বিপদ,পর্ব- ০৪

0
869

বিপদ,পর্ব- ০৪
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা

রাত ন’টা বিশ মিনিট। চারপাশ স্তব্ধ হয়ে আছে। গ্রামের হিসেবে এ সময়টা গভীর রাতের প্রারম্ভ। রাত ন’টা বাজতে না বাজতেই সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পরে। অন্যদিন হলে হয়তো তৃণাও এটাই করত। কিন্তু আজকের রাতটা সেরকম নয়। আজ সে কবরস্থানের সামনে টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে।

কিছু একটা দৌড়ানোর শব্দ পেয়ে তৃণা পেছন ফিরে তাকায়। শব্দটা যেন ধীরে ধীরে আরো কাছে আসছে। ও সেদিকে টর্চের আলো ছুড়ল। আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে বস্তুটা। না বস্তু নয়! বস্তুগুলো! অনেকগুলো মানুষ! দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে দৌঁড়াচ্ছে। তারা এভাবে এগিয়ে আসছে কেন! তৃণা বুঝতে পারল না। সে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়ল তারা। টর্চের আলোয় ও দেখতে পেল, মানুষগুলো দেখতে ঠিক মানুষের মতো নয়। মানুষ কিন্তু কেমন ফ্যাকাশে সাদা বর্ণের। কালশিটে দাগে পূর্ণ শরীর।
হঠাৎ ওর চোখ পরল তাদের মুখের ওপর। কী আশ্চর্য তাদের ঠোঁটের আশেপাশের স্থান এমন টকটকে লাল কেন? মনে হচ্ছে রক্তের মতো চটচটে ভেজা কিছু লেগে আছে! অকস্মাৎ ওর মনে প্রশ্ন এল। রক্তই নয় তো!
তৃণার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক মুহূর্তেই ভেবে নিল অনেক কিছু। বোকার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তৎক্ষনাৎ টর্চের আলো নিভিয়ে দিল। যেন মানুষের মতো দেখতে কিন্তু ঠিক মানুষ নয় লোকগুলো বুঝতে না পারে। যে সে এখানে। সে নিঃশব্দে হেঁটে কবরস্থানের দেয়ালের ওপাশে লুকিয়ে পরল। কিছুক্ষণ বাদেই শুনতে পেল লোকগুলোর পায়ের শব্দ। মুখ দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ বের করতে করতে তারা ওর পাশে চলে এল। কিন্তু থামল না। হয়তো ওকে দেখেনি বলে! একইরকম ভঙ্গিতে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

কয়েক মিনিট বাদে তৃণা বেরিয়ে এল। সে নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না। ওগুলো কী ছিল! ভূত? পিশাচ? না-কি অন্যকিছু!

রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। তৃণা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় নানারকম ভাবনা আসছে তার। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। যেকোনো একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু সে কিছুতেই বুঝতে পারছে তার এখন কোন দিকে যাওয়া উচিত। বাবার দোকানে যেতে হলে সেদিকে যেতে হবে, যেদিকে ওই অদ্ভূত মানুষগুলো গেল। আর যদি বিপরীত পাশে যায় তাহলে তো আর মা-বাবাকে খোঁজা হবে না।
সিদ্ধান্তহীনতায় তৃণা নিজের মাথার চুল টানতে লাগল। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বান্তনা দিল। মনে মনে বলল, সে সেদিকেই যাবে যেদিকে ওই লোকগুলো গেল। তাকে তার বাবা-মাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
টর্চের আলো জ্বালিয়ে তৃণা নিজের গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল। কিছু মুহূর্ত পরই অন্য পাড়ায় এসে পরল। পাড়ায় ঢুকতেই হান্নান তালুকদারের বাড়ি। চেয়ারম্যান মান্নান তালুকদারের বড় ভাই হান্নান তালুকদার। সে মোটেও চেয়ারম্যানের মতো অমন কাটখোট্টা নয়। গ্রামের সকলের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক।
তৃণা দেখল হান্নান তালুকদারের বাড়ির দরজা খোলা। বাড়ির কার্নিশে তিনি পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। তৃণা বিস্মিত হল। পুরো পাড়া ঘুমিয়ে। অথচ হান্নান তালুকদার জেগে একা কার্নিশে বসে আছেন! ব্যাপারটা ঠিক ভালো ঠেকল না তার কাছে।
কিন্তু কয়েক সেকেন্ড বাদেই দুঃশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলল। এই ভুতুড়ে পরিবেশে পরিচিত মানুষ দেখতে পেয়ে খুশি হল। হান্নান তালুকদারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘চাচা, এত রাইত্তে বাইরে বইয়া আছেন ক্যান? ঠান্ডা বাতাস ছাড়ছে। পরে আপনের শইল খারাপ অইব।’

