বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ০৬,০৭

0
1030

#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ০৬,০৭
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৬
__________________

আকাশ ছাপিয়ে বৃষ্টি ঝরছে। রিমঝিম একটা শব্দ তুলেছে প্রকৃতি। শ্রাবণ ক্যাফের কাচের জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছে। কাচের উপর অজস্র পানি কণা ঝাঁপিয়ে পড়ে আবার গড়িয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি তার পছন্দ না। তার নামের সাথেও একটা বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব আছে। শ্রাবণ! মা-বাবা যে কেন ডাক নাম শ্রাবণ রাখলো সে আজও বুঝলো না। বৃষ্টির সময়ে জন্ম নিয়েছিল না কি? সেজন্যই কি নাম শ্রাবণ রাখলো? হতে পারে। বৃষ্টি পছন্দের না হলেও আজকে বৃষ্টি ভালো লাগছে শ্রাবণের। তার মনের অবস্থাও তো এই বৃষ্টির মতো জল থলথলে। খুব কষ্ট তার হৃদয়ে! অথচ এই কষ্ট দেখার মতো কেউ নেই। ক্ষুদ্রশ্বাস ফেললো শ্রাবণ। জানালা থেকে চোখ সরিয়ে এনে সামনে বসে থাকা মিহিকের দিকে তাকালো। তাকিয়েই একটু ঘাবড়ে গেল। মিহিক তার দিকে তাকিয়ে আছে। একদম ঠাঁয় তাকিয়ে আছে। সে তাকানোতেও কোনো ভাবান্তর হলো না মিহিকের। শ্রাবণ একটু নার্ভাস ফিল করলো। এ মেয়েটা এমন কেন? আগে কোনোদিন তো এমন দেখেনি।
মিহিক তাকিয়েই থাকলো। শ্রাবণের কিছু বলতেও অস্বস্তি হচ্ছে। অপরাধ বোধও হচ্ছে। মেয়েটাকে এভাবে বলাটা কি উচিত হবে? বলেই দিক। শ্রাবণ মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে বললো,
“আসলে আমি…আমি আপনাকে ঠিক বিয়ে করতে পারবো না মিহিক।”

মিহিক স্বাভাবিক। এমন কথা শুনে মিহিক স্বাভাবিক থাকবে এমনটা আশা করেনি শ্রাবণ। মিহিক শান্ত-স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন বিয়ে করতে পারবেন না?”

মিহিকের প্রশ্নে শ্রাবণ আরও অবাক হলো। মেয়েটা এত শান্তভাবে কী করে এই প্রশ্ন করছে? যাই হোক, সে উত্তর দিলো,
“কারণটা তো আপনি জানেন। আমি…মানে আমি রুম…”

“রুমকিকে ভালোবাসেন এই তো?” শ্রাবণের মুখ থেকে ছোঁ মেরে কথা কেড়ে নিলো মিহিক।

শ্রাবণ থমকে গেল। আজকে মিহিককে দেখে সে শুধু অবাকের উপর অবাক হচ্ছে।

“ঠিক আছে, এই কথাটা আপনার মা-বাবাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন। বলুন যে, আমি তোমাদের পছন্দ করা মেয়েকে নয়, আমার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করবো। বলুন এটা।”

মিহিকের কথায় শ্রাবণ আহত হচ্ছে। মেয়েটার বলার ভঙ্গিমা কেমন শ্লেষপূর্ণ। শ্রাবণ সেসবে পাত্তা না দিয়ে বললো,
“আমি চাইছি এই বিয়েটা ভেঙে দিতে।”

“তাহলে দিন। কে নিষেধ করছে আপনাকে? যে ছেলে অন্যের বিয়েতে ঝামেলা করেছে, অন্য একটা মেয়েকে বিয়ের মজলিসে চিৎকার করে ‘ভালোবাসি’ বলেছে, সেই ছেলেকে আমার পক্ষেও বিয়ে করা সম্ভব নয়। আশা করছি এই বিয়েটা খুব দ্রুত ভাঙবেন আপনি।”
মিহিক উঠে দাঁড়ালো।

“আপনি চলে যাচ্ছেন? কোনো সাহায্য করবেন না এ বিয়ে ভাঙতে?”

মিহিক বিদ্রূপ চোখে তাকালো।
“সাহায্য? বিয়ে ভাঙতে আমার সাহায্য চাইছেন আপনি? কী করে ভাবলেন যে আমি আপনাকে সাহায্য করবো? বিয়ে করতে পারবে না এটা কে বলেছে আগে? আপনি। বিয়েটাও আপনিই ভাঙবেন। একা একা। আমার সাহায্য আশা করলে ভুল করবেন। আসছি।”

মিহিক দাঁড়ায় না আর। পাশের চেয়ার থেকে ব্যাগটা উঠিয়ে সোজা হেঁটে গেল। শ্রাবণ সেদিকে অপলক তাকিয়ে থেকে বললো,
“এই মেয়েটা এমন কেন? মা এই মেয়েকে লক্ষ্মী বলে? এর থেকে তো আমার রুমকি হাজার গুণ ভালো।”

তবে শ্রাবণের চিন্তা হচ্ছে। চাইছিল মিহিককে খুব ভালো করে সব বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু বলতে তো পারলো না কিছু। আর মিহিকও দাঁড়ালো না। এখন এই মেয়ে যদি কোনো ঝামেলা করে তাহলে কী হবে?

