বিনি সুতোর টান #পর্ব-২৩

0
2042

#বিনি সুতোর টান
#পর্ব-২৩
#শারমিন আঁচল নিপা

কিছু বুঝে উঠার আগেই মনে হলো কোনো অঘটন ঘটে গেছে। নিরার কান্নার আওয়াজটা প্রখর করে বলল

“আপু নীল ভাইয়া ড্র ইং রুমে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। মনে হচ্ছে তিনি আর নেই।”

নিরার মুখে এমন কথা শুনে আমার কলিজাটা কাঁপতে লাগল। দৌঁড়ে যাব নাকি স্থির হয়ে বসে থাকব বুঝতে পারছি না। সচলহীন পা টাও যেন সচল হয়ে দ্রূত বেগে চলতে চাচ্ছে। আমি চিৎকার করে উঠে বললাম

“আমাকে নীলের কাছে নিয়ে যা নিরা।”

নিরা আমার হুইল চেয়ারটা ধরে ড্রইং রুমের দিকে এগুলো। সাথে সাথে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে গেলাম। শিরধারা বেয়ে কোনো বাতাস যেন প্রবাহিত হয়ে শরীরে কম্পন দিতে লাগল। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। বোকার মতো সবার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি কী সত্যি দেখছি নাকি মিথ্যার বেড়াজালে নিজেকে কল্পনা করছি তাও মিলাতে পারছি না। আমার চুপ হয়ে থাকা দেখে সবাই মুচকি মুচকি হাসছে। নিরা মুচকি হাসার পরিবর্তনে খলখল করে হেসে বলল

“হ্যাপি বার্থ ডে আপুই। তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই নীল ভাইয়া এমনটা বলতে বলেছে। কেমন লেগেছে সারপ্রাইজ। ”

আমি শুধু চারপাশে তাকাতে লাগালাম। নীলের দিকে তাকাতেই নীল চোখ টিপ দিয়ে উঠল। আমার কম্পমান হার্টটা এখনও কম্পিত হচ্ছে। প্রথমে কম্পিত হয়েছে একটা কষ্টের দাবানলে এখন কম্পিত হচ্ছে সুখের অভাসে। আমার মুখ দিয়ে যেন কোনো কথায় বের হচ্ছে না। নীলের মা, বাবা পার্টি স্প্রে দিতে লাগল। সাগরের ঢেউয়ের ফেনায় যেন আমি ভাসছি। নীল আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সবাই হাসতে হাসতে বলতে লাগল

“হ্যাপি বার্থ ডে।”

আমার আনন্দ প্রকাশের কোনো ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তবে কিছুটা অভিমান বুকে এসে জমাট বাঁধলো। কারণ নীলের কিছু হয়েছে এমন বলে আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়া উচিত হয়নি। কারণ আমার তীব্র দুর্বল জায়গা নীল সে জায়গায় কেউ হাত দিলে মনে হবে আমার কলিজায় কেউ হাত দিয়েছে। আমি মুখটাকে গোমরা করে বসে আছি। সবাই হাসলেও অভিমানী মুখ করে আমি বসে আছি। নীল আমার কাছে এসে বলল

“আপনি এত চুপচাপ কেন? খুশি হননি?”

আমি নীবরতা ভেঙে হালকা গলায় বললাম

“আপনার কিছু হয়েছে এমন বলে আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়া ঠিক হয়নি। আমার কতটা কষ্ট হচ্ছিল আপনি কী জানেন? এরকরম মজা কোনোদিনও করবেন না। আমি আপনাকে বাস্তবে কেন কল্পনাতেও হারাতে চাই না। ”

নীল কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল

“এটার অভিমান পরেও ভাঙানো যাবে। আপাতত বাড়ির সবার সামনে গোমরা মুখটা ঠিক করুন। আপনার বাবা আপনাকে দেখে ভাববে আমাদের বাসায় আপনি সুখে নেই তাই মুখটাকে এমন করে রেখেছেন। এখনই যদি এমন ধারণা উনার মনে আসে তাহলে কী পারমানেন্ট থাকার জন্য অনুমতি দিবেন। মনে হয় না দিবেন অনুমতি।”

নীলের কথায় আমি হালকা হেসে বললাম

“বুঝেছি আপনার ব্ল্যাকমেইল।”

তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম

“আমার জন্মদিন আমিই ভুলে গেছি। পায়ের জন্য হয়েছে এমনটা। আমাকে আগে বলোনি কেন আজকে আমার জন্মদিন।”

বাবা হাসতে হাসতে জবাব দিলেন

“আগে বললে কী এত আনন্দ দিতে পারতাম।”

এর মধ্যেই মাজেদা খালা প্রবেশ করলেন ঘটনায়। মাজেদা খালা প্রবেশ করেই বললেন

“হুপি ফার ডে আম্মা। ”

আমি চোখ গুলো কুঁচকে বললাম

“হুপি ফার ডে মানে কি?”

