতে। ”
নীলের কথা গুলো যতই শুনছিলাম ততই যন্ত্রণার পরিমাণটা বাড়তে লাগল। যন্ত্রণাটা কোনোরকম চাপা দিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে জবাব দিলাম
“আপনি চিন্তা করবেন না যতটা প্রয়োজন ততটা সাহায্য আমি করব। নিজের বোনের বিয়ে বলে কথা। বড়ো বোন হিসেবে আমাকেই তো সব দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
নীল আর কোনো কথা বাড়াল না। গাড়িতে উঠে গাড়িটা চালাতে লাগল। আমি নীলের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছি। লক্ষ্য করলাম নীল নিরার সাথে মৃদু সুরে কী যেন বলছে। কথাগুলো আমার কান অবধি আসতে আসতে মৃদু হয়ে যাচ্ছে। এবার নীল বেশ জোরে জোরে বলে উঠল
“নিরা তোমার তো আইসক্রিম পছন্দ। আগে কী আইসক্রিম খাবে নাকি সরাসরি শপিং এ যাবে। আইসক্রিম খেলে সামনে একটা আইসক্রিমের দোকান আছে সব ধরণের আইসক্রিম পাওয়া যায় সেখানে গাড়িটা থামাব।”
নীলের কথা শুনে নিরার দিকে তাকালাম। নিরার মুখ ভঙ্গি লক্ষ্য করতে লাগলাম। নিরা বেশ লাজুক গলায় উত্তর দিল
“এখন আইসক্রিম খাব না সরাসরি শপিং করব। বিয়ের অনেক কিছু কেনা বাকি।”
নীল নিরার কথায় মুচকি হাসলো। বুঝায় যাচ্ছে দুজন বেশ খুশি। তবে আমার এত খারাপ কেন লাগছে? আমার কেন বুকটা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে কেনই বা মনটা এলোমেলো হচ্ছে। অযাচিত ভাবনার মধ্যেই ডুবে গেলাম। নীলের সাথে কাটানো ভালো মুহুর্ত গুলো এখন চোখে ভাসছে। স্মৃতি গুলো বিষন্নতায় ছেয়ে গেলেও সেটা মুছে ফেলা বড়ই কঠিন। সৃষ্টিকর্তা যদি কোনো কিছু ভুলে যাওয়ার সুইচ বাটন দিতেন তাহলে হয়তো দুনিয়ায় প্রতিটা মানুষ সুখী হত।
গাড়িটা বেনারসি শাড়ির দোকানে থামল। নীল গাড়ি থেকে নেমে নিরার হাতটা ধরে নামিয়ে বলল
“তোমার যা পছন্দ কিনবে।”
নিরাও শুধু মাথা নেড়ে গেল। এবার নিরা আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল
“আপু চলো শাড়িটা আগে কিনি তারপর বাকি সব কিনব।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। গলায় বেশ একটা জড়তা চলে এসেছে। কথা বলতে গেলেই হয়তো গলাটা কান্নায় ভেঙে যাবে। আমি শুধু মাথা নেড়েই গেলাম।
তিনজনে শাড়ির দোকানে ঢুকলাম। নিরা একের পর এক শাড়ি দেখছে নীলও দেখছে। আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাদের অবলোকন করছি। আমার শূন্যস্থানটা নিরা কত সুন্দর করে পূরণ করে ফেলেছে সেটাই ভাবছি।
নিরা হুট করে ডেকে নীলের হাতে থাকা শাড়িটা দেখিয়ে বলল
“আপু শাড়িটা কেমন। আমি তোমার পছন্দে শাড়ি কিনব। একটু এসে পছন্দ করে দিয়ে যাও না। নীল ঠিক করে পছন্দ করতে পারছে না।”
আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। শাড়িটা আমি পছন্দ করে দিতে না চাইলেও নিরা বায়না ধরে বসবে আমিই যেন পছন্দ করে দিই। এতে করে আরও বিপত্তিও বাড়বে, সময়ও নষ্ট হবে, নাটকের ও উৎপত্তি হবে। তাই সবকিছু এড়াতে গিয়ে আমি নিজেই একটু এগিয়ে নীলের কাছে গেলাম। কয়েকটা শাড়ি ঘেটে লাল বেনারসি বের করে নিরার হাতে দিয়ে বললাম
“এটা তোকে অনেক মানাবে।”
নিরা শাড়িটা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বলল
“আপু এটা তোমার জন্য নিয়ে নাও। আমার বিয়েতে তুমি বেমারসি পড়বে এটা আমার ইচ্ছা। আমার কাছে ঐ গোলাপি বেনারসিটা বেশ ভালো লাগছে। আমার জন্য আমি ঐটা নিচ্ছি।”