________________

কবির সাহেবের মাথা প্রচণ্ড গরম। সন্ধ্যার পর ইদ্রিস খান নিজ বাড়িতে হালকা নাস্তা এবং খোশ গল্পের জন্য ডেকেছিল তাকে এবং তার স্ত্রীকে। সেখানে গিয়ে এমন একটা খবর শুনলো যাতে তার মাথা গরম না হয়ে পারলো না। এত বড়ো সাহস শ্রাবণের? মিহিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে বিয়ে করবে না বলেছে? কবির সাহেব বাড়ি এসে কোথাও এক দণ্ড না দাঁড়িয়ে সোজা ছেলের রুমে এলেন। এত জোরে দরজাটি খুললেন যে রুমে থাকা শ্রাবণ আঁতকে উঠলো। মা এবং বাবার রাগে তপ্ত মুখ দেখে শ্রাবণের মন বলে উঠলো, লক্ষণ বেশি ভালো নয়!

ভয়ে শ্রাবণ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো,
“কী হয়েছে আব্বু?”

কবির সাহেব একেবারে ছেলের সামনে এসে থেমে প্রচণ্ড রাগের সাথে বললেন,
“এত বড়ো সাহস তোর? মিহিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে ওকে বিয়ে করবি না বলেছিস? বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে, এক্ষুণি বেরিয়ে যা। তোর মতো একটা কুলাঙ্গার সন্তান আমার বাড়িতে বেমানান।”

ভয়ে শ্রাবণের বুক কাঁপতে শুরু করেছে। ঘামে সারা শরীর ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা তার বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে সব? কেমন মেয়ে হলে এটা তার বাবাকে বলে দিতে পারে?

কবির সাহেবের গলা এত উচ্চ ছিল যে বাড়িতে এই মুহূর্তে উপস্থিত সবাই ছুটে এলো। বাতাসের বেগে শ্রাবণের রুমে এসে প্রবেশ করলো রুপালি এবং জুন। কারিব এবং আষাঢ় বাড়িতে নেই। সিলেট থেকে এখনও ফেরেনি তারা। এগারোটার আগে দেখা যাবে না তাদের।
“বিবেক বুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলেছো? ওই রুমকি কি তোমার মগজ ধোলাই করেছে? কী দেখেছো তুমি ওর মাঝে? দিন দিন এত বেয়াদব হয়ে কেন উঠছো? নিজের হবুবউয়ের কাছে গিয়ে বলছো তুমি তাকে বিয়ে করবে না? কারণ, তুমি রুমকিকে ভালোবাসো? এত বেয়াদবি কোত্থেকে শিখেছো? এই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তোমাকে?”

শ্রাবণের ভয় করছে। তার বাবা রগচটা মানুষ। কিন্তু ভয় পেয়ে মুখ বুজে থাকলে হবে না। বলতে হবে। অনেক কিছু বলতে হবে তাকে। এটাই বলার মতো একটা সময়। শ্রাবণও জেদি গলায় বলে উঠলো,
“মিহিককে বিয়ে করতে পারবো না আমি। রুমকিকে বিয়ে করবো আমি। আমি রুমকিকে ভালোবাসি। রুমকি আমার সব। আমার স্ত্রী হলে ও-ই হবে।”

“শ্রাবণ…” কবির সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন।
লায়াল খানম স্বামীর হাত ধরে বললেন,
“শান্ত হন আপনি। শান্ত হন একটু।”

“শান্ত কী করে হবো লায়লা? তোমার ছেলে কেমন বেয়াদবি করছে দেখতে পাচ্ছ না?”
কবির সাহেব ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
“রুমকিকে বিয়ে করবি, তাই না? কর, এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে কর। রুমকি জীবনে আমার বাড়ির বউ হয়ে আসবে না।”

“মিহিক আসতে পারলে, ও কেন আসতে পারবে না? কী দোষ ওর মাঝে?”

“চুপ একদম চুপ। আর একবার ওর নাম মুখে আনলে, তোকে সত্যি সত্যি বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো। মিহিকের সাথে আর চার দিন পর তোমার বিয়ে হবে। এটাই শেষ কথা। এর উপর কথা বলার চেষ্টা করলে তেজ্যপুত্র করবো তোমায়। তাহলেই তোমার মাথার গন্ডগোল ভালো হয়ে যাবে।”
কবির সাহেব এতটাই রাগান্বিত যে আর এখানে থাকতে পারলেন না, বেরিয়ে গেলেন।

শ্রাবণ রিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। অসহায় লাগছে তার। খুব অসহায় লাগছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে আকুল কণ্ঠে বললো,
“মিহিককে করবো না আমি বিয়ে, করবো না আম্মু।”

লায়লার কষ্ট লাগছে। ছেলের এমন অবস্থা সহ্য করতে পারছে না সে। কিন্তু তাই বলে তো রুমকির সাথে বিয়ে দেওয়া যায় না শ্রাবণের। শ্রাবণের মাথায় হঠাৎ এত রুমকির ভূত চেপে বসলো কেন? লায়লা খানম অতি নরম কণ্ঠে বললেন,
“এমন করো না বাবা। মিহিককে বিয়ে করো। সুখী হবে তুমি। রুমকি তোমার সাথে মানানসই নয়। রুমকি ভালো নয়। রুমকি ভালো হলে আমরাই রুমকির সাথে তোমার বিয়ে দিতাম, অমত করতাম না। কিন্তু ও তো ভালো নয়, এটা কি তোমাকে বার বার বুঝিয়ে বলতে হবে?”

