বিপদ,পর্ব- ০৯ (শেষ পর্ব)

0
2558

বিপদ,পর্ব- ০৯ (শেষ পর্ব)
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা

গোয়ালিমান্দ্রা গ্রামের প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষ নরখাদকে পরিনত হয়েছে। মরে গিয়ে জ্যান্ত হয়ে মানুষখেকো হয়ে ওঠায় যেন সবাই প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। প্রতিযোগিতার ফলাফল যেন এই মৃত্যুপুরী!
মহামারীর শুরুতে যারা বেঁচে ছিল তাদের কেউ কেউ নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার পথে জোম্বির আক্রমণের শিকার হয়েছে। কেউ কেউ আবার গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে সক্ষম হয়েছে। কেউ কেউ এই মৃত্যুপুরীতেও লড়াই করে টিকে আছে। টিকে থাকার মধ্যে অন্যতম তৃণা, প্রিয়া, আহাদ, জুবায়ের। তবে ঠিক কতদিন টিকে থাকতে পারবে তাতে রয়েছে ঢের সংশয়!
প্রায় একমাস যাবৎ প্রিয়াদের বাড়িতে একপ্রকার বন্দী হয়ে আছে ওরা। জমা করে রাখা সমস্ত খাবারই শেষের পথে।

—————
মহামারীর পঞ্চম সপ্তাহ। শীতকাল। সন্ধ্যা ছয়টা। সবাই বসার ঘরের রঙ্গিন টেলিভিশনের সামনে বসে আছে। সন্ধ্যার খবর দেখার জন্যে। টিভির পর্দায় খবর শুরু হতেই সবাই সেদিকে মনোযোগ দেয়। টেলিভিশনের ওপর পাশ থেকে একজন মহিলা দৃঢ় কন্ঠে সংবাদ পড়তে আরম্ভ করে। সংবাদের একপর্যায়ে একটা বাক্য শুনে উপস্থিত সবাই থমকে যায়। বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল গোয়ালিমান্দ্রা জোম্বিদের আক্রমণের শিকার!
তৃণা, প্রিয়া, আহাদ কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু তাদের গ্রাম জোম্বিদের আক্রমণের শিকার! পুরো বাংলাদেশ নয়! সবাই আবার খবরে মনোযোগ দিল।
খবর শেষ হতেই আহাদ লাফিয়ে উঠল। ‘আমগো শীঘ্রই এই গ্রাম থিকা বাইর অইতে হইব। যেমনেই হোক!’

তৃণা, প্রিয়া স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। তাদের মাথায় কিছুই ঢুকছে না! এতদিনে তো পুরো বাংলাদেশ ছড়িয়ে পরবার কথা। ছড়ায় নি! এর মানে নিশ্চয়ই শুরুতেই তাদের গ্রামের দুর্দশার কথা সরকার জানতো! তাইতো দেশটাকে রক্ষা করা গেছে! কিন্তু তাদের গ্রামের কথা রাঘব-বোয়ালরা কেন ভাবল না? তাহলে তো তাদের বাবা-মা আজ বেঁচে থাকত! বাবা-মায়ের কথা মনে হতেই তৃণার দু’গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরল। তাদের কত স্বপ্ন ছিল তৃণাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখার!
তৃণা ভেবেছিল সব শেষ। বাবা-মায়ের স্বপ্ন তো পূরন করতে পারবেই না। সেই সঙ্গে নিজের জীবনকেও বেশিদিন রক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু আজকের খবর দেখার পর তার সে ভুল ভেঙ্গে গেল। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে সে! নিজের জীবনও রক্ষা করতে পারবে। এ গ্রাম থেকে বেরোতে পারলেই সব সম্ভব!

তৃণার ভাবনায় প্রিয়া ছেদ ঘটায়। ‘সরকার ক্যান এই সিদ্ধান্ত নিছে! এই গ্রামে আগুন লাগাইয়া দিলে আমরা কেমনে বাঁচুম?’

তৃণা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘বলদের মতো কথা কইস না প্রিয়া। আগুন লাগানের আগেই আমগো এই গ্রাম থিকা বাইর অইতে হইব।’

প্রিয়া আবার বলল, ‘আমাগো বাঁচানের লিগা সরকার মানুষ পাডাইবো না?’

