বিপদ,পর্ব- ০৮
লেখাঃ ত্রয়ী আনআমতা
আহাদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেইটের বাইরে কাউকে দেখতে পেল না। আশ্চর্য! তাহলে ঢিল ছুড়ল কে? কাছ থেকে দেখার জন্য সে লোহার গেইটের দিকে এগোলো। শিক ধরে বাইরে উঁকি দিল। কিছুই দেখতে পেল না। আশ্চর্যজনকভাবে একটা জোম্বিও উপস্থিত নেই সেখানে। আহাদ অবাক হল। সেই সঙ্গে স্বস্তির নিশ্বাসও ফেলল। যাক জোম্বিগুলো চলে গেছে।
আহাদ সেখান থেকে চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। গেইটের শিকের ওপর তার হাত রাখা ছিল। সেখান থেকে হাত সরাতে চাইল। ব্যর্থ হল।
অকস্মাৎ কিছু একটা তার হাত চেপে ধরল।
★
পনেরো মিনিট আগে…
প্রায় দু’ঘন্টা যাবৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে আছে ওরা চারজন। প্রিয়া, তৃণা, মারিয়া, জুবায়ের।
মারিয়া, জুবায়েরকে সঙ্গে নিয়ে ফের যখন ওরা হাঁটতে শুরু করে। তখন সবাই হঠাৎই ভূমিকম্প অনুভব করে। আর কেউ না বুঝলেও তৃণা বুঝে যায় আসলে কী হতে চলেছে। এর আগেও একবার আসন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল সে।
এই বিদ্যালয় পেরোতেই সামনে উচ্চ বিদ্যালয়। আপাতত দৃষ্টিতে তৃণার মনে হচ্ছে সেই স্থানটাই কম্পন সৃষ্টির মূল স্থল। তৃণাকে সঠিক প্রমাণ করে সেখান থেকে কম্পনটা তাদের দিকে এগোতে শুরু করল। আর এক মুহুর্তও দেরি না করে তৃণা ঘোষণা দেয়, ‘সবাই জলদি ওই দেয়ালডার পিছে লুকাইয়া পড়ো।’
আকাশ পরিষ্কার। মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা বেরিয়ে পরেছে। কিছুক্ষণ আগের তিমির পরিবেশ এখন জোছনায় থই থই। দেয়ালের আড়ালে লুকিয়েই তৃণারা পরিষ্কার দেখতে পেল, শতশত জোম্বি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে। কিছু জোম্বি তাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কিছু রাস্তায় গড়গড় আওয়াজ করতে করতে হাঁটছে। মাঝে মাঝে মৃদু কেঁপে উঠছে। কিছু আবার এদিক সেদিক দৌঁড়াতে লাগল। সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট জুবায়েরের গা শিউরে উঠল। দু-হাত দিয়ে সে বোনকে জড়িয়ে ধরল। মারিয়া ওর চোখের ওপর ডান হাত রাখল। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ওই দিকে তাকাইস না ভাই। ডরাইস না। আমি আছি নাহ! তর বইন বাইচ্চা থাকতে তর কিচ্ছু হইতে দিবো না!’
দু’ঘন্টা যাবৎ দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে আছে ওরা। জোম্বিগুলো একটা-দুটো করে রাস্তার ওপর থেকে সরছে। এখনো পাচঁ-ছয়টা জোম্বি রাস্তায় ঘুরঘুর করছে। এখন ভোর রাত। একটু পরেই আলো ফুটতে শুরু করবে। তাহলেই সব শেষ! শেষ রক্ষা আর হবে না। তখন ওরা জোম্বিগুলোর চোখে পরবেই। উপস্থিত সবারই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। আসন্ন মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া ছাড়া কী আর কোনো উপায় নেই!
দমকা হাওয়ার মতো মারিয়ার মাথায় একটা বুদ্ধির আগমন ঘটল। সে তৃণা, প্রিয়াকে বলল, ‘একটা কাম করলে কেমুন অয়?’
প্রিয়া বলল, ‘কি কাম?’
মারিয়া উত্তর দেয়, ‘আমি পিশাচগুলির মনোযোগ আমার উপর আনুম। আর হেই সুযোগে তুই আর তৃণা আমার ভাইরে লগে নিয়া এইহান থিকা পালাবি।’
তৃণা মৃদু চেঁচিয়ে উঠল। ‘অসম্ভব। জোম্বিগুলি তর উপরে আক্রমণ করলে! আমরা এই ঝুঁকি কিছুতেই লমু না। কিছুতেই নাহ!’
