বিপরীতে_তুমি_আমি #পর্বঃ০৪

0
1300

#বিপরীতে_তুমি_আমি
#পর্বঃ০৪
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম

ভোরের আলো কেবলি ফুটছে। দু একটা পাখি সবে মাত্র সকালের বার্তা নিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে যাচ্ছে। মৃদু মন্দ শীতল হাওয়া বাহিরে অথচ ক্যলেন্ডারে তাকালে বোঝা যাবে চৈত্র মাসের অর্ধেকটা পার হয়ে গিয়েছে। ঋতু বোধহয় আগের রীতি অনুসরণ করে না। নতুবা অগ্রহায়ণে ঘামে কেন শরীর ভিজবে আর কেনই বা চৈত্রের আগমনেও কাথায় শরীর ওম খুঁজবে? সাত পাঁচ বিভিন্ন দিক ভেবে বিছানা ছেড়ে ওঠে বসলো অর্ণব। দু পা মেঝেতে রেখে পিছু ফিরে তাকালো। বিছানার ওপাশটায় ঘুমিয়ে আছে কিরণ। শরীরটা বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে আছে। মুখটা ওদিক ফিরিয়ে রাখা। নিঃশব্দে অর্ণব পা ফেলে চলে গেল কিরণের পাশে। শরীরের সাদা চাদরটা ফেলে রেখেছে মেঝেতে। সযত্নে তা তুলে দিলো গায়ে। অর্ণবের খুব করে মন চায়ছে বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকা নারীটির ললাটে গভীর চুম্বন দিতে। অদৃশ্য চুম্বকীয় শক্তি যেন অবিরত টানছে। অর্ণবে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে দ্রুত পা ফেলে চলে গেলো ওয়াশরুমে।

বাহিরে হাঁটতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে অর্ণব। ঘড়ির পড়তে পড়তে বের হয়ে এলো রুম থেকে। পুনরায় পিছু ফিরে কিরণকে এক পলক দেখে নিয়ে দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে গেলো। এ মেয়ে কি করে এতো ঘুমায় তা? অবশ্য যতক্ষণ ঘুমায় ততক্ষণ বুঝি একটু নিশ্চিতে থাকে অর্ণবে। সিড়িগুলো নামতে নামতে মস্তিষ্কে হানা দেয় বছরের কয়েক আগের স্মৃতি। এমন দিনের অপেক্ষায় বিগত কত বছর সে পুড়েছে, কত ত্যাগ করেছে তা কেবল এক বর আরেক সেই হয়তো জানে। সাত সাতটি বছরের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। কিন্তু এ সাত বছরে অভিমান নামক এক অদৃশ্য প্রাচীর যে এতো মজবুত হয়ে দাঁড়াবে তা ভাবতে পারে নি অর্ণব। হৃদ গহ্বর থেকে বেড়িয়ে এলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস। অর্ণবের বোধ হলো এ নিঃশ্বাস বোধ হয় তার হৃদ চিড়ে নির্গত হলো। চিন চিন যন্ত্রনা! বোঝতে না পারার যন্ত্রণা। বোঝাতে না পারা অক্ষমতার যন্ত্রণা।

ঘামে গায়ের কালো টি শার্টটা ভিজে আছে অর্ণব। তবুও সাবলিল ও স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে শশ্বরের পাশে। হাতে চায়ের কাপ। কয়েক মিটার দৌড়িয়ে গরমে বেশ জেঁকে ধরেছে। কেবলমাত্র সৌজন্যতার খাতিরে শশ্বরের চায়ের সঙ্গি হয়েছে। পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে ততক্ষণে পুরোপুরি সকাল। প্রতিটি প্রাণী ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজ কর্মে। ছাদের একাংশে দুটো চেয়ারে বসে আছে অর্ণব ও কিরণের বাবা শাফিউদ্দিন শরিফ। দুজনের হাতেই চায়ের কাপ। সামনের টেবিলটায় মোড়ানো সংবাদপত্র। গতরাতে প্রথা অনুযায়ী মেয়ে এবং মেয়ের জামাইকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। ভোরের শেষে অর্ণবকে দেখে বসিয়ে নিলেন নিজের পাশে। বিশেষ আলাপ তবে বিশেষ কোনো কথা এখন পর্যন্ত বলেন নি। নীরবতা কাটিয়ে তুলতে চায়ের কাপ রেখে অর্ণব বললো,

বাবা বলবো নাকি স্যার?