“রুমকি খারাপ নয়, ও অবশ্যই ভালো। আমি চিনি ওকে। আমি কিছুতেই মিহিককে বিয়ে করতে পারবো না। প্লিজ! আব্বুকে একটু বুঝিয়ে বলো তুমি।”

“তোমার আব্বুকে বোঝানোর সাধ্যি আমার নেই। আর আমার ইচ্ছাও নেই তাকে বোঝানোর। তোমার আব্বুকে তো তুমি চেনো। উনি যা বলেছেন উনি তা অবশ্যই করতে পারেন। মিহিককে বিয়ে না করলে উনি তোমাকে সত্যি সত্যি বাড়ি থেকে বের করে দেবে। এত বছর ধরে তোমাকে আদর যত্ন দিয়ে আগলে রেখেছি আমরা, এখন তোমার যদি মনে হয় আমাদের থেকে রুমকি তোমার বেশি প্রিয়, তাহলে তোমার বাবার কথা মতোই চলে যেতে পারো!”

“আম্মু…” অসহায় কণ্ঠে ডাকলো শ্রাবণ।

লায়লা খানমের চোখে জল চিকচিক। সে বললো,
“আমি এখনও বলছি, মিহিককে বিয়ে করো তুমি। সুখী হবে। রুমকিকে ভুলে যাও। যদি তুমি ভেবে থাকো তুমি আসলেই রুমকিকে বিয়ে করবে, তাহলে আগেই বলে দিই, এটা না তোমার বাবা মানবে, আর না আমি।”

লায়লা খানম আর দাঁড়ালেন না। অশ্রুসিক্ত চোখে বেরিয়ে গেলেন।

শ্রাবণ পড়লো মহা বিপাকে। এ কোন পরিস্থিতিতে এসে পড়লো সে? এ কেমন কঠিন সময়? মাথাটা ব্যথা করছে। পাগল পাগল লাগছে। শ্রাবণ মাথা চেপে দাঁড়িয়ে রইল। রুমকিকে ভুলতে পারবে না সে। আর না তো মা-বাবার মনে আঘাত হানতে পারবে।

জুন ভাইয়ের এমন দুর্বিষহ অবস্থা দেখে বললো,
“মিহিক আপুকেই বিয়ে করে নাও ভাইয়া। তোমাদের দুজনকে খুব ভালো মানাবে। মিহিক আপু খুব ভালো।”

“ভালো না ছাই। কতটা ভালো সেটা তো দেখলামই।” বলে শ্রাবণও বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

দাঁড়িয়ে রইল জুন এবং রুপালি। একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো তাদের। রুপালি বললো,
“আসলে শ্রাবণের সাথে মিহিকরেও মানাইবো না আর রুমকিরেও মানাইবো না। মিহিক হলো রাগী, জেদি আর রুমকি হলো খারাপ।”

জুন শুকনো মুখে বললো,
“তাহলে কার সাথে ভাইয়াকে মানাবে বলে তোমার মনে হয় রূপ খালা?”

“নোয়ানা! নোয়ানার লগে মাইনাইবো শ্রাবণরে।”

“নোয়ানা আপু? নোয়ানা আপুর সাথে কী করে মানায় আমার ভাইয়াকে? নোয়ানা আপু তো আমার ভাইয়ের মতো এতো সুন্দর না।”

“আরে, আমি কি সুন্দরের কথা কইছি না কি? আমি তো কইছি মনের কথা। নোয়ানার মন খুব ভালো। খুব ভদ্র মেয়ে। ওর সাথেই মানাইতো শ্রাবণরে।”

জুন মানতে পারলো না। সে বললো,
“ভুল বললে রূপ খালা ভুল। ভদ্রতার দিক দিয়েই যদি বিচার করো তাহলে আমার ভাইয়ের সাথে নয়, কারিব ভাইয়ের সাথে মানাবে নোয়ানা আপুকে। কারিব ভাইও তো নোয়ানা আপুর মতো কত ভালো, কত ভদ্র! হ্যাঁ, কারিব ভাইয়ের সাথেই সবচেয়ে ভালো মানাবে নোয়ানা আপুকে। একদম পারফেক্ট ম্যাচ দুজনের।”

জুনের মুখে কারিবের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো রুপালি,
“কারিবের কথা কও না কি? ও ভালো? ও হইলো একটা মিচকা শয়তান। ওর সাথে যে মেয়ের বিয়ে হবে সে মেয়ের দুঃখের সীমা থাকবে না। ওর সাথে নোয়ানারে মিলিয়ো না। শুধু শুধু মেয়েটার জীবনে দুঃখ নামিয়ে দিয়ো না।”

জুন রুপালির কথা কানে না তুলে বললো,
“কারিব ভাইয়ের সাথে নোয়ানা আপুর বিয়ে হলে দারুণ হতো!”

