বিপরীতে_হিত-০৫,০৬

0
216

#বিপরীতে_হিত-০৫,০৬
#পর্ব-৫

“আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি যে? আচ্ছা, এসেছিস ভালো হয়েছে, তোর বাবাও আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছে অফিস থেকে। দুপুরের খাবারটা আজ একসাথে খেতে পারবো।”
আশা গরগর করে একনাগাড়ে কথা বলে যায়। সুমনা বিরক্ত হলেও কিছু বললো না। মায়ের কথার জবাব না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলো-
“গাবলু কোথায়? এসেছে স্কুল থেকে?”
“হ্যা, এসেছে তো।”
“আচ্ছা, তুমি তাহলে টেবিলে খাবার লাগাও আমি গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
মাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সুমনা টুপ করে নিজের রুমে ঢুকে গেলো। এখন কথা বলতে শুরু করলে মা আর থামবে না, তাই আগেভাগেই কেটে পড়া। ক্লাস শেষ হওয়ামাত্র কোনো দিকে না তাকিয়ে আজ ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে এসেছে সুমনা। কেন যেন মনে হচ্ছিল আজ সিনিয়রগুলো আবার ওকে ধরবে। ওর ইনটুইশন পাওয়ার খুব ভালো। যেটা মনে আসে সেটা কেন যেন ফলে যায়। তাই ভাবনাটা মাথায় আসতেই একরকম ভেগে এসেছে সুমনা।

খেতে বসা মাত্রই ছোট ভাই গাবলু জিজ্ঞেস করে বসলো-
“পু, তোমার কপালে কি হয়েছে? একটা আলু বেড়িয়েছে দেখছি?”
গাবলুর কথা শুনে সুমনা হেসে ওর গাল টেনে দিলো-
“ব্যাথা পেয়েছি রে? এইজন্য আলু বেড়িয়েছে।”
বাবা মা দু’জনই একসাথে জিজ্ঞেস করলো –
“কিভাবে ব্যাথা পেলি?”
“তাড়াহুড়ো করে ক্লাসে যাচ্ছিলাম, একজনার সাথে ধাক্কা লেগেছিলো।”
“নিশ্চয়ই কোনো বয় হবে, তাই না পু? সিনেমায় যেমনটা দেখায়?”
“আচ্ছা! আর কি দেখায় সিনেমায়?”
সোহেল আর আশা ছেলেমেয়ের গল্প শুনে মুচকি হাসলো। গাবলু সুমনার কথাশুনে অতি উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করলো-
“তারপর ঐ যে চোখাচোখি, নাচানাচি, কান্নাকাটি আর শেষে একটু ঢিসুম ঢাসুম হয়ে তারপর মিল হয়।”
“এগুলো তো পুরনো মুভিতে হতো? তুই কি পুরনো মুভি দেখেছিস নাকি?”
“ঐ সবই একই কাহিনী। মা দেখে মাঝে মাঝে, আমিও একটু পাশে বসে দেখি।”
পাকা বুড়োদের মতো ভঙ্গিতে কথা বলে গাবলু। ওর কথার ভঙ্গিতে সুমনা হেসে দিলো। গাবলুর এখন ছয় বছর চলছে। ভাইটা তার পাক্কা পনেরো বছরের ছোট, ভীষণ ভালোবাসে সুমনা তার ভাইকে। ছোটর থেকে নিজেই লালন পালন করেছে। দেখতে একটু নাদুস নুদুস বলে সুমনা ওকে গাবলু বলে ডাকে। আর গাবলুও বোন বলতে অজ্ঞান। সুমনাকে সে আদর করে পু বলে ডাকে।

