বিপরীতে_তুমি_আমি #পর্বঃ০২

0
1920

#বিপরীতে_তুমি_আমি
#পর্বঃ০২
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম

মাত্র আধঘন্টার মধ্যেই বিয়ের কার্যক্রম শুরু হবে। কিরণ পর্দার বেড়াজাল ভেদ করে বাহিরের পরিস্থিতি দেখে নিলো। বরপক্ষ ভোজনে বসেছে। কিন্তু বর কোথায়? নিশ্চয় নিজের আসনেই বসে আছে। কিরণের মন থেকে শ খানেক বকা ঠোঁটের গোঁড়ায় এসে ফিরে যাচ্ছে। অজ্ঞাত কারণে বের হচ্ছে না। কিরণের অবস্থা নাজেহাল। বিয়ে সে করবে না। প্রেমজনিত কোনো কারণ তার নেই। বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই এটাই একমাত্র ও মুখ্য কারণ। তার মধ্যে ডিফেন্সের হলে তো একদমই না। ডিফেন্সের মানুষ অপন্দের প্রধান কারণ তার নিজের বাবা। কেননা তার বাবাও ডিফেন্সের ছিলেন। দীর্ঘ সময় নৌবাহিনীর সাথে নিযুক্ত থেকে বর্তমানে অবসর গ্রহণ করেছেন। ছোট বেলা থেকে কিরণ দেখে এসেছে তার বাবাকে একজন বদ মেজাজী মানুষ হিসেবে। পরিবারের একমাত্র অধিপতি তিনি। আর পাঁচজনের বাবার মতো সে তার বাবার সাথে বন্ধু সুলভ আচরণ পাই নি। সর্বদা থেকে বাবার কঠোর নিয়মের মাঝে। তার কথা বেদ বাক্যের মতো। রাগী হওয়ার দরুণ সেই বেদবাক্য খন্ডাবে এতো স্পর্ধা কারো হয় নি। সেই থেকে তার ধারণা ডিফেন্সে চাকুরীরত সকলেই ভীষণ বদ রাগী হয়। তারা পরিবারকে সময় দিতে পারে। ডিউটির জন্য মাসের কয়েকরাত প্রায়ই অফিসে কাটাতে হয়। বছরের একাংশ প্রায় ঘরহীন জাহাজে কেঁটে যায়। মিশন তো রয়েছেই। নেহাতই করণের মা রাগী হলেও বড়ই ধৈর্যশীল মহিলা বলেই তার বাবার সাথে সংসার করতে পেরেছেন নতুবা তাহা বোধহয় সম্ভব ছিল না। রাগ কেবলই সন্তানদের উপর অর্পিত হয় যা কিনা বাবার অংশের। তাই বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই কিরণ পণ করেছিল আর যাই হোক সে ডিফেন্সের কোনো ছেলেকে বিয়ে করবে না। কিন্তু হলোটা আর কোথায়? সেই তো সেই কুয়াতেই পড়তে চলেছে। এখানে একবার পড়ে যাওয়া মানে তার নিকট মৃত্যু অনিবার্যিত। কয়েকমাস পর খবর আসবে কিরণ দড়িতে ঝুলছে। আবার হতে পারে কোনো এক নিঃসঙ্গ বাদল রাতে ভূতের ভয়ে স্ট্রোক করে মা*রা গিয়েছে। আকাশ কুসুম এসব ভাবনায় চমকে ওঠে দাঁড়িয়ে পড়লো কিরণ। ভারি লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা পড়ে শান্তিতে নড়তেও পারছে না। চিন্তায় বোধ হয় পাগলই হয়ে যাবে। শেষ এক চেষ্টা তো করতেই হবে। তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো তার প্রাণের দোষর হৃদের কথা। মেয়েটা সেই যে কাজ করে ভেগেছে তারপর কোনো খোঁজ খবরই নেই। নির্ঘাত ম*রেছে। কিরণ মোবাইল খুঁজে ফোন করে নিলো হৃদকে। প্রথম কলটা অনায়েসে কেটে গেল। দ্বিতীয় কলে গিয়ে রিসিভ হতেই মৃদু আওয়াজ ভেসে এলো অপর থেকে,

হ্যা কিরণ! বল! সবাই চল গেছে? আমি খুবই ক্লান্ত রে। ঘুমাচ্ছি এখন। সন্ধ্যায় এসে দেখা করে যাবো।