কথাটা বলেই নিরা নীলকে বলল দুটো শাড়ি যেন কিনে দেয়। নিরার কথা নীল ফেলতে পারল না। দুটো শাড়িই কেনা হলো। একটা আমার জন্য একটা নীলের জন্য। হাস্যকর লাগছে খুব,ছন্নছাড়াও লাগছে। বেনারসি কেনা হলেও প্রিয় মানুষটা আমার হবে না। ভাগ্য বড়ই নির্মম। তবুও চিন্তা করলাম নীল আর নিরার বিয়েতে আমি মন ভরে সাজব। বেনারসি পরেই সাজব। অনেক চিন্তায় মনে বুনন করে যাচ্ছি আর শপিং কমপ্লেক্সে হেঁটে যাচ্ছি। এটা সেটা অনেক কিছুই কিনছি কিন্তু কিছুতেই আমার মন নেই। আমার মন পড়ে আছে অজানা এক মন খারাপের দেশে। ভীষণ একা লাগছে নিজেকে। রিক্ততা যেন ঘিরে ধরেছে সারা শরীরে। অনেকটা সময় কেটে গেছে। দিন পেরিয়ে রাতও নেমে গেল। শপিং শেষ হলো সবে। বাসায় আসার জন্য রওনা দিলাম। সারাদিন খাওয়া দাওয়া করার সময়ও মেলে নি। নীল গাড়িতে বসে নিরাকে জিজ্ঞেস করল কিছু খাবে কি’না। নিরা মৃদু গলায় উত্তর দিল তার খুব চাউমিন খেতে মন চাচ্ছে। নীল আর কথা বাড়াল না গাড়িটা উল্টো পথে চালাতে লাগল। পেছনে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট ফেলে এসেছে সেজন্য।
গাড়িটা রেস্টুরেন্টে এসে থামল। তিনজন গাড়ি থেকে নেমে বসলাম। আমি চুপচাপ আছি কোনো কথা বলছি না। বলা চলে গলাটা বসে গেছে অনেকটা। নীল আর নিরা এটা সেটা বলেই যাচ্ছে, সেগুলো আমি কানেই তুলছি না কারণ এতে কষ্ট আরও বাড়বে। তাই শুধু নিজের কথা চিন্তা করছি।
খাবার অর্ডার করা হলো কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার চলেও আসলো। আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কী খাব। আমি উত্তর দিয়েছিলাম একটা হলেই হলো। তাই আমার জন্যও চাউমিন অর্ডার করা হয়েছে। খাবার নিয়ে খেতে নিলাম। গলা দিয়ে যেন খাবার নামছে না। এত অসহনীয় যন্ত্রণা কেন হচ্ছে জানি না। মনে হচ্ছো নিরার মতো এবার আমিও সুইসাইডের পথ বেছে নিই। তবে বাবার জন্য সেটা আর করা হয়ে উঠবে না। নিরার এমন ঘটনায় বাবা কতটা কষ্ট পেয়েছিল নিজের চোখে অবলোকন করেছি এরপর এমন করার সাহস আমার কখনও হয়ে উঠবে না।
খাওয়ার পর্ব শেষে বাসায় আসলাম। নিরা তার রুমে বসে নীলের সাথে ফোনে কথা বলছে। আর আমি পাশের রুমে বসে বিরহের দিন গুনছি। এই তো বেশি সময় নেই প্রিয় মানুষটা অন্য কারও হয়ে যাবে। বিরহের প্রতিটা ক্ষণ যেন সহস্র বছরের সময়। এত খারাপ সময় হয়তো এর আগে কখনও পার করিনি। এখন হারে হারে টের পাচ্ছি নীলকে আমি কতটা ভালোবেসেছি। ভালোবাসা হয়তো এমনেই চলে যাওয়ার পর আরও বেশি নাড়া দেয় মনে। আরও বেশি সজীব হয়ে উঠে। রক্তাক্ত ক্ষরণ ঘটে।
তীব্র যন্ত্রণাময় দিন পেরিয়ে অবশেষে আজকে নীল আর নিরার বিয়ে। গুটি কয়েক আত্মীয় এসেছে বিয়েতে। নিরা গোলাপি রঙ এর শাড়ি পরেছে নীল পরেছে সোনালি রঙয়ের পান্জাবি। নিরাকে অনেকটা ফুটন্ত গোলাপের মতো সুন্দর লাগছে৷ আজকে আমিও লাল বেনারসি পরেছি। মুখে সাজের আভাস থাকলেও মলিনতার আভায় যেন সব নিমিষে ম্লান হয়ে গিয়েছে। নীল আর নিরা সোফায় বসে আছে। আমি ঘরের দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখছি। নীলের বাবা, মা ও সেখানে। মাজেদা খালাও নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো আমার মতো মাজেদা খালারও এ বিয়ে মানতে কষ্ট হচ্ছে। বাবা চুপচাপ। পরিবেশটায় থমথমে। সবকিছুতে যেন এখনও আমি মিশ্রিত। নীলের মা আমার দিকে এগিয়ে আসলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নীচু গলায় বলল
“আমাকে ক্ষমা করে দিস মা।”
আমি আর কোনো কথা বললাম না। চুপ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। কাজী সাহেব চলে এসেছেন বিয়ে পড়াতে। আমার বুকটায় জলোচ্ছাসের ঢেউ যেন আঁচড়ে পড়ছে। এর মধ্যেই নিরা বলে উঠল
“আপু কোথায় আপুকে বলো এখানে আসতে। আমি কবুল বলব আপু পাশে থাকবে না তা কি হয়?”
