বিনি সুতোর টান,পর্ব-৪,৫

0
2040

#বিনি সুতোর টান,পর্ব-৪,৫
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৪

বেশ রাগী চোখে পাশ ফিরে তাকিয়ে আরও কিছুটা বিস্মিত হলাম। দুজন ভদ্রলোক,ভদ্র মহিলা এসেছেন। একজন মহিলা। বয়স আনুমানিক ৪৫-৫০ হবে। অপরজন পুরুষ। বয়স আনুমানিক ৫০-৬০ হবে। ভদ্র মহিলা দেখতে বেশ সুন্দর। মাথায় বেশ গুছালো ভাবে উড়না টানা। পরনে বেগুনী বর্ণের থ্রি-পিস পরা। ফর্সা শরীরে বেগুনী বর্ণ ধারণ করা পোশাকটা যেন অনেকটা কুচুরিপানা ফুলের উপমা বহন করছে। উনাকে বেশ মানিয়েছেও। অপরদিকে যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছেন উনার পরনে সাদা বর্ণের পাঞ্জাবি পরা। গায়ের রঙ দুজনের একদম বিপরীত। ভদ্র মহিলার গায়ের বর্ণ ধবধবে ফর্সা হলেও ভদ্র লোকের গায়ের রঙ সে অনুযায়ী কালো। আমি তাদের দিকে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, উনারা কারা? আর আমিই বা কেন উনাদের শারিরীক গঠন এত খেয়াল করছি? আচ্ছা উনারা কী স্বামী স্ত্রী? হতেই পারে। এরকম বিয়ে তো অনেক দেখেছি। আচ্ছা দেখতে অসম মানুষগুলোর সম্পর্ক কী সুন্দর হয়? হওয়াটা অস্বাভাবিক না । সুন্দর না হলে এতদিন পাশে থাকতে পারত না। এদিকে আমিও তো তেমন সুন্দর না। লম্বায় অনেক ছোটো নীলের তুলনায়। কোথায় নীল ৬ ফিট আর আমি ৫ ফিট। কোথায় নীলের লাবন্যতা সূর্যের কিরণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে আর আমার লাবন্যতা ঘানি ভাঙা সরিষার তেলের মতো কালো হয়ে ঝলক দিচ্ছে। আর আমাদের বয়সের ফারাকও কম না। সব মিলিয়ে বলা চলে আমাদের বাহ্যিক গঠনও বিপরীত। তাহলে কী আমাদের সম্পর্কটা সামনের দিকে এগুনোর চিন্তা করতে পারি? তাকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখতে পারি? তার সাথে যুগলবন্দী হওয়ার কল্পনা করতে পারি? তার বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ করতে পারি? গুটিকয়েক প্রশ্ন মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল।

সাত পাঁচ অনেক ভেবে নিজেকেই নিজে বোকা উপাধি দিয়ে ভাবনার ইতি টানলাম। কারণ ভাবনা শুরু হয়েছিল আগন্তুক দুজন মানুষকে নিয়ে আর সে ভাবনার ডানা মেলে উড়তে উড়তে আমার আর নীল অবধি চলে এসেছে। বলা চলে এ একটা জায়গায় মানুষ বেশ স্বাধীন। এ জায়গায় মানুষ নিজের মতো সব করতে পারে। এখানে তাকে বাঁধা দেওয়ার মতো কেউ নেই। এখানে সেই রাণী, সেই রাজা। এখানের সব চাওয়া গুলো অবাস্তব হলেও এখানে মানুষ বেশ সুখী। ভাবনার আকাশে মানুষ বেশ স্বাধীনভাবে ডানা মেলে উড়তে পারে। মানুষের সব অপূর্ণ চাওয়াও এ ভাবনার মাধ্যমে পূর্ণ করে।