সুমনা গাবলুর গাল টেনে দিলো-
“স্কুলে তোর কাউকে পচ্ছন্দ হয়েছে?”
সুমনার কথা শুনে গাবলু যেন লজ্জা পেলো।
“পু, কি যে বলো না? আমি তো এখনও অনেক ছোট। তবে বড় হলে আমি রিদিমাকে বিয়ে করবো।”
গাবলুর কথা শুনে আশা, সোহেল, সুমনা সবাই একসাথে হেসে দিলো। সোহেল আশাকে ফোড়ন কাটে-
“দেখলে আশা, ছেলে তোমার কষ্ট কমিয়ে দিলো? তোমার আর কষ্ট করে বউমা খুঁজতে হবে না?”
“তাই তো দেখছি? তবে আমি রিদিমার মায়ের সাথে কথা বলে রাখি, কি বলিস গাবলু?”
“উফফ মা, তোমাকে কতদিন বলেছি আমাকে এ নামে ডাকবে না? এটা শুধু পুর ডাক।”
“ওরে আমার পুর চামচা, আমরা কি তবে?”
গাবলু মায়ের কথার জবাব না দিয়ে মন দিয়ে খেতে লাগলো। সুমনা ততক্ষণে অন্য জগতে। সকালের ছেলেটাকে মনে পড়ে গেলো। গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, উজ্জ্বল শ্যামবর্নের মাঝে চোখ দুটোই যেন ভীষণ রকম জলজলে। সুঠাম দেহের অধিকারী ছেলেটার চুলগুলো একটা লম্বা আর কোকরা। হঠাৎ সুমনার মনেহলো ছেলেটা গিটার বাজিয়ে গান গাইলে বেশ লাগবে। ছেলেটার আউটলুকের সাথে ভালো যাবে। ধুস, কি ভাবছে এসব? সুমনা খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলো। আর ভাল্লাগছে না।
“কি রে খাবি না আর?”
“না মা মাথা ব্যাথা করছে। ”
“একটা পেইনকিলার খেয়ে নে। আর কপালের ফোলা জায়গাটায় বরফ লাগা।”
“মা, বরফ আমি লাগিয়ে দিচ্ছি পুকে।”
গাবলু বলে চটপট।
“লাগবে না রে। আমি এখন একটু ঘুমাবো। পরে লাগিয়ে দিস।”
“ওকে।”
সুমনা আর দাঁড়ালো না। নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দিলো।

*******

বাসায় এসেও নিজের রুমের দরজা আঁটকে শুয়ে ছিলো আদি। মাথা থেকে কিছুতেই মেয়েটার চিন্তা যাচ্ছে না। বারবার কেন যে মেয়েটার মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে মানসপটে তাও বুঝে পাচ্ছে না। তার উপর ক্লাস শেষে যখন জুনিয়র মেয়েটাকে দেখতে গেলো তখন তাকেও পেলো না। মেয়েটা নাকি আগেভাগে বেড়িয়ে গেছে। তখন থেকেই কেমন যেন একটা অস্থিরতা গ্রাস করে আছে আদিকে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতেই হঠাৎ শফিকের কথা মনে এলো। শফিক মেডিকেলে পড়ছে। আদিও চান্স পেয়েছিলো কিন্তু পড়েনি। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ওর কোনো কালেও ছিলো না। যদিও ওর এই সিদ্ধান্তে বাবা মা দু’জনই খুব কষ্ট পেয়েছিলো। তবুও আদি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। সে যাইহোক, আচ্ছা শফিককে ফোন দিলে কেমন হয়? ভাবতে ভাবতেই শফিকের নাম্বার ডায়াল করে ফেলে-
“আররে, আদি যে? হঠাৎ এই অধমকে মনে পড়লো যে?”
“ফাজলামি করিস না তো, মুড নাই এখন। একটা হেল্প চাই তোর কাছ থেকে। ”
“কি হয়েছে দোস্ত? এনি প্রবলেম?”
“তোর মনে আছে, আমাদের ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে এসেছিলো ক্লাস নাইনে ভর্তি হলো। তারপর হঠাৎ একদিন স্কুল ছেড়ে দিলো?”
“মনে থাকবে না আবার? তোকে যে নাকানি চুবানি খাইয়েছিলো সেই তো?”
শফিকের কথা শুনে রাগে গা জ্বলে গেলেও পাল্টা উত্তর না দিয়ে বললো-
“ওর সাথে দিবাদের অনেক খাতির হয়েছিলো। তুই কি একটু দিবার নাম্বারটা আমাকে দিতে পারবি?”
“তোর কাছেও তো ছিলো?”
“ওটা বন্ধ পাচ্ছি।”
“আচ্ছা, আমি তোকে এসএমএস করে দিচ্ছি। তবে ঘটনা কি বলতো? হঠাৎ সেই মেয়েকে নিয়ে এতো টানাটানি কেন গুরু?”
“পরে বলবো তোকে। আপাতত ফোন রাখছি।”
আদি শফিককে আর কথা বলার সুযোগ দিলো না। ফোন কাটতেই শফিকের ম্যাসেজ এলো। আদি কিছু না ভেবেই দিবার নাম্বারে ডায়াল করলো। দিবাও বিশেষ কোনো ইনফরমেশন দিতে পারলো না। স্কুল
ছাড়ার পর নাকি সুমনা কারো সাথেই যোগাযোগ রাখেনি। দিবার সাথে কথা বলে আদি কিছুক্ষন থম ধরে বসে রইলো। সে বুঝে পেলো না তার আজ হয়েছেটা কি? কেন সে ঐ মেয়ের জন্য এতো উতলা হচ্ছে? নিজেকে নিজের কাছেই অচেনা লাগছে আদির। তবে কি সে মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভাবে? একটা মেয়ে শুধু তার কারনে স্কুল ছেড়ে দিলো এইটা কি তার মনে কোন কারনে দাগ কেটেছিলো? তা না হলে এতোদিন বাদে এসে এমনটা হচ্ছে কেন তার?

