বিনি সুতোর টান,পর্ব-২৯

1
2266

#বিনি সুতোর টান,পর্ব-২৯
#শারমিন আঁচল নিপা

নীলের সামনে একটা মেয়ে দাঁড়ানো। মেয়েটাকে আমার চিনতে তেমন ভুল হচ্ছে না। নীলের নিখুঁত বর্ণণার প্রতিটা ছক যেন মেয়ের মুখে লেপ্টে আছে। নীলের মুখে এ মেয়ের বর্ণণা এত নিঁখুত ভাবে শুনেছি একে চিনতে আমি কেন! যে কেউ এ বর্ণণা শুনলে ভুল করবে না। সে আর কেউ না মিহি দাঁড়িয়ে আছে। মিহি হঠাৎ এখানে কী করছে তাই ভাবছি আমি। নীল কী তাহলে আবার মিহির হয়ে যাবে। না,না একি ভাবছি আমি। নীল তো বলেছিলই মিহির সাথে তার কখনও আর সম্ভব না। কোনোভাবেই তারা এক হতে পারবে না। তাহলে মিহি এখানে কী করছে? আমার বিয়োগ ব্যথায় নতুন যন্ত্রণার সূচণা হলো। আমি কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে নীলকে দেখছি। নীল মিহির সাথে কী যেন বলছে। দূরত্ব হওয়ায় নীলের কথা গুলো আমার কান পর্যন্ত আসছে না। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ঘটনা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার সাহস ও পাচ্ছি না। হাত, পা ক্রামান্বয়ে কাঁপছে। নীল মিহিকে নিয়ে কোথাও যেন যাচ্ছে। আমি নীলের পিছু নিব কি’না ভাবতে লাগলাম। তবে শত ভাবনার পরও পিছু নেওয়ার সাহস আর পেলাম না। নীল আর মিহি চলে গেল। আমি শুধু তাদের চলে যাওয়া অবলোকন করছিলাম। ঠাঁই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চুপ করে রইলাম৷ কোনো রকম উপায় না পেয়ে ঘরে ছুটে আসলাম।

ঘরে ঢুকতেই নিরার সম্মুখীন হলাম। নিরাকে দেখেই গা টা জ্বলে গেল। নিরা যদি আমাকে একটু ইঙ্গিত দিত তাহলে নীলের সাথে আমার এত ঝামেলা হত না। আর সেদিন যদি নিরা আমাকে পরিষ্কার করে সবটা বলত তাহলে এতটা সমস্যা আজকে পোহাতে হত না। নিরার দিকে তাকিয়ে বেশ রাগী গলায় বললাম

“এখনও কথা শিখলি না? কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় এখনও তোকে শিখাতে পারলাম না। সেদিন তুই পরিষ্কার করে বললে আজকে এত ঝামেলা হত না। পরিষ্কার করে বললে কী খুব ক্ষতি হত তোর? তোর জন্য আজকে আমার জীবনটা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে একবার ভাব। কোনো কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। কেন এমনটা করলি তুই? ”

নিরা বিরক্ত গলায় জবাব দিল

“আমি তো তোমাকে পরিষ্কার করেই বলতে চাচ্ছিলাম। এর আগেই তো তুমি নীল ভাইয়ার রুমে গিয়ে যা বুঝার বুঝে এত বড়ো কাহিনি করলে। আমাকেও তো একবার এসে জিজ্ঞেস করলে না৷ আর সেদিন আমি অনেক হতাশায় ছিলাম তাই তোমাকে গুছিয়ে বলতে পারিনি। তুমি নিজেও সময় দাও নি কাউকে। এত দ্রূত স্টেপ নিয়েছো যে বাধ্য হয়ে আমাকে এতটুকু করতে হয়েছে৷ আপু তুমি নীল ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলো উনি বুঝবেন আমার মনে হয়। সমস্যা হয়েছে সমাধানও হবে। শুধু শুধু একে তাকে দোষারূপ করে নিজের জীবনটা জটিল করো না। সহজভাবে সব নিতে শিখো সহজ লাগবে সব। ”

“তোকে আমাকে জ্ঞান দিতে হবে। আমার সামনে থেকে যা। আমার মন মেজাজ একদম ভালো না। তোকে দেখলেই রাগ উঠছে অনেক।”

কথাগুলো গজগজ করে বলে আমার রুমে আসলাম। বিছানায় হেলান দিয়ে মিহি আর নীলের কথায় ভাবতে লাগলাম। মিহিকে নিয়ে নীলকে পুনরায় সন্দেহ করার সাহস ও পাচ্ছি না। একবার এমন সন্দেহ করে আমি চরমভাবে কষ্ট পেয়েছি। সহজ ব্যপার গুলো জটিল করেছি। এ মুহুর্তে মিহিকে নিয়ে সন্দেহ করে নীলকে কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে নীলের সাথে আমার কথা বলা জরুরি। এখন নীলকে না পেলেও সন্ধ্যার পর নীলকে বাসায় পাব। তখন বাসায় গিয়ে নীলের কাছে ক্ষমা চেয়ে সবটা ঠিক করে নিব। কিন্তু মিহির আগমনটা আমার কাছে মোটেও ভালো লাগছে না। অস্থিরতা ভীষণভাবে আমাকে গ্রাস করছে। এ অস্থিরতা কীভাবে কাটাব সেটাই ভাবছি আমি। ভাবতে ভাবতে চোখটা লেগে আসলো একটা সময়।

