#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ০৯
#লেখা: ইফরাত মিলি
আষাঢ়ের হাতে বাইনোকুলার। জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির ব্যালকনির উপর তার অবলোকন দৃষ্টি। বারান্দাতে এই মুহূর্তে নোয়ানা অবস্থানরত। তিন্নি ছিল সাথে, এই মাত্র ভিতরে ঢুকে গেল সে। আষাঢ়ের অধরে মুচকি হাসির রেখাঙ্কন। নোয়ানার মুখে ব্যালকনির গ্রিল ভেদ করে সোনালি প্রভাতকিরণের পরশ বিদ্যমান। নোয়ানা এখন দূরে, অথচ আষাঢ়ের মনে হচ্ছে নোয়ানা তার খুব কাছে। মুখটা কত কাছ থেকে দেখছে সে। ভাগ্যিস কারিব রাতের ভিতরে একটা বাইনোকুলারের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। নয়তো সকাল রোদ্দুরের পরশ আঁকা নোয়ানার মায়াবী মুখটা এত ভালো করে দেখা হতো না তার। নোয়ানার নাকের নোজপিনটা চিকচিক করছে। তার হাতে একটা বই। বইয়ে দৃষ্টি রেখেই চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। মেয়েটা রোজ এই সময় এখানে বই নিয়ে বসবে। এটা তার অভ্যাস। আষাঢ় নোয়ানার এই অভ্যাসের সাথে পরিচিত হয়েছে গত কালকে। কালকেও নোয়ানাকে এই সময় বই নিয়ে বসে থাকতে দেখেছিল। ধারণা করেছিল আজকেও থাকবে। ঠিক তাই।
কারিব রুমে প্রবেশ করে আষাঢ়কে এখনও জানালার কাছে বাইনোকুলার নিয়ে দাঁড়ানো দেখলো। অজান্তেই ক্ষুদ্রশ্বাস ফেললো সে। নোয়ানার জন্য দুঃখ হচ্ছে তার। শেষ পর্যন্ত এ মেয়েটারও কপাল পুড়লো! মনে শঙ্কা হয়েছিল আষাঢ় কোনোরকম ভাবে নোয়ানার প্রতি আকর্ষিত হয়েছে। ঠিক তাই হলো। নোয়ানা সত্যি সত্যি আষাঢ়ের স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ড লিস্টে চলে এসেছে। একবার সে আষাঢ়ের প্রেমে ডুবলেই হয়েছে! পরে মেয়েটার দুঃখ করতে হবে এ নিয়ে। তবে কারিব আষাঢ়ের ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। আষাঢ় নোয়ানার প্রতি ইন্টারেস্ট ফিল করতে পারে এর সম্ভাবনা খুব কম ছিল। তবুও সেই আষাঢ় নোয়ানার প্রতি ইন্টারেস্ট। যেন তা আবার একটু বেশিই। আষাঢ় যে কেন নোয়ানাকে নিজের স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ড বানাতে টার্গেট করলো সেটা কারিব ভেবে পাচ্ছে না। নোয়ানা পাশের বাড়ির মেয়ে, এরপর আবার আত্মীয় হতে চলেছে। ক’দিন পর কী করে ফাঁকি দেবে নোয়ানাকে? আর এ ব্যাপারে কবির সাহেবের কানে কিছু গেলে এর পরিণাম হবে অতি ভয়াবহ! আষাঢ় সব জেনে-শুনে কেন এই খেলায় নামলো? আষাঢ়কে কিছুটা সাবধান বাণী শুনিয়েছিল সে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আষাঢ় নিজ অবস্থানে অটুট রইল। সেও নিরুপায় আষাঢ়ের সব কথা শুনলো।
“ফোন নাম্বার এনেছো কারিব?”
