বিপদ,পর্ব- ০৭

0
1208

বিপদ,পর্ব- ০৭
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা

আহাদ প্রায় ছুটে বাড়িটার ভেতর ঢুকে গেল। অন্ধকারে তাকে দেখতে না পেয়ে এদিক-ওদিক দৌড়াতে লাগল নরখাদকগুলো। আহাদ কী করা যায় ভাবতে লাগল। বাড়ির ভেতর ঢুকে পরলেও সে নিরাপদ নয়। বিপদ শেষ হয়ে যায়নি এখনো। জোম্বিগুলো টের পেয়ে গেলে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়বে!
আর সময় নষ্ট করলে চলবে না। তাকে কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। ভাবনা মতন আহাদ বাড়ির বসার ঘর পেরিয়ে মেইন রুম গুলো মাড়িয়ে স্টোররুমে ঢুকল। স্টোররুমটা বেশ বড়। তার মনে হচ্ছে সে কোনো গুদামঘরে এসে পরেছে। ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। আহাদ সুইচ চেপে আলো জ্বালানোর কথা ভাবল। পরক্ষণেই ভাবনা নাকচ করে দিল। আলো জ্বালালে জোম্বিগুলো টের পেয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং কষ্ট করে অন্ধকারেই হাতড়ে জিনিসটাকে খোঁজা যাক।

স্টোর রুম ভাঙ্গাচুড়ো আসবাবপত্রে ভর্তি। সবগুলো আসবাবপত্রের ড্রয়ার হাতড়ে বেরাতে লাগল আহাদ। অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। বোঝাও যাচ্ছে না কী কী আছে এর ভেতরে। নাহ! তাকে যেভাবেই হোক তালা খুঁজে বের করতেই হবে। সদ্য বের করা এই নিরাপদ স্থানটাকে বিপদজনক স্থানে কিছুতেই পরিনত হতে দিতে পারে না সে।
ভাঙ্গা ওয়ারড্রবের সবচাইতে নিচের ড্রয়ার হাতড়াতে গিয়ে কিছু একটা হাতে ঠেকল তার। চাবির গোছা! এর মানে তালা এই ড্রয়ারেই আছে। ড্রয়ারের একেবারে পেছন দিকটায় আহাদ দুটো বেশ বড়সড় তালা পেয়ে গেল। তন্মধ্যে একটা হাতে নিয়ে আহাদ গেইটের দিকে এগিয়ে গেল। গেইটের কাছে পৌঁছাতেই তার মনে হল কিছু একটা ভেতরে ঢুকল। কয়েক সেকেন্ড বাদেই গায়ে হিম ধরানো সেই পরিচিত গরগর আওয়াজ শুনতে পেল। আহাদ সতর্ক হয়ে গেল।
নিজেকে বাঁচাতে এই মূহুর্তে নরপিশাচটার সঙ্গে লড়াই করা ছাড়া তার কাছে অন্য কোনো উপায় নেই। আহাদ নিঃশব্দে গেইটের কাছ থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে দাঁড়াল। তৎক্ষনাৎ কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করল। মাথায় আসতেই আহাদ দৌঁড়ে রান্নাঘর খুঁজতে লাগল। স্টোর রুমের ডান পাশেই রান্নাঘরটা পেয়ে গেল সে। রান্নাঘরে দরজা হাট করে খোলা। সন্তর্পণে ভেতরে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাতেই আহাদ বটিটা দেখতে পেল। ওটাকে হাতে নিয়ে পুনরায় দৌঁড়ে গেইটের কাছে চলে এল। দেখল পিশাচটা ধীরে ধীরে তার কাছেই এগিয়ে আসছে। যদিও ওটা এখনো টের পায়নি একটা জীবন্ত মানুষ ওর সামনে দাঁড়িয়ে!
আহাদ গেইট বরাবর লক্ষ্য করে তার হাতে থাকা তালাটা ছুড়ে মারল। লোহার কেঁচিগেইটে লেগে সেটা কান ধরানো আওয়াজ তুলল। পিশাচটা সেদিক লক্ষ্য করে দৌঁড়ে গেল। পিশাচটা গেইটের কাছে পৌঁছাতেই আহাদ তার হাতের বটিটা দিয়ে পিশাচের মাথায় শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কোপ মারল। কোপ খেয়ে দু’ভাগ হয়ে পড়ল পিশাচের মাথা। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটিয়ে আহাদের শরীর ভিজিয়ে দিল। মাথার খুলি খানিকটা খুলে ঝুলে পড়ল পিশাচের। আহাদ এবার নরখাদকটার শরীর বরাবর লক্ষ্য করে আঘাত করল। নরখাদকটি ছিটকে গেইটের বাইরে গিয়ে পড়ল। আহাদ জানে কোপাতে কোপাতে টুকরো টুকরো করে ফেললেও এরা মরবে না। এরা জোম্বি হয়েই থাকবে। তাই শরীরে বাকি থাকা সামান্য শক্তিটুকু আর নষ্ট করল না। জলদি ভেতরে ঢুকে গেইট আটকে তালা মেরে দিল। শরীরে লেগে থাকা পিশাচের পঁচা রক্তের গন্ধে আহাদের দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। এই মূহুর্তে তার এখন পরিষ্কার ঝকঝকে পানি দরকার যা দিয়ে গত কয়েকদিন ধরে ঘটা দুঃস্বপ্নগুলোকে শরীর থেকে মুছে দিতে পারবে।
এ বাড়ির গোসলখানা খুঁজে বের করতে আহাদের মাত্র দু মিনিট লাগল। চাপ কলের ঠান্ডা পানি শরীরে লাগতেই আহাদের মনে হল এ’কদিনের সমস্ত গ্লানি তার গা থেকে ঝরে পড়ছে।

