বিপদ,পর্ব- ০১
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা
রাত বারোটা পাঁচ মিনিট। রাতের নিরবতায় পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। খানবাড়ির খাবার ঘর থেকে মুরগির চি চি শব্দ ভেসে আসছে। রেহানা খানমের কাঁচা ঘুম। সামান্য আওয়াজেই তার ঘুম ভেঙে যায়। আওয়াজের উৎস খুঁজতে তিনি বিছানা ছেড়ে নামলেন। সন্তর্পণে হেঁটে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন। টের পেলেন আওয়াজ খাবার ঘর থেকে আসছে। রান্নাঘর আর খাবার ঘর পাশাপাশি। রান্নাঘর পেরিয়ে খাবার ঘরে ঢুকতে হয়। রেহানা রান্না ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে খাবার ঘরের দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে তার বুক কেঁপে উঠল।
রেহানা খানমের মুরগি পালার শখ আছে। শখের বশবর্তী হয়ে তিনি চারটি মুরগি ও দুটো মোরগ পালেন। তারমধ্যে একটি বাচ্চাওয়ালা মুরগি। মোট এগারোটি বাচ্চা। বাচ্চা শুদ্ধ মুরগিটিকে রেহানা খানম আলাদা করে খাবার ঘরে পলো দিয়ে আটকে রেখেছিলেন। সেখান থেকে নিয়ে একটি বাচ্চা নাহিদা টুপ করে জ্যান্ত মুখে পুরে চিবোতে লাগল। তার মুখ পাংশুটে বর্ণের হয়ে আছে। পুরো মুখ রক্তে লেপ্টে। হাতে পায়ে চেহারায় কালশিটে দাগ। তার পেছনে মুশফিক দাঁড়িয়ে। তাকেও দেখতে ঠিক নাহিদার মতোই লাগছে। রেহানা খানম আর তাকিয়ে থাকতে পারলেন না।
_______ ______
সাল ২০০৪। বিক্রমপুরের ছোট্ট একটি গ্রাম গোয়ালিমান্দ্রা। সে গ্রামের একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার ভুঁইয়া পরিবার। পরিবারটির মাথা রফিক ভুঁইয়া। এই মূহুর্তে দুশ্চিন্তায় মাথা চেপে ধরে বসে আছেন তিনি। কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। তাদের গ্রামের চেয়ারম্যান মান্নান তালুকদার তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। রফিক ভুঁইয়া ভাবছে, নিশ্চয়ই তার বিচার হবে। গত বছর সে মান্নান তালুকদারের কাছ থেকে এক লাখ টাকা ধার নিয়েছিল। বছর পেরিয়ে গেছে তবু টাকাটা শোধ করতে পারেনি। ব্যাপারটা স্বাভাবিক। সংসারের এই টানাটানি পরিস্থিতিতে যেখানে নিজেদের দুবেলা অন্ন জোটেনা, সেখানে অত টাকা শোধ করতে পারার কথাও নয়।
আগে রফিক ভুঁইয়ার সংসারের অবস্থা এমন ছিল না। মেজো ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য ধার-দেনা করতে করতে এই অবস্থা। নয়তো রফিক ভুঁইয়ার গ্রামে একটা সম্মান ছিল। তার গ্রামে ছোটো একটা মুদির দোকান আছে। গ্রামের সকলে তার দোকান থেকেই মাসকাবারির সদাই কেনে। এতে তার সংসার বেশ ভালো ভাবেই চলে যেত। কিন্তু এখন ধার শোধ করতে করতেই সমস্ত টাকা শেষ হয়ে যায়।
যে ছেলের জন্য এত কিছু সে ছেলে বিদেশে গিয়ে বাবা-মাকে বেমালুম ভুলে বসে আছে। আর বড় ছেলে বিয়ের পর বউ নিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। মেজো ভাইয়ের মতো সেও মা-বাবার খোঁজ নেবার প্রয়োজন বোধ করে না। তাই বর্তমানে রফিক ভুঁইয়ার সংসারে মাত্র তিনজন সদস্য। সে, তার স্ত্রী এবং তার ছোটো মেয়ে তৃণা। ষোড়শী তৃণা ক্লাস টেইনে পড়ে।