আষাঢ়ের প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরলো কারিবের। আষাঢ়ের দিকে মনোযোগ দিলো সে। আষাঢ় প্রশ্নটা তার দিকে না ফিরেই করেছে। কারিব উত্তর দিলো,
“জি, এনেছি।”
“তাহলে দ্রুত দাও।”
কারিব আষাঢ়ের দিকে এগিয়ে এলো। আষাঢ় ঘুম থেকে উঠেই তাকে নোয়ানার ফোন নম্বর জোগাড়ের দায়িত্ব দিয়েছিল। কোত্থেকে নোয়ানার ফোন নাম্বার জোগাড় করবে বুঝতে পারছিল না। আষাঢ়ই তাকে উপায় বলেছিল। লায়লা খানমের ফোনে নিশ্চয়ই নোয়ানার ফোন নাম্বার থাকবে, সেখান থেকে কালেক্ট করতে বলেছে। কারিব টেকনিক খাটিয়ে লায়লা খানমের মোবাইল থেকে নোয়ানার ফোন নাম্বার কালেক্ট করেছে।
কারিবের কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে নিজের মোবাইলে সেভ করলো আষাঢ়। নতুন কোনো সিম কার্ড না ঢুকিয়ে নোয়ানার নাম্বার ওঠাতে দেখে অবাক হলো কারিব। নিজের স্থায়ী গার্লফ্রেন্ড ছাড়া সব স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ডদের সাথেই আষাঢ় নতুন সিমকার্ড ঢুকিয়ে কথা বলে। নোয়ানাকে নিজের স্থায়ী গার্লফ্রেন্ড বানাতে চাইছে না কি আষাঢ়? কারিব নিজেই নিজেকে মনে মনে শুধালো, এ্যাহ, এটা হতেই পারে না। সে তো আষাঢ়ের স্থায়ী গার্লফ্রেন্ডদের দেখেছে, কত সুন্দরী তারা! নোয়ানা তো তাদের মতো সুন্দর নয়। হয়তো আত্মীয় হতে যাচ্ছে বলে একটু সম্মান দেখিয়ে নিজের স্থায়ী যোগাযোগ মাধ্যমে স্থান দিয়েছে। হ্যাঁ, এটাই হবে। কারিব আরও অবাক হলো যখন দেখলো আষাঢ় নোয়ানার ফোন নাম্বার ‘Tulip’ লিখে সেভ করেছে। কারিবের সেদিনের কথা স্মরণ হলো। সেদিনও আষাঢ় টিউলিপ নিয়ে কথা বলেছিল।
“নাও।” কারিবের দিকে কারিবের ফোন এগিয়ে দিলো আষাঢ়।
কারিব কিছু না বলে ফোনটা নিলো।
আষাঢ় কল দিলো নোয়ানার নাম্বারে।
এখানে থাকা উচিত হবে কি না ভাবলো কারিব। যদিও গার্লফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলার সময় সে থাকলে তাতে কিছু যায় আসে না আষাঢ়ের। আষাঢ়ের কথা বলতে তাতে মোটেই অসুবিধা হয় না। তবুও কারিবের মনে হলো তার চলে যাওয়া উচিত। যদিও তার চলে যাওয়ার থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আষাঢ়ের কথাবার্তা শোনাটাই উচিত হবে, তাও সে কী কারণে যেন থাকতে পারলো না। আষাঢ় যখন নিজের স্থায়ী গার্লফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলে, তখনও সে অনেক থেকেছে আষাঢ়ের সাথে। কিন্তু আজকে তার কী হলো কে জানে। সে আষাঢ়কে বিরক্ত না করে চুপচাপ পিছন থেকে চলে এলো।
আষাঢ় এক হাত দিয়ে ফোন আর একহাত দিয়ে বাইনোকুলার ধরে রাখলো। রিং হচ্ছে।
নোয়ানা চেয়ার ছেড়ে ভিতরে চলে গেল। হয়তো আগমনী কলটা রিসিভ করতেই গিয়েছে সে। আষাঢ় হাসলো।
অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে। নোয়ানা একটু সময় নিয়েই রিসিভ করলো। ফোনটা নিয়ে আবার ব্যালকনিতে ব্যাক করলো সে। চেয়ারে বসলো। ফোনের ওপাশটা নীরব দেখে সে নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
“হ্যালো! কে বলছেন?”
“আমি কে সেটা জানা কি খুব জরুরি?”