বান্ধবী এথায় বিপদে পড়েছে আর ওখানে নাকি এ মেয়ে ঘুমাচ্ছে। ভাবা যায়! এরা বান্ধবী? কিরণের মন বলছে একে নদীতে ধাক্কা মেরে ফেলতে পারলে বোধ হয় আত্মিক শান্তি অনুভূত হতো। রাগে মাথার রগ টন টন করছে। চাপা ঝাঝালো কন্ঠে সে উত্তর দিলো,

ঘুমা তুই। সন্ধ্যায় এসে আমার ফেলে যাওয়া আত্মার সাথে দেখা করিস। বেদ্দপ মহিলা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসবি। পাঁচ মিনিট মানে পাঁচ মিনিট। না হলে কল যাবে প্রফেসরের কাছে। ওয়াশরুমের কেলেঙ্কারির কথা মনে আছে তো? প্রমাণ পাঠিয়ে দেব।

ধবধবে সাদা ছাদের উপর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিরণ। বহু কষ্টে নানা অযুহাতে নিজের ঘরে এসেছে সে। ভারি লেহেঙ্গাটা নিয়েই বিছানা জুড়ে হাত ছড়িয়ে শুয়ে আছে। তারই সামনের সোফায় জোড়া শিং এ বসে আছে হৃদ। ওরকম ধমকির পর কি ঘুমিয়ে থাকা যায়? বাসা পাশাপাশি হওয়ার দরুণ আসতে ঠিক মিনিট তিনেক সময় লেগেছে। এখন দুজন ডুব দিয়েছে পরিকল্পনায়। পরিকল্পনায় ব্যস্ত দুই নারীর মাঝে হুট করে কিরণ বলে ওঠলো,

মাথার উপর ঝারটা যদি হুট করে পড়ে যায় তাহলে কেমন হয় বলতো?

হৃদের মনোভাব বুঝতে কিরণ ওঠে বসলো। হৃদ কপাল কুচকে চোখ তুলে তাকালো। বলে কি এ মেয়ে? নিশ্চয় মাথার সংযোগস্থল বিচ্ছিন্ন হয়েছে। নতুবা এমন সিনেমাটিক কল্পনা করতো না। বড্ড বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো,

রোমান্টিক দৃশ্য তৈরী হতো। সারা বাড়ি জায়গা রেখে তুই শুধু শুধু ঝারের নিচে একা দাঁড়িয়ে থাকতি। আমি ঝারের দড়ি কাটতাম আর সেইটা তখনই অর্ণবের চোখে পড়তো আর তোকে টান দিয়ে বুকের সাথে আগলে নিতো। আহা! কি দৃশ্য! তাই না? মাথা মোটা। ঝারের তো কান আছে যে সে আমার কথা শুনে তোর শরীর ছুঁয়ে পড়তো।

কিরণ এবার ভাবলো। কথা ভুল নয়। বাড়ি ভর্তি মানুষ। আর ঝারটাও শুধুমাত্র শরীরের নির্দিষ্ট জায়গায় পরবে তারও নিশ্চয়তা। নিজে তো ম*রবেই সাথে আরো কয়েকজন বোনাসে ম*রতে পারে। কিরণ বুদ্ধির অভাবে নখ কামড়াতে থাকলো। কেটে গেলো নিরবতায় আরো মিনিট পাঁচের মতো। তখনই হৃদ কষে ফেললো চমৎকার এক ছক। দেরি করার সময় একদমই নেই। তাই হৃদ পরিকল্পনা মতো চলে গেলো রান্না করে। তেল খুজছে। অর্ণবকে ফেলবে? মোটেও না। ওরকম বোকামি তারা করবে না। আত্মঘা*তী করবে। কিছুটা ব্যথা পাবে আর অনেকটা দেখাবে। এদিক ওদিক দেখে নিলো ভালো করে। এদিকটায় এখন কেউ নেই। হল রুমটায় বরপক্ষ নিয়ে সবাই ব্যস্ত। এইতো মক্ষম সুযোগ। সিড়িতে কিছু তেল ঢালতে ঢালতে নিজেদের এমন ছিঁচকে পরিকল্পনার প্রশংসা না করে থাকতে পারলো না। কাজ শেষে হৃদ দৌড়ে গেলো কিরণের রুমে। কিরণ নিজেকে প্রস্তুত করছে কিভাবে সে পড়ে যাবে, কিভাবে অজ্ঞান হয়ে থাকবে। তেলটা তো শুধু নামমাত্র ফেলা হয়েছে দেখানোর জন্য। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে হৃদের দিকে তাকালো। হৃদ চোখ দিয়ে সাহস যুগালো। বের হওয়ার আগে একগ্লাস পানি ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে খেয়ে নিল।