আমি তাদের দিকে তাকিয়েই আছি। এর মধ্যে মাজেদা খালার আচমকা চিৎকার কানে ধেয়ে আসলো। তিনি বেশ উৎকন্ঠা সুরে দুজন আগন্তুক লোককে উদ্দেশ্য করে বললেন

“ও মায়া গো আফা আর ভাইসাব দেহি এহানে। নীল বাবাও দেহি এহানে। আঁচল মারে দেখতে আইছেন নাকি আপনারা। ওমাগো একলগে সবাইরে দেইখা কী যে ভালা লাগতাছে।”

ভদ্র মহিলা একটু বিরক্তি টেনে উত্তর দিলেন

“আহ মাজেদা চিল্লাচ্ছ কেন? চুপ করো তো। নীল বলল মফিজ সাহেবের মেয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে তাই দেখতে আসলাম। তা ভাই কোথায় বসায় নেই নাকি?”

এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম উনারা নীলের বাবা, মা। আমি কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম এটা ভেবে আমাকে দেখতে উনারাও চলে এসেছেন! আমার স্তব্ধতার রেশ কাটে আংকেলের কণ্ঠে। উনার নাম শারাফ উদ্দিন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বেশ মোলায়েম কণ্ঠে বললেন

” তোমার শরীর কেমন মা? তোমার বাবা কোথায়?”

আমি কিছুটা নম্র গলায় জবাব দিলাম

“বাবা মনে হয় একটু বাইরে গেছেন। আমার শরীর ভালোই। পায়ে একটু ব্যথা। ”

আংকেল আর কথা বাড়ালেন না। নিরা আংকেল আর আন্টিকে চেয়ার এনে দিলেন বসার জন্য। উনারা বসে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছেন। ডাক্তার আমার পা দেখে নীলের দিকে তাকিয়ে বললেন

“পা টা বেশ ফুলে গিয়েছে। ভেঙে গিয়েছে কি’না বুঝা যাচ্ছে না। কালকে একটা এক্সরে করিয়ে নিয়ে আসবেন। আপাতত আমি পেইন কিলার দিয়ে যাচ্ছি। ঐটা খেলে ব্যথা কমে যাবে।”

এদিকে মাজেদা খালাকে আমি যতই ইশারা করছি চা বসানোর জন্য ততই মাজেদা খালা আমার দিকে ফিক করে তাকিয়ে আছে। আমার ইশারা বুঝার ক্ষমতাও উনার হচ্ছে না। নিরাও এত বোকা কেন বুঝতেছি না। মেহমান এসেছে কিছু না দিয়ে সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছে। যতই হোক আমার হবু শ্বশুড় শ্বাশুড়ি এসেছে। নিরাকে ডেকে কিছু বলব কি’না বুঝতেছি না। আর বাবাও কোথায় গেছেন কে জানে।

এদিকে ডাক্তার সাহেব পা টা দেখে চলে গেলেন। উনারা এখনও বসে আছেন। মিনেট পাঁচেক পর বাবা আসলেন। তিনি এসে আংকেলকে দেখে বলতে লাগলেন

“আরে তুই আসবি বলবি না। আমি তো বাজারে গিয়েছিলাম নীলের জন্য কিছু আনতে। তুই আসলে তো তোর জন্য তোর পছন্দের হালিম নিয়ে আসতাম।”

শারাফ উদ্দিন সাহেব খিলখিল করে হেসে জবাব দিলেন

“তোর পাগলামি আর গেল না। আমি এসেছি তোর মেয়েকে দেখতে, খেতে না। আরেকদিন এসে খেয়ে যাব। বাজারের কি’না হালিম না তোর হাতে বানানো হালিম।”

“সে নাহয় করা যাবে। ভাবি কেমন আছেন?”