_______________

শ্রাবণ সোজা ছাদে চলে এসেছে। আবহাওয়ার একটু খারাপ অবস্থা। দমকা হাওয়া বইছে। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। শ্রাবণ আষাঢ়ের কাছে ফোন দিলো। এই মুহূর্তে তার আষাঢ়কে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। শ্রাবণের অস্থির ভাব। কয়েকটা রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে আষাঢ়ের আহ্লাদী কণ্ঠ শোনা যায়,
“হোয়াট’স আপ ব্রো? ছোট ভাইটির এত কম খোঁজ খবর নাও যে এখন? হবু বউ পেয়ে ভাইকে ভুলে গেলে না কি?”
কথাটা বলে ফিচেল হাসে আষাঢ়। শ্রাবণ না দেখেও বুঝতে পারে সেটা। সে কথা না পেঁচিয়ে বললো,
“তোকে আমার খুব দরকার। এক্ষুণি বাসায় চলে আয়, দ্রুত।”

“আই অ্যাম স্যরি ব্রো! আজ রাতে আমরা বাসায় ফিরতে পারবো না। এখানে আমাদের অনেক ইম্পরট্যান্ট কাজ পড়ে আছে। ফেরা সম্ভব নয়। কী কারিব? ফেরা কি সম্ভব?”
আষাঢ় তার পাশে থাকা কারিবকে প্রশ্ন করে।

কারিব বললো,
“সম্ভব নয়।”

শ্রাবণ বললো,
“ঠিক আছে, রাতে ফেরা সম্ভব না হলে ভোরেই চলে আসবি। তোকে আমার খুব দরকার।”

আষাঢ় হেসে বললো,
“এতদিন তো জানতাম আমি শুধু মেয়েদের দরকারি। এখন আবার আমার ভাইয়েরও দরকারি হয়ে উঠলাম? ওয়াও! দারুণ!”

শ্রাবণের কথা বলতে ভালো লাগছে না, সে ‘তাড়াতাড়ি আসিস’ বলে কল কেটে দিলো। ঠিক করেছে বিয়ের এই ঝঞ্ঝাট আষাঢ়ের মাধ্যমেই কাটাবে সে।

(চলবে)

#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৭
_____________

“আমার হবু ভাবি আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে এটা তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?”

“ভেবেছিলাম আপনি জানেন। যেহেতু…”
কারিবের কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো না আষাঢ়, তার আগে ভাইকে বললো,
“ও কে ব্রো, আমি অবশ্যই হেল্প করবো তোমাকে। যেখানে তুমি বিয়ে করতে চাও না সেখানে আব্বু কেন বিয়ে দেবে তোমার? ডোন্ট ও্যরি, এ বিয়ে ভাঙা আমার কাছে কোনো ব্যাপারই না। আচ্ছা, মেয়ে কি আসলেই খুব সুন্দর?”

শ্রাবণ বললো,
“হ্যাঁ, অনেক সুন্দর।”

আষাঢ় উঠে দাঁড়ালো,
“তাহলে এ বিয়ে ভাঙা তো আমার কাছে আরও সহজ। চিন্তা করো না, তোমার হবু বউকে পটিয়ে ফেলবো আমি। এ কাজে আমি দারুণ পারদর্শী। কারিব লেট’স গো।”

কারিবও উঠে দাঁড়ালো। আষাঢ়কে বোঝানোর চেষ্টায় বললো,
“এটা করা উচিত হবে না আষাঢ় ভাই। আপনার আব্বু জানলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আপনার ভাইয়ের মাথায় না হয় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে, আপনার মাথায়ও কি দিয়েছে?”

“শাট আপ কারিব, কোনো কথা নয়। যেটা বলেছি সেটাই হবে। লেট’স গো।”

আষাঢ় বেরিয়ে গেল শ্রাবণের রুম থেকে। কারিব অসহায়! বাধ্য হয়ে তাকেও যেতে হলো পিছন পিছন।

“আপনি কি জানেন আপনার ভাই এই বিয়ে কেন করতে চাচ্ছে না? আপনার ভাই ওই…”

“আমার ভাই কেন বিয়ে করবে না, কী কারণ, এসব জেনে আমার লাভ নেই। ওটা তার পার্সোনাল বিষয়। আমি শুধু জানি সে এই বিয়েতে রাজি নয়, আমাকে এই বিয়েটা ভাঙতে অফার দিয়েছে। এ বিয়ে আমি ভাঙবোই। আর আমারও তো দেখতে হবে আমার বাড়ির পাশে কোন সুন্দরীর বসবাস!”
কথাটা বলেই আষাঢ় ফিক করে হেসে দিলো। কারিব বেশ বুঝতে পারছে, মিহিকের প্রতি আষাঢ় ভাইয়ের একটা ইন্টারেস্ট কাজ করছে। সে বললো,
“বড্ড ভুল করছেন কিন্তু আপনি। মামা-মামি খুব করে চায় এই বিয়েটা হোক। মামা যদি জানতে পারে আপনি ঝামেলা করেছেন, তাহলে শ্রাবণ ভাইয়ের সাথে সাথে আপনাকেও তেজ্যপুত্র করবে। এখানেই থেমে যান, ভালো হবে।”

“থামবো না। সুন্দরী দেখার তেষ্টা আমার একটু বেশিই। আমার ভাই যাকে না করে দিয়েছে তাকে দেখলে নিশ্চয়ই আমার অন্যায় হবে না?”

“হবে, অনেক অন্যায় হবে।”

“সুন্দরী দেখার অপরাধে যদি আমি অন্যায়ের সাগরে ভেসেও যাই, তাও মানতে রাজি।”

কারিব অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। আষাঢ়কে থামানো গেল না। সে ঠিকই এসে উপস্থিত হলো পাশের বাড়িতে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে দরজায় শব্দ করলো। কারিব দরজা থেকে ওদিকটায় সরে দাঁড়ালো। দরজার সামনে দাঁড়ানোর মুখ তার নেই। আষাঢ় ভাই কী থেকে কী করবে জানে না সে। সে শুধু ফিসফিস করে আষাঢ়কে হুঁশিয়ার বাণী শোনাতে লাগলো,
“আষাঢ় ভাই, এখনও সময় আছে, চলেন ফিরে যাই।”

“চুপ থাকো।” বিরক্তি কণ্ঠ আষাঢ়ের।

“আপনার সাথে সাথে আমারও গর্দান যাবে।”

আষাঢ় গরম চোখে তাকালো,
“চুপ থাকতে বলেছি তোমাকে?”