কিরণ সিড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পা কাঁপছে। কিভাবে পড়বে সে? যদি সত্যি সত্যি আছাড় পড়ে কোমর ভেঙ্গে যায়? নাহ্! ভয়ে পেলে চলবে না। বড় কিছু পেতে এমন ছোট ব্যাথা পাওয়াই যায়। কিরণ এক পা এক পা করে এগোলো। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সিঁড়ি গুনে গুনে পা ফেলছে। হৃদের ভাষ্যমতে উপর থেকে ছয় নম্বর সিঁড়িতে সে তেল ফেলেছে। অথচ কিরণ নয় নম্বর সিঁড়িটা পাড় হয়ে এলো। কোথাও তো তেল পেলো না। শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করে এসে হৃদের দিকে বজ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। হৃদও যেন হতবাক! হলোটা কি? কিরণ তো পড়লো না। সিঁড়ি ভেঙে নিচে আসতেই কিরণ হৃদের ডান হাত চেপে ধরে ধীর গলায় বললো,

কিরে! তোর তেল কোথায়? পুরো সিঁড়ি তো ফাঁকা। মিথ্যা বলছিস কেন?

হৃদ নিজেও বোকা বনে আছে। সে তো নিজ হাতে তেল ফেলেছে। গেলো কই এতো অল্প সময়ের মাঝে? কথার মাঝে হঠাৎ একদল মেয়ে এসে নিয়ে গেলো কিরণকে। বিয়ের সময় হয়ে গিয়েছে। কিরণ, হৃদ দুজনের বোকা বনে গিয়েছে। কিরণকে টেনে এনে পূর্বের আসনে বসিয়ে দেওয়া হলো। কিরণ পাথরের ন্যায় বসে আছে। আবার পরিকল্পনা ব্যর্থ। হৃদ অসহায় ভঙ্গিতে পাশে বসতেই কিরণ ঝলসানো চোখে হৃদের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হৃদ সরলভাবে বলে,

বিশ্বাস কর আমি ফেলেছিলাম তেল। তিন সত্যি। কিভাবে তেল উধাও হলো আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।

তেলের পা গজিয়েছে। হেঁটে হেঁটে স্থান পরিবর্তন করেছে। আমারই ভুল হয়েছে তোর কথা শুনে। সকালে একটা পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো এখন আবারো একটা। তুই কোনো কর্মেরই না।

হৃদ অসহায় ভঙ্গিমায় বললো,
আমি সত্যিই ফেলেছিলাম। আর গতকালকের অর্ণবের অফিসের নাম্বারটাও আমি সঠিকই এনেছিলাম। তুই তো কথা বলে জিজ্ঞাসাও করেছিলি। তারা তো বলেওছিল ওটা অর্ণবের অফিস। এখন আমাকে দোষ দিচ্ছিস কেন? কত কষ্ট করে পিছু নিয়ে নাম্বার জোগার করেছিলাম তা মনে নেই তোর? এখন ব্যর্থ হয়ে আমাকে দোষ দিচ্ছিস?

সত্যিই তো! নাম্বারটাও তো সঠিকই ছিল। বিয়ের কনের একদিন আগে বের হওয়া নিষেধ। তাই চেয়েও কিরণ বের হতে পারে নি। কিরণ জানতো অর্ণব সরকারি চাকুরিজীবী। সরকারি চাকুরিজীবী হওয়ায় যেমন সুবিধা তেমন অসুবিধাও রয়েছে। কার্যালয়ে কর্মরত ব্যক্তিদের “স্ত্রী” গণও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছেন। কিরণের বাবার দরূণ এ ব্যপারে সে অবগত হয়েছে। কৌশলে অফিসের ফোন নম্বর জোগার করেছিলো হৃদ। গতকাল বিকেলে অর্ণবের পিছু নিয়েছিল। খুবই সাবধানতার সহিত এক কর্মচারির কাছ থেকে অফিসের নাম্বার নিয়েছিল। সেখানেও কাঠখর পুড়াতে হয়েছে। কিরণ ফোন দিয়ে বলেছিলো তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাচ্ছে তাকে তালাক দেওয়া ব্যতীত। কিরণ নিশ্চিত ছিল এইটা কাজ করবে শতভাগ। সেখানে এখন জানতে পেরেছে সে প্রতিরক্ষা কর্মী। নিয়ম কানুন অধিকতর জোড়ালো। জবাবদিহি করতে, প্রমাণ জোগার করতেও একটা দিন লেগে যাওয়ার কথা।চাকরি সংশয়ে থাকার কথা। বিয়েতে উপস্থিত হওয়া অসম্ভব। কেন তবে অর্ণব বর বেশে এখানে? কিভাবে? তখনই ফোনের ম্যসেজ,