আষাঢ়ের কথা শুনে চমকে উঠলো নোয়ানা।
আষাঢ় বাইনোকুলার দিয়ে প্রত্যক্ষ করলো নোয়ানার সেই চমকে যাওয়া ভাব।
নোয়ানা নীরব হয়ে গেল। মনে মনে যেন উত্তর হাতড়ে বেড়ালো, কে লোকটা? উত্তর পেল কি না ঠিক বোঝা গেল না। আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কে আপনি?”
আষাঢ় একটু হেসে বললো,
“আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখো, থাকতেও পারি তোমার খুব কাছাকাছি।”
আষাঢ়ের কথায় সচকিত হয়ে উঠলো নোয়ানা। ব্যস্ত ভাবে একবার আশপাশে চোখ বুলালো নোয়ানা। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। ব্যর্থ হয়ে বললো,
“আপনি ঠিক কে বলুন তো?”
“আমি কে সেটা তোমার না জানলেও চলবে প্রিয়তমা! তবে তোমাকে জানার একরাশ তেষ্টা আমার মনে। কে তুমি?”
আষাঢ়ের বলা সব কথার মাঝে ‘প্রিয়তমা’ শব্দটি খুব করে লাগলো কানে। নোয়ানা কল কেটে দেওয়ার জন্য মোবাইলটা কান থেকে সরাতে উদ্যত হলো, আষাঢ় সেটা বুঝতে পেরেই বললো,
“এই না, কল কাটবে না। তোমার সাথে কথা শেষ হয়নি আমার।”
আষাঢ়ের কথা জাদুর মতো কাজ করলো, নোয়ানা চাইতেও কলটা কাটতে পারলো না।
আষাঢ় নীরব হাসে। বললো,
“যেখানে আমার সাথে মেয়েরা কথা বলতে চায় আর আমি তাদের সাথে কথা না বলে কল কেটে দিই, সেখানে আমি নিজ থেকে তোমাকে কল দিয়ে কথা বলছি। অথচ তুমি কল কেটে দিতে চাইছো? খুব খারাপ হবে কিন্তু। কতটা খারাপ হবে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। একেবারে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসবো। আর তারপর… তারপর কী হবে বলো তো?”
নোয়ানা স্তব্ধ হয়ে শুনছে। অন্তঃকরণে রাগ জেগে উঠছে তার।
“কী হলো চুপ কেন? কী হবে জানো না তুমি? বিয়ে! বিয়ে হবে গো প্রিয়তমা!”
নোয়ানার আর সহ্য হলো না, সে ফোন কেটে দিলো। তারপর উঠে চলে গেল রুমের ভিতর।
আষাঢ় বাইনোকুলার নামিয়ে ফেললো। তার সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে আছে। অপমানে তিক্ত সে। নোয়ানা এভাবে ফোন কেটে দিলো? রাগ, জেদ সব চেপে বসলো তার মাথায়। সে আবার কল দিলো। বাইনোকুলারে চোখ দিয়ে আবারও তাকালো বারান্দায়। ওপাশ থেকে কল কেটে দেওয়া হলো।
অস্থির হয়ে পড়লো আষাঢ়। অপমানিত সে। নোয়ানা তাকে বিশাল আকারে অপমান করেছে। সে কোনো দিক ভেবে না পেয়ে কল দিলো কারিবের কাছে।
“কারিব, এক্ষুণি রুমে এসো। হারি আপ!”
কারিব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। আষাঢ়ের গলায় অস্থিরতা ছিল। কী হলো আষাঢ়ের?
“কী হয়েছে আষাঢ় ভাই?”
“মেয়েদের দেমাগ কীসে বিনাশ হয় জানো তুমি?”
“হঠাৎ করে এ প্রশ্ন কেন? কে আবার দেমাগ দেখিয়েছে আপনার সাথে?”
“যেখানে আমি মেয়েদের সাথে কথা বলতে বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিই, সেখানে নোয়ানা আমার মুখের উপর ফোন কেটে দিয়েছে! ভাবতে পারো তুমি?”
“সত্যি আষাঢ় ভাই?”
“নয়তো কি মিথ্যা? আমার গলা চিনতে পেরেও ও এমন করলো। কতটা খারাপ!”