কারিব চুপ হয়ে গেল। মনে মনে দোয়া-দরূদ পড়তে লাগলো। খারাপ কিছু যেন না হয়!

আরও দুই বার নক করার পর দরজা খুললো। দরজার কপাটটি খুলে যেতেই চোখে ভাসলো হালকা শ্যামবর্ণের এক মেয়ে। মেয়েটির মুখ দেখেই থমকে গেল আষাঢ়। থমকে গেল তার মস্তিষ্ক, সেই সাথে হৃদয়। কেটে গেল তার চঞ্চলতা। এই মুখ…আষাঢ় কীয়ৎক্ষণ তাকিয়ে দেখলো মেয়েটিকে। শান্ত তীক্ষ্ণতা ভর করলো তার চোখে। মেয়েটির চোখ, ঠোঁট, নাক পুরো মুখ মন্ডলে দৃষ্টি বুলালো সে। মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি হলো। চোখে ভেসে উঠলো একটা মেয়ে মুখ আর এক গুচ্ছ টিউলিপ। ভাবনা সব জট পাকিয়ে উঠলো আষাঢ়ের। ভালো করে দেখতে লাগলো। মেয়েটি একটু শুকনো ধরণের। চেহারা গোলগাল। নাকে বসে আছে ক্ষুদ্র একটি নোজপিন। চোখের রং চাপা খয়েরি। আষাঢ়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেয়েটার চেহারা থেকে সরলো না। সে মেয়েটির চেহারাটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। খুব শান্ত ভাবে। বিশেষ করে মেয়েটার চোখ। যেন চোখ দেখেই সবকিছু ধরে ফেলবে।

আষাঢ়কে দেখে অবাক কারিব। হঠাৎ করে কী হলো আষাঢ় ভাইয়ের? যেরকম করে এসেছিল তাতে তো এমন থাকার কথা নয়!

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপরিচিত মানুষটিকে ভ্রু কুঞ্চিত করে দেখছে নোয়ানা। লোকটা এমন করে দেখছে কেন তাকে? নোয়ানা প্রশ্ন করে উঠলো,
“কে আপনি?”

নোয়ানার প্রশ্নে আষাঢ়ের চোখের তীক্ষ্ণতা কমলো না। চোখ সরলো না নোয়ানার মুখ থেকে। তার চোখ নোয়ানার মুখে নিবিড় দৃষ্টি বুলিয়ে গেল। নোয়ানার চোখ, কথা বলার ধরণ গভীর ভাবে পরখ করতে করতেই জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কি আমার হবুভাবি?”

নোয়ানার কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আরও বেশি কুঁচকে গেল।
“কী?”

আষাঢ়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জোড়া এবার স্বাভাবিক হলো। ঝলমল করে উঠলো মুখখানা। অধরে প্রশস্ত হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“আপনি কি আমার হবু ভাবি নন?”

“কে আপনি?”

আষাঢ়ের অধরের হাসি ধীরে ধীরে বিলীন হলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফিরে এলো আবার। নোয়ানার চোখ দুটোতে গভীর দৃষ্টি বুলাতে বুলাতে বললো,
“চিনতে পারছো না আমায়?”

আষাঢ়ের প্রশ্নে থমকে গেল নোয়ানা। থমকে যাওয়া ভাবটা স্পষ্ট ফুঁটে উঠলো তার মুখে। নোয়ানার চোখও তীক্ষ্ণতার আঁচড় কাটলো। চোখের কোটরে সৃষ্টি হলো নিবিড় পর্যবেক্ষণ। নিবিড় চোখ জোড়া প্রথমেই পর্যবেক্ষণ করলো আষাঢ়ের চোখ। নোয়ানাকে নিবিড় চোখ বুলাতে দেখে আষাঢ় হাসলো। নোয়ানার চোখ গেল আষাঢ়ের ঠোঁটে। তীক্ষ্ণ চক্ষুসে দেখলো আষাঢ়ের হাসি। এই হাসি পরিচিত কেন লাগছে? আষাঢ়ের চোখ, হাসির ধরণ সবকিছু গভীর ভাবে খেয়াল করলো। মস্তিষ্ক দ্বিধা জর্জরিত হয়ে পড়লো। এই মুখ চেনা চেনা লাগছে! নোয়ানার মাথায় হঠাৎ যন্ত্রণা শুরু হলো। চোখ বুজলো সে। কোথায় দেখেছে এই মুখ, এই হাসি? মনে করতে পারলো না নোয়ানা। চোখ খুললো সে। নিজের অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করলো। জোর করে চেহারায় স্বাভাবিকতা আনলো। কিন্তু চোখ দুটোতে নিবিড় পর্যবেক্ষণ স্থায়ী রয়েই গেল।

“আপনি কি ফেমাস কেউ?” প্রশ্নটা করতে করতেও নোয়ানা আষাঢ়ের চোখ দুটোতে নিবিড় দৃষ্টি বুলিয়ে যাচ্ছিল।

আষাঢ় হেসে ফেললো। তীক্ষ্ণ চোখ জোড়াকে স্বাভাবিক করে নিলো সম্পূর্ণ। হাস্য মুখে বললো,
“এক রকমের ফেমাসই বলা চলে। একটা ইংলিশ মুভিতে কাজ করেছি তো, এখন অনেকেই দেখলে বলে, ‘তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি’।”

নোয়ানা খানিক অবাক সুরে বললো,
“মুভিতে কাজ করেছেন? কোন মুভি?”