*******

“এই মেয়ে, এই! ”
ডাক শুনে ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকালো সুমনা। দেখলো প্রথমদিন হেনস্তা করা সিনিয়রদের সাথে গতদিনের ধাক্কা খাওয়া ছেলেটা,দাড়িয়ে আছে। ছেলেটার কপালে একটা ব্যান্ডেজ লাগানো। সুমনা একটু ভাবার চেষ্টা করলো, ছেলেটা ব্যাথা ওর চাইতে বেশি পেয়েছিলো কিনা। মনে করতে পারলো না। ও মনেহয় গতকাল নিজেকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলো।
“এই মেয়ে, কি যেন নাম বলেছিলে তোমার?”
“আজরা জাবিন।”
“উহু, আরেকটা নাম বলেছিলে তো? কি যেন সুমি… না..সু…”
মামুনকে কথা শেষ করতে দিলো না সুমনা, নিজেই জবাব দিয়ে দিলো-
“আজরা জাবিন সুমনা। সুমনা আমার ডাক নাম।”
“ইয়েস সুমনা! এটাই মনে আসছিলো না।”
সুমনা নামটা শুনেই আদির মুখটা উজ্জ্বল হলো। এই তবে সেই? কিন্তু শিওর হবে কি করে? আদি জিনাতের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো, সুমনা সেটা দেখেও না দেখার ভাব করলো। তখনই জিনাত ওকে প্রশ্ন করে-
“কোন স্কুল ছিলো তোমার?”
“বি এম স্কুল।”
“কখনো কি তুমি সৃষ্টি স্কুলে পড়েছিলে?”
চমকে গেলো সুমনা। মনটা কেমন একটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো। যে স্মৃতি ভুলতে চায় তার কথা কেন?হঠাৎই যেন মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়! কে ও যার সাথে ধাক্কা খেলো? আদি নয়তো? না না আদি কেন এখানে থাকবে? আচ্ছা! যদি সত্যি সত্যি আদি হয়? কি করবে ও? আবারও পালাবে? কোথায় পালাবে?আদির দিকে তাকিয়ে তিক্ত গলায় জবাব দেয় সুমনা-
“স্কুলের সাথে এখানে পড়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি?”
“না তা নেই! এমনিতেই কিউরিওসিটি বলতে পারো?”
“ওহহহ! বললামই তো আমি বি এম স্কুলে পড়েছি। আমি কি এখন যেতে পারি?”
মামুন আর জিনাত মাথা নাড়ে। আদি ইচ্ছে হচ্ছিল আরো কিছুক্ষন কথা বলে। মেয়েটা যেমন ক্রুর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো, ও শিওর যে এই সুমনা সেই সুমনাই। তবুও কোনো রিক্স নেওয়া যাবে না এবার। সুমনা কিছুদূর যেতেই আদি জিনাত আর মামুনের কাছ থেকে বিদায় নিলো। ছুটতে ছুটতে সুমনার পিছু নিলো। কিছুদূর যাওয়ার পর ডাকলো-
“সুমনা!”
সুমনা থেমে গেলো। আদি যেয়ে ওর সামনে দাঁড়ালো-
“তুমি কি সেই সুমনা? সৃষ্টি স্কুলে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিলে? আমায় চিনতে পারছো? আমি আদি!”
সুমনা মনে মনে চমকালেও মুখে স্বাভাবিক হাসি ধরে রাখলো-
“আপনি ভুল করছেন ভাইয়া, আমি সেই সুমনা না! আর কালকের জন্য সরি, আপনি দেখছি বেশ ব্যাথা পেয়েছেন?”
সুমনার এমন ভদ্র কথাবার্তা শুনে আদি থতমত খেলো। ও যে সুমনাকে চেনে সে তো এতো ভদ্রভাবে কথা বলে না? তবুও সে শেষ চেষ্টা করলো-
“আমি জানি, তুমি সেই! তোমার সাথে আমার কথা ছিলো একটু!”
“বললাম তো ভাইয়া আমি সে না? পথ ছাড়ুন, যেতে দিন আমাকে।”
সুমনা আদিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আদি আনমনে নিজের গাল হাতালো। ও কি খুব অন্যরকম হয়ে গেছে? আগের আদি আর এখনকার আদির মাঝে কি কোনো মিল নেই? একদম কি চেনা যায় না নাকি? নাকি সুমনা ইচ্ছে করে ওকে চিনছে না? নাম বলার পর মেয়েটার মুখের এক্সপ্রেশন একদম চেন্জ হয়ে গেছিলো। ও যে সেই সুমনা, আদি একেবারে হানড্রেড পারসেন্ট শিওর। শয়তানি হাসি দিলো আদি। ওকে গার্ল! সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করে কি করে ঘি তুলতে হয় তা এই আদি ভালোমতোই জানে! তুমি নিজের থেকেই বলবে, তুমি কে?