আবারো ব্যর্থ চেষ্টা! আফসোস!

অর্ণবের ম্যসেজই বলে দিচ্ছে এবারো তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করার পেছনে তারই হাত রয়েছে। কি সাংঘাতিক! করলো কখন?

কিরণ মুখের উপর এক হাত ঘোমটা টেনে বসে আছে। ডানপাশে ওর মা এবং বাম পাশে বাবা বসে আছে। সামনের চেয়ারে বসে আছেন কাজী সাহেব। হার সন্নিকটে। অবধারিত। বের হওয়ার আর কোনো পথ নেই। তাই উপায়হীন হয়ে কবুল করছে বিয়ে। গলা অবরুদ্ধ হয়ে আসছে। কবুল শব্দটা যেন বেরই হচ্ছে না। হাত ঘেমে একাকার। অবাধ্য চোখের জল বয়ে চলছে অবিরাম। অর্ণবের বলা তিন কবুল তার কানে এসেছে। তখন থেকে কিরণের হৃদযন্ত্র অদ্ভুতভাবে কাঁপছে। তার নামে গোটা একটা মানুষ দখল হয়ে গেল। কিরণকে কবুল করে নিয়েছে। দীর্ঘ সময় পূর্বে এই পুরুষকে তো সে এমন রূপেই চেয়েছিল। আজ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে পেয়েও গেল। তবে কেন সে পছন্দ আজ অপছন্দের তালিকায়? কেন সে চাওয়ায় আজ পড়েছে বাঁধ?

আধঘন্টা পর বিয়ে সম্পন্ন হলো। চারিদিকে মুখোরিত হলো ‘ আলহামদুলিল্লাহ ‘ শব্দে। পাশের আসন থেকেও মৃদু আওয়াজে ভেসে এলো ‘আলহামদুলিল্লাহ’ স্বর। কিরণের কানে শব্দটা আসতেই শিরদাঁড়ায় বয়ে গেল শীতল অনুভূতি।

শুরু হলো বিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম। অর্ণব যেন এরই আশায় রয়েছে। রঙ্গিন পর্দা ও ফুলের আবরণ ভেদ করে দৃষ্টি রয়েছে তার ওপারে। অপেক্ষার প্রহর গুনছে এ দেয়াল ধসে পরার। অপেক্ষার প্রহর শূন্যের কোঠায়। ধীর গতিতে পর্দা সরিয়ে নিলো অর্ণব। কিরণের সামনে গিয়ে একহাত লম্বা ঘোমটাটা ছুঁতেই উপলব্ধি করলো তার হাত কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা হাতে প্রেয়সীর ঘোমটা খুললো। অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এলো ‘ মাশাল্লাহ! ‘

অর্ণব খুবই সাবধানে আরেকটু নিকটে গিয়ে নমনীয় স্বরে বললো,

তার নাম তার রূপেরই বৈশিষ্ট্য!

কিরণ চোখ তুলে তাকালো। চোখে মুখে বিষ্ময়! অর্ণবের এমন স্বরের সাথে কিরণের কোনো সাক্ষাৎ নেই। এমন আচরণ সম্পর্কেও অবগত নয়। এত মাদকতা কেন এই কন্ঠে?

