#বিনি সুতোর টান
#পর্ব-১
#শারমিন আঁচল নিপা
দরজার বাইরে বসে জুতার বক্সটা খুলে জুতা বের করছিলাম। সে সাথে জুতাগুলো দক্ষ মুচির মতো পরিষ্কার করছিলাম। জুতার ধুলা গুলো মেঘের মতো চারপাশে উড়ছে। মাথায় চুপচুপা তেল দেওয়া। পরনে এক বর্ণের জামা পরা আর অন্য বর্ণের সেলোয়ার পরা। গলায় উড়নার পরিবর্তনে গামছা ঝুলানো। নিজের এই বেশ নিয়েই আবিষ্ট মনে জুতা পরিষ্কার করছিলাম। এমন সময় চোখ গেল একটা পায়ের উপর। পায়ের দিকটা লক্ষ্য করে উপরের দিকে তাকালাম। সম্ভবত ৬ ফিট লম্বার একজন সুদর্শন পুরুষ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো বেশ পরিপাটি করে আঁচরানো। ফরমাল শার্ট, প্যান্ট পরিধান করা আর হাতে সিলভার কালার ঘড়ি পরা। মুখ বেশ গম্ভীর করা। যুবকটিকে দেখার পর মনটা কেমন জানি উতলে উঠল। মনে হচ্ছিল কোনো রূপকথার রাজপুত্র আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ পলকহীন দৃষ্টি নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আনমনে কী যেন ভাবছিলাম। আমার ভাবনার সাগরে হঠাৎ করে আঁচড়ে পড়ে একটা গুরু গম্ভীর কণ্ঠসুর। যুবকটি আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখটা নাড়িয়ে গম্ভীর সুরে বললেন
“এভাবে ধুলো উড়োচ্ছেন কেন? আশেপাশের মানুষ খেয়াল করে কাজ করবেন তো।”
আমি আবার একটু ত্যাড়া প্রকৃতির মানুষ। তার উপর উনার প্রতি কেন জানি না বিশেষ অনুভূতির সঞ্চার হয়েছে হুট করেই। প্রথম দেখায় কারও প্রতি এমন অনুভূতির বিচরণ আগে কখনও হয়নি৷ এটা নিতান্তই আমার বোকা মনের বোকা আবেগ ব্যতীত কিছু নয়৷ এ অনুভূতিকে পাত্তা দেওয়ার মতো বো’কা পাবলিক আমি না। তাই বেশ বাঁকা সুরে জবাব দিলাম
“ধুলো কী আমার ক্রী’তদাস নাকি যে আমি হুকুম করেছি আর ধুলো উড়তে চলেছে। বাইরে থেকে বাতাস আসছে আর যেহেতু জুতো পরিষ্কার করছি সেহেতু ধুলো উড়া তো স্বাভাবিক। এ স্বাভাবিক বিষয়টা মানতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন আপনার? নাকি চোখের মাথা খেয়েছেন?”
তিনি তেমন কথা বাড়ালেন না। শুধু মুখটা নাড়িয়ে ফাজিল মেয়ে বলে স্থান পরিত্যাগ করলেন। আমি বিষয়টা তখনও পাত্তা দেইনি। কিন্তু আমার ছোটোবোন হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে এসে যা বলল তা শুনে আমি বিষয়টা কতটা পাত্তা দিব বুঝতে পারছি না। আমার ছোটো বোন বলল
“আপু কার সাথে এভাবে কথা বলতেছিলে তুমি কি জানো?”
আমি বিরক্ত মাখা সুরে জবাব দিলাম
“কেনো কী হয়েছে। তিনি কী বাঘ নাকি যে আমার জানতে হবে.”