“সেটা জানা কি খুব জরুরি?”

“না, জরুরি নয়। কিন্তু আপনার পরিচয় কী? আমি আপনার হবু ভাবি কি না এটা কেন জিজ্ঞেস করলেন?”

“পাশের বাড়ি…পাশের বাড়িতে থাকি আমি। আনান ইসলাম ওরফে শ্রাবণ, আমার বড়ো ভাই। আমি হলাম আষাঢ়। এখন আমার যেটা জানা জরুরি সেটা হলো, আমার ভাই কি আপনার হবু বর?”

নোয়ানা ধরতে পারলো ব্যাপারটা। সলজ্জ হাসলো। আষাঢ়ের ভুল ভাঙিয়ে বললো,
“জি না, সে আমার হবু বর নয়। আমি আপনার হবু ভাবি নই। আমি নোয়ানা। আমার বড়ো বোন মিহিকের সাথে আপনার ভাইয়ের বিয়ে হওয়ার কথা।”

“ও আচ্ছা।” নিশ্চিন্ত হলো আষাঢ়। মনে মনে একবার আওড়ালো,
‘নোয়ানা?’

“আসলে আপনাকে কোনোদিন দেখিনি, তাই চিনতে পারিনি। শুনেছিলাম আপনি বিদেশে থাকেন। আপুর সাথে দেখা করতে এসেছেন? আসুন, ভিতরে এসে বসুন।”

আষাঢ় মুচকি হেসে বললো,
“থাক, বসবো না। আমার ভাইয়ের সাথে আপনার বোনের বিয়েটা জোরদার করতে এসেছিলাম। মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়েই যাবে। এই বিয়েটা অবশ্যই হতে হবে।”
বলে হাসে আষাঢ়। কারিবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কারিব, চলো। এখানে থেকে চলে যাওয়াই উত্তম।”

নোয়ানা কারিবকে দেখেনি। দরজা থেকে ওদিকে সরে থাকায় দেখতে পায়নি। তাই একটু অবাক হলো। উঁকি দিলো।
নোয়ানা তাকাতে কারিব একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলো।
আষাঢ় স্মিতহাস্য মুখে বললো,
“আশা করছি আপনার সাথে আরও অনেকবার দেখা হবে আমার।”

নোয়ানা তাকালো। নিবিড় দৃষ্টি চলে গেল আষাঢ়ের কালো নেত্রতে। একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
“নিশ্চয়ই।”

আষাঢ় হাসির রেখা দীর্ঘ করলো। নোয়ানার মুখখানি আরও একবার ভালো করে দেখে নিয়ে, কারিবকে নিয়ে চলে গেল।
ওরা চলে যেতেই নোয়ানার চেহারায় জোর করে এনে রাখা স্বাভাবিকতা কেটে গেল। কালো, গম্ভীর, চিন্তিত আভা ফুঁটে উঠলো থমথমে মুখখানিতে। আষাঢ়কে এর আগে কোথায় দেখেছে সে? আষাঢ়ের সাথে এর আগে দেখা হওয়া তো অসম্ভব! তারা এ বাড়িতে ভাড়া থাকছে দু বছর চলছে এখন। এই দুই বছরের ভিতরে আষাঢ় বাংলাদেশ আসেনি। এই প্রথম দেখা আষাঢ়ের সাথে। তাহলে চেনা চেনা লাগছে কেন?

_______________

ব্যাপারটা কী হলো কিছুই ধরতে পারলো না কারিব। আষাঢ়কে কখনও এমন দেখেনি সে। নোয়ানাকে দেখার সাথে সাথেই কেমন যেন পাল্টে গেল আষাঢ়। গিয়েছিল মিহিকের সাথে দেখা করার জন্য, বিয়ে ভাঙার জন্য, মিহিককে পটানোর জন্য। অথচ মিহিকের সাথে দেখা না করেই চলে এলো! কাহিনীটা কী? আবার খুব খুশি খুশিও দেখাচ্ছে তাকে। মুচকি একটা হাসি ফুঁটে আছে তার ওষ্ঠতে। নোয়ানার প্রতি আকর্ষণ বোধ করছে না কি আষাঢ়? না এটা হওয়া সম্ভব নয়। আষাঢ়ের কেবল সুন্দরী মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ। নোয়ানা তেমন একটা সুন্দর নয়। নোয়ানার প্রতি আকর্ষণের সৃষ্টি হতে পারে না আষাঢ়ের মাঝে। তাহলে আসল রহস্য কী?

“আপনার কী হয়েছে আষাঢ় ভাই?” কারিব জানার আগ্রহকে দমিয়ে রাখতে পারলো না।

আষাঢ় হেসে বললো,
“খুব শীঘ্রই তোমার বিয়ে দেবো কারিব।”

“কী?” কারিব বিস্ময়াবিষ্ট। সে কী জিজ্ঞেস করলো, আর এ কী বললো তার আষাঢ় ভাই?