—– —— ——

ঝোপের ভেতর থেকে দৌড়ে এসে কিছু একটা গায়ের ওপর হুড়মুড়িয়ে পরতেই প্রিয়া চমকে উঠল। তৃণা, প্রিয়া দুজনেই ভয়ে এক হাত পেছনে পিছিয়ে গেল। হঠাৎ সেটা প্রিয়াকে দু’হাতে চেপে জড়িয়ে ধরল। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রিয়া হতভম্ব হয়ে গেল। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে আগন্তুক বলল, ‘আমারে বাঁচান! আমারে বাঁচান!’

তৃণা, প্রিয়া হাঁপ ছাড়ল। তাহলে কোনো জোম্বি এসে তাদের গায়ের ওপর পরেনি।
আগন্তুক আবার বলল, ‘আমারে বাঁচান! ‘
প্রথমে কন্ঠস্বর খেয়াল করেনি কেউ। দ্বিতীয়বার যখন আগন্তুক কথা বলল তখন কারোরই বুঝতে বাকি রইল না মেয়েটা কে!
প্রিয়া চমকে বলল, ‘মারিয়া তুই এহনো বাইঁচা আছস!’

আগন্তুক বোধহয় এতক্ষণ বুঝতে পারেনি সে কার কাছে সাহায্য চাইছে। সেও চমকে উঠল, ‘প্রিয়া!’

প্রিয়া বলল, ‘তুই এইহানে ক্যামনে! আমি ভাবছি তরা কেউ আর বাঁইচা নাই!’

মারিয়া বলল, ‘ গতপরশুদিন স্কুল থিকা ফিরার পথে কতগুলি পাগল আমার চোখের সামনেই আসাদ চাচারে খুন করে। তহন থিকা এইহানেই পলাইয়া রইছি। এহনো আছে আশেপাশে ওই পাগলগুলি। কোনো সুস্থ মানুষ পাইলেই কামড়াইয়া মাইরা হালায়। তাই আর সাহস পাইনাই জঙ্গল থিকা বাইরে বাইর অনের। হের লাইগা…’

কথা থামিয়ে মারিয়া ঝোপের আড়াল থেকে কেশে ইশারায় কাউকে বের হতে হলে। তৎক্ষনাৎ ঝোপ থেকে একটা সাত বছর বয়সী বাচ্চা ছেলে বেরিয়ে আসে। ওর হাত ধরে মারিয়া আবার বলে, ‘হেরলাইগা আমি আর জুবায়ের তহন থেইকা জঙ্গলের ভিতরে পলাইয়া রইছি। এহন পায়ের শব্দ শুইনা মনে অইল কোন স্বাভাবিক মানুষ যাইতাছে। তাই সাহায্য চাওনের লাইগা বাইর অইছি।’

তৃণা, প্রিয়ার বুঝতে বাকি রইল না মারিয়া পাগল কাদের বলছে। ভেতরে ভেতরে দু’জনেই বিস্মিত হল মারিয়ার বেঁচে থাকা দেখে। অবাক হল ছোটো ভাইটাকে নিয়ে মারিয়ার গত তিনদিন ধরে ঝোপের আড়ালে এভাবে পালিয়ে থাকা দেখে।

মারিয়া এতিম। জুবায়ের তার আপন ভাই। আজ থেকে ছয় বছর আগে মারিয়ার বাবা-মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তখন মারিয়াকে আর তার এক বছরের ভাই জুবায়েরকে গ্রামের এতিমখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই মানুষ হয় মারিয়া আর জুবায়ের। বর্তমানে মারিয়া তৃণা, প্রিয়ার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। দশম শ্রেনীতে। আর তার ভাই জুবায়ের ক্লাস ওয়ানে। মারিয়া রোজ হাই স্কুলে যাওয়ার সময় তার ভাইকে প্রাইমারি স্কুলে দিয়ে আসে। আবার আসার সময় একইভাবে নিয়ে আসে। সেদিন তার স্কুল ছুটির শেষে ভাইকে নিয়ে ফেরবার সময় সেই ভয়ংকর ঘটনার সম্মুখীন হয় সে।

প্রিয়া বলল, ‘কেউ তগো খোঁজ করতে আহেনাই?’