বিদায় পর্ব শেষে কিরণ ও অর্ণব পাশাপাশি বসে আছে গাড়িতে। কিরণ অর্ণবের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু অর্ণব খুবই শান্তভাবে বসে আছে। দৃষ্টি তার ফোনে। ভিষণ রকমের মেলোড্রামা করে কিরণ এ গাড়িতে হৃদকে বসিয়েছে। সামনের সিটটা দখল করে বসে আছে। কিরণের মন বলছে অর্ণব আশাহত হয়েছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। এতেই সে খুশি। আহা! কিছুতে তো সফল হলো।

বাহিরের ভিষণ বাকবিতন্ডা মিটিয়ে অর্ণব বাসর ঘরে প্রবেশ করেছে। কিন্তু একি! তার বউ তো খাটে নেই। অবশ্য এতে খুব বেশি অবাক সে হয় নি। গাড়িতে কিরণ খুবই চুপচাপ ছিল। তখনই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছিল মস্তিষ্কে কিছু রান্না হচ্ছে। অর্ণব বিলম্ব না করে ঘরের রঙ্গিন বাতি নিভিয়ে সাধারণ বাতি জ্বালিয়ে দিল। এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘোরাতেই দেখতে পেলো কিরণ ড্রেসিং টেবিলের উপর বসে তার জন্য বরাদ্দ মিষ্টি খাচ্ছে। এ মেয়ে কি সারাদিন খায়?

খাওয়া শেষে কিরণ হাতের প্লেটটা পাশে রেখেই উঠে দাঁড়ালো। চোখ তুলে তাকালো অর্ণবের দিকে। অর্ণবের নির্লিপ্ত চাহনি কিরণের বুকে গ্রীষ্মকাল এনে দিচ্ছে। না চাইতেই অর্ণবকে পরখ করে নিলো। অর্ণবের উচ্চতা বুঝি পাঁচ ফুট দশ ছাড়িয়ে যাবে। শ্বেত বর্ণের রং এ নীল রংটা যেন জেঁকে বসেছে। এ পুরুষ এতো সুদর্শন কেন? এ সুদর্শন পুরুষটি তার ভাবতেই কিরণের উপলব্ধি হলো সে পথভ্রষ্ট হচ্ছে। অর্ণবের উপর প্রেম বিশ্লেষণ করা তার কাজ নয়। নিভিতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অর্ণবের মুখোমুখি দাঁড়ালো। অর্ণবের ভাবলেশহীন মুখ। বোঝার উপায় নেই কিরণের কাজকর্ম সে কিভাবে নিচ্ছে। কিরণ এক হাত সামনে রেখে সরাসরি বলে ফেললো,

আমার দেনমোহর!

অর্ণবের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি। কিরণের পাশ দিয়ে পিছনে চলে গেলো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে আলমারি থেকে একটা খাম বের করে ধরিয়ে দিল কিরণের হাতে। কিরণ খামটা বের করে দেখলো তিন লক্ষ টাকার চেক। এতো সহজেই দিয়ে দিলো? চেকটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললো,

ধন্যবাদ আশা করবেন না। এটা আমার অধিকার।

অর্ণবেরও সোজাসোজিও কথা,

তোমার অধিকার বুঝে নিলে এবার আমারটাও বুঝে নেই?

কিরণ চমকে উঠলো। তার অধিকার মানে? সে স্বামীর অধিকার চাইছে। দেনমোহর মিটিয়ে দিয়েছে তাই তার কোনো বাঁধা নেই আর। ভয়ার্থ চোখে অর্ণবের দিকে ঘুরতেই বুঝতে পারলো অর্ণব তার সন্নিকটে। ভয়ে পিছিয়ে পড়লো কিরণ। কোমর বরাবর ঠেঁকেছে ছোট টেবিলটা। পরিস্থিতি বেগতিক। এবার বুঝি অর্ণব শোধ তুলবে? কি করা যেতে পারে? হাত মুঠ করে লেহেঙ্গা চেপে ধরতেই বিদ্যুৎতের গতিতে খেলে গেল কূটবুদ্ধি। খুবই দ্রুত বলে ওঠলো,