নীলের মা সাহেদা বেগম বেশ হাসি মুখে উত্তর দিলেন

“আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি।”

আরও কিছু বলতে নিবেন। সে বলায় ব্যাগরা দিল নীল। তিনি নম্র গলায় বাবাকে বললেন

“উনাকে নিয়ে কালকে গিয়ে একটু এক্সরে করিয়ে আনবেন। পায়ে বেশ ব্যথা পেয়েছেন তিনি। এক্সরে করলে বুঝা যাবে পা ভেঙেছে কি’না।”

আন্টি নীলের দিকে তাকিয়ে বেশ জোরালো কণ্ঠে বললেন

“নীল আঁচল তোমার ছোটো ওকে কেন আপনি বলে সম্বোধন করতেছো। ওকে তুমি বলেই সম্বোধন করো কেমন?”

আন্টির কথাটা শুনে আমার মনটা যেন জুড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছিল আমার মনের কথায় তিনি বলে দিয়েছেন। তবে সে সুখটা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী রইল না। পরপরই তিনি বললেন

“ও তো তোমার বোনের মতোই। আপনি বলার দরকার নেই।”

আমি চুপ হয়ে উনার দিকে বোবার মতো তাকিয়ে আছি উনি কী উত্তর দেয় সেটা শুনার জন্য। চাতক পাখির মতো চোখ দুটো তার চোখে নিবদ্ধ হয়ে আছে। উনি বেশ স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলেন

“আচ্ছা ঠিক আছে। আস্তে ধীরে হয়ে যাবে। ”

নীলের মা এবার আমার পাশে বসে বললেন

“তোমার পা কী অনেক ব্যথা করছে?”

এতক্ষণ হুমধুমে পায়ের ব্যথাটা টের না পেলেও এখন বেশ টের পাচ্ছি। মনে হচ্ছে ব্যথাটা বেশ বাড়ছে। তবুও কষ্টটা দমিয়ে বললাম

“এখন তেমন ব্যথা লাগছে না। ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

“নিয়ম করে ঔষধ খেও। আর নিজের যত্ন নিও। পা ভালো হলে আমাদের বাসায় গিয়ে আমার সাথে আড্ডা দিয়ে আসবে। সারাদিন আমি একাই থাকি। নীল অফিসে থাকে আর মেয়েটা তো শ্বশুড় বাড়ি। তুমি আর নিরা যেও। তুমি আর নিরা গেলে আমার ভালো লাগবে। একসাথে জমিয়ে কথা বলা যাবে। সারাক্ষণ একা বাসায় থাকতে ভালো লাগে না।”

আন্টির কথায় ব্যাগরা বসিয়ে মজেদা খালা বলে উঠলেন

” আরে আফা ছেলের বিয়ে দিয়ে দিন তাহলেই তো আর একা থাকতে হয় না।”

নীল বিয়ের কথা শুনে বসা থেকে উঠে দ্রূত বের হয়ে গেল রুম থেকে। বুঝতে পারছিলাম বিষয়টা তিনি সম্মানের সহিত এড়িয়ে গিয়েছেন। আর আন্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল

“দেখেছই তো বিয়ের কথা শুনলে কেমন করে। বিয়েতে তো রাজিই করতে পারি না। ভালো মেয়েও পাই না যে বিয়ে করাব।”

আন্টির কথা শুনে আমার ভীষণ লজ্জা লাগতে শুরু করল। মনে মনে ভাবতে লাগলাম

“আপনার সামনেই তো একজন ভালো মেয়ে বসে আছে। একটু আমার দিকে তাকালেও তো পারেন।”

অতঃপর তারা দুজন একটু আড্ডা দিয়ে কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলেন। ইতোমধ্যে আমার পা ব্যথাটা বাড়তে শুরু করে। একটা ট্যাবলেট খেয়ে চোখটা বন্ধ করলাম। চোখটা বন্ধ করার কিছুক্ষণ পর মনে হলো আমার পা টা আর নড়াতে পারছি না। হাত পা অনেক কাঁপছে। বাবাকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারতেছি না। কী হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছি না। মাজেদা খালা এসে পা ধরে চিল্লাতে লাগল। খালায় বা কেন এরকম চিল্লানো শুরু করল বুঝতে পারছি না। শরীর হিম হয়ে যেতে লাগল। কারণ টা এখনও সুনিপুণ ভাবে উদঘাটন করতে পারছি না।

চলবে?

