#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ১৪
#লেখা: ইফরাত মিলি
“রুপালি দাদি, এক কাপ কফি প্লিজ!”
আষাঢ়ের কথায় রুপালি ক্ষেপে গেলেন,
“হুনো আষাঢ়, তোমারে আগেও কইছি, এখনও কচ্ছি, আমারে দাদি বলে ডাকবা না। আমারে দাদি বলে ডাকো তুমি কোন আক্কেলে? আমি কি তোমার দাদির বয়সী? আমি তোমার মা’র থেকেও এক বছরের ছুডু। তোমার বড়ো ভাই, ছুডু বোন আমারে খালা বলে ডাকে, তুমিও খালা বলে ডাকবা। না হয় রূপ আপা অথবা আপু বলে ডাকবা।”
“ইম্পসিবল রুপালি দাদি, ইম্পসিবল। তোমাকে তো আগেই বলেছি, তোমাকে আমি ‘দাদি’ই ডাকবো। তোমাকে দেখলেই আমার দাদির কথা মনে পড়ে, সেজন্যই তো তোমাকে দাদি ডাকি।”
“কেন আমারে দেখলে তোমার দাদির কথা মনে পড়ে? তোমার দাদির চেহারার সাথে তো আমার চেহারার কোনো মিল নাই। অযথা যুক্তি দেখিয়ো না। আমারে দাদি ডাকবা না তুমি। খালা, আপু বা আপা বলে ডাকবা।”
“রূপ দাদিকে খুশি করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাকে দাদিই ডাকবো আমি। কফিটা তৈরি করে রেখো।”
আষাঢ় জায়গা ত্যাগ করলো।
রুপালি খুব রাগ। আষাঢ়কে এর জন্যই তার পছন্দ না। ঘাড় ত্যাড়া ছেলে একটা। তার বয়স কি বেশি? কেন দাদি বলে ডাকবে তাকে? প্রথম থেকেই ছেলেটা তাকে দাদি বলে ডাকে। কত বুঝিয়েছে সে আষাঢ়কে। দাদি না, খালা বলে ডাকো, বা আপা ডাকো। কিন্তু এ ছেলে কি আর বোঝে! না বুঝুক, কফিও পাবে না। নিজে বানিয়ে খাক।
________________
আষাঢ়ের ধারণা ছিল মিহিকের এ বাড়িতে বিয়ে হলে নোয়ানার আসা যাওয়া বেশি হবে এ বাড়িতে। কিন্তু তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আসা যাওয়া তো বেশি হচ্ছেই না, বরং নোয়ানা এ বাড়িতে আসাই বন্ধ করে দিয়েছে। আসারই বা কী দরকার? বোনকে দেখতে আসবে, সে বোনই তো উল্টো তাদের দেখার জন্য যায়।
হু, মিহিক এখন নিজের বাবার বাড়িতে রোজ চলাচল করে। যখন ইচ্ছা তখন যায়। মা-বাবার উপর থেকে রাগ যে এখন পড়ে গেছে। শুধু অভিমান জমে আছে। গিয়ে বোনদের সাথে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে তারপর আবার আসে। আজকে শুক্রবার। নোয়ানা, তিন্নির স্কুল-কলেজ নেই। মিহিক ভেবেছে আজকে গিয়ে সারাদিন ওখানেই কাটাবে। এ ব্যাপারে কেউ কখনো আপত্তি করে না। আপত্তি করার মানুষই বা কