বিপদ,পর্ব- ০৩

0
834

বিপদ,পর্ব- ০৩
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা

নিশুতি রাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এ পাড়ায় ইলেক্ট্রিসিটি নেই। সামনের কয়েকটা বাড়ি পেরোলেই কবরস্থান। তারপর অন্য পাড়া। সেখানে গ্রামের চেয়ারম্যান মান্নান তালুকদারের বাড়ি। তাদের বাসায় ইলেক্ট্রিসিটি তো আছেই, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটরের ব্যবস্থাও আছে। বাড়িটার পর মেইন রাস্তা। রাস্তাটা পেরোলেই রফিক ভুঁইয়ার দোকান। তৃণা মনে মনে সূরা পড়তে লাগল। এমনিতেই সে ভীতু। তার ওপর এমন রাতের বেলা অন্ধকারে বাইরে বেরিয়েছে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই।

সাতটার সময় শাহিদা বেগম বেরিয়েছিল। রফিক ভুঁইয়ার দোকানে যাবার জন্যে। রাত নয়টা বেজে গেছে। তবুও ফেরেনি। তাই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে মা’কে খুঁজতে বেরিয়েছে তৃণা।
ওর হাতে ছোটো একটা টর্চ লাইট। এটার বয়স প্রায় ছয় বছর। বিদেশ থেকে তার ছোটো চাচা শফিক পাঠিয়ে ছিল। বিয়ের আগে বড় ভাইয়ের বেশ খোঁজ খবর রাখত। চার বছর হতে চলল শফিক বিয়ে করেছে। এখন নিজের সংসার ছেড়ে অন্যের সংসারে নজর দেয়ার সময় কোথায়!

ঠান্ডা বাতাস বইছে। বৃষ্টি হবে নিশ্চয়ই। তৃণা দ্রুত পায়ে হাটতে লাগল। কবরস্থান পার হবার সময় টের পেল তার বুক ধুকপুক করছে। তৃণার চোখ পরল সবচাইতে কর্নারের কবরটার ওপর। কঞ্চির বেড়া দেয়া চারপাশে। সেটার ওপর টর্চের আলো ফেলল। টর্চলাইটের আলোয় কবরটাকে যেন আরো ভৌতিক দেখাচ্ছিল। কিন্তু ওর ভয় লাগল না। উলটো দু’চোখ ঝাপসা হয়ে এল। ওটা ওর দাদীর কবর।

তখন তৃণা ক্লাস নাইনে পড়ে। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে বায়না ধরে সেদিন স্কুলে যাবে না। বাবার সঙ্গে দোকানে যাবে, বাবার দোকানদারি দেখবে। ফলে মা রেগে যান। তেড়ে লাঠিপেটা করতে আসেন। দাদী এসে তাকে থামায়। তৃণাকে বুকে জড়িয়ে বলে, ‘খবরদার আমার নাতনির গায়ে যাতে একটা ফুলের টোক্কাও না লাগে।’
তৃণা ছিল তার দাদীর চোখের মণি। তাই মা ওকে আর কিছু বলে না।
কে জানতো সকাল বেলার জলজ্যান্ত মানুষটা দুপুর গড়াতেই স্ট্রোক করে এমন টুক করে মরে যাবে!

তৃণার গাল বেয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরল। কবর থেকে চোখ সরিয়ে ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছে নিল। সেখানে আর দাঁড়াল না। কয়েক কদম এগোতেই অকস্মাৎ তৃণার মনে হল, মাটি কাঁপছে। ভূমিকম্প শুরু হল না-কি! নাহ ঠিক সে রকম নয়। মনে হচ্ছে কাছেই মাটিতে খুব ভারী কিছু একটা দাপড়াচ্ছে। সত্যিই কী এমন হচ্ছে! না-কি সে ভীত হয়ে আছে বলে এমনটা মনে হচ্ছে! তৃণা হাটার গতি কমিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল। টের পেল মাটিতে কিছু একটা দাপড়াচ্ছে না, দৌঁড়াচ্ছে। তৃণা আশ্চর্য হল। এ রাতের বেলা কারা এমন দৌড় ঝাপ করবে!