হান্নান তালুকদার উত্তর দিলেন না। থম মেরে বসে রইলেন। তৃণা আবার বলল, ‘চাচা আপনের কী অইছে? ‘

এবারো কোনো উত্তর এল না। তৃণা এবার কাজের কথায় এল। ‘ও চাচা, আমার মায়রে এদিক দিয়া যাইতে দেকছেন?’

আশ্চর্যজনক ভাবে হান্নান তালুকদার চুপ করেই রইলেন। তৃণা ভীষণ অবাক হল। ভাবল, চাচার কী হল হঠাৎ! তিনি ঠিক আছেন কি-না দেখার জন্য তার দিকে টর্চের আলো ছুড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি গড়গড় আওয়াজ করতে করতে তৃণার দিকে এগিয়ে এলেন। ঠিক ওই লোকগুলোর মতন দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে। তৃণা ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু অবাক হল না। যখন এত বার ডাকার পরেও হান্নান উত্তর দিচ্ছিলেন না। তখন তৃণা মনে মনে ভয়ংকর কিছুর জন্যই নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিল। হান্নান তালুকদারের মুখের দিকে তাকিয়ে তৃণা নিশ্চিত হল। তিনি ঠিক ওই লোকগুলোর মতোই আচরণ করছেন। কোনো কিছু না ভেবেই ও প্রাণপনে দৌঁড়াতে লাগল। একটাবারও পিছু তাকাল না। কিন্তু হঠাৎই গ্রামের একমাত্র পরিত্যক্ত কুড়েঘরের উঠোন দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ একজন ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে তৃণাকে টেনে ধরল। মুহূর্তেই হাত দু’টি ওকে ভেতরে নিয়ে গেল।

(গোয়ালিমান্দ্রা সরকারি স্কুল)

লোকগুলো আহাদের দিকে তাকাতেই ওর বুক ধ্বক করে উঠল। আচমকা দাড়োয়ানকে ছেড়ে তারা ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আহাদ পালানোর উদ্দেশ্যে উল্টো দিকে দৌড় দিল। তাড়াহুড়ো করে স্কুলের সিড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।
দোতলায় উঠে করিডর দিয়ে দৌড়াবার সময় আহাদ এদিক ওদিক দেখতে লাগল। কোনো রুম খোলা কি-না। লুকোনোর জায়গা আছে কি-না। কিন্তু ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয়। ইতোমধ্যে সে বারান্দার সর্বশেষ রুমের সামনে এসে পৌঁছেছে। অথচ সেটি তালাবদ্ধ। পিশাচ লোকগুলো সিড়ি বেয়ে করিডরের সামনে এসে গেছে। তারা দ্রুতগতিতে আহাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের রক্তমাখা মুখ দেখে ওর গা শিউরে উঠল। এখন যদি সে এখান থেকে পালাতে না পারে তাহলে নির্ঘাত মারা পরবে। লোকগুলো তার রক্ত শুষে নেবে। শেষমেশ সেও মরে গিয়ে জ্যান্ত হয়ে উঠবে। একটাসময় তাদের মতো অস্বাভাবিক হয়ে যাবে। তারপর সুস্থ স্বাভাবিক মানুষদের কামড়ে খাবে। নাহ এসব ভাবতেও চায় না সে।