আষাঢ় মিহিকদের বাড়ি থেকে ফিরে ভাইয়ের রুমে এলো প্রথমে। বাইরে এখন সকালের ঝলমলে রোদ। শ্রাবণ জানালার ধারে টুলে বসে রুমকির সাথে চ্যাটিং করছিল, কারিব আর আষাঢ়কে দেখে এগিয়ে এলো সে। তার মুখটা খুশিতে ঝলমল করছে।

“কাজ হয়ে গেছে?” হাসি মুখে জানতে চাইলো শ্রাবণ। তার মনে চাপা উত্তেজনা।

আষাঢ় তার হাসি মুখকে গুঁড়িয়ে দিয়ে বললো,
“এই বিয়েটা তোমাকে করতে হবে ব্রো।”

“কী?” আননে আঁধার ছেয়ে গেল শ্রাবণের।

“হ্যাঁ, এ বিয়ে ভাঙতে পারবো না আমি। আব্বুর কথার অবাধ্য হওয়া একদম উচিত হবে না। আব্বু তেজ্যপুত্র করবে তোমাকে। সাথে আমাকেও। কারিবেরও গর্দান যাবে। এত লোকের সর্বনাশ কেন করবে তুমি? বিয়েটা করে নাও চুপচাপ। তোমার বউ তো খুব সুন্দর। এত সুন্দর মেয়েকে বউ করতে সমস্যা কী?”

“এসব কী বলছিস? তোকে এত ভরসা করলাম আমি, আর তুই…”

“তোমার হবু বউকে বিয়ে করতে সমস্যা কী তোমার? বিয়ে করবে না কেন? তোমার হবু বউ তো মাশাআল্লাহ খুব লক্ষ্মী, সুন্দর, শিক্ষিত, ভদ্র। এতটা ভদ্র মেয়ে এই প্রথম দেখলাম আমি। আমার সাথে মাথা তুলে পর্যন্ত কথা বলেনি সে। আমার ভাবি হিসেবে সে একদম পারফেক্ট। তোমার সাথে খুব মানাবে তাকে।”

কারিব থ। মাথা ভনভন করছে তার। কথা বলা তো দূরের থাক, যে মেয়েকে এক সেকেন্ডের জন্য একটু চোখের দেখাও দেখলো না, সে মেয়ের সম্পর্কে হঠাৎ এত ভালো ভালো বাণী শোনাচ্ছে! হচ্ছেটা কী ঠিক?

শ্রাবণ বললো,
“তোর হয়েছে কী? যেখানে তাকে তোর নিজের জন্য পছন্দ করার কথা, সেখানে আমার জন্য পছন্দ করে এসেছিস মানে? সে সুন্দরী সেটা তো আমি জানি-ই। সুন্দরী বলেই তো গেলি তাকে নিজের জন্য পটাতে। এখন এসব কী বলছিস?”

“উহ ব্রো, তুমি বুঝতে পারছো না। সবাই এক হয় না। অনেকে আছে যাদের দেখলে ভিতর থেকে সম্মানবোধ আপনা থেকেই জেগে ওঠে। সেও হলো সেই দলেরই একজন। তাকে দেখেই মনে হয়েছে সে আমার বোন।”

কারিবের মাথাটা এখনও ঘুরছে। কীসব হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। শ্রাবণও বুঝতে পারছে না। কথা ছিল এক, হলো এক। সে বললো,
“তাহলে তুই-ও চাইছিস আমি বিয়েটা করি?”

“হ্যাঁ অবশ্যই। যে মেয়ে এত ভালো সে মেয়েকে বিয়ে করতে আপত্তি কোথায়? অন্য কাউকে পছন্দ করো তুমি? যদি করে থাকো তাহলেও লাভ হবে না! আমি তো বলবো, হবু ভাবিকেই বিয়ে করে নাও ভালোয় ভালোয়। এতে তোমারও মঙ্গল, বাকি সবারও মঙ্গল! আচ্ছা, যাকে তুমি পছন্দ করো সে কে? তোমার যদি মনে হয় তোমার বিয়ের পর সে মেয়ে ঝামেলা করবে, তাহলে এটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি দুদিনে তাকে তোমার দিক থেকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে নিয়ে আসবো। কে সে?”

কারিব ঝটপট উত্তর দিলো,
“রুমকি।”

আষাঢ় চমকে উঠলো,
“রুমকি?”

“হ্যাঁ, আপনার ভাই রুমকির প্রেমেতে ডুবে আছে।”

আষাঢ় অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো ভাইয়ের দিকে।
“এটা কি সত্যি ব্রো? তুমি রুমকির প্রেমে দিওয়ানা?”

শ্রাবণের থেকে কোনো উত্তর এলো না।

আষাঢ় বললো,
“রুমকি একটা ডেঞ্জারাস মেয়ে! ও আমাকে পর্যন্ত পটানোর চেষ্টা করেছিল। ওর হিস্ট্রি জানি বলে ওর দিকে পা বাড়াইনি আমি। অথচ এখন শুনলাম আমার নিজ ভাই ওর প্রেমে দিওয়ানা। ওহ ব্রো, কী হয়েছে তোমার? যেখানে রুমকি আমার টাইপের না, সেখানে ও তোমার টাইপের হয় কী করে? তুমি কি অবুঝ?”