তৃণা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘না।’

‘ক্যান আমরা গ্রামের মাইনষেরা কী দোষ করছি?’

প্রিয়ার প্রশ্নে আহাদ উত্তর দিল, ‘আমরা কোনো দোষ করি নাই। দোষ আমগো কপালের। মন্ত্রীরা হয়তো ভাবছে এই গ্রামে কেউই বাঁইচা নাই। তাই জোম্বিগুলিরে ধ্বংস করতে পুরা গ্রামে আগুন লাগাইয়া দিতে চাইতাসে।’

প্রিয়া আর কিছু বলল না। যা বোঝার সে বুঝে গেছে।

জুবায়ের শোবার ঘরে ঘুমিয়ে ছিল। ঘুম থেকে উঠে তৃণার কাছে এসে চোখ ডলতে ডলতে বলল, ‘তৃণা আপা, আমার মারিয়া আপা কবে আইবো?’


মহামারীর পঞ্চম সপ্তাহের প্রথম দিন। রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিট। চেয়ারম্যান বাড়ির বর্তমান সদস্যরা গভীর ঘুমে মগ্ন। বাড়ির আশেপাশের কোত্থেকে যেন পোড়া গন্ধ আসছে। আহাদের পাতলা ঘুম। গন্ধ নাকে এসে লাগতেই তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। শোয়া থেকে উঠে বসতে গিয়ে খেয়াল করল জুবায়ের তার শরীরের ওপর এক পা দিয়ে শুয়ে আছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তার গায়ের ওপর থেকে জুবায়েরের পা সরিয়ে দিল। রুমের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই পোড়া গন্ধটা আরো প্রকট হল। গন্ধটা গেইটের বাইরে থেকেই আসছে। বুঝতে পেরে গেইটের দিকে এগোতে লাগল সে। গেইটের দিকে চোখ পরতেই আহাদ হকচকিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল না কী করবে! এমন পরিস্থিতিতে তার কী করা উচিৎ! বুদ্ধিশক্তি লোপ পেয়ে গেল তার।
মিনিট দুয়েক লাগল তার ধাতস্থ হতে। তৎক্ষনাৎ সে দৌঁড়ে তৃণাদের রুমে চলে গেল। রুমে ঢোকার আগে অনুমতি নেবার কথা বেমালুম ভুলে গেল। ঘুমন্ত তৃণা, প্রিয়াকে উচ্চস্বরে ডাকতে লাগল আহাদ। ‘তৃণা, প্রিয়া তোমরা জলদি ঘুম থিকা উঠো! আমগো সর্বনাশ হইয়া যাইতাসে!’

আহাদের প্রায় চিৎকার করা কন্ঠস্বরের কারণে তৃণা, প্রিয়া জেগে গেল। দুজনেই একপ্রকার লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠল। ‘কী হইছে! কী হইছে!’

আহাদ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘বাড়ির বাইরে আগুন! সবজায়গায় আগুন! গ্রামে আগুন লাগাইয়া দিছে তারা!’

তৃণা, প্রিয়া একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর দুজনেই দৌঁড়ে গেইটের কাছে চলে এল। দেখল তাদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। প্রিয়া সেদিকে তাকিয়েই বলল, ‘কিন্তু আগুন তো সামনের সপ্তাহে লাগানের কথা আছিল!’
তৃণা মাথা ঝাঁকাল। তারপর বলল, ‘এহন আমগো আর হেগুলি ভাবলে চলব না। শিগগিরি পালাইতে হইব এইহান থিকা। ‘

আহাদ তাদের পেছন পেছন গেইটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু আমরা কই যামু?’

তৃণা জবাব দিল, ‘খবরে কী কইসে মনে আছে? বাংলাদেশের খালি একটা গ্রাম জোম্বিগো আক্রমণের শিকার। মানে আমগো গ্রাম। আর আমগো গ্রামের চারপাশে বাঁধ দেওয়া। কারেন্টের কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া। যাতে এই গ্রাম থিকা জোম্বি অন্য গ্রামে পৌঁছাইতে না পারে।’

আহাদ পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘তাইলে আমরা অন্য গ্রামে কেম্নে যামু?’