প্রিয়া বলল, ‘হ। তৃণা ঠিকই কইছে। এইডা কিছুতেই আমরা হইতে দিতে পারিনা।’
মারিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘শোন। তরা অনেক বুদ্ধিমতী। বুদ্ধি দিয়া এইডা একবার ভাইবা দেখ। এই ঝুঁকিডা যদি আমরা না লই তাইলে আমগো সবারই মরতে অইব ওই পিশাচগুলির হাতে। এর থিকা এইডা ভালো না, একজন ঝুঁকি লই। তাইলে অন্তত বাকি তিনজন তো বাইচ্চা থাকব!’
তৃণা, প্রিয়া কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আমি যাম।’
তৃণা বলল, ‘না প্রিয়া। তরে আমি কিছুতেই যাইতে দিমু না। আমি যামু।’
প্রিয়া বলল, ‘আমি দুনিয়াতে থাকতে তরে কহনো ওই জোম্বিগুলির খাওন অইতে যাইতে দিমু না।’
তৃণা প্রিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘বুজার চেষ্টা কর প্রিয়া!’
প্রিয়া এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলল, ‘তুই বুজার চেষ্টা কর। ‘ তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুই ছাড়া দুনিয়াতে আমার আর কে আছে!’,
দুজনকে থামিয়ে মারিয়া বলল, ‘তগো কারো যাওনের দরকার নাই। আমি যামু। আমার কতা শুন তরা।’
তৃণা বলল, ‘দরকার নাই। আমরা কেউই যামু না।’
প্রিয়া বলল, ‘হ। দরকার পরলে সবাই একলগে মরুম। কিন্তু কেউরে নিজের চোক্ষে মরতে দেকতে পারুম না।’
মারিয়া আর কিছু বলে না। নিচু হয়ে ভাইয়ের কপালে চুমু খায়। জুবায়েরকে বলে, ‘ভাল থাকিস ভাই। সাবধানে থাকিস। আমার লিগা চিন্তা করিস না। ‘
ভাইয়ের থেকে চোখ ফিরিয়ে অশ্রুসজল দৃষ্টিতে তৃণা, প্রিয়ার দিকে তাকায়। প্রিয়া, তৃণা কিছু বুঝতে পারে না। হঠাৎই মারিয়া ওদের দুজনের হাত চেপে ধরে। ‘আমার ভাইডার খেয়াল রাখিস তৃণা, প্রিয়া! তরা আমার ভাইডার খেয়াল রাখিস! ‘
তারপর আচমকা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দৌঁড়ে আসে। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে উন্মাদের মতো চিৎকার দেয়। আওয়াজ শুনে আশেপাশের স্থান থেকে সব জোম্বি বেরিয়ে আসতে শুরু করে। তার দিকে এগোতে থাকে নরখাদকগুলো। মারিয়া রাস্তার বিপরীতে জঙ্গলের দিকে দৌঁড়াতে আরম্ভ করে। জোম্বিগুলো তার পিছু নেয়। কান ফাটানো গড়গড় আওয়াজ করতে করতে মারিয়ার পেছনে দৌঁড়াতে শুরু করে।
ঘটনার আকস্মিকতায় তৃণা, প্রিয়া হতভম্ব। ধাতস্থ হতে কিছু সময় লাগে তাদের। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে মারিয়া তাদের সকলের আসন্ন মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে অজানায় পাড়ি দিয়েছে। জুবায়ের বুঝতে পারল তার বোন তাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। বোনকে কাছে না পেয়ে সে কাঁদতে শুরু করল। তৃণা, প্রিয়া অবুঝ শিশুটাকে বুকে জড়িয়ে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিল, ‘চিন্তা করিস না জুবায়ের। আমাগো মারিয়া ফিরা আইবো। তর বইন কি তরে ছাইড়া দূরে থাকতে পারে!’