#বিনি সুতোর টান
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫

কারণ টা এখনও সুনিপুণ ভাবে উদঘাটন করতে পারছি না। মাজেদা খালার কান্নার আওয়াজটা আরও প্রখর হলো। আমি চোখটা খুললাম কোনো রকম। পায়ের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম ফুলে ফেঁপে গেছে। পায়ের ব্যথায় কথাও বলতে পারছি না। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। বাবা পাশের রুম থেকে দৌড়ে আসলেন। পায়ের অস্বাভাবিক ফোলা দেখে বাবা ভয় পেয়ে গেলেন। নিরাও ফুঁপাতে ফুঁপাতে কাঁদতে লাগল। আমি সহজে অসুস্থ হই না। এ প্রথম অনেকদিন পর পায়ের এ হাল হলো তাই বাসার সবাই চিন্তা করতে লাগল। বাবা নিরাকে বলল

“নিরা আমার ঘর থেকে আমার মোবাইলটা নিয়ে আসো। ”

নিরা আর দেরি করল না। দৌড়ে গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে আসলো। বাবা কাকে যেন কল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ কণ্ঠে বলল

“নীলকে কল দিতে চেয়েছিলাম মোবাইলে তো টাকা নেই।”

আমি শুধু কথাগুলো শ্রবণ করছিলাম। বলার ইয়ত্তা পাচ্ছিলাম না। নিরা চট করে বাবাকে বলে উঠল

“আপুর মোবাইল দিয়ে কল দাও বাবা। উনি বেশ ভালো লোক মনে হয় বললে সাহায্য করবে। আপুকে তো একা তুমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারবে না৷ আর ডাক্তারও তো উনার পরিচিত। ”

নিরার কথায় এ ব্যথার মধ্যেও আমার এক অদ্ভূত প্রশান্তি লাগছে এই ভেবে যে আমি নীলের নম্বরটা পেতে চলেছি।

*মানুষ যখন ভালোবাসায় ডুব মারে তখন মানুষের হিতাহিত জ্ঞান অনুভূতি গুলো লোপ পেতে শুরু করে। তখন তার চিন্তা কেবল সে মানুষটাকে ঘিরে হয়। তার ভাবনার সন্নিবেশে কেবল সে মানুষটাকে ঘিরে ঘুরপাক খায়। মানুষ চরমভাবে সে মানুষটার প্রতি দুর্বল হতে শুরু করে। আর এ দুর্বলতায় মানুষকে হয় তলিয়ে দেয় নাহয় সাফল্যের চরম শিখরে নিয়ে যায়। একটা ভালোবাসায় পারে মানুষকে বদলে দিতে। একটা ভালোবাসায় পারে মানুষের সকল ধ্যান ধারণা চিন্তার বিন্যাস ঘটাতে। একটা ভালোবাসায় পারে মানুষকে সাফল্যের সন্নিকটে নিয়ে যেতে। অপরদিকে একটা ভালোবাসায় পারে মানুষকে কষ্টের অনলে পুড়াতে রসাতলে ডুবিয়ে দিতে। সঠিক মানুষকে ভালোবাসলে সন্নিবেশগুলোও পাকাপুক্ত আর সঠিক হয় আর মানুষটা সঠিক না হলে সন্নিবেশ গুলো নড়বড়ে খরখরে হয়ে যায়। ভালোবাসার সংজ্ঞা রঙ একেক জনের কাছে একেক রকম। কারও কাছে সেটা মধুর অনুভূতি আর কারও কাছে সেটা তিক্ততার অংশবিশেষ।*