রফিক ভুঁইয়াকে সারা ঘর জুড়ে পায়চারী করতে দেখে শাহিদা বেগম বললেন, ‘কি অইল আপনের? আর কতক্ষন ভাববেন? দেরি অইয়া যাইতাছে না? পরে তো চেরম্যান সাব আপনেরে কতা শুনাইব।’
রফিক ভুঁইয়া বিধ্বস্ত দৃষ্টিতে শাহিদা বেগমের দিকে তাকালেন। ‘ আমি এহন কী করি কও তো শাহিদা! চেরম্যান সাবের মুখোমুখি হইতে তো সাহস হইতাছে না।’
‘আপনে শুধুশুধু ভয় পাইতাছেন। আল্লাহর রহমতে কিছু অইব না, যান।’
প্রাণে সাহস সঞ্চার করে রফিক ভুঁইয়া ঘর থেকে বেরোন। যাবার পথে শাহিদার দিকে ফিরে তাকান। বলেন, ‘সন্ধ্যা অইয়া গেছে। এহন আর ঘর থিকা বাইর হইয়ো না। তৃণারে লইয়া দরজা আটকাইয়া ঘরে বইয়া থাকো।’
★
দ্রুত পায়ে হাটার ফলে রফিক ভুঁইয়া জলদিই মান্নান তালুকদারের বাসায় চলে আসেন। দেখেন তার বাড়ির উঠোনে বিশাল মাদুর পাতা। সেই মাদুর ভর্তি করে মানুষজন বসে আছে। সবগুলোই পুরুষ। মাদুরের বিপরীতে কাঠের চেয়ারে বসে আছেন মান্নান তালুকদার। রফিক ভুঁইয়ার বুক ধরফর করতে লাগল। বোধহয় তার বিচারের জন্যই মান্নান সাহেব গ্রামের সকল পুরুষদের তার বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছেন। ভয়ে ভয়ে রফিক ভুঁইয়া সেদিকে এগিয়ে গেলেন। তাকে দেখে মান্নান তালুকদার একপ্রকার খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘ মিয়া সেই কহন ডাকছি তোমারে আর তুমি এহন আইছো? তুমি কোনহানকার মন্ত্রী-ম্যাজিস্টেট যে তোমার লাইগা আমগো সবার অপেক্ষা করতে অইব?’
রফিক ভুঁইয়া কাঁচুমাচু হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মান্নান তালুকদার বললেন, ‘আইচ্ছা যাও বাদ দেও।এহন ওইহানে গিয়া বসো।’
তার কথামতো রফিক ভুঁইয়া মাদুরের কোনায় গিয়ে বসল।
মান্নান তালুকদার কথা শুরু করলেন। ‘যেই কারণে আজকে আপনেগো সবাইরে এইহানে ডাকছি। আপনেরা সবাই কী জানেন খান বাড়ির পোলা জাফর আমগো পাশের দেশ ভারতে ঘুরতে গেছে?’
মাদুরে বসা মানুষজন সমস্বরে বলল, ‘জি চেরম্যান সাব ।’
মান্নান তালুকদার আবার বললেন, ‘হেয় আজকে সকালবেলা সেইহান থিকা ফিরা আইছে। তয় ফিরার পর থিকাই সে অনেক আজব আচরণ করতাছে। যারে পায় তারেই কামড়াইয়া দেয়। কামড়াইয়া রক্ত বাইর কইরা ফেলে।’
মান্নান তালুকদারের কথা শেষ না হতেই সেখানকার উপস্থিত মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করতে লাগল। কেউ কেউ বলল, খান বাড়ির বড় ছেলে জাফর পাগল হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ বলতে লাগল, ভুতে ধরেছে তাকে।
তাদের কথা শুনে মান্নান তালুকদার বিরক্ত হলেন। সবার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললেন, ‘আমি কী আপনেগো এইহানে ডাকছি নিজেগো মধ্যে কতা কইতে?’
উপস্থিত মানুষগুলো চুপ হয়ে গেল। মান্নান তালুকদার আবার বললেন, ‘ এহন সবাই আসল কতাডা শোনেন। তেমন ভয়ের কিছু নাই। শুদু কয়ডা মাস একটু সাবধানে থাকবেন। খান বাড়ির আশেপাশেও যাওয়ার দরকার নাই। সন্ধ্যার পর বাইত থিকা বাইর অইবেন না। বুঝছেন সবাই?’