তৃণা বলল, ‘ভালো কইরা ভাইবা দেহো। মেইন রাস্তা ছাড়াও কিন্তু আরেকটা রাস্তা আছে যেইডা দিয়ে আমরা অন্য গ্রামে পোঁছাইতে পারি।’

প্রিয়া চেঁচিয়ে উঠল, ‘নদী!’

তৃণা মৃদু হাসল। ‘হ।’

প্রিয়া চিন্তিত কন্ঠে বলল, ‘কিন্তু আমগো লগে তো জুবায়ের আছে। ওয় তো সাতার জানে না।’

তৃণা কপাল চাপড়াল। ‘আরে বোকা আমরা সাতরাইয়া ক্যান যামু! একবার ঘাটে পৌঁছাইতে পারলেই অইব। নদীর ঘাটে কত নৌকা বাঁধা থাকবো দেহিস। গ্রামের আর বাকি সবাই জোম্বি হইয়া গেসে। জোম্বিরা কী নৌকা চালাইয়া অন্য পারে গেছে? যে আমরা নৌকা পামু না! খবরে দেহস নাই? সাংবাদিকরা কী কইসে? জোম্বিগো কোনো বুদ্ধি নাই। ওরা পানি ভয় পায়। সাতারও কাটতে পারে না। খালি পারে মাইনষেরে কামড়াইয়া মাইরা হালাইতে।’
কিছুক্ষণ থেমে তৃণা আবারো বলল, ‘হইছে। তোমগো আর ভাবতে হইব না। সবাই শুনো নিজেগো নিরাপত্তা সবার আগে। প্রিয়া পাকঘরের বটিটা নিয়া আয়। আহাদ জুবায়েররে ঘুম থিকা উঠাইয়া গেইটের সামনে আইসা খাঁড়াও। আমি রাম’দাডা খুঁইজা নিয়া আহি।’


আগুন ঝড়ের গতিতে সবকিছু পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দিচ্ছে। আহাদ, তৃণা, প্রিয়া, জুবায়ের সাবধানে গেইটের বাইরে এসে দাঁড়াল। চারদিকে দৃষ্টি ক্ষেপণ করল। আগুন আর জোম্বিদের অবিরত ছোটাছুটি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। হাতের কাছে যা ছিল তাই নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে তারা। তৃণার হাতে রাম’দা। আহাদের হাতে ধারালো বটি। তারা দুজন আগে। পেছনে প্রিয়া, জুবায়ের ভেজা কম্বল গায়ে। আগুনের হাত থেকে বাঁচতে এই প্রক্রিয়া। একেতো বিশাল। তার ওপর আবার ভেজা। কম্বলের ওজন সামলাতে প্রিয়ার হিমশিম খেতে হচ্ছে।
আগুন থেকে গা বাঁচিয়ে চলছে তারা। এখনো পুরো গ্রামে ছড়াতে পারেনি আগুন। কিছু জায়গা বাকি। সেখান দিয়েই চলার চেষ্টা করছে তারা। উদ্দেশ্য নদী।


পনেরো-বিশ মিনিট হল তৃণারা রওয়ানা দিয়েছে। আর দশ মিনিটের রাস্তা বাকি। ধান বোনার ক্ষেত গুলো পেরোলেই বিশাল নদী। এখানটায় এখনো আগুন তার ডাল-পালা মেলতে পারেনি। জোম্বিও দেখা যাচ্ছে না। প্রিয়া, জুবায়ের-এর গায়ে এখনো ভেজা কম্বল। হোঁচট খেতে খেতে ধীর পায়ে হেটে এগোচ্ছে তারা। আচমকা কিছু একটা প্রিয়ার ওপর আক্রমণ করল। প্রিয়া চেঁচিয়ে উঠল। তৃণা, আহাদ পেছন ফিরে তাকাল। দেখল দুটো জোম্বি প্রিয়ার ঘাড়ের কাছে কম্বল কামড়ে ধরে আছে। তৃণা চিৎকার করে বলল, ‘কম্বল হালাইয়া দে প্রিয়া!’