ছোটো বোন আমার ভাবের পাত্তা না দিয়ে গড়গড় করে বলে উঠল
” তিনি আমাদের বাসার বাড়ি ওয়ালার বড়ো ছেলে পেশায় একজন ম্যাজিস্ট্রেট।”
কথাটা শুনে আমি চুপসে গেলাম। একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে আমি এভাবে যা’তা বললাম বিষয়টা আমার হজম হচ্ছে না। তার উপর নিজের দশা দেখে নিজেই ভড়কে গেলাম। ছেলেটার চাহনি আমার প্রথম থেকেই ভালো লোগেছিল তাই একটু মজার ছলে উত্তর প্রদান করেছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মজা করতে গিয়ে আমি ভয়ানক বেয়াদবি করে ফেলেছি। তবে উনার প্রতি এত ভালোলাগা কেন কাজ করছে জানি না। বোকা মনের বোকা আবেগ বোকা অনুভূতির বিচরণ ঘটছে কেবল৷ আর সবচেয়ে বড়ো কথা আমি পড়াশোনা করি চিটাগং ভার্সিটিতে। এতদিন সেখানেই ছিলাম। এর মধ্যে বাবা বাসা পরিবর্তন করে। আর আমার ভার্সিটিও করোনার জন্য বন্ধ রাখা হয় যার দরুণ বাসায় আসি। তাই উনার পরিচয় আমার জানা নেই। কিন্তু এভাবে একজন মেজিস্ট্রেটকে অপমান করা মোটেও ঠিক হয়নি। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট না হলেও তাকে এভাবে অপমান করা ঠিক হত না। এটা নিতান্তই আমার বোকামি ব্যতীত কিছু নয়। তার উপর উনাদের বাসার ভাড়াটিয়া আমি। সবমিলিয়ে বিষয়টা জটিল আকার ধারণ করতে পারে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম বাবার কানে শালিস গেলে বিষয়টা কতটা লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে তাই ভাবছি৷ মা মরা মেয়ে আমি তাই বাবা তেমন শাসন করে না। তবে বাবাকে এমন পরিস্থিতিতে কল্পনা করতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। মাথায় হয়তো জ’মদূত এসে ঝেঁকে বসেছিল তাই এমনটা করে ফেলেছি৷ নাহয় এরকম কূটবুদ্ধির আবিষ্কার উনার সামনে কেন ঘটালাম সেটাই এখনও বোধগম্য হচ্ছে না। মনস্থির করলাম পরিস্থিতি বিগড়ে যাওয়ার আগেই সবটা সামলে নিতে হবে। উনাকে খুঁজে বের করে সবার আগে ক্ষমা চাইতে হবে। কারণ পৃথিবীতে ক্ষমা চাওয়ার মতো মহৎ কাজ আর কোনোটা হতে পারে না। এখনের যুগে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টা বেশ বিলুপ্তির পথে। তাই বিলুপ্ত বিষয় অবলুপ্ত আমাকেই করতে হবে। ভাবনার জাল বুনে অনেক শব্দ মালায় সাজাচ্ছি। এর মধ্যে বাবার ডাক কানে আসলো
“আঁচল একটু রান্না ঘরে আয় তো মা৷ তরকারিটা একটু টেস্ট করে দেখ কেমন হয়েছে। সে কখন থেকে জুতার পেছনে লেগে আছিস। কতবার বলেছি মাজেদা আসলে জুতা পরিষ্কার করে দিবে। তোর মতো নাছোরবান্দা মেয়ে আমার কথা শুনলে তো। ”
এতক্ষণে বাবার ডাকে আমার নামটা অবশ্য জানা হয়ে গিয়েছে সবার৷ যাইহোক আমার পরিচয় দেবার মতো তেমন কিছু এখনও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাই আমার পরিচয় নাহয় গল্পের স্রোতে দিয়ে যাব। মাজেদা হলেন এ বাসার পার্ট টাইম কাজের মানুষ। মানুষটা বেশ ভালোই শুধু একটু কথা বেশি বলে। উনার ভাষ্যমতে উনি সবচেয়ে খানদানি বংশের মেয়ে। কোনো এক ঝড়ের কবলে পড়ে উনার এ হাল। যদিও এসব কথার পাত্তা তিনি কারও কাছে পান না তবে উনার কথার জাল উনি উনার মতো করে বুনে যান। কারও পাত্তা পাওয়ার আকাঙ্খা হয়তো উনার মনে নেই। আর আমার বাবা মহোদয় মায়ের মৃত্যুর পর আমাদের দু বোনকে মানুষ করেন। অফিসের বাকি সময়টা রান্নার আর ঘরের কাজে ব্যায় করেন। আমি বাসায় না থাকলে উনার কাছে বাসাটা পাংশে মনে হয়। তবে আমি বাসায় থাকলে উনি বেশ উদ্দীপনা নিয়ে রান্না করেন৷ যতক্ষণ পর্যন্ত রান্নাটা আমি টেস্ট না করব ততক্ষণ পর্যন্ত উনার মনে হয় পেটের ভাত হজম হয় না। এর মধ্যেই আবার বাবার ডাক পড়ল। আমি হন হন করে বাবার কাছে গেলাম।
সূর্যের হেলে যাওয়াতে বুঝা যাচ্ছে বিকেল নেমেছে। বিকেলের রোদটা বেশ মিষ্টি। ছাদে গিয়ে রোদ পোহালে মন্দ হয় না। ভাবনার আবেশ ঘটনার সাথে সথে ছাদে যাওয়ার পথ ধরলাম। ছোটো বোন পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করল
“হুট করে বিছানা থেকে উঠে হনহন করে কোথায় যাচ্ছ আপু?”
