#বিপরীতে_তুমি_আমি
#পর্বঃ১৬
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম
সেদিন থেকে কিরণের মন হলো চঞ্চল, উতলা। বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে থাকতো অর্ণবে এদিক ওদিক। প্রতিদিনের রুটিন পরিবর্তন হয়ে গেল নিমেষেই। তৈরী হলো নতুন নিয়মানুবর্তিতা। পাঠদানে ঠিক দশ মিনিট আগে শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করা কিরণ অর্ণবের আগে স্কুলে চলে আসতো। সুযোগ করেই বসে থাকতো স্কুলের সদর দরজাটার দিকে। লুকিয়ে দেখাটাই হয়ে ওঠেছিল তার নিত্যদিনের কাজ। সরাসরি গিয়ে দাঁড়ানোর সাহসটা করে ওঠতে পারতো না। মনে হতো অর্ণবের ধারালো চোখের দৃষ্টিতে তাপ আছে। প্রচন্ড তাপ! কিরণর উপর পরলেই যেন ভষ্ম হয়ে যাবে তার সমস্ত শরীর।
এর মাঝে তাদের রাস্তা যে এক হয় বিষয়টা একদমই তা নয়। বরং কিরণ হতে দেয় নি। দূর হতে যখন অর্ণবের কায়া চোখে পড়তো হন্তদন্ত হয়ে ফিরে যেতো। নতুবা বিকল্প রাস্তায় মুখ ঘোরোতো।
কিন্তু বিধাতার লিখন না যায় খন্ডন। কিরণের বিতর্ক প্রতিযোগিতার প্রতি ছিল ভিষণ আকর্ষণ। ছোট হলেও সর্বদা এ ধরনের প্রতিযোগিতায় অর্ন্তভুক্ত থাকতে সে ছিল প্রচন্ড আগ্রহী। আন্তঃ প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিযোগিতার একের পর এক ধাপ এগিয়ে যখন তার দল পৌঁছে গেল শীর্ষ তিনে তখন তার বিরোধী দল হিসেবে নির্বাচিত হলো অর্ণবের দল। কয়েকদিনের সকল মেহনতে পড়ে গেল পানি। এক সমুদ্র পানি! মানব জীবনো কাকতালীয় ঘটনা সম্পর্কে কিরণ শুনেছে কিন্তু এতোটা কাকতালীয় তা হয়তো জানা ছিল না। আগের রাতের সকল প্রস্তুতিকে বৃথা করে কিরণ নিজের বক্তব্য এলোমেলো করে ফেললো। অর্ণবের উপস্থিতিতেই বেলুনের মতো চুপ গেল তার আত্মবিশ্বাস। দাপটের সাথে বিরোধী পক্ষকে হারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। যার কাছে নিজের তন মন খুইয়ে নিঃস্ব তাকে কি হারানো যায়?
দলের প্রধান স্বাভাবিকভাবেই ছিল একজন বড় ভাই। দশম শ্রেণীর ছাত্র। সেও ছিল দুর্দান্ত ছেলে। কিরণের ভুল শুধরাতে না পারলেও দলকে হেরে যেতে দেন নি। সেরার মুকুট অর্ণবের দল পেলেও দ্বিতীয় সেরা হিসেবে পরিচিতি লাভ করলো কিরণের দল। তবে এ জল এখানেই থেমে থাকলো না। গড়িয়ে গেলো সামনে। ঘটনার সপ্তাহ খানেক পরই জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রতিষ্ঠানের হয়ে লড়তে একটা সুযোগ পেলো কিরণ। ব্যপারটা খটকা লাগল কিরণের। সে তো ভালো করে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনই করতে পারে নি। তবে তাকে কিভাবে প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত করে? প্রশ্নের উত্তর হিসেবে পায় তার পূর্বের পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে নির্বাচিত করা হয়েছে।
কিরণ মনে খুশিতে মেতে ওঠলো। এতো বড় সুযোগ আসবে এই বয়সেই সে ভাবে নি।
পরেরদিন থেকেই ওদের চর্চা শুরু। নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করতেই পুনরায় থমকে গেল কিরণ। পা আটকে গেল। কোনো রকমে দলের সাথে গিয়ে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক খেয়াল করে দেখলো তার বয়সী এখানে কেউ নেই। কেবলমাত্র সেই নয়, এখানে উপস্থিত কারো সহপাঠী নেই। প্রতি ক্লাস থেকে সেরা একজনকেই বাছাই করে নেওয়া আনা হয়েছে। তারমাঝেই কিরণ সর্ব কনিষ্ঠ। তারা এখানে উপস্থিত পাঁচ জন। সাথে দুজন শিক্ষক-শিক্ষিকা । ওরা সকলেই সারি বদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। কিরণের হাত ঘেমে আসছিল বারবার। অর্ণবের উপস্থিতিতেই কিরণ উশখুশ করছে। সামনে ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষিকা। উনারা অর্ণবেকে ডেকে নিলেন। দলনেতা হিসেবে নির্বাচিত করলেন অর্ণবকে। কিরণের মন বলছে এখান থেকে বেড়িয়ে যেতে। কিন্তু চাইলেই হয় সব? নির্বাচন করা শেষ। এই পর্যায়ে সরে আসা মানেই বিশাল জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে প্রধানের কাছে। প্রতিষ্ঠানের মান সম্মান জড়িয়ে আছে। কিরণ মেনে নিল সব। নিজেকে যথেষ্ট শক্ত করে ধরে রাখার স্বার্থে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো ক্রমাগত। কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। চূড়ান্ত বাছায়ের দিন কিরণের করা ভুলে শিক্ষক শিক্ষকা চিন্তিত হয়ে তার দায়িত্ব অর্পন করে দিল অর্নবের কাছে।
কথাটা শোনা মাত্রই কিরণ কেঁপে উঠলো। হাত পায়ে সে কি সাংঘাতিক পর্যায়ের কাঁপুনি! এখন তার উপায় ? যা থেকে এতোদিন সে পালিয়ে বেড়ালো সেখানেই তার আস্তানা হলো।
সকলে আলোচনা শেষে একে একে চলে যেতে লাগলো। কিরণ সারাটা সময় মূর্তির মতো চুপ রইলো। কি বলবে সে? সে যে বাকহারা! ক্লাসের দরজার দিকে এগোতেই পেছনের ডাকে সাথে সাথে থেমে গেল কিরণ। সাথে থেমে গেল যেন ওর হৃদস্পন্দনও। দু হাতে জামা খামছে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এখনই যেন কিরণ সত্য সত্যই মুর্তি হলো। মানব মুর্তি। পেছন থেকে পুনরায় ডাক এলো,
এই কোঁকড়া চুল! ডাকছি শোনো নাই?
কিরণ পিছন ফিরলো। অর্ণব একটা বেঞ্চের উপর দু হাতের ভর দিয়ে দাড়িয়ে আছে। কিরণ মাথা নিচু দাঁড়িয়ে ছিল। আঁড় চোখে দেখতে পেলো অর্ণবের পায়ের দিকে। এক পায়ের উপর আরেক পা ক্রশ করে দাঁড়িয়ে। কি আরাম! অর্ণব নিজের অবস্থানেই রয়েছে। কিরণও নিজের অপরিবর্তিত স্হানে। অর্ণব আবারো বললো,
এই যে জনাবা! আমার দিকে তাকান।
কিরণের দু ঝুটি করা চুলের গোড়া বেয়ে ঘাম বেয়ে নামলো। গরমে ঘেমে যাচ্ছে আর অন্যদিকে হাত পা যেন ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। মৃদু ধমকে ওঠলো আবারো,
কি সমস্যা তোমার? বললাম না মাথা উঁচু করতে। আমার দিকে তাকাতে। ফাস্ট! আমার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রাখো তো। কুইক!
কিরণ ধমক শুনে অর্ণবের পানে চাইলো। আবারো সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মুহুর্তেই ঝলছে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলো কিরণের। তড়িৎ গতিতে চোখে নামিয়েই অগোছালো হয়ে বললো,
জ জ জ্বি ভাইয়া.. কিকিছু ব বলবেন?
মাটির দিকে এক ইঞ্চি ঝুঁকে থাকলে কথা বলবো কি করে? বক্তব্য কি এরকম নতুন বউয়ের মতো মাথা ঝুকিয়ে দেবে?
কিরণ মাথা দিয়ে না করতেই অর্ণব নিজের লম্বা পায়ের সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে এলো। নিজেদের মাঝে দু হাতের পার্থক্য রেখে দাঁড়লো। অর্ণবকে এগোতে দেখে কিরণ ভয়ে পিছিয়ে যেতে অর্ণব গম্ভীর কন্ঠে ধমকে বললো,
ডোন্ট মু্ভ। লুক এট মি রাইট নাও এন্ড স্পিক আপ। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে। যতক্ষণ না বলব ততক্ষণ তোমার ছুটি নেই। আজকে তোমার কাজ এতোটুকই। ফাস্ট!
কিরণ এক আঙ্গুল দিয়ে আরেক আঙ্গুলের নখ খুটাচ্ছে। শুকনো ঢোক গিলে মাথা ঝুকিয়েই বললো,
আ আমি.. আমার চোখে তাকিয়ে কথা বলতে অ অস্বস্তি লাগে।
কথার বিপরীতে কিরনের কানে ভেসে আসে অর্ণবের শান্ত কন্ঠস্বর,
মনে চোর থাকলে চোখের দিকে তাকাতে অস্বস্তি তো লাগবেই।
চলবে~~~~