বিপদ,পর্ব- ০৬

0
994

বিপদ,পর্ব- ০৬
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা

গতকাল রাত থেকে প্রিয়া, তৃণা এই কুড়েঘরটায় আটকে আছে। গতপরশু থেকে বাবা-মায়ের মৃত্যুর শোকে দুজনে উন্মাদের মতো কান্নাকাটি করেছে। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পরেছে খেয়াল নেই। তৃণার ঘুম ভাঙ্গতেই খেয়াল হল চোখ জ্বলছে। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। অনেকক্ষণ কাঁদার ফলে হয়তো! বসা থেকে উঠতে গিয়ে খেয়াল করল তার কাঁধে মাথা রেখে প্রিয়া ঘুমুচ্ছে। প্রিয়ার দু’গালে সরু শুকনো জলের রেখা। তৃণা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কেন তাদের সাধারণ সুন্দর জীবনটা এমন এলোমেলো হয়ে গেল! আচ্ছা তারা কি কোন অন্যায় করেছে? যার জন্যে জীবন এমন বিভীষিকাময় হয়ে উঠল!

গতকালের রাত পেরিয়ে দিন চলে এসেছে। সেই দিন শেষে আজকের রাতও চলে এল। এতটা সময় তারা নরখাদকগুলোর ভয়ে এ ঘরটাতেই বন্দী হয়ে ছিল। কিন্তু আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না এই কুড়েঘরে। ঘর একদম নড়বড়ে। কখন ভেঙ্গে যায় বলা যায় না। নরখাদকগুলো যদি একবার টের পেয়ে যায় তারা এখানে তাহলে নিশ্চিত হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে ঢুকে পরবে। ইতি-উতি ভেবে তৃণা প্রিয়াকে ডাকল, ‘প্রিয়া? ওই প্রিয়া উঠ!’

দু’ডাকেই প্রিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, তৃণা ডাকছে। দুয়েক সেকেন্ড সময় লাগল প্রিয়ার পুরো ব্যাপারটা বুঝতে। ধীরে ধীরে তার মনে পরল সে এখানে কীভাবে, কেন এসেছে। মা-বাবার কথা মনে পরতেই ওর বুকটা ধ্বক করে উঠল। হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করল ও। সাথে সাথে তৃণা ধমকে উঠল। ‘চুপ! একদম চুপ! কাঁনবি না খবরদার! এহন আমগো কান্দনের সময় না!’

আচমকা ধমকে প্রিয়া হকচকিয়ে গেল। তবে বুঝতে পারল তৃণা ঠিকই বলছে। এখন শত কান্নাকাটি করেও বা কী লাভ! তাদের মা-বাবা কি আর ফিরে আসবে! কিন্তু মন তো আর মানে না!

তৃণা আবার বলল, ‘আমগো এহন এইহান থিকা বাইর অইতে হইব। ‘

প্রিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যান?’

তৃণা ভ্রু কুঁচকে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কুড়েঘরটির একমাত্র জানালাটি খুলতে খুলতে বলল, ‘যেকোনো সময় পিশাচগুলি ঘর ভাইঙ্গা ভিতরে ঢুইক্কা পরব। তার আগেই আমগো নিরাপদ জায়গায় পালাইতে অইব।’

প্রিয়া সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল।

অদ্ভূত শান্ত পরিবেশ। কোথাও কোনো শব্দ নেই। পৃথিবী থমকে আছে। শুধু কোত্থেকে যেন নরখাদকগুলোর গর্ গর্ আওয়াজ ভেসে আসছে।
তৃণা আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘কিন্তু নিরাপদ জায়গা কই পাম!’

প্রিয়া বলল, ‘আমি জানি!’

তৃণা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী?’

‘একটা নিরাপদ জায়গা আছে।’

তৃণা অবাক হল। ‘কই প্রিয়া? কোন জায়গার কথা কস তুই?’