জানালা দিয়ে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ছাট এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে। চোখ গুলো খুলতে চাইলেও খুলতে পারছি না। ভীষণরকম মাথা ব্যথা করছে। এ কয়দিন এত কেঁদেছি মাথা ব্যথা করা অস্বাভাবিক না। বাইরে বেশ নীরব তবে ঝড়ের তান্ডবে সব যেন লন্ড ভন্ড হয়ে যাচ্ছে। ভীষণ রকম কষ্ট এসে বুকে বাঁধা বাধছে। আচ্ছা নীল কী আমার হবে না? তাকে কী আমি হারিয়ে ফেলেছি। এতটা অসহায় কেন লাগছে। কপালে কারও স্পর্শ অনুভব করলাম। চোখটা টেনেও খুলতে পারছি না। কারও কণ্ঠ কানে ধেয়ে আসলো। অনিচ্ছা সত্যেও এবার চোখ দুটো খুলে ফেললাম। লক্ষ্য করলাম মা সামনে বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে। আমাকে তাকাতে দেখে হালকা ঠোঁট প্রশস্ত করে মোলায়েম কণ্ঠে বলল

“বাইরে ঝড় বইছে। রাতও বেশ হয়েছে। নীল এখনও বাড়ি ফেরেনি। কেন জানি না মনটা ছটফট করছে। নীলকে অনেক কল দিয়েও পাইনি। তোমার কাছে আসলাম তুমি কিছু জানো কি’না । কারণ তোমাদের ভুল বুঝাবুঝির তো সমাধান হলো। এসে বুঝতে পারলাম তোমার শরীরটাও ভালো না। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তোমার। চোখ দুটো বেশ ফোলা। তাই ডাকার সাহস পাচ্ছিলাম না। অনেকক্ষণ মাথায় বুলালাম। তবে মায়ের মন তো ভীষণ ছটফট করছে তাই ডাকতে বাধ্য হলাম। মা তুমি কি জানো নীল কোথায় গিয়েছে? তোমাকে কী কিছু বলে গিয়েছে?”

মায়ের কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। জ্বরে শরীর ব্যথা করলেও আমার শরীরের ব্যথা তেমন অনুভূত হচ্ছে না। আমি দ্রূত পায়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম রাত ১ টা বাজে। তার মানে আমি টানা ১২ ঘন্টার উপর ঘুমিয়েছি। কিন্তু নীল কোথায় যাবে? সে তো শেষবার মিহির সাথে বের হয়েছিল এরপর কী নীল বাড়ি আসেনি। আমি অস্থির গলায় মাকে বললাম

“আমি নীলকে মিহির সাথে বের হতে দেখেছিলাম সেই সকাল বেলা। এরপর কী নীল আর আসে নি?”

মা আমার দিকে বড়ো চোখ করে তাকিয়ে বলল

“ওকে মিহির সাথে বের কেন হতে দিলে তুমি?”

আমি হতাশ গলায় উত্তর দিলাম

“উনাকে আটকানোর অধিকারটা যে আমি হারিয়ে ফেলেছি মা। আপনি চিন্তা করবেন না হয়তো উনি মিহির সাথেই আছে।”

মা আমার দিকে তাকাল আবার। মায়ের চোখে জল ছলছল করছে। কিছু বলতে নিয়েও যেন বলতে পারছে না। আমি কেন জানি না মাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও পাচ্ছিলাম না। মা দ্রূত বের হয়ে গেল রুম থেকে। আমাকে বের হওয়ার আগে বলে গেল

“মিহির সাথে বের হতে দেওয়াটা তোমার ঠিক হয়নি। মিহি নীলের সাথে যা করেছিল তার পর থেকে আমার ছেলেটার স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগে। এখন মিহির যে অবস্থা না জানি মিহিকে নিয়ে নীল কী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। এ মেয়ে কখনও নীলকে ভালোবাসেনি। ভালোবাসলেও সেটা প্রয়োজনে, স্বার্থে। আবার কী চায় কে জানে। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারলে তুমি।”

আমি মায়ের কথাটা শুনে দম ধরে বসে আছি। মা রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। মিহি খারাপ জানি। নীলের সাথে খারাপ করেছে তাও জানি। নীল স্বীকার করে মিহি যা করেছে তা অন্যায়। তবে এটাও বলেছে মিহির প্রতি সে অনেক দুর্বল। আর মিহি তাকে ভালোবাসে এটাও সে স্বীকার করে। তাহলে কী আবারও আমার আর নীলের মাঝে মিহির আগমণে ছেদ ঘটবে। আরও বেশি খারাপ লাগতে শুরু করল। কিন্তু নীল এটাও বলেছিল মিহির সাথে তার কিছু সম্ভব না। মিহি সিনগেল মাদার। তার সন্তানকে নিয়ে সে ভালো আছে। তাহলে আবার কেন মিহি নীলের কাছে আসলো। নীলকে আবারও অবিশ্বাস করার সাহাস আমার হচ্ছে না আবার মিহির ব্যপার টা এড়িয়ে যেতেও পারছি না। ক্রমশেই আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগল। শুধু চিন্তা করতে লাগলাম আমি কী নীলকে এবার হারিয়েই ফেললাম?

চলবে?

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here