তৃণা, প্রিয়া তাদের সহপাঠীর ভবিষ্য পরিনতির কথা ভেবে কষ্ট পায়। মারিয়ার ত্যাগ ওদের দু’চোখের কোনে অশ্রু জমা করে।
মারিয়ার কল্যাণে জুবায়েরকে নিয়ে প্রিয়া, তৃণা নিরাপদে প্রিয়াদের বাসার কাছে এসে পড়ে। গেইটের কাছে পৌঁছাতেই দেখে গেইট ভেতর থেকে তালা দেয়া। ওরা বুঝে যায় ভেতরে কেউ আছে। এমন পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই আড়ালে লুকিয়ে দুজনে ইটের টুকরো ছুড়তে থাকে গেইট বরাবর। লক্ষ্য আওয়াজ শুনে যেন ভেতরের আগন্তুক বেরিয়ে আসে। তাদের পরিকল্পনা সফল হয়। আগন্তুক বেরিয়ে গেইটের কাছে এসে দাঁড়ায়। তাদেরকে খুঁজতে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। তারা আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। ওদেরকে খুঁজে না পেয়ে আগন্তুক চলে যেতে নিলে প্রিয়া আগন্তুকের হাত চেপে ধরে। ‘আপনে কে? আমগো বাসায় কী করেন? তালা খোলেন শিগগির! ‘
আগন্তুক বলে উঠে, ‘প্রিয়া!’
★
প্রিয়াদের বসার ঘরে সবাই মাদুর বিছিয়ে গোল হয়ে বসে আছে। তৃণা জুবায়েরকে শরবতে পাউরুটি ভিজিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে। ফেরার পর থেকে জুবায়ের কেঁদেই চলেছে। আধ ঘন্টা হলো ওরা ফিরেছে। আহাদের কাছে তাদের অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু জুবায়েরের সামনে বলা ঠিক হবে না বলে এখনো চুপ করে আছে। জুবায়েরের খাওয়া শেষ হলে তৃণা ওকে নিয়ে শোবার ঘরে চলে গেল। ওকে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগল। মিনিট পেরোতেই জুবায়ের ঘুমিয়ে গেল। তৃণা দরজা ভিজিয়ে বসার ঘরে চলে এল।
তৃণা ফিরতেই প্রিয়া আহাদকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমগো বাসায় ক্যান আহাদ?’
আহাদ ওদেরকে সব খুলে বলল। কীভাবে সে তিনদিন স্কুলে আটকে ছিল, কীভাবে সে প্রিয়াদের বাড়িটা খুঁজে পেয়েছে, কীভাবে আশ্রয় নিয়েছে!
সব শুনে তৃণা, প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অন্যকে জেরা করার মতো অবস্থা তাদের নেই। আহাদের পরিস্থিতিতে তো তারাও থাকতে পারত! তখন হয়তো তারা নিরাপদ স্থান খুঁজতে অন্যের বাড়িতেই আশ্রয় নিত!
যদিও তাদের অবস্থা আহাদেরই মতোন।
তৃণা, প্রিয়া তিন রাত ঘুমুতে পারেনি। এখন তাদের ঘুমানো দরকার। আগামীকাল বাকি সব দেখা যাবে। তাই ওরা জলদি কিছু শুকনো খাবার খেয়ে ঘুমোতে চলে গেল। আহাদকে বলল জুবায়েরের সঙ্গে ঘুমুতে। বাচ্চা ছেলে একা ভয় পাবে তাই।
আহাদ কারো সঙ্গে ঘুমোতে পারে না। কিন্তু এখন এত বাছবিচার করার মতো অবস্থা নেই তার। তাই নিরুপায় হয়ে উচ্চবাচ্য না করে জুবায়েরের সঙ্গে ঘুমুতে চলে গেল।
____________
পনেরো দিন হতে চলল এ বাড়িতে আসার। এ বাড়ির বর্তমান সদস্য সংখ্যা চারজন। তৃণা, প্রিয়া, আহাদ, জুবায়ের। প্রিয়ার বাবা চেয়ারম্যান মান্নান তালুকদার সবসময় চলতি মাসের মাসকাবারি বাজার অগ্রিম করে রাখেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ওরা চারজন এতদিন তা-ই খেয়ে জীবন বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু যে খাবার আছে তাতে আর মাত্র এক সপ্তাহ চলবে। তারপর ওরা কী খাবে? কী খেয়ে বাঁচবে ওরা! তৃণা, প্রিয়া, আহাদ সপ্তাহখানেক ধরে এই দুঃশ্চিন্তাই করছে। অনেক চেষ্টা করছে এর সমাধান খোঁজার। কিন্তু কিছুতেই কোনো উত্তর মিলছে না। তৃণা, প্রিয়া নিজের চাইতে বেশি জুবায়েরের জন্য চিন্তা করছে। যার বোন নিজের জীবন বাজি রেখে ওদেরকে বাঁচাল তাকে কীভাবে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে ওরা! মারিয়া নিজের প্রাণপ্রিয় ভাইকে ওদের আশায় রেখে গিয়েছে। তাকে তো ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হবেই। সেটা যেভাবেই হোক না কেন!
চলবে…