গ্রামবাসীদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান তারা ভাবল এ কথাই আসল কথা নয়। চেয়ারম্যান সাহেব কথায় কিছু রহস্য তো রেখেছেন! বাকি আমজনতা ভেতরে ভেতরে খানিক ভয় পেল। তবুও সবাই একসঙ্গে বলল, ‘ঠিকাছে।’
সবাই ভীত হলেও শুধু ভীত হলেন না রফিক ভুঁইয়া। পাওনা টাকার জন্য তাকে ডেকে আনা হয়নি বলে মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
★
খান বাড়ির সদস্য সংখ্যা মোট দশ জন। খান বাড়ির কর্তা আব্দুল খান, তার স্ত্রী রেহানা খানম এবং তাদের চার ছেলে ও বড় আর মেজো ছেলের বউ। মেজো ছেলের বউ অন্তসত্ত্বা। তাই বর্তমানে সে বাপের বাড়ি।
রাত সাড়ে সাতটা। মাত্র কিছুক্ষণ আগেই সন্ধ্যা পেরিয়েছে। প্রতিদিন এসময়ে সন্ধ্যাকালীন খাবারের ব্যবস্থা করতে থাকেন খান বাড়ির বউরা। কিন্তু আজকের সন্ধ্যাটা ব্যতিক্রম। আজ এবাড়িতে যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কিছুদিন আগে শখের বশে ঢাকাইয়া বন্ধুর সঙ্গে খান বাড়ির বড় ছেলে জাফর ইন্ডিয়া ঘুরতে গিয়েছিল। আজ সকালে সেখান থেকে ফিরে এসেছে। ফেরার পর থেকেই সে পাগলের মতো আচরণ করছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই কামড়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোনো সামান্য কামড়ে সে ক্ষান্ত হচ্ছে না। কামড়ে দাত দিয়ে খুঁচিয়ে মাংস উঠিয়ে ফেলছে।
সর্বপ্রথম তার কামড়ের শিকার হয় তার বউ নাহিদা। সকালে জাফর ঘরে ফিরে তার কাছে পানি চায়। নাহিদা পানি নিয়ে এসে জাফরের দিকে এগিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সে নাহিদার বাম হাতে কামড়ে দেয়। মূহুর্তেই নাহিদার হাত রক্তে ভেসে যায়। সে শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে জোরে চিৎকার দেয়। তার চিৎকার শুনে বাড়ির সকলে দৌড়ে আসে।
জাফরের মা রেহানা খানম বাড়ির বউদের জোরে কথা বলা অপছন্দ করেন। নাহিদার চিৎকার শুনে উনি রেগে গেলেন। বড় বউকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কী ব্যাপার বউমা? সকাল সকাল এমুন চেঁচামেচি করতাছো ক্যান? বাড়ির গুরুজনরা কী ভাবব সেইটা একবার ভাবছ?’
কথা শেষ হতেই তার চোখ পরে নাহিদার হাতের দিকে। জাফর তখনো নাহিদার হাত কামড়ে ধরে আছে। ওর হাত বেয়ে টপটপ করে রক্ত ঝরে পরছে। তাই দেখে উনি ভয় পেয়ে যান। পাশে দাঁড়ানো মেজো ছেলের হাত চেপে ধরেন। মেজো ছেলে আশফাক ও সেজো ছেলে মুশফিক দৌড়ে গিয়ে বড় ভাই জাফরকে ধরে।
পরিস্থিতি সামলাতে জাফরকে বেঁধে রাখা হয়। জাফরকে বাঁধতে গিয়ে মুশফিকও কামড়ের শিকার হয়।
তারপর দুপুর অব্দি সব ঠিকই ছিল। হঠাৎ দুপুর গড়াতেই নাহিদা ও মুশফিক দুজনেই জাফরের মতো আচরণ শুরু করে।
তখন খান বাড়ির সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। বাড়ির কাজের মেয়েটি রান্নাঘর থেকে খাবার এনে এগিয়ে দিচ্ছিল। নাহিদা তাকে ডাকে, ‘ আরিফা আরেকটু ভাত দিয়ে যা।’
কাজের মেয়েটি তার সামনে আসতেই হঠাৎ নাহিদা তাকে আক্রমণ করে বসে। তার ঘাড় কামড়ে ধরে। আচমকা মুশফিকও খাবার ফেলে দৌড়ে এসে মেয়েটিকে কামড়াতে থাকে। একপর্যায়ে দুজনে খুবলে খুবলে মেয়েটির ঘাড় ও হাতের অনেকখানি রক্ত-মাংস খেয়ে ফেলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি মারা যায়। তৎক্ষনাৎ দুজনে ওকে ছেড়ে দেয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় বাড়ির বাকি সদস্যরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ নাহিদা আর মুশফিক তাদের দিকে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে এক অদ্ভূত ভঙ্গিমায় এগিয়ে আসতে থাকে। ওদের দুজনকে এগিয়ে আসতে দেখে তাদের টনক নড়ে। তারা প্রাণপণে দৌড়ে বাইরে চলে আসে। তারপর খাবার ঘরের দরজা বাইরে থেকে আটকিয়ে তালা মেরে দেয়। তখন থেকেই মুশফিক ও নাহিদা খাবার ঘরে বন্দী। আর জাফর তার নিজের ঘরে। বাড়ির তিন সদস্যের এমন বিচিত্র বেহাল অবস্থার কারণে খান বাড়ি একপ্রকার মরা বাড়িতে পরিণত হয়েছে।
চলবে…