শাফিউদ্দিন হেসে ওঠলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,

আমি তোমার কোনো সম্পর্কেই স্যার হই না অর্ণব।

বয়সে এবং পদবিতে, উভয় ক্ষেত্রেই আপনি আমার বড়।

শাফিউদ্দিন পুনরায় মুচকি হেসে জবার দিলেন,

আমি পদবিতে বড় তবে তোমার বাহিনীতে নয়। আর বয়সে বড় হলেও স্যার ডাকা প্রযোজ্য নয়। তাই স্যার ডাকার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। তুমি আমার একমাত্র জামাতা। জামাতার মুখে বাবা ডাকটাই বোধ হয় শ্রেয়।

অর্ণব মুচকি হাসলো। হাসি এলো মানুষের পরিবর্তন দেখে। এই মানুষ আর সাত বছর আগের মানুষটার মাঝে কত পরিবর্তন! এ পরিবর্তন কি সময়ের নাকি তার অবস্থানের জন্য? অর্ণব মস্তিষ্কের চিন্তা শক্তিতে অবরোধ দিল। অতীতের কথা যত পুনরাবৃত্তি করা হয় তত তিক্ততা বাড়ে। ফেলে আসা জিনিস ফেলে রাখাই ভালো। তাই অর্ণবও ফেলে রাখলো তা পিছনে। কন্ঠে কৃতজ্ঞতা নিয়ে বললো,

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা! জানি ধন্যবাদ দেওয়াটা বেমানান তবুও এইটা আমার কৃতজ্ঞতার ক্ষুদ্রতম প্রয়াস হিসেবে ধরে নেবেন। আমার আমানতের খেয়ানত না করার জন্য আমি চির কৃতজ্ঞ বাবা!

শাফিউদ্দিন চায়ের কাপ রেখে অর্ণবের দিকে তাকালেন। চোখের চশমা খুলে মুছতে মুছতে গম্ভীর গলায় বললেন,

আমাদের আরেকটা নীতি আছে হয়তো জানো। মানবিক নীতি! আমাদের ওয়াদাই আমাদের দলিল। কথা যখন দিয়েছিলাম তখন তা আমাকে রাখতেই হতো। তোমার কথা তুমি রেখেছো আমার কথা আমি। এ বিষয়ে কথ না বলাই আমি উত্তম মনে করি। আমি চাই না কিরণ এ বিষয়ে অবগত হোক।

অর্ণবও সহজ জবাব দিলো,

আমিও চাই না আমার আপনার কথা রব ব্যতীত দ্বিতীয় কেউ জানুক। তবে সেরকম পরিস্থিতি আসলে নিজেকে ডিফেন করতে আমার এর আশ্রয় গ্রহন করতে হলে আমি করবো।

হঠাৎ ব্যতিক্রমি শব্দে ছন্দপতন হলো আলোচনার। অর্ণব পকেট থেকে ফোন বের করলো। শাফিউদ্দিনের দিকে তাকাতেই তিনি ইশারায় অর্ণবকে মুলতবী দিলেন। অর্ণব সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে নেমে এলো ছাদ থেকে। রুমে ঢুকে বিছানাটা ফাঁকা আবিষ্কার করলো। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। দরজা লাগিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। একহাতে ফোন। অপর হাত পকেটে। দুবার রিং হতেই রিসিভ হলো ফোন। ওপাশ থেকে আওয়াজ আসার আগেই অর্ণব সু দৃঢ় কন্ঠে বললো,

রিপোর্টিং, উইং কমান্ডার অর্ণব শাহরিয়ার।

দিস ইজ এয়ার কমোডর আসাদুজ্জামান। অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি তোমার সাতদিনের ছুটির আবেদন গ্রহণ করা হয় নি। তাই আগামীকালই হেড কোয়ার্টারে তোমার উপস্থিতি দিতে হবে।
তবে হ্যা আনন্দের সংবাদও রয়েছে।

সেইটা কি স্যার?