আহাদের পেছনে বারান্দার শেষ রেলিং। সামনে পিশাচের মতো মানুষগুলো। একমাত্র বাঁচার রাস্তা তালাবদ্ধ রুমটি। আহাদ চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করল। পরক্ষণেই চোখ খুলে এদিক ওদিক চোখ বুলাতে লাগল। নিচের দিকে চোখ পরতেই খেয়াল করল অর্ধেক ভাঙ্গা ইট! নিশ্চয়ই ক্লাসের কোনো ছাত্র এনে রেখেছে। বাতাসের বিরুদ্ধে দরজায় ঠিকা দেবার জন্যে। আহাদ তড়িঘড়ি করে ইটটি হাতে নিয়ে তালায় বারি দিতে লাগল। লোকগুলো ওর কাছাকাছি এসে গেছে। কিন্তু তালা খোলার নাম নেই। যেকোনো সময় লোকগুলো ওর ওপর ঝাপিয়ে পরবে।
লোকগুলো একদমই তার কাছে। আচমকা তার ওপর ঝাপিয়ে পরল। তৎক্ষনাৎ আহাদ সরে গেল। তালা খুলে গেছে। ভেতরে ঢুকে পরেছে সে। তবে দরজা আটকাতে পারেনি। লোকগুলো দরজা ঠেলতে লাগল। তারা যেভাবে দরজা ঠেলছে তাতে করে তারা যেকোনো মুহূর্তে ভেতরে ঢুকে পরবে। আহাদ শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ভেতর থেকে দরজা ঠেলতে লাগল। একহাত দিয়ে দরজার ওপরের ছিটকিনি লাগানোর চেষ্টা করল। কিন্তু অনবরত ধাক্কার ফলে দরজা পুরোপুরি লাগছিল না। ফাঁকা হয়ে থাকছিল। আহাদ পেরে উঠছে না লোকগুলোর সঙ্গে। তবুও হাল ছাড়ছে না। হাতের সঙ্গে সঙ্গে ডান পা দিয়েও দরজা ঠেলতে শুরু করল সে। অপরদিকে ডান হাত দিয়ে ছিটকিনি লাগানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখল। ভাগ্যের পরিহাস! পিশাচ লোকগুলোর একজন একটা হাত দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বাঁচার শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হল বোধ হয়! কিন্তু নাহ। আহাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছে বোধহয় পিশাচ লোকগুলোর পৈশাচিক শক্তির চেয়েও বেশি। আহাদ হাতটাকে দরজা দিয়ে চেপে আঘাত করার চেষ্টা করল। নিজেকে অবাক করে দিয়ে সফলও হল। পিশাচ লোকটা হাত বাহিরে নিয়ে নিল৷ সঙ্গে সঙ্গে আহাদ দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে ফেলল।
স্কুলের ময়লা পাকা মেঝেতে ধপ করে বসে পরল সে। লাগামহীনভাবে আল্লাহ’কে শুকরিয়া আদায় করতে লাগল। আর নিজেকে দোষারোপ করতে লাগল। কেন যে বাবার কথা শুনল না! তাহলে আজকে আর এই দিনটা দেখতে হত না।
সন্তানরা বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে কেবল নিজের দুঃখই ডেকে আনে।

তৃণাকে ভেতরে টেনে নিয়েই আগন্তুক দরজা আটকে ফেলল। হান্নান তালুকদার ওকে খুঁজে না পেয়ে অদ্ভূত ভঙ্গিমায় হেটে ফিরে যেতে লাগল। তিনি চলে যেতেই আগন্তুক বলে উঠল, ‘বান্ধবী ঠিক আছস?’

তৃণা আগন্তুকের কন্ঠে চমকে উঠল। প্রিয়ার কন্ঠস্বর!
প্রিয়া চেয়ারম্যানের একমাত্র মেয়ে। আর তার সবচাইতে ভালো বান্ধবী! চাচার মতো সেও মোটেও বাবার স্বভাব পায়নি। তাইতো সামাজিক মর্যাদার এত তফাৎ উপেক্ষা করে নিম্নবিত্ত তৃণার সাথে মেশে।

তৃণা বিস্ময়ের সপ্তম চূড়ায় পৌঁছে গেল। তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘প্রিয়া তুই?’

‘হ আমি। তুই ঠিক আছস তো?’

তৃণা মাথা নাড়ল। উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘ আমি ঠিক আছি। তুই এইহানে কী করছ? আর গ্রামডার এই অবস্তা ক্যান? হান্নান চাচার কী অইছে? সবাই এমুন করতাছে ক্যান?’

প্রিয়া ওর কাঁধে দু’হাত রাখল। বলল, ‘সব কমু। আগে তুই শান্ত হ।’

তৃণা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু এত কিছু ঘটার পর নিজের কৌতুহলকে আর দমাতে পারল না। প্রিয়াকে বলল, ‘একটু তাড়াতাড়ি ক বান্ধবী। আমার অনেক চিন্তা অইতাছে।’

প্রিয়া জবাব না দিয়ে কাঁদতে লাগল। হঠাৎ কান্না থামিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল, ‘ তর আমার দুইজনেরই বাপ-মা মইরা গেছে।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here