কারিব আর কিছু না বলে চুপ মেরে গেল। আষাঢ় চোখ নামিয়ে ফেলে শূন্য দৃষ্টি স্থাপন করলো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে, আনমনে হেসে বলে উঠলো,
“দারুণ টিউলিপ ফুল! নতুন করে আবার প্রেমে পড়ছি কিন্তু তোমার। চিনতে পেরেও এত সুন্দর না চেনার ভাণ ধরলে? আমি তো মুগ্ধ! এত মুগ্ধতায় ডোবাও কেন আমায়? কিছুটা আগের মতোই আছো তুমি। পালিয়ে বেড়ানোর স্বভাব। এখন তো বড়ো হয়েছো, বুদ্ধি হয়নি? এখনও পালিয়ে বেড়াবে? ঠিক আছে, যত পারো পালাও তুমি। আমিও ছুটছি তোমার পিছন পিছন। ঠিকই ধরে ছাড়বো। পালিয়ে যেতে পারবে এ আশা করো না ভুলক্রমে।”
কারিব ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আষাঢ়ের কার্যক্রম সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
আষাঢ় কারিবের দিকে চোখ তুলে চাইলো।
“আজকে কী প্ল্যান আমাদের?”
কারিব স্বাভাবিক করলো নিজেকে। জবাব দিলো,
“তেমন তো কোনো প্ল্যান নেই আজকে। কোনো গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করার নেই। ঝামেলামুক্ত সব।”
“বিয়ের শপিং আছে না আজকে? আচ্ছা, তোমার কী মনে হয়? ব্রো বিয়েটা করবে?”
“বিয়ে করা ছাড়া তো উপায় নেই। কাল তো মামা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, হয় বিয়ে, না হয় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে।”
আষাঢ় আনন্দিত হেসে বললো,
“এই বিয়েটা হলে সবচেয়ে কার বেশি ভালো হবে বলো তো?”
কারিব কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো,
“কার?”
“আমার! নোয়ানার বোনের এ বাড়িতে বিয়ে হলে নোয়ানার আসা যাওয়া একটু বেশি হবে না? পাশের বাড়িতে বোন, যখন তখন এসে দেখা করবে। আর সেই দেখার ছলে আমার সাথেও বাক্যলাপ হবে, দেখা হবে, প্রেম হবে! সবকিছু হবে। এই জন্যই আমি এত করে চাইছি হবু ভাবির সাথেই আমার ভাইয়ের বিয়েটা হয়ে যাক।”
আষাঢ় খুশি মনে উঠে দাঁড়ালো। ওয়ার্ডোবের ভিতর থেকে চকলেট বের করে, একটা চকলেটের খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুরলো।
কারিব পিছন থেকে জিজ্ঞেস করলো,
“নোয়ানার জন্য এত পাগল হলেন কেন আপনি?”
আষাঢ় কারিবের জন্য একটা চকলেটের খোসা ছাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। চকলেটটা কারিবের মুখে পুরে দিয়ে বললো,
“কেন এত পাগল হলাম বুঝবে না কারিব। এটা বোঝার বয়স হয়নি তোমার। তুমি এখনও যথেষ্ট ছোট।”
বলে বেরিয়ে গেল আষাঢ়।
ছোট মানে? আষাঢ় ভাই তার বয়স ভুলে গেছে না কি? কারিব দুশ্চিন্তায় পড়লো। যেখানে সে আষাঢ়ের থেকে এক বছরের বড়ো, সেখানে আষাঢ় তাকে ছোট বললো?