‘আমগো বাসা।’ উত্তর দিয়ে প্রিয়া থামল। কিছুক্ষণ বাদেই আবার বলল, ‘তৃণা এই গ্রামে কয়ডা ইটের দালান?’

তৃণা জবাব দিল, ‘দুইডা। একটা চেয়ারম্যান চাচার বাড়ি মানে তগো বাড়ি, আরেকটা খান বাড়ি। ক্যান ক তো?’

‘শোন এই গ্রামে দুইডা দালান বাদে বাকি সব কাঠের ঘর। কাঠের ঘরে যদি আশ্রয় নেই আমরা তাইলে কী অইব জানস? জোম্বিগুলি যদি একবার দেখতে পায় আমগো সহজেই ঘর ভাইঙ্গা ঘরে ঢুকব। কিন্তু ইটের দালানে তো আর ভাঙ্গচুর কইরা ঘরে ঢুকতে পারব না। একবার ঘরে ঢুকতে পারলেই আমরা নিরাপদ। ‘

‘হ। কিন্তু আমরা এতদূর কেম্নে যামু! সামনে কতগুলি বাড়ি, তারপর মেইন রাস্তা, তারপরে আমাগো স্কুল তারপরে তগো বাড়ি। এতখানি রাস্তা আমরা জোম্বিগো কেমনে ফাঁকি দিমু!’

প্রিয়া উত্তর দিল, ‘কেমনে দিমু সেইডা বড় কথা না। বাঁচতে অইলে আমগো যে দিতে অইবই।’ তারপর আবার বলল, ‘তুই না প্রত্যেক বছর আমগো স্কুলে দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম অস?’

তৃণা মাথা নাড়াল। ‘হ, ক্যান?’

প্রিয়া বলল, ‘আজকেও তরে প্রথম হইতে অইব।’

__________

প্রায় দু’দিন দু’রাত পেরিয়ে গেল আহাদের অনাভুক্ত অবস্থায়। দূর্বল শরীরে নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও যেন নেই। এ দু’দিন স্কুল ছেড়ে বের হবার কোনোরকম সুযোগ পায়নি সে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! আধ বোতল পানি দিয়ে এ দু’দিন পিপাসা মিটিয়েছে। এখন তো আর সেটুকুও নেই। শীঘ্রই স্কুল থেকে বেরোতে না পারলে অনাহারে, পিপাসায় এই ক্লাসরুমেই পঁচে মরতে হবে তার।

এখন গভীর রাত। বারোটা পেরিয়ে গেছে। এই রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়েই তাকে পালাতে হবে। কিন্তু কোথায় যাবে সে! এই গ্রামে কি এমন নিরাপদ কোনো জায়গা আছে যেখানে জোম্বি নেই! এর উত্তর তার জানা নেই। কিন্তু সে জানে তাকে আজকের রাতের ভেতর এই স্কুল ছেড়ে পালাতে হবেই। নয়তো মৃত্যু অবধারিত। হয় জোম্বিদের হাতে না-হয় অনাহারে, পিপাসার্ত হয়ে!

যেই ভাবা সেই কাজ। আহাদ প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। স্কুল ব্যাগটাকে রেখে যেতে তার মায়া লাগল। তেমন ভারী নয় ব্যাগটা। ভেতরে শুধু দুটি বই, একটি খাতা। তাই ব্যাগটাকে কাঁধে চাপিয়ে নিল ও। ক্লাসরুমের বাইরে আলো জ্বলছে। গত পরশু রাতে এনার্জি বাল্বটাকে সেই জ্বালিয়েছিল। স্কুল গেইটের সামনেও আলো জ্বলছে। সেই আলো পুরো স্কুলটাকে আলোকিত করে রেখেছে।
তাকে সবার আগে পুরো স্কুলের আলো গুলো নেভাতে হবে। নয়তো এত আলোর ভেতরে সে নরখাদকগুলোর চোখ কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারবে না।