সকাল বেলা বাবার নিষেধ শোনেনি আহাদ। ফলস্বরূপ সে এখন স্কুলে বন্দী হয়ে আছে।
সকালে সে যখন ক্লাসে প্রবেশ করে তখন তার দিকে সবাই এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল যেন ভূত দেখেছে। কেউ কেউ টিটকিরি মেরে বলে, ‘ওই দেখ পাগলের ভাই পাগল আইতাছে!’ সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের বাকি সবাই হেসে দেয়। অথচ এ ঘটনার আগে সবাই ওকে কত সম্মান করত। সে ছিল ক্লাসের হেড। খান বাড়ির ছেলে কি-না! আর এখন! ভাগ্যের পরিহাসে আহাদের হাসতে কাঁদতে দুটোই একসঙ্গে করতে ইচ্ছে করল।

ক্লাস শেষে ছুটির ঘন্টা পরলে সবাই বাসায় চলে যায়। শুধু যায় নি সে৷ মন খারাপ করে ক্লাসের কোনার একটি বেঞ্চিতে বসে ছিল। মন ভালো করার উদ্দেশ্যে অংক কষতে শুরু করে । কিছু সময় পেরোতেই আহাদ সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। তরিঘড়ি করে রুম থেকে বেরোতে গিয়ে দেখে দরজা বাইরে থেকে আটকানো। নিশ্চয়ই দারোয়ান চাচা বরাবরের মতো রুম চেক না করেই তালা মেরে গেছে। এজন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে এত বকা খায় তবুও তার বদঅভ্যাস গেল না। মনে মনে দারোয়ানকে কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিল আহাদ। আজ তার জন্যই আহাদকে ক্লাসে আটকা পরে থাকতে হচ্ছে।
সারাদিন না খেয়ে থাকায় শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছে তার। ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল আহাদ। নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।

খান বাড়ির একের পর এক দূর্ঘটনায় আব্দুল খান বিরক্ত। এই বয়সে এত ধকল তার শরীর আর নিতে পারছে না। বাড়ির বড় ছেলে, বড় ছেলের বউ, মুশফিক এক অদ্ভূত রোগে আক্রান্ত। বলা যায় পাগলই হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে একজন আবার উধাও। কাজের মেয়েটা মরে গিয়ে না-কি জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। এরমধ্যে আবার ছোটো ছেলে আহাদকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
আব্দুল খানের মনে হচ্ছে এই সংকটময় পরিস্থিতিতে তার বুদ্ধিও বোধহয় লোপ পেয়েছে। কিছুই মাথায় আসছেনা তার।

আব্দুল খান বাড়ির মালি মাসুমকে ডাকল। মাসুম পাঁচ বছর যাবৎ এ বাড়িতে কাজ করছে। খান বাড়ির বিশাল বাগানের দেখাশোনা সেই করে। তার বয়স অল্প। তেইশ বছর কেবল। এই বয়সেই বিয়ে করে সংসার পেতে ফেলেছে। একটা ছ’মাসের বাচ্চাও আছে। তাদের ভরণপোষণের জন্যে পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। তবুও সংসারে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা।

মাসুম খেতে বসেছিল। খান বাড়িতে গতকালের রান্না হওয়া অনেক খাবার বেঁচেছে। তাই খান সাহেবা বলেছে রাতে খেয়ে যেতে। আর যাওয়ার সময় বাকি খাবার নিয়ে যেতে। শুনে অনেক খুশি হয়েছে সে। বিয়ে হবার পর থেকেই তার বউ হামিদা ছাইপাঁশ খেয়েই দিন কাটিয়েছে। ভালো খাবার চোখে দেখে না কতদিন! আজ একটু ভালো মন্দ খেতে পারবে মেয়েটা।
ভাবনার মাঝেই হঠাৎ শুনতে পেল খান সাহেব ডাকছে। তৎক্ষনাৎ হাত ধুয়ে দৌড়ে গেল সে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘জী সাহেব।’

আব্দুল খান বললেন, ‘তর একটা কাজ করতে হইব।’

মাসুম জানতে চাইল, ‘কী কাজ, সাহেব?’

‘পুরা এলাকা তন্নতন্ন কইরা খোঁজ। দেখ আহাদ কই। হেই সকাল বেলা উধাও হইছে আর কোনো খবর নাই।’

মাসুম মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আইচ্ছা সাহেব।’

আব্দুল খানের আদেশে মাসুম ওই অবস্থাতেই বেরিয়ে গেল।

মাসুমের অর্ধেক এলাকা খোঁজা হয়ে গেছে। কোথাও আহাদের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। রাস্তার ওই পারটা খুঁজবে কি-না ভেবে মেইন রোড পেরোলো। কিছুদূর হেটে এগোতেই দেখতে পেল বটতলায় কেউ একজন বসে আছে। অন্ধকারের কারণে চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। মাসুম লোকটার মুখের ওপর টর্চের আলো ফেলল।
লোকটা কিছু একটা খাচ্ছিল। মুখের ওপর আলো পরতেই মাসুমের দিকে ফিরে তাকাল। লোকটার মুখের চারপাশে রক্ত লেগে আছে। মাসুম চমকে দু’কদম পিছিয়ে গেল। লোকটা আর কেউ নয় খান বাড়ির বড় ছেলে জাফর!
কী খাচ্ছিল সে! মাসুম মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল সে যেটা ভাবছে তা যেন না হয়। কাঁপা কাঁপা হাতে মাসুম লাইটের আলো নিচের দিকে ফেলল। দেখতে পেল একটা মানুষ দাপড়াচ্ছে। মানুষটাকে মাসুমের চেনা চেনা লাগল। ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝতে পারল মানুষটা এ গ্রামের মুদি দোকানদার রফিক ভুঁইয়া। তার ঘাড়ের অংশ রক্তাক্ত হয়ে আছে। কিছু জায়গা জুড়ে মাংস নেই। ভয়ে মাসুমের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। সে বুঝতে পারল জাফরই রফিক ভুঁইয়াকে কামড়ে মেরে ফেলেছে। সে আর দাড়িয়ে থাকার মতো ভুল করল না। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে দৌড় দিল। কিন্তু ভাগ্য বোধহয় তার সহায় ছিল না।
মাসুম সামনের কিছু একটায় পা আটকে মাটিতে পরে গেল। তার হাতের টর্চলাইটটা দূরে ছিটকে পরে জ্বলেই রইল। সেই আলোয় দেখতে পেল, সে একটা লাশের ওপর এসে পরেছে। লাশটার দিকে তাকাতেই দেখল সেটা রফিক ভুঁইয়ার স্ত্রী শাহিদা বেগম।
মাসুম দ্রুত লাশটার ওপর থেকে উঠতে নিল। লাশটা আচমকা জ্যান্ত হয়ে উঠে বসল। বসেই তাকে পেছন থেকে টেনে ধরল। সে আবার মাটিতে পরে গেল। তবুও মাটির ওপর থেকে উঠার চেষ্টা করল। পারল না। লাশটা পেছন থেকে তাকে দু’হাত দিয়ে খামচিয়ে ধরে অকস্মাৎ ঘাড়ের ওপর কামড়িয়ে ধরল। নারকীয় যন্ত্রণায় মাসুম ছটফট করতে লাগল। নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হল না।
শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গেলে একসময় সে হাল ছেড়ে দিল। শেষ নিশ্বাসটুকু নেবার সময় মাসুম ক্ষীন দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকাল। দেখল জাফর এবং একটু আগেই মরে যাওয়া রফিক ভুঁইয়া দৌড়ে তার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে।

আহাদ ক্লাসরুমে বন্দী হয়ে টেবিলের ওপর মাথা রেখে বসে ছিল। হঠাৎ স্কুল গেইটের সামনে কিছু হুড়মুড়িয়ে পরার শব্দে সে চমকে যায়। ঘটনা বুঝতে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে উঁকি দেয়। কিন্তু অন্ধকারের কারণে কিছু দেখতে পায় না।
রুমের ভেতর এতক্ষণ অন্ধকারেই বসে ছিল সে। এখন উঠে গিয়ে সুইচ চেপে আলো জ্বালাল। আলো জ্বলে উঠতেই আহাদের ক্লাসরুমের পেছনের দরজার দিকে চোখ পরল। দেখল দরজা ভেতর থেকে লাগানো। কী মনে করে ও দরজার শিটকিনি খুলল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা হা হয়ে খুলে গেল। আহাদ নিজেকে ধিক্কার জানাল। কি গাঁধা সে! একটাবার চেষ্টা করে দেখতে পারল না পেছনের দরজা খোলা যায় কি-না! তাহলে তো আর বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্লাসরুমে এমন বন্দী হয়ে বসে থাকতে হতো না!

মনের চিন্তা মনেই ঝেড়ে ফেলল আহাদ। বাইরের ঘটনা জানার জন্য কৌতুহলী হল। স্কুলের গেইটের সামনে একটা তিনশো ওয়াটের এনার্জি বাল্ব লাগানো। আহাদ সিড়ির সামনে গিয়ে সুইচ চেপে সেটা জ্বালাল। তারপর স্কুলের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বাল্বের ধবধবে সাদা আলোয় দেখতে পেল দাড়োয়ান চাচা মাটিতে পরে আছে। তার শরীর রক্তে মাখামাখি। দুটো ফ্যাকাশে বর্ণের মানুষ তাকে কামড়ে ধরে আছে। মূহুর্তেই আহাদের মনে পরল তার বড় ভাই জাফরের কথা। এই লোকগুলো জাফরের মতো আচরণ কেন করছে! আহাদ মনে মনে ভাবল তার বড় ভাই জাফরেরই কাজ নয়তো এটা! জাফরই কী সুস্থ স্বাভাবিক মানুষগুলোকে কামড়ে এমন পিশাচ বানিয়ে দিয়েছে! হঠাৎ তারা আহাদের দিকে তাকাল। এক অজানা আশংকায় ওর বুক কেঁপে উঠল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here