বাবা আমার মোবাইলটা নিয়ে নীলকে দ্রূত কল দিলেন। কিছুক্ষণের জন্য আমার পায়ের ব্যথাটা এ খুশিতে উপশম হতে লাগল। বাবা কল দিয়ে হ্যালো বলে বললেন

“বাবা একটু বাসায় আসো। আঁচলের পায়ের অবস্থাটা ভালো না। আর পা টা ভীষণ ফুলেছে। ও ব্যথাও পাচ্ছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ভালো হত। নিরাকে মাজেদার কাছে রেখে যাব আর আঁচলকে একা নিয়ে বের হতে পারব না৷ একটু মুশকিলে পড়ে গেলাম। তুমি আসলে সবচেয়ে ভালো হত। তুমি কী আসতে পারবে?”

ওপাশ থেকে ঘুম ঘুম কণ্ঠে উত্তর আসলো। যদিও রাত বেশি বাজে না, ১১ টা বাজে। উনার হয়তো দ্রূত ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস উনার কণ্ঠ শুনে এমনটায় ধারণা করতে পারছি।

“আংকেল আমি এখনই আসতেছি। আপনি রেডি হতে থাকুন। মিনেট পাঁচ সময় লাগবে আসতে।”

বাবা কলটা কেটে দিলেন। বাবা কল কেটে মোবাইলটা আমার পাশে রেখে পাশের রুমে গেলেন তৈরী হওয়ার জন্য। এখন আমার পা ভালো হোক এটা গৌণ উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে। মুখ্য উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে আমি আগে নীলের নম্বরটা সেভ করে রাখি। ভাবনার দেয়াল উঁচু ঢিবি পর্যন্ত উঠার আগেই নীলের নম্বরটা সেভ করলাম প্রিয় নীলাচল লিখে। ভালো লাগছে দুজনের নামের যুগলবন্দী করে দিয়েছি এটা দেখে৷

এর মধ্যেই কলিং বেলটা বেজে উঠল। বুঝতে পারছিলাম নীল এসেছে। পাশ ফিরে নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই ভয় পেলাম। এমন দেখা যাচ্ছে কী বলব! একটু গুছিয়ে নিতে পারলে ভালোয় হয়। অন্তত উনার চোখে আমাকে সুন্দর লাগবে। নাছোরবান্দা ভালোবাসা মাঝে মাঝেই উন্মাদ করে তুলে আমাদের। নিরা গেছে দরজা খুলতে। মাজেদা খালাও সাথে গেছে৷ আমি চেয়েছিলাম মাথাটা একটু আঁচড়ে নিতে। তাই ফুলা পা নিয়েই উঠতে গিয়ে ধপাস করে মেঝেতে থুবরে পড়ি। এর মধ্যেই উনার আগমন। আমাকে বেশ দ্রূত পরিসর নিয়ে ধরে বলতে লাগলেন

“একা একা উঠার চেষ্টা কেন করেছেন? এখন তো পায়ের অবস্থা আরও বিগড়ে গেল। ওয়াশ রুমে যেতে চেয়েছিলেন কী? নিরাকে ডেকে বললেও পারতেন।”

তার দুটো হাত আমার বাহুরডোর দুটো আবদ্ধ করে রাখা। আমি বেশ নীচু গলায় বললাম

“ওয়াশরুমে যেতে চাইনি। কী যে করতে চেয়েছিলাম মনে নেই। ভুলে গেছি।”

“এটা আপনার পুরাতন ব্যাঁমু। আপনি কখন কী করেন আপনি নিজেও জানেন না। মাথার কয়েকটা তার ছুটে আছে আর কিছু নড়বড়ে আছে। শাসনের অভাবে আপনার এমনটা হয়েছে। আকাশ কুসুম চিন্তাও করেন আপনাকে দেখে বুঝা যায়।”

উনার কথা শুনে চুপসে গেলাম। উনি জানলো কী করে আমি আকাশ কুসুম চিন্তা করি। বেশ চুপ গলায় উত্তর দিলাম

“আপনি একটু বেশি বেশি ভাবছেন। আপনার ভাবনা সত্যি না। কী করেছি আমি যে এমন বলছেন?”

“আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই অকাজ করে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ভালো কোনো কাজ করতে দেখিনি। তাহলে আপনাকে নিয়ে আমি এর বেশি কী ভাবতে পারি?”

নীলের কথা পাত্তা দেওয়ার মতো কোনো কারণ আমি দেখছি না। মাথায় এবার জোরা দেওয়া তারগুলোও ছুটে গেল। বেশ খিলখিল করে বলে উঠলাম

“আপনার গার্লফ্রেন্ড কী আজকে আপনাকে অনেক বকেছে আপনাকে এত রাগী লাগছে যে?”

তিনি এবার হালকা হেসে বললেন

“আমার গার্লফ্রেন্ড এতটাও পাগল না যে বকবে। সে খুব ভালো মেয়ে। আমাকে অনেক ভালোবাসে। আপনি কি মেঝেতেই বসে থাকবেন নাকি ভর দিয়ে উঠবেন। আপনাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। মনে হচ্ছে পা টা ভেঙে ফেলেছেন।”

উনার মুখের কথা শুনে আমার ভেতরে হাহাকার বইতে লাগল। তার মানে উনার গার্লফ্রেন্ড আছে৷ আমি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম সেটাই ভাবছি। পায়ের ব্যথা থেকে মনের ব্যথাটা বেশ প্রখর হয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। চোখের ইষৎ কোণে অশ্রু ফোঁটা শিশির বিন্দুর ন্যায় জমে গেল। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে কিছু না বলে পাঁজাকোলা করে বলতে লাগলেন

“চোখের এ অবস্থা কেন? পায়ে ব্যথা কি বেশি লাগছে?”

বলেই বিছানায় বসালেন আমাকে। আমি চুপ করে মাথা নেড়ে গেলাম। আমার পায়ের ব্যথা সবাই দেখলেও এ মুহুর্তে আমার মনের ব্যথা কেউ কল্পনা করতে পারছে না। কেউ আমার মনের কষ্ট বুঝার চেষ্টাও করবে না। দুনিয়ায় মানুষ গুলো তখনই অসহায় হয় যখন বাইরের ক্ষত দেখাতে পারলেও ভেতরে বয়ে যাওয়া রক্তক্ষরণ দেখাতে পারে না। চুপিসারে বসে আছি আমি৷ বাবা আসার পর নীল আবার আমাকে ধরল। পুনরায় পাঁজাকোলা করে বাবাকে বললেন

“আপনি নীচে নামুন আমি ওকে নিয়ে আসছি। গাড়ি করে হাসপাতালে চলে যাব। ”

বাবা নীলের কথায় বাসা থেকে বের হলো। মাজেদা খালা পিছু ডেকে কী জানি বলতে নিল। নিরা মাজেদা খালার মুখটা আটকে দিয়ে বলল

“খালা পিছু ডেকো না। যেতে দাও।”

মাজেদা খালাও চুপ হয়ে গেল। আর আমি নীলের দিকে তাকিয়ে আছি। ছেলেটা আমাকে ধরে নীচে নামছে। এ মুহুর্তে নিজেকে গল্পের নায়িকা আর নীলকে নায়ক মনে হচ্ছে। তবে নীলের গার্লফ্রেন্ড আছে কথাটা ভেবেই আবারও বুকটা কেঁপে উঠল। মনের অজান্তেই বলে উঠলাম

“সত্যিই কী আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?”

নীলের স্বাভাবিক উত্তরটা যা আসলো সেটা আমার জন্য মেনে নেওয়া বেশ করুণ মনে হলো। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যেতে লাগল।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here