“অবুঝই হয়ে গেছে শ্রাবণ ভাই। ওনাকে বুঝিয়ে লাভ নেই।” কারিব বলে উঠলো।

আষাঢ় কারিবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ব্রো যদি অবুঝ হয়, তাহলে আমার আব্বু হলো অবুঝদের বোঝানোর ওস্তাদ। ব্রোকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবে সে। এ নিয়ে আমার এবং তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমরা শুধু বিয়ে খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবো। বিয়েতে এনজয় হবে খুব।”

আষাঢ় ভাইয়ের দিকে তাকালো। ভাইয়ের মুখে অসহায়ত্ব, সাথে রাগও দেখা যাচ্ছে। রুমকিকে নিয়ে এভাবে বলায় রাগ তো হবেই তার। শত হলেও পছন্দের মানুষ!
আষাঢ় সেসব গ্রাহ্য না করে কারিবকে নিয়ে চলে এলো।

_______________

নিশুতি রাত। খোলা জানালা দিয়ে চন্দ্রমা আলো প্রবেশ করেছে রুমে। কারিব ওয়ার্ডোব ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আষাঢ়ের থেকে দূরে। আষাঢ় বেডে বসা। সেই কখন থেকে কারিব দেখছে আষাঢ়কে। আষাঢ় হাসছে। মিটিমিটি হাসছে তখন থেকে। কিছু বলছে না, কোনো দিকে দৃষ্টিপাত করছে না। কারিবের মনে ভয় ভয় হচ্ছে। পাগল হয়ে গেল না কি আষাঢ়? সে কখনও আষাঢ়কে এমন করতে দেখেনি। সে তাকিয়ে থাকলো রুদ্ধ চোখে। আর আষাঢ় হেসে গেল। অনেকক্ষণ পর কথা বললো আষাঢ়। ভাবুক বেশে, অন্যমনা হয়ে বললো,
“টিউলিপ ফুল কি আমায় সত্যিই চিনতে পারছে না? না কি না চেনার ভাণ করছে?”

কারিব শুনলেও কিছু বুঝতে পারলো না। জিজ্ঞেস করলো,
“কী?”

কারিবের কথা আষাঢ়ের কান অবধি এসে পৌঁছলো না। তার ধ্যান এখন শুধু নিজেকে ঘিরে এবং টিউলিপ ফুলকে ঘিরে। অন্যদিকে মনোযোগ ফেললো না সে। আগের মতো আনমনা ভাবে বললো,
“যদি চিনেও না চেনার ভাণ করে তাহলে এটা পছন্দ করি আমি, আর যদি সত্যিই না চিনে থাকে তাহলে আরও বেশি পছন্দ করি।”

কারিব বোকা হয়ে তাকিয়ে থাকলো। আষাঢ় কী বলছে এসব?

“আপনি কী বলছেন, কী করছেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না আষাঢ় ভাই!”

আষাঢ় তাকালো কারিবের দিকে। সবদিকে মনোযোগ ফিরে এসেছে তার। বেড থেকে নেমে কারিবের কাছে এসে বললো,
“ইউ নো কারিব? আমেরিকায় আমি একটা পাখি পুষতাম। কিন্তু দুঃখের কথা হলো পাখিটা কয়েক মাস পরই আমার কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। উড়ে চলে গিয়েছিল আমার থেকে! পাখিটাকে আমি খুঁজিনি কখনও, পাখিটাও নিজ থেকে আর ধরা দেয়নি। কিন্তু অনেক বছর পর আমি আবার সেই পাখির সন্ধান পেয়েছি। তোমার কী মনে হয়? কী করা উচিত আমার? পাখিটাকে খাঁচায় বন্দি রাখা উচিত? না কি আগের মতোই মুক্ত? যাতে সে আবারও হারিয়ে যেতে পারে আমার থেকে?”

বেশ ভাবনার কথা! ভাবনায় পড়লো কারিব। একটু ভেবে বললো,
“পাখি খাঁচায় আটকে রাখা তো বেআইনি। আপনার মুক্ত রাখা উচিত। পাখি উড়ে গেলে কী আর করতে পারবেন? পাখি উড়বে সেটাই তো স্বাভাবিক। ওড়াই তো পাখির ধর্ম।”

আষাঢ় ঘুরে দাঁড়ালো। জানালার দিকে যেতে যেতে বললো,
“নো কারিব, এটা পারবো না আমি। এবার আর পাখিকে মুক্ত রাখবো না কিছুতেই। হোক বেআইনি, পাখিকে আমি খাঁচাতেই বন্দি রাখবো। উড়াল দেওয়ার সুযোগ দেবো না।”

আষাঢ় জানালার কাছে এসে থামলো। তার রুম থেকে ইদ্রিস খানের বাড়িটা দেখা যায় না ভালো করে। বিশেষ করে মিহিকদের রুমের সাথের ব্যালকনিটা দেখা যায় না। একপাশ দেখা যায় শুধু, না দেখার মতো। আষাঢ় সেদিকটায় তাকিয়ে থেকে অস্ফুট স্বরে বললো,
“চাঁদ আমার বাড়ির ঠিক পাশটাতে অবস্থান করছে, অথচ সেই চাঁদের আলো আমার কাছে এসে পৌঁছচ্ছে না? এ তো চলবে না। ওই চাঁদের আলোতে শুধু আমিই শোভা পাবো। চাঁদটা একান্ত আমার! বহু বছর পর চাঁদটার সাথে দেখা, জোৎস্না না মেখে তো থাকবো না আমি।”

আষাঢ়ের কথা ঠিকভাবে শুনতে পেল না কারিব। কী বললো আষাঢ় বিড়বিড় করে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here