প্রিয়া শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কম্বলটা ছুড়ে মারল। জোম্বিগুলো তখনো কম্বলটা কামড়ে ধরে ছিল। কম্বলের সাথে সাথে সেগুলোও মাটির ওপর গিয়ে পরল। তৃণা রাম’দা উঁচু করে জোম্বিগুলোর দিকে দৌঁড়ে গেল। একটা জোম্বির মাথা বরাবর কোপ লাগিয়ে দিল। আহাদও তার সঙ্গ দিল। ধারালো বটি দিয়ে অপর জোম্বিটার মাথা দু’ভাগ করে ফেলল। জোম্বিগুলো মাটির ওপর দাপড়াতে লাগল। কিন্তু আর মাটি ছেড়ে উঠতে পারল না। ওরা বুঝতে পারল কিছু সময় লাগবে জোম্বিগুলোর আবার জীবন্ত হতে! তাই আর দেরি করল না। সবাই দৌঁড়াতে আরম্ভ করল। পাছে জোম্বিগুলো ফের না আক্রমণ করে!

কিছুদূর দৌঁড়াতেই জুবায়ের হাঁপিয়ে গেল। বলল, ‘আমি আর দৌঁড়াইতে পারতাছি না। পাও ব্যাথা করে।’

তৃণা বলল, ‘আমার কোলে আয়।’

জুবায়েরকে কোলে নিয়ে তৃণা আবারো দৌঁড়ানো আরম্ভ করল। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারল না। সেও হাঁপিয়ে গেল। সাত বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে কী দৌঁড়ানো যায়!
বাধ্য হয়ে আহাদ জুবায়েরকে কোলে নিল। একপর্যায়ে সেও হাঁপিয়ে উঠল। এবার জুবায়েরকে কষ্ট করে আরেকটু পথ হাঁটতে বলল তৃণা। ‘আর পাঁচ মিনিট ভাই! একটু কষ্ট কর!’

মিনিট সাতেক পরে একটাসময় নদীর ঘাটে এসে পোঁছাল তারা। উপস্থিত সবাই খুব অবাক হল। দেখল তৃণার কথাই সত্যি। ঘাটে পাঁচ – ছয়টা নৌকা বাঁধা। তৃনা ঘোষণা করল, ‘কেউ নৌকা চালাইতে পারো?’

আহাদ উত্তর দিল, ‘আমি পারি!’

তৃণা বলল, ‘ঠিকাছে। তয় তুমিই চালাও।’

সবাই নৌকায় উঠে বসতেই আহাদ বৈঠা বাইতে আরম্ভ করল। ততক্ষণে আগুন ক্ষেতে এসে পৌঁছেছে। খালি জমি থাকায় তেমনভাবে ছড়াতে পারেনি। কিন্তু একটু দূরেই পুরো গ্রামে আগুন ছড়াতে দেখল তারা। মনে মনে আহাদকে ধন্যবাদ দিল তৃণা। ভাগ্যিস তার কাঁচা ঘুম! নয়তো এতক্ষনে বাড়ির ভেতর পুরে ছাই হয়ে থাকত তারা।
ভাবনায় এত মগ্ন ছিল তৃণা যে খেয়ালই করল না কেউ একজন বসা থেকে উঠে তার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে এগিয়ে আসছে। আহাদ বিষয়টা খেয়াল করল। সে নৌকা চালানো বন্ধ করে ঘটনা পরিলক্ষিত করতে লাগল। হঠাৎই সেটা তৃণার ওপর আক্রমণ করতে নিতেই আহাদ বৈঠা দিয়ে সেটার মাথায় বারি দিল। তৎক্ষনাৎ প্রিয়া নৌকার ওপর লুটিয়ে পরল। তৃণার ধ্যান ভাঙ্গল। সে বসা থেকে লাফিয়ে উঠল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল। জুবায়েরকে এক হাতে ধরে আহাদের দিকে এগোলো। আহাদের বৈঠা ধরা হাতটাকে ধরে তাকে বাঁধা দিতে দিতে বলল, ‘ওরে মারো ক্যান! ও কী দোষ করছে! ওরে ছাইড়া দেও! ওরে ছাইড়া দেও!’