মারিয়া উত্তর দিল, ‘না।’

তৃণা গলা নামিয়ে বলল, ‘ হইছে। এইবার চুপ করো সবাই। সবকথা পরে শুনন যাইব। আগে আমরা নিরাপদ জায়গায় যাইয়া লই। এইহানে কথা কইলেই বিপদ বাড়ব। পিশাচগুলি টের পাইয়া যাইব আমরা এইহানে।’

মারিয়া, প্রিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তৃণা মারিয়াকে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে। তারপর পুনরায় চারজনে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে নিঃশব্দে হাঁটতে আরম্ভ করল।

কিছুদূর এগোতেই জুবায়ের পেটে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। মারিয়া ব্যস্ত হয়ে ভাইয়ের সামনে হাটু গেড়ে বসে বলল, ‘কী অইছে ভাই! কী অইছে!’

জুবায়ের কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আর হাঁটতে পারি না। পাও ব্যাথা করে। পেট ব্যাথা করে।’

মারিয়া ওড়না দিয়ে ছোটো ভাইয়ের চোখের জল মুছে দেয়। ‘কান্দিস না ভাই, কান্দিস না। আর ইকটু রাস্তা বাকি আছে।’

—– —– —–
আহাদ এতক্ষণ ঝক্কিঝামেলার মাথায় বুঝতে পারেনি এটা কার বাড়ি। এখন তার মাথায় এল এটা নিশ্চয়ই চেয়ারম্যান মান্নান তালুকদারের বাড়ি। এ গ্রামে তাদের ইটের দালান ছাড়া তো কেবল চেয়ারম্যানেরই দালান আছে। কিন্তু এ বাড়ির মানুষজন সবাই কোথায়! তারা কী সবাই বেঁচে আছে না-কি জোম্বির আক্রমণের শিকার হয়ে জোম্বি হয়ে গেছে!

আহাদ গোসল করে মান্নান তালুকদারের একটা পুরোনো লুঙ্গি আর একটা পুরোনো গেঞ্জি পরেছে। গেঞ্জিটা আহাদের তুলনায় অনেক বড়। বারবার কাঁধ গলে পড়ে যাচ্ছে।

অন্যের জিনিস না বলে ধরাটা অপরাধ। অন্যের খাবার তার অনুমতি ছাড়া খাওয়া অপরাধ। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে আহাদের পক্ষে দুটোর একটাও মানা সম্ভব নয়। প্রায় তিন দিন যাবৎ সে না খেয়ে আছে। প্রচন্ড খিদে ও পানি পিপাসা দুটো একত্রে পেয়েছে তার। কিছু খাবারের আশায় এ বাড়ির ফ্রিজ খুঁজতে লাগল। মান্নান তালুকদার এলাকার চেয়ারম্যান। এত টাকা তাঁর! তাঁর বাড়িতে ফ্রিজ থাকবেনা তা কখনো হয়?
খাবার ঘরেই আহাদ ফ্রিজের দেখা পেয়ে গেল। ফ্রিজের ডিপ খুলতেই দেখল মাছ-মাংসে ভর্তি। আহাদ কীভাবে রাঁধতে হয় জানে না। বিকল্প কিছু খুঁজতে সে ফ্রিজের নরমাল খুলল। দেখল দুটো পাউরুটির প্যাকেট, কিছু ফলমূল আর কিছু শাকসবজি। একটা বোতল ভর্তি ঠান্ডা পানিও আছে।
আহাদ একটা পাউরুটির প্যাকেট বের করে মুখে পুরতে লাগল। প্রায় অর্ধেকটা খেয়ে ঠান্ডা পানি পান করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল।
আহাদের মনে হচ্ছে খাবার পরে শরীর আরো দূর্বল হয়ে পড়েছে। ঘুমুলে ঠিক হয়ে নিশ্চয়ই! ভাবনামতো গিয়ে আহাদ দু’টো শোবারঘরের একটাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল। মূহুর্তেই গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল সে।


লোহার গেইটে অনবরত ঢিলের আওয়াজে আহাদের ঘুম ভাঙ্গল। তখন রাত প্রায় তিনটে। আহাদ শোয়া থেকে উঠে বসল। ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করল সে। আবার লোহার গেইটে ঢিল ছুড়ে মারার আওয়াজ শুনতে পেল। জোম্বিগুলো কখনো ঢিল ছুড়বে না। অত বুদ্ধি ওগুলোর নেই। তাহলে! তাহলে তো কোনো মানুষেরই কাজ এটা! একরাশ কৌতুহল ঘিরে ধরল আহাদকে। বসা থেকে উঠে ঘটনার মূল দেখতে এগিয়ে গেল সে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here