_______________
বিয়েটা না করে আর উপায় নেই। বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে মিহিককে বিয়ে না করলে, এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। শ্রাবণ চাইছিল মা-বাবাকে বুঝিয়ে বলবে, কিন্তু হলো বিপরীত। বোঝাতে গিয়ে তাদের আরও ক্ষেপিয়ে দিলো। এখন বিয়েটা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। না, এই জীবন আর রইল না সুষ্ঠ। আবার কাল রাতে মা’ও জানিয়ে দিয়েছে এ বিয়ে না করলে সে খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ করে দেবে। সেই দরুণ হিসেবে রাতে, সকালে কিছুই খায়নি সে। দুপুরে অনেক জোরাজুরির পরে খেয়েছে। এখন বিকেল চলে।
সব কিছু মিলিয়ে পাগল পাগল লাগছে শ্রাবণের। সে শত ভেবে ডিসিশন ফাইন্যাল করেছে। বিয়েটা চুপচাপ করে নেওয়াটা এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বিয়ের পর মিহিককে বুঝিয়ে ডিভোর্স দিয়ে দেবে মিহিককে। আর তাছাড়া মিহিক যেমন মেয়ে, এ বাড়িতে বউ হয়ে এলে তারপর সবাই বুঝতে পারবে মিহিক কতটা দজ্জাল! তখন হয়তো তারা নিজেরাই ডিভোর্স দেওয়ার কথা বলবে। হ্যাঁ, ভালো একটা সিদ্ধান্ত। কিন্তু সমস্যা হলো রুমকি। রুমকিকে কী করে বোঝাবে? এটা নিশ্চয়ই বেশিদিন চাপা থাকবে না রুমকির কাছ থেকে। বিয়ের কথা জানতে পেরে রুমকি আবার ব্রেকআপ করে চলে যাবে না তো?
শ্রাবণের চোখে একটা বীভৎস দৃশ্য ভেসে উঠলো, রুমকি তার সাথে ব্রেকআপ করে চলে যাচ্ছে। আর যাওয়ার আগে দুই গালে দুটো করে মোট চারটে চড় মেরেছে।
শ্রাবণ নিজের দুই গাল চেপে ধরলো। রুমকি তাকে ছেড়ে গেলে সে বাঁচবে না। রুমকিকে বোঝাতে হবে। বিয়েটা আগে হয়ে যাক। তারপর সে নিজেই বোঝাবে রুমকিকে।
“ভাইয়া, তোমার হবু বউ এসেছে। দেখা করবে না?” দরজায় দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে খবরটা জানালো জুন।
শ্রাবণ নিজ কক্ষে শয়ন অবস্থায় ছিল। চকিতে উঠে বসলো সে।
“কে এসেছে?”
“আরে তোমার বউ।”
আষাঢ় আর কারিব শ্রাবণের রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। জুনের কথা তাদের কানে এসে পৌঁছলো। তারা বাইরে একটু ঘোরাঘুরি করবে বলে বের হচ্ছিল। জুনের কথা শুনে আষাঢ়ের চেহারা চকচক করে উঠলো। তারা প্রায় শ্রাবণের রুমের দরজা অতিক্রম করে ফেলেছিল, আবার ফিরে এলো জুনের কাছে।
“কে এসেছে?”
আষাঢ়ের প্রশ্নে জুন দীর্ঘ হাসির রেখা টেনে বললো,
“আমাদের হবু ভাবি। লিভিং রুমে বসে আছে।”
“সে একা?”
“না, সাথে তার বোনেরাও আছে।”
আষাঢ়ের মন বেজায় খুশি হয়ে উঠলো। সে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আরে ব্রো, তুমি এখনও বসে আছো? আমি যদি শুনতাম আমার হবু বউ আমাদের বাড়িতে এসে লিভিং রুমে বসে রয়েছে, তাহলে এক ছুটে গিয়ে এখনই তাকে জড়িয়ে ধরতাম। আর তুমি…চলো তাড়াতাড়ি।”
শ্রাবণের মনে হলো তার গায়ে জ্বর এসেছে। সে দুর্বল কণ্ঠে বললো,
“আমার গায়ে জ্বর এসেছে ভাই, আমাকে জ্বালাতন করিস না।”
কথাটা বলে শুয়ে পড়লো সে। জুন ভাইয়ের জ্বর এসেছে শুনে উতলা হয়ে রুমে ঢুকলো।
আষাঢ় দাঁড়ালো না। কারিবকে নিয়ে চলে এলো। সিঁড়িতে থাকতেই দেখতে পেল তিন বোন তাদের লিভিং রুমকে আলোকিত করে রেখেছে। সে কারিবকে নিচু স্বরে বললো,
“কারিব, তিন তিনটা চাঁদ জোৎস্না ছড়াচ্ছে আমাদের ঘরে, তুমি কি তা দেখতে পাচ্ছ?”
“এখন তো বিকেল টাইম, চাঁদ উঠবে কীভাবে? আর চাঁদ তো একটা হয়।”
“আমি তিনটা দেখতে পাচ্ছি।”
কারিব স্মিত হেসে বললো,
“কোন চাঁদটাকে বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে?”
“বেশি সুন্দর তো আমার হবু ভাবি, তবে নোয়ানা নামের চাঁদটা বেশি ভালো লাগছে আমার।”
কারিব আষাঢ়ের এমন কথার জবাবে বলার কিছু পেল না।
আষাঢ় লিভিং রুমে নেমে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম তিন বোন।”
তিন বোনের কারোর মনোযোগই আষাঢ়ের দিকে ছিল না, তারা লায়লা খানমের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল। লায়লা খানম বাড়ির উপর গিয়ে নিয়ে এসেছে তাদের। মিহিক আসতে চাইছিল না, কিন্তু লায়লা খানম ছাড় দেননি। পিঠা পুলির আয়োজন করা হয়েছে, সেজন্য তিন বোনকে পিঠা খাওয়াতে নিয়ে এলেন। তিন বোন একই সাথে আষাঢ়ের সালামের উত্তর দিলো।
আষাঢ় মুচকি হাসতে হাসতে মায়ের পাশে বসলো। কারিব দাঁড়িয়ে রইল। লায়লা খানম বললেন,
“তোমরা বোধহয় ওর সাথে পরিচিত না। বলেছিলাম না আমার ছোট ছেলে এসেছে? ও আমার ছোট ছেলে আষাঢ়। আসলে আমার ছেলেটা ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করে। বাংলাদেশ এসেই এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। খুব একটা বাসায় থাকে না। যার কারণে ওকে দেখতে পাওনি তোমরা।”
“না, দেখা হয়েছিল তো।” আষাঢ় বলে উঠলো। নোয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো,
“নোয়ানার সাথে দেখা হয়েছিল তো আমার।”
লায়লা খানম পুলকিত কণ্ঠে বললেন,
“তাই? কবে দেখা হয়েছিল?”
মিহিক বললো,
“আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল আষাঢ়। আমার সাথে দেখা করতে। তবে কোনো একটা কারণে দেখা না করেই চলে এসেছিল।”
লায়লা খানম ছেলেকে বললেন,
“দেখা করতে গিয়ে দেখা করোনি কেন বাবা?”
“দেখা না করে চলে এসে ভালো হলো না? সেদিন আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম, আর আজ হবু ভাবি নিজেই চলে এলো আমাদের বাড়িতে। নিজ বাড়িতে বসে হবু ভাবিকে দেখার মাঝে অন্য রকম একটা ব্যাপার আছে।”
কথাটা বলে নোয়ানার দিকে তাকালো আষাঢ়।
মিহিকের বিরক্ত লাগলো। বুঝে গেল এ ছেলেও শ্রাবণের মতো! খুব একটা ভালো নয়।
আষাঢ় অনেকক্ষণ বসলো এখানে। লায়লা খানমের সাথে কথা চলছিল তিন বোনের। আষাঢ়ের দিকে কারো তেমন দৃষ্টিপাত ছিল না। নোয়ানা অবশ্য আড় চোখে কয়েকবার দেখেছিল তাকে। আষাঢ় সেটা ধরতে পেরে হেসেছে মনে মনে। কথাবার্তার মাঝে আষাঢ়ের দৃষ্টি সকলের অগোচরে নোয়ানাকেই দেখেছে। নোয়ানার চোখ দুটো দেখছিল সে গভীর ভাবে। ওই চোখে কিছু একটা নেই আগের মতো। বিষণ্ণ, বিষাদের ছাপটা এখন অপরিলক্ষিত। তবুও যেন ভাসা ভাসা একটা ছাপ রয়ে গেছে। আষাঢ় মনে মনে বললো,
‘তোমার চোখ দুটোতে কেন আগে বিষণ্ণ আর বিষাদের ছাপ দেখতে পেতাম টিউলিপ ফুল?’
(চলবে)