মাজেদা খালা দাঁত কেলিয়ে জবাব দিলেন

“আফায় দেখা যায় ইংজেরিও পারে না। হুপি ফার ডে মানে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।”

মাজেদা খালার কথা শুনে সবাই এক জোরে হেসে দিলাম। মানুষটার জন্য মাঝে মাঝে ভীষণ হাসার সুযোগ পাই। সবার হাসি দেখে মাজেদা খালাও বোকার মতো হাসতে লাগল।

অতঃপর কেক কাটা শেষ হলো। আমার পছন্দের খাবার গুলো রান্না করা হলো। রাতে খাবার পর্বও শুরু হলো। বাবার কাছে নীলের বাবা মা ডাইনিং টেবিলে বসে আমাদের বিবাহের প্রস্তাব রাখলেন। বাবা সব জেনে অমত করলেন না। আমার খুশি দেখে কে। সে খুশির প্রকাশ ঘটল গলায় ভাত আটকে গিয়ে। খুশিতে না পারছিলাম হাসতে না পারছিলাম কথা বলতে তাই শ্বাসনালি আর খাদ্যনালির ক্রিয়া একত্রে শুরু হতে লাগল। যার ফলশ্রূতিতে কুহু কুহু করে কাশতে লাগলাম। নীলকে মা জোরে জোরে বলতে লাগল

“নীল বৌ মা কে পানি দে।”

মায়ের মুখে কথাটা শুনে আরও যেন গদোগদো হয়ে গেলাম। আবেগের বশে আবারও শ্বাসনালি আর খাদ্যনালির ক্রিয়া একই হারে হতে লাগল। যার ফলশ্রুতিতে মাথাটাও ঘুরপাক খেতে লাগল, চোখটাও বন্ধ হয়ে যেতে লাগল।

মিনেট দশেক পর চোখ খুলে লক্ষ্য করলাম আমার মাথাটা নীলের কোলে আর সবাই চারপাশে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই বাবা বলে উঠলেন

“কী রে ভালো লাগছে এখন? গলায় খাবার আটকে এমন হয়েছে হয়তো।”

মা পাশে দাঁত কেলিয়ে বললেন

“ভাই সাহেব এ রোগের কারণ আপনি বুঝবেন না। আমি বুঝেছি। পরে সব হিসাব নিকাশ করে নিচ্ছি। আর পা টা ভালো হলে আর দেরি করছি না। একেবারের জন্য হিসাব নিকাশ করতে নিয়ে আসব। নীল আর আঁচল থাকুক। বাকিরা এসে খাওয়ার পর্ব শেষ করেন।”

নিরা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। এ মেয়ের মাথায় কী চলছে কে জানে। কতক্ষণ হেসে রুম থেকে বের হলো। সবাই গেল খাবার খেতে। নীল আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

“হঠাৎ কী হয়েছিল আপনার?”

“অতিরিক্ত খুশিতে এমন হয়েছে। আর আপনি আমাকে সবার সামনে কোলে নিয়ে বসে আছেন কেন? আমার তো অনেক লজ্জা লাগছিল।”

“এতে আপনার লজ্জা লাগছে আর সবার সামনে ধামরা মেয়ে খুশিতে গলায় খাবার আটকে পড়ে গিয়েছিল তখন লজ্জা লাগে নি। আমি তো বুঝতে পারছিলাম না আপনার কী হয়েছে। ঘরে এনে আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম আর চোখে পানি দিচ্ছিলাম। ডাক্তারকে ফোন দিলাম। আসতে তো উনার সময় লাগবেই। তাই প্রাথমিক ভাবে আপনার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছিলাম। ”

“হয়েছে এবার তো উঠতে দিন আমি তো এখন সুস্থ।”

নীল আমার মাথাটা চেপে ধরে বলল

“বুড়োর কোলে মাথা রাখতে কি বেশ অসুবিধা হচ্ছে?”

আমি জোরপূর্বক মাথাটা তুলে বললাম

“চ্যাংরা পোলার কোলে মাথা রাখতে বেশ সরম লাগছে। তবে আমার সাথে এমন করাটা মোটেও ঠিক হয়নি। আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন নিরাকে দিয়ে এসব বলিয়ে।”

“আচ্ছা নিরার কথাটা সত্যি হলে কী করতেন।”

আমি নীলের মুখটা চেপে ধরে উত্তর দিলাম

“কখনও যেন এমন নাহয়। আমি যেন আপনার কোলে মরতে পারি। আপনাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আপনাকে ছাড়া একটা মুহুর্তও কল্পনা করতে পারি না। এখন তো মনে আপনি আমার হার্টের স্পন্দন। কিছু মানুষ এমন হয় যাদের সাথে থাকলে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মনে হয়। আপনি আমার তেমন একজন মানুষ।”

নীল আমার দিকে তাকাল। হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল

“জীবনের গতি হারিয়ে ফেলেছিলাম। চিন্তা করেছিলাম কাউকে ভালোবাসতে পারব না। কিন্তু সে চিন্তাটাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিলেন আপনি। মিহিকে এখনও আমি ভালোবাসি অস্বীকার করতে পারব না। তবে মিহির জায়গাটায় অনেকদিন পর কেউ একজন পূরণ করতে চলেছে মনে হয়। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি বলব না তবে আপনার প্রতি আমি কোনো অবিচার করব না। আপনাকে আমি সবসময় আগলে রাখব। একজন ভালো বন্ধু, ভালো স্বামী হিসেবে আমি আপনার পাশে সবসময় থাকব।”

নীলের কথায় ভালো লাগার সাথেও হালকা বিরহ ব্যাথাও জাগল। মিহির প্রতি দুর্বলতা এখনও নীলের আছে এটা শুনে কেমন যেন লাগছে। যদিও সে সম্পর্ক নতুন করে গড়ে উঠবে না। তবুও অচেনা বিয়োগ ব্যাথা নিজেকে আঁকড়ে ধরছে। চোখের কোণে না চাইতেও জল চলে আসছে। তবে অনেক কসরত করে সেটা আটকে দিলাম।

দেখতে দেখতে সময়ের স্রোত এগুতে লাগল। আজকে আমার পায়ের প্লাস্টার খোলার তারিখ। নীল আমাকে আর নিরাকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন। হাসপাতালে গেইটে ঢুকতেই নীলের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। আমি কিছু বলে উঠার আগেই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here