গরম লাগছে! মানে এতো ভারি গহনা, লেহেঙ্গা পড়ে গরম লাগছে। আমার পরিবর্তন করা দরকার।

বলেই ছুট লাগালো নিজের লাগেজের দিকে। কিন্তু সারাঘর খুঁজেও কোথাও তার লাগেজটি পেলো না। পোষাকের ভারে সারা ঘর খুঁজে ক্লান্ত হয়ে বসে পরলো বিছানায়। অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব সোফায় গা এলিয়ে পা তুলে বসে আছে। দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ। ঠোঁটে উপহাসের হাসি। কিরণের ধারালো মস্তিষ্ক সেকেন্ডেই বুঝে নিল এ কাজ অর্ণবের। এখন কি করবে সে? সারা রাত এ পোষাক পড়ে থাকলে সে নির্ঘাত বিনা আগুনে সিদ্ধ হয়ে যাবে। রাগ তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। অর্ণবের মুখের নিরব হাসি যেন আগুনের মাঝে ঘি। কিরণ উঠে গিয়ে অর্ণবের সামনে গিয়ে চেচিয়ে বলে ওঠে,

আমার লাগেজ কোথায়? ভালই ভালই দিন। আমি জানি আপনি সরিয়েছেন আমার লাগেজ।

অর্ণবের শান্ত স্বর,

কোনো প্রমাণ আছে?

কি সাংঘাতিক পুরুষ! প্রমাণ চাইছে! একই বাক্যে স্বীকারোক্তি আবার প্রমাণও চায়ছে? কিরণ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে রুমময় পায়চারি শুরু করছে। হঠাৎই থেমে গেল পা। দৃষ্টিতে আটকালো টেবিলের উপর রাখা আলমারির চাবি। দ্রুত গতিতে চাবি হাতিয়ে নিলো। অর্ণব কিছু বোঝার আগেই জানালা ভেদ করে চাবি পৌঁছে গেল বাগানের ঝোপে। অর্ণব দ্রুত ওঠে এসে দাঁড়ালো কিরণের মুখোমুখি। চোখে মুখে বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

এটা কেন করলে?

কিরণের মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। এতোক্ষণে তার অসীম শান্তি অনুভব হচ্ছে। হেলে দুলে বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বসলো। হাত দিয়ে হেলে বসলো। রন্ধ্রে রন্ধ্রে এবার একটু শান্তি প্রবাহিত হচ্ছে। হাসি হাসি মুখেই জবার দিলো,

আমি এমন বস্তা পড়ে সারারাত কষ্ট করবো আর আপনি আরাম করবেন? তা কি আমি হতে দিতে পারি?

অর্ণব কিরণের বোকামিতে এবার না হেসে পারলো না। মেয়েটা প্রতিবারই নিজের চালে নিজে ফেঁসে যাচ্ছে। ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠলো। কিরণের ভ্রু কুচকে এলো। হাসছে কেন লোকটা? পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি? সামান্য চাবির শোকে পাগল হওয়া অসম্ভব। তাহলে কাহিনিটা কি? অর্ণব হেসে কাউচে বসলো। শেরওয়ানির বোতামগুলো খুলতে খুলতে বললো,

তোমার আজকের দিনটাই ব্যর্থতার বুঝলে? আমার মতে এই দিনটা তোমার দিনপঞ্জিতে বিশেষ ভাবে দাগ কেটে রাখা উচিৎ।

কিরণের চোখে মুখের জিজ্ঞাসা দৃষ্টি। অর্ণব শেরওয়ানি খুলে ফেললো। তার নিচে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি। কাউচ থেকে ওঠে পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে একটা তাওয়াল হাতে নিলো। ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই বলে ওঠলো,

আলমারির ভেতরে তোমার জন্য একটা সুতির শাড়ি ছিল। আফসোস! আবারো গোল খেলে!

অর্ণব দরজা আটকে ভেতরে ঢুকে গেলো। আর কিরণ বসে রইলো বোকা বনে।
নিজের বোকামিতে ভিষণ আফসোসে ব্যস্ত হয়ে হঠাৎ চোখ পড়লো হালকা নীল রঙ্গের পোষাকে। কৌতুহলে এগিয়ে গেলো। অর্ণবের ইউনিফর্ম! লোগো দেখে মস্তিষ্ক জানান দিলো তার এই মারাত্মক ধুরন্ধর স্বামী বিমানবাহিনীর। বুকের পাশটায় লাগানো নামটায় আপনাআপনি হাত চলে গেলো। অস্ফুট স্বরে উচ্চারিত হলো,

” উইং কমান্ডার অর্ণব শাহরিয়ার ”

চলবে ~

আমার লেখার মাঝে বানান ভুলের জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। অনেকদিন চেষ্টায় না থাকার কারণে বানান ভুল হয়ে যাচ্ছে। এ ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আবেদন রইলো। ধন্যবাদ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here