দরজার সামনে থেকে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে আহাদ বেঞ্চিগুলো সরাতে আরম্ভ করল। তারপর ক্লাসরুমের ভেতরের আলো নিভিয়ে দিল। ভেতর থেকে একটা জানালা খুলে বাইরের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করল সে। মাঠের ওপর কয়েকটা জোম্বি গর্ গর্ ধ্বনি তুলে মৃদু কাঁপতে কাঁপতে হাঁটছে। সে যদি এখন ক্লাস থেকে বেরোয় তাহলে নিশ্চয়ই বারান্দার বাল্বের আলোতে জোম্বিগুলো তাকে দেখে ফেলবে। তারপর তার ওপর আক্রমণ করবে।
আহাদ মাথা চুলকালো। ভাবল, এই স্কুলের ট্রান্স মিটার সামনের সিড়ির পেছনের দেয়ালে। যেটা এই ক্লাসরুমের সামনেই । তাকে জোম্বিদের নজর এড়িয়ে সেখানে গিয়ে মিটারটার মেইন সুইচ অফ করতে হবে। এতে পুরো স্কুল অন্ধকার হয়ে পরবে। তাহলেই একমাত্র পালানো সম্ভব।
কিন্তু সে জোম্বিদের চোখ এড়াবে কীভাবে! চট করে আহাদের মাথায় একটা বুদ্ধি এল। ও ধীরপায়ে দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরোলো। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে যতটা দূরে সম্ভব ছুড়ে মারল। বোতলটা স্কুলের শেষপ্রান্তের দারোয়ানের টিনের ঘরে গিয়ে বারি খেল, যেটা পাহারাদার এবং দারোয়ানদের রাতে থাকার জন্য থাকার জন্য তৈরি। আওয়াজ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে জোম্বিগুলো সেদিকে দৌড়ে গেল। আহাদ একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেল। সে নিঃশব্দে দৌড়ে সিড়ির পেছনে চলে এল। মেইন সুইচ অফ করে দিয়ে দৌড়ে তৎক্ষনাৎ স্কুলের গেইটের বাইরে চলে এল। স্কুলের বাইরে এসেও সে দৌড় থামাল না। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে দৌড়াতে লাগল। স্কুল পেরিয়ে চলে এসেছে বুঝতে পেরে আহাদ দৌড় থামাল। তারপর দাঁড়িয়ে হাটু ধরে হাঁপাতে লাগল। হাঁপাতে হাঁপাতেই তার মনে এল বাড়ির কথা। তার বাড়ির এখন কী অবস্থা কে জানে! সবাই সুস্থ আছে তো! যুক্তি দিয়ে ভাবতে গেলে আহাদের মনে হচ্ছে তাদের কেউই জীবিত নেই! যদি জীবিত থাকতোই তাহলে তারা কী আহাদের খোঁজ নিত না? এভাবে বাড়ির ছেলের গুম হয়ে যাওয়াটা কী তারা মেনে নিতে পারত! আহাদের মনে হল, তার কী এখন বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত! কিন্তু মস্তিষ্ক বলল, না! বিপদ!
আহাদ নিজেও বুঝতে পারছে তার পরিবার আর নেই। ভাগ্যের ফেরে হয়ত তারা..! আহাদের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। নাহ! সে আর ভাবতে পারছে না!
হঠাৎ পেছন থেকে গোংঙ্গানির আওয়াজ শোনা গেল। মনে হচ্ছে হিংস্র কোনো পশুর শব্দ। আহাদ এক সেকেন্ডেই বুঝে গেল সবকিছু। তার মস্তিষ্ক বলল সামনের ওই বাড়িটাতেই তার এখন দ্রুত আশ্রয় নিতে হবে। আহাদ পুনরায় চোখমুখ খিঁচিয়ে দৌড় দিল। কিন্তু এবার সে আর একা না। সঙ্গে নরখাদকগুলোও পিছু নিল।

___________

তৃণা কুড়েঘর থেকেই জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিল। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু পিশাচগুলোর গর্ গর্ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ঠিকই। ও ভালভাবে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করল আওয়াজটা ঠিক কতদূর থেকে আসছে। মনে হল কাছেপিঠেই কোথাও। তৃণা জানালা আটকে প্রিয়াকে বলল, ‘শোন প্রিয়া। বাইরে অনেক আন্ধার। কিছু দেহা যায় না। তাই আমরা বাইরে গেলেও জোম্বিগুলো আমগো দেখতে পাইব না। ‘

প্রিয়ার মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটল। বলল, ‘ এইডা তো আমগো লিগা খুশির খবর!’