আমি আবার খুব ত্যাড়া প্রকৃতির মানুষ। সোজা উত্তরটাও বাঁকা সুরে দিতে বেশি পছন্দ করি। তাই বিনয়ী সুর টেনে বললাম
“ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরতে যাচ্ছি। ”
ছোটো বোন আমার আর কোনো কথা বলল না৷ সে বুঝতে পারল তার প্রশ্ন করাটা নেহাৎ অন্যায় হয়েছে৷ তাই চুপ করে বইয়ের দিকে নজর দিল। দুজন পিঠাপিঠি আমরা। সবার ধারণা ছোটো গুলো ব*জ্জাত হয় বেশি৷ তবে আমাদের দিক দিয়ে বিষয়টা বেশ উল্টো। আমি বড়ো হয়েও বেশ ত্যাড়া অপরপক্ষে আমার ছোট বোন নিরা ছোটো হয়েও বেশ শান্ত শীতল সুলভ। এদিকে আর কথা না বাড়াই।
হনহন করে ছাদে গেলাম। এ বাসার ছাদটা বেশ সুন্দর। চারদিকে ফুলের সুভাস মোহনীয় মাতাল নেশা জাগাচ্ছে মনে। আমার অবুঝ চোখ দুটো চলে গেল ছাদের কার্ণিশ ঘেষে সদ্য ফোটা গোলাপ ফুলের দিকে। দ্রূত পায়ে ফুলের দিকে এগুলাম। ফুলটার কাছে গিয়ে ফুলটাকে হাতে স্পর্শ করে সৌন্দর্য অবলোকন করছিলাম। এর মধ্যেই একটা তীব্র কণ্ঠস্বর কানে আসলো।
“ফুলে হাত দিয়েছেন কেন?”
আমি আর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করলাম না কথাটা কে বলেছে। ত্যাড়ামির চরম বিচরণ ঘটিয়ে বললাম
“দেখছেন না ফুলের সৌন্দর্য অবলোকন করছি।”
অপর পক্ষ থেকে উত্তর আসলো
“সৌন্দর্য দূর থেকেই অবলোকন করা শ্রেয়। কাছে গেলে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। খুয়ে যায়। ফুল থেকে হাত সরান।”
আমি ফুলে আরও বেশি হাত দিয়ে বলতে লাগলাম
“আমি আপনার মতো কবি সাহিত্যিক নই। আমি সাধারণ মানুষ তাই সৌন্দর্য কাছ থেকে অবলোকন করি। আপনি কে হ্যাঁ এখানে এসে গজ গজ করছেন। ভারী বেয়াদব তো!”
কথাটা বলেই দৃষ্টিটা পেছন দিক থেকে সামনের দিকে নিলাম। দৃষ্টি সামনে দিতেই আমার চোখ কাপলে উঠল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন আমার সামনে। এখন কী করা উচিত বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। কারণ পূর্বের তর্কের জন্য ক্ষমা চাইব নাকি নতুন করে যাওয়া তর্কের জন্য ক্ষমা চাইব বিষয়টা বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি আমার দুটানাকে টেনে হিঁচড়ে দিয়ে বললেন
“সমস্যা কী আপনার? সবসময় ত্যাড়া করে কথা বলেন কেন? ফুলে হাত দিতেছেন কেন? জানেন না এ ছাদের ফুলে হাত দেওয়া নিষেধ।”
আমি খানিক ঢুক গিলে বললাম
“ফুলটা অনেক সুন্দর তো তাই হাত দিয়ে দেখছিলাম। তবে আপনার সাথে একটা কথায় সম্মতি প্রদান করতে পারলাম না। কাছে না গেলে সৌন্দর্য দৃষ্টি গোচর হবে কী করে?”
“আপনি একটা মাথামোটা বুঝতে পেরেছেন? আকর্ষণীয় জিনিস গুলো দূর থেকেও চমকপ্রদ কাছ থেকেও। তবে বেশি কাছে গিয়ে দেখতে গেলে চমকপ্রদ জিনিস গুলো নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা রয়ে যায়।”
উনার সাথে দ্বিমত পোষণ করে ফুলটায় আবার হাত দিয়ে বলতে লাগলাম
” দেখুন কাছ থেকে সৌন্দর্য অবলোকন করছি কই ফুল তো ঠিকেই আছে নষ্ট তো হয়নি।”
কথাটা বলে হাতটা হতচকিয়ে সরাতে গিয়ে হাতে ফুড়লো কাঁটা। আর সাথে সাথে ফুলটায় হালকা ধাক্কা লেগে ফুলের বোঁটাটা গেল ভেঙে। এবার আমার অবস্থা হলো এমন টাইপ যে
” হে আল্লাহ মাটিটা ফাঁকা করো আমি ঢুকে যাই।”
তবে অবস্থার পরিবর্তন তো এখন আল্লাহর তরফ থেকে আসতেছে না। কী বলব বুঝে উঠার আগেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাজ দেখে হতবাক হতভম্ব হয়ে গেলাম।
চলবে?