চলবে—–
Farhana_Yesmin

#বিপরীতে_হিত
#পর্ব-৬

ক্লাসে এসে চুপচাপ নিজের সিটে বসেছিলো সুমনা। এখন ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট এনালাইসিস ক্লাস হবে। সুমনার বেশ মজাই লাগে এই ক্লাসটা করতে। কারনটা অবশ্য স্যার! স্যার এতো সুন্দর মজা করে পড়া বুঝায় যে কঠিন জিনিসও সহজে বুঝে যায়। স্যারের নামটাও মজার, মোতাহার হোসেন। আজও যথারীতি নাম ডেকে স্যার লেকচার শুরু করবেন তখনই পেছনের দিকের সিটে তার নজর গেলো।
“আদি না? তুই এখানে কি করছিস?”
আদি কাচুমাচু মুখে উঠে দাঁড়ালো। স্যারের দিকে তাকিয়ে বললো-
“স্যার, আপনাকে মিস করছিলাম। আর তাছাড়া এই সাবজেক্টটা আমার ফেভারিট ছিলো, জানেন তো?”
“সে বুঝলাম! কিন্তু তোদের সাথে তো আমার ক্লাস আছেই, তাহলে মিস করার কথাটা মিথ্যে। এবার বলতো কি কারনে এসেছিস? কাকে জ্বালানোর প্ল্যান করেছিস?”
স্যার ভ্রু নাচালেন আদির দিকে তাকিয়ে।
“স্যার, আসলে যাচাই করতে এসেছিলাম যে সবকিছু আমার মনে আছে কিনা।”
“তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি আদি, তুই শুধু শুধু আমার এখানে আসিসনি!”
আদি কিছু না বলে একবার সুমনার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করলো। আদির তাকানো দেখে সুমনা মনেমনে রেগে বোম। জানে, ওকে জ্বালাতেই আদি এই ক্লাসে এসেছে। আদিকে উদ্দেশ্য করে খুব খারাপ ভাষায় দুটো গালি দিয়ে দিলো সুমনা নিচু স্বরে। পাশের মেয়েটা ওকে টোকা দিলো-
“তুমি কি কিছু বলছো আমাকে?”
সুমনা মাথা নাড়ে। আদি স্যারের প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনা। তাই স্যার মুচকি হেসে আদিকে ক্লাস রুম থেকে বের করে দেয়। সুমনা মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচে। যাক বাবা! এখন তো বাঁচা গেল? ঐই শয়তান ছেলে কি না কি করবে কে জানে? আনমনে ব্যাগ থেকে খাতা বের করার জন্য ব্যাগে হাত ঢোকাতেই হাতের উপর কিছু একটা নড়ে উঠলো। সুমনা তাড়াতাড়ি হাত বের করতেই দেখলো হাতে একটা তেলাপোকা ঝুলছে। সুমনা আআআআআ করে চিৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত ঝাঁকি দিলো। সেই তেলাপোকা যেয়ে পড়লো আরেক মেয়ের গায়ে। সেও কোনো কিছু না বুঝে দিলো চিৎকার। তেলাপোকাটা ঝারতেই আরেকজনের গায়ে। পুরো ক্লাস জুড়ে তেলাপোকা উড়ে বেরাতে লাগলো। শেষে এক ছাত্র তেলাপোকাটা ধরে পায়ের নিচে পিষে মারলো। ক্লাসে একটা হুলুস্থুল পরে গেছিলো। সেটা ঠান্ডা হতেই স্যার সুমনাকে কষে ধমক দিলেন। এতো বড় হয়েও কেন বাচ্চাদের মতো আচরণ করলো সুমনা? সুমনা সায়েন্স এর স্টুডেন্ট, সে কেন তেলাপোকা ভয় পাবে? স্যার বারকয়েক আফসোসের শব্দ করলো। বাকি ক্লাসের ছেলেমেয়েরা হাসছিলো মিটিমিটি সুমনার দিকে তাকিয়ে।

সুমনা জানে এ কাজ কে করেছে। তার ব্যাগে তেলাপোকা কে রেখেছে। সুমনার ইচ্ছে হলো একবার বলে, স্যার এ কাজ আপনার প্রানপ্রিয় ছাত্র আদির। সে আগেও বদ ছিলো এখনো আছে। আমার সাধের চুলগুলো নষ্ট করেও ওর বদমায়েশি কমেনি। এখন আবার আমার পিছনে লেগেছে। কেন? আমার পরিচয় বের করার জন্য। আরে বাবা! আমাকে দিয়ে তোর কি কাজ? তুই নিজের মতো থাক আমাকেও থাকতে দে। এতো কেন চুলকানি তোর আমাকে নিয়ে? আমাকে কি এখানেও শান্তি মতো পড়তে দিবি না নাকি? সুমনা নিজের মনে বিরবির করে।