আহাদ চেঁচিয়ে বলল, ‘প্রিয়া আর মানুষ নাই তৃণা। ও জোম্বি হইয়া গেছে! ‘

‘কী কইতাসো আবোলতাবোল! ‘

‘হ তৃণা। আমি সত্যই কইতাসি।’

আহাদের কথা শেষ হতেই তৃণা প্রিয়ার ওপর টর্চের আলো ছুড়ল। প্রিয়ার ঘাড়ের কাছে কামড়ের দাগ দেখতে পেল। এর মানে তখন কম্বলের সাথে সাথে প্রিয়ার ঘাড়েও কামড় বসিয়েছে জোম্বিরা!
হঠাৎ প্রিয়া কেমন বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে উঠতে লাগল। তার হাঁত, পা, মাথা সব কেমন বেঁকে যাচ্ছে। আহাদ তৃণাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না। সে প্রিয়ার কাছে গিয়ে বৈঠা দিয়ে প্রিয়াকে মারতে মারতে পানিতে ফেলে দিল। ফেলে দেবার আগমুহূর্তে তৃণা দেখতে পেল প্রিয়ার চোখে জল! তৃণার দুচোখ ঝাপসা হয়ে এল। তারা কী দোষ করেছিল! তাদের সাথেই কেন এমন হল!

প্রিয়াকে পানিতে ফেলে দিতেই ও ডুবে যেতে লাগল। আহাদ দ্রুত বৈঠা বাইতে লাগল। তৃণা জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরে বসে বসে চোখের জল ফেলতে লাগল।

______________
সাল ২০১৪। দশ বছর হতে চলল পৃথিবী আবার আগের রূপে ফিরে এসেছে। আগুন লাগিয়ে জোম্বিদের আক্রমণে মৃত্যুপুরী হয়ে যাওয়া গ্রাম ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল দশ বছর আগে। এই দশ বছরে সবকিছু বদলে গেছে। জোম্বিগুলো ধ্বংস হয়ে পুনরায় বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠেছে গোয়ালীমান্দ্রা। আগের চাইতে আরো বেশি মানুষ বসবাস করে এখন এখানে। গ্রামটি বর্তমানে আরো উন্নত।
তবে এই স্মৃতিবিজড়িত স্থানে তৃণা- আহাদ এখন আর থাকে না। কারণ সব হারানোর সেই বিভীষিকাময় রাতগুলোর কথা তারা আর স্মরণ করতে চায় না।
এখন তাদের বাসস্থান রাজধানী ঢাকায়। দু’বছর হল তারা বিয়ে করেছে।
জুবায়ের এখনো তাদের কাছেই থাকে। নিজেদের ভাইয়ের মতোই তারা ওকে লালনপালন করে বড় করেছে। এবারই হাইস্কুল থেকে কলেজে ভর্তি হয়েছে ও।


তৃণা অন্ত:সত্ত্বা। আজ সকালে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহাদ সকাল থেকেই মেডিকেলে দৌড়াদৌড়ি করছে। চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। অবশেষে তৃণার ডেলিভারি সম্পন্ন হল। কন্যাসন্তান এসেছে তার কোল আলো করে। আহাদ হাসিমুখে তৃনার হাত ধরে মা-মেয়ের পাশে নিঃশ্চিন্ত মনে বসে আছে।
কলেজ থেকে ফিরেই জুবায়ের জলদি হাসপাতালে চলে এল। তৃণার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, ‘তৃণা আপা, এখন ভালো আছো?’

তৃণা মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। তারপর চোখের ইঙ্গিতে পাশে শুয়ে থাকা মেয়েকে দেখিয়ে দিল। জুবায়ের হেসে বাচ্চাটাকে কোলে নিল। তৃণা জিজ্ঞেস করল, ‘চিনতে পারছিস দেখতে কার মতোন?’

জুবায়ের ছলছল চোখে বাচ্চাটার দিকে তাকাল। তারপর উল্লাসে একপ্রকার চিৎকার করে বলল, ‘মারিয়া আপা! আমার মারিয়া আপা ফিরে এসেছে!’

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here