নিরার কথায় বাবা বাধ্য হয়ে আমাকে ডাকলেন। আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। কাজী সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললাম
“আপনি বিয়ে পড়ান।”
কথাটা বলার সাথে সাথে নীল বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার গাল বরাবর কষিয়ে চড় দিয়ে বলল
“ভালোবাসার মানুষের প্রতি এ ভরসা?”
নীলের এমন আচরণে সবাই চুপসে গেল। আমিও বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে এসব। অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই নীল বলে উঠল
“নিরার আমার সাথে না আমাদের উপর তলায় ভাড়া থাকে অভ্রনীলের সাথে সম্পর্ক ছিল। আর সে সম্পর্ক গড়িয়ে এতদূর যায়। অভ্রনীল এখন দেশের বাইরে। চাইলেও নিরার দায়িত্ব নিতে পারছিল না৷ নিরা বাধ্য হয়ে আমাকে সবটা বলে। আমি ওকে সাহায্য করি। সেদিন অভ্রনীলের সাথে নিরার ঝগড়া হয়। আর সে ঝগড়া থেকে এ ঘটনার সূচনা হয়। আপনি যখন নিরাকে জিজ্ঞেস করেছিলে তখন নিরা কতটা সেন্সে ছিল বলেন? পুরো বিষয়টা আপনাকে বলতে পারেনি গুছিয়ে। এর আগেই আপনি আপনার মতো ভেবে নিলেন সবটা। আমার গুষ্টি উদ্ধার করে দিলেন সবার সামনে। আমি এতটাও খারাপ না, যতটা আপনি ভেবেছিলেন। আমার এতটাও মেয়ের নেশা নেই। তবে আপনাকে বুঝানো দরকার ছিল। তাই নিরার সাথে পরিকল্পনা করে বাকিটা করি। আমার সাথে আজকে নিরার বিয়ে হচ্ছে না। অভ্রনীল আর নিরার বিয়ে হবে। আপাতত সে দেশের বাইরে আছে তাই ফোনে বিয়ে হবে।”
কথাটা বলে বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল
“আপনাদের সবার সাথে এমন নাটক করার জন্য আমি দুঃখিত। যেখানে নিজের বাবা, মা আর প্রিয় মানুষটায় ভুল বুঝল সেখানে আর কিছু বলার নেই। সবাই আসতে পারেন।”
নীলের কথা শুনে আমি থমকে গেলাম। নিকট আত্মীয় যারা এসেছিল তারা ততক্ষণে যেতে শুরু করেছে। নীলের বাবা, মা ও নিশ্চুপ। নীল কাজী সাহেবকে বললেন নিরার বিয়ে পড়ানোর জন্য। অভ্রনীলকে ফোনে কল দেওয়া হলো। অভ্রনীলের পরিবারও উপস্থিত হলো আমাদের বাসায়। অভ্রনীল আর নিরার বিয়ে সম্পন্ন হলো। এবার নিরা তার রুমে চলে গেল। বাবা বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নীলের কাছে ক্ষমা চাইলেন। নীল বাবাকে জড়িয়ে ধরে বুঝালেন এতে বাবার কোনো দোষ ছিল না। নীলের বাবা, মা ও ছেলের কাছে নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলেন। নীল তাদের শুধু জড়িয়ে ধরে বললেন
“যাচাই না করে আমাকে ভুল বুঝাটা তোমাদের ঠিক হয়নি। তবে যা হবার হয়েছে আমি কিছু মনে করিনি।”
আমি এখনও চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কী যে হচ্ছে সব যেন আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। নীলের মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। নীলও চলে গেল। নীলকে পিছু ডাকার সাহস আর হলো না। শুধু ভাবতে লাগলাম আদৌ নীল কী আমাকে মানতে পারবে না’কি পারবে না? আমি আর দাঁড়িয়ে রইলাম না। দ্রূত নীলের পিছু নিলাম। খানিক দূর যেতেই পুনরায় আতঙ্কিত হয়ে গেলাম।
চলবে?