তোমার কালকের আবেদনটা উপর মহল গ্রহণ করেছে। এতো দ্রুত কারো আবেদন আজ পর্যন্ত আমি গ্রহণ করতে দেখি নি। সো কংগ্রাচুলেশনস মাই বয়! লেটারটাও কালকে এসে নিতে হবে।

ছুটি বাতিলের কথা শুনে অর্ণবের কপাল কুচকে এলো। প্রথমে তা বিরক্তের হলেও সিনিয়রের পরবর্তী কথা তা চিন্তায় পরিবর্তন করে দিলো। দ্বিতীয় আবেদন বলতে কি বুঝিয়েছে? কোন আবেদনের কথা বলছে? আদেশ শিরধার্য করে ফোন কেটে রুমে ডুকেই চোখ পরলো কিরণের উপর। সদ্য গোসলে করে আসা স্নিগ্ধ রমনীতে অর্ণবের হৃদযন্ত্র যেন বিকল হয়ে পড়েছে। অঙ্গে শোভা পাচ্ছে সেই লাল শাড়ি। ভেজা চুলে কেবলি তাওয়ালের খোঁপা বাঁধছে। হাতের সোনালি চিকন চুরিটায় পাক্কা ঘরনি লাগছে কিরণকে। অর্ণবের মনে পড়ে যায় চিরচায়িত সেই কথাটি, ” নারীকে আগুনের আলো ও পানির বিন্দু অধিক মোহময় করে তুলে। ”

কিরণ চুল বেঁধে বিছানার দিকে এগোতেই বুঝতে পারে ঘরে দ্বিতীয় ব্যক্তিটির উপস্থিতি। ঘাড় ঘুরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকালো। দু হাত পকেটো গুঁজে বলিষ্ঠ দেহটা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দিকে তাকাতেই ধক করে কেঁপে ওঠলো বুক। ওই চোখে আজও তাকানোর সাহস হলো না কিরণের। সম্মোহন চোখ জোড়া। কিরণ মন বলে এ দৃষ্টি কেবল কিরণের দিকেই নিক্ষিপ্ত হয়। লোকটা জেনে বুঝে ইচ্ছে করে এমন করে যেন কিরণ তাকাতে না পারে। যদিও বা ভুলক্রমে তাকায় তবে যেন ম*রে যায়। বাজে ভাবে ম*রে যায়। কিরণ চট করে ঘুরে দাঁড়ায়। হাত কাঁপছে মারাত্নক ভাবে। দ্রুত বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। বিছানা অগোছালো পড়ে আছে। বালিশটা হাতে নিতেই ঘাড়ে উষ্ণতা অনুভব হলো। বালিশ পড়ে যেতে যেতে ধরে ফেললো কিরণ। উষ্ণতার উৎস কিরণ ইতিমধ্যে উপলব্ধি করে ফেলেছে। সর্বনাশ হয়ে যাবে নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রনে না আনলে। এতো বছরের অভিমান এ মূহুর্তে এভাবে দূর্বলতার কাছে হেরে যেতে পারে না। বালিশটা খামচে ধরে পিছন ঘুরতে চেয়েও পারলো না। অর্ণবের সুঠাম হাত কিরণের কোমর পেঁচিয়ে ফেলেছে। বৃহৎ বৃক্ষকে যেমন তৃণমূল জড়িয়ে রাখে তেমনি অবস্থান যেন অর্ণব ও কিরণের। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ফেঁসে গেল কিরণ। অর্ণব খুবই কৌশলে আটকে রেখেছে কিরণকে। কানের পেছন টায় অর্ণবের নিঃশ্বাসের প্রতিফলনে কিরণকের শ্বাসকষ্টের উপদ্রব দেখা দিচ্ছে। মন মনে কোঠর প্রতিজ্ঞা করলো। এই পিড়ার শোধ হাড় জ্বালানো হবে। গলা কাঁপছে কিরণের। শব্দ বের হচ্ছে না। কিন্তু এই আওয়াজই তো তার পরিচয়, তার শক্তি! এতো সহজে রুদ্ধ হলে চলবে কি করে?

দূরত্বের খুব শখ আপনার তাই না? আবার ডাকছে সেই দূরত্ব আপনাকে!

চলবে ~~

অসুস্থায় দুদিন ধরে একটু একটু করে লিখেছি। ভুলভ্রান্তি হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। আশা করছি প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ বিষয়টা বিবেচনায় রাখবেন। গল্পে অল্প সংখ্যক রহস্য রয়েছে। ধৈর্য নিয়ে পড়ুন। ধীরে ধীরে খোলাশা হবে। গঠনমূলক মন্তব্যের আশা প্রার্থী। ধন্যবাদ সবাইকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here