‘হ। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।’

‘কী সমস্যা?’

তৃণা উত্তর দিল, ‘আমগো কোনোরকম শব্দ করন যাইবো না। শব্দ পাইলে ওরা আমগো উপরে আক্রমণ করতে পারে।’

প্রিয়া বলল, ‘তাইলে আমরা এহন কী করুম!’

‘সাবধানে যামু। কোনোরকম শব্দ ছাড়াই।’

‘কিন্তু দৌড়াইলে তো আওয়াজ অইব!’

তৃণা বলল, ‘আমরা তহনই দৌড়ামু যহন পিশাচগুলি আমগো উপর আক্রমণ করতে নিবো। নাইলে পুরা রাস্তা নিঃশব্দে হাইঁটা যামু। বুঝসস?’

প্রিয়া উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল।

.
.

তৃণা দরজা খুলে বাইরে এক-পা রাখতেই কোত্থেকে একটা ইঁদুর এসে প্রিয়ার পায়ের ওপর দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেল। প্রিয়া চমকে মুখ দিয়ে সামান্য শব্দ বের করল। তৎক্ষনাৎ গর্ গর্ আওয়াজটা আরও কাছে আসতে লাগল। প্রিয়া, তৃণা দু’পা পিছিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। দু-তিনটে জোম্বি তাদের সামনে দিয়েই কুড়েঘর থেকে পনেরো-বিশ কদম দূরের জঙ্গলে দৌড়ে চলে গেল। ওরা ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। ঘরের ভেতর থেকেই উঁকি দিয়েই কুড়েঘরের পেছনের জঙ্গলের দিকে তাকাল। অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না। শুনল, ইঁদুরের চিঁচিঁ আওয়াজ ভেসে আসছে, সঙ্গে জোম্বিগুলোর গর্ গর্ ধ্বনি। এরমানে জোম্বিগুলো ইঁদুরগুলোর আওয়াজ শুনেই দৌড়ে এসেছে। তাদের আওয়াজ শুনে নয়! ওরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তারপর অতি সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগোতে লাগল।
তিনটি বাড়ি পেরোতেই দেখল মেইনরাস্তা। রাস্তার এপারে তৃণার বাবার দোকান। দোকানের সামনে এসে পৌঁছাতেই ওরা থমকে গেল। মুহূর্তেই তৃণার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। ক’ফোটা জল গড়িয়ে পরল গাল বেয়ে। প্রিয়া হয়তো বুঝতে পারল ব্যাপারটা। তৃণার কাছে এগিয়ে ওর পিঠে স্বান্তনার হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। যদিও তার নিজের পরিস্থিতিই তৃণার সম।
তৃণা গলার স্বর অতি নামিয়ে বলল, ‘তুই কেমনে জানলি প্রিয়া আমার মা-বাপ বাঁইচা নাই?’

প্রিয়া বলল, ‘আমি নিজের চোখে দেখছি খালা-খালুরে জোম্বিগো মতন আচরণ করতে।’

তৃণা আর কিছু বলল না। চোখ মুছে আবার হাঁটতে শুরু করল। মেইন রাস্তার ওই পারে একটা বিশাল বটগাছ। রাস্তা পেরিয়ে বটগাছের পাশ দিয়ে যেতেই কাছের ঝোপটা নড়ে উঠল। সেখান থেকে বেরিয়ে কিছু একটা ঝাঁপিয়ে পরল প্রিয়ার ওপর।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here