*******

সকালের দিকে সুমনাদের ক্লাস থেকে চিৎকার চেচামেচি শুনে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ মন ভরে হাসছিল আদি। এখন ক্লাস শেষে বেড়িয়ে আবার সুমনাকে ধরার প্লান ছিলো। মাঝে মামুন এসে বাগরা দিলো-
“দোস্ত, তোর সাথে কথা আছে।”
“বলে ফেল।”
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে আদি।
“আমার না ঐ মেয়েটাকে খুব পচ্ছন্দ হইছে?”
“কোন মেয়ে?”
আদির হাত থেমে গেলো। সে অবাক হয়ে মামুনের দিকে তাকালো।
“ঐই যে, সেদিন তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম না?”
আদির মুখ হা হয়ে গেলো, সে হা মুখ নিয়ে মামুনের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকলেও, মনে মনে
আদির ইচ্ছে হলো এক ঘুষি দিয়ে মামুনের নাকটা ফাটিয়ে দিতে। কত্তোবড় সাহস ওর, ও সুমনার দিকে নজর দেয়? ও জানেনা! সুমনা কে? পরক্ষণেই আদি মনে মনে নিজেকে গালি দেয়। সে কেন এতো উত্তেজিত? নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলো-
“আচ্ছা! সুমনা কে? আর মামুন কিভাবে জানবে সুমনার ব্যাপার?”
“দোস্ত! কি হইছে তোর? এমন স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেন? কি হইছে রে? আমি কি ভুল কিছু বলে ফেলেছি?”
মামুন আদিকে ধরে ঝাকি দিলো। আদি তাড়াতাড়ি করে নিজের হা করা মুখটা বন্ধ করলো। সে আবার নিজের ব্যাগ গোছানোতে মন দিলো। মনেমনে গুছিয়ে নিচ্ছে মামুনকে কি বলবে।
“আদি, কিছুতো বল?”
“কি বলবো? তোর জীবন তোর ইচ্ছা, এখানে আমার বলাতে কি আসে যায়?”
“তবুও?”
“আচ্ছা, জানতে যখন চাইছিস তাহলে বলি, কি বলিস?”
“হ্যা বল না?”
উৎসাহী হলো মামুন।
“দেখ দোস্ত! এইসব ব্যাপারে এরকম হুটহাট ডিসিশন নিতে হয় না। আর তাছাড়া, ঐই মেয়ে নাকি তোকে নাচিয়ে ছেড়েছে? তুই কেন ওকে নিয়ে ভাবছিস? ও তো সারাজীবন তোকে নিজের ইশারায় নাচাবে?”
“দোস্ত! এই রকম একটা আগুন টাইপ মেয়ের সাথে সারাজীবন নাচতেও মজা লাগবে!”
“এটা তুই কি বললি! এটা কোন পুরুষ মানুষের মতো কথা বলছিস? তুই এতো ভালো সাবজেক্ট এ পড়িস, ভবিষ্যতে না জানি কত ভালো চাকরি করবি? তুই কেন আগে থেকেই একটা মেয়ের সাথে নাচার জন্য রেডি থাকবি? ছি ছি, এরকম ম্যান্দা মারা নাকি নাকি হাফ লেডিস চিন্তা তোর? আগে জানতাম না, জানলে…”
খেঁকিয়ে ওঠে আদি। মামুন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খায়। খুব একটা অপরাধী মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই দেখে আদি মুখ নিচু করে একটু হেঁসে নেয়। মামুন অসহায় মুখ করে বলে-
“কিন্তু আমার যে ওকে ভালো লেগে গেছে?”
“ভালো লেগে গেছে মানে কি? ওকে ছাড়া বাঁচবি না নাকি? ও মাই আল্লাহ! মামুন, তোকে আমি কি ভেবেছিলাম আর তুই কি বেরুলি?”
“দোস্ত! এভাবে বলছিস কেন?”
“তো কিভাবে বলবো? মামুন! ইউ নটি বয়, কেন তোমার ওকেই পচ্ছন্দ হলো? দুনিয়ায় আর কোনো মেয়ে কি নেই?”
মেয়েদের মতো নাকি সুরে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে আদি। মামুন আদির দিকে তাকালো অবাক চোখে-
“এভাবে মেয়েদের মতো কথা বলছিস কেন, আদি?”
“ভালোভাবেই বলছি! তোর সাথে কথা বলতে আমার আপাতত একটুও ভালো লাগছে না। আমি গেলাম। ”
আদি গটগট করে হেঁটে বেড়িয়ে এলো। পেছনে বিস্মিত মামুন ভাবছে, এই ছেলের আবার কি হলো, এতো রেগে গেলো কেন?
আদি গেলো ফাস্ট ইয়ারের ক্লাস রুমের দিকে। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে সে, এই সুমনার সাথে একটা ফয়সালা করতেই হবে। ভার্সিটিতে আসতে না আসতেই সবার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে কেন সে?

ফাস্ট ইয়ারের ক্লাসরুম ফাঁকা। দু চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। এরমধ্যে দু-তিনটে ছেলে মেয়ে গোল হয়ে বসে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছিলো। আদি সেদিকে এগিয়ে গেলো –
“তোমাদের ক্লাস শেষ?”
আদিকে দেখে ওরা দাঁড়িয়ে গেলো, আফটারঅল আদি সিনিয়র ব্যাচ। একটা মেয়ে জবাব দিলো-
“জ্বী, ভাইয়া?”
“সুমনাকে কোথায় পাওয়া যাবে?”
“সুমনা?”
তিনজনই একসাথে বলে ওঠে। আদি মাথা চুলকায়। এরা তো মনেহয় সুমনা নামে চিনবে না? কি যেন নাম বলেছিলো সেদিন? কি যেন! কি যেন! মাথা চুলকে সুমনার ভালো নাম মনে করার চেষ্টা করে আদি। হঠাৎ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, মনে পরেছে। ও চট করে মেয়েটাকে বলে-
“আজরা জাবিন।”
“ওহ, ককরোচ গার্ল?”
“ওর নাম ককরোচ নাকি?”
আদি অবাক হলো। বাহ! একদিনেই এতো বিখ্যাত?
“আজই তো ককরোচ নিয়ে হইচই হলো, তখনই ওর এই নাম দিলাম আমরা। ও তো একটু আগে বেরুলো। বাসায় চলে গেছে হয়তো আর না হলে ওয়াশরুম গেছে। ও বাড়ি যাওয়ার আগে একবার অবশ্যই ওয়াশরুম যায়। এটা ওর রুটিন।”
“কেন? ওর কি ডায়াবেটিস আছে নাকি?”
আদির কথা শুনে ওরা খিলখিল করে হেঁসে উঠলো।
“তা তো জানিনা,ভাইয়া? জিজ্ঞেস করা হয়নি।”
“ওকে থ্যাংস।”
আদি রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। মেয়েদের ওয়াসরুমে তো যাওয়া যাবে না। কাউকে দিয়ে খবর নিতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে একবার ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। সাড়ে তিনটে বাজে, এইসময়টা ক্যাম্পাস খুব ঝিমিয়ে থাকে। মেয়েদের ওয়াশরুমের কাছে এসে কিছুক্ষন আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকলো আদি। মেয়েরা বেরুচ্ছে ঢুকছে,কিন্তু সংখ্যায় কম। বেশিরভাগই পরিচিত মুখ। অপরিচিত এক মেয়ে ঢোকার সময় ডাকলো আদি-
“আপু কোন ইয়ার?”
“ফাস্ট ইয়ার।”
খুশিতে আদি বাকবাকুম হয়ে গেলো।
“আপু, একটা কাজ করে দিতে পারবে?”
“জ্বী ভাইয়া, বলুন?”
“তুমি একটু খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাও তো, আজরা জাবিন নামে ওয়াশরুমে কেউ আছে কিনা? আমার কথা আবার কিছু বলো না,কেমন? এমনিতেই জাস্ট নাম জিজ্ঞেস করবে, পেলে আমাকে বলবে।”
“ঠিক আছে।”
মিনিট পাঁচেক পর মেয়েটা বেরিয়ে যাওয়ার সময় খবর দিলো-
“না ভাইয়া, ভেতরে কেউ নেই। ”
“ওহ,ঠিক আছে। থ্যাংকু আপু।”
মেয়েটা হেঁসে চলে গেলো। আদির রাগ লাগলো, আজও ধরা গেলো না মেয়েটাকে? ভাবতে ভাবতেই সামনে তাকিয়ে দেখলো সুমনা হেলতে দুলতে হেঁটে আসছে ওয়াশরুমের দিকে। আদি ওকে দেখে পিলারের আড়ালে লুকালো। লুকিয়েই দেখলো সুমনা ওয়াশরুমে ঢুকছে। আদি কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে মাথায় নিজের প্ল্যান সাজিয়ে নিলো। বিরবির করে বললো-
“আজ তোমাকে খাঁচায় ভরেই ছাড়বো পাখি! দেখি তুমি কিভাবে পার পাও? আজ নিজের পরিচয় তোমাকে দিতেই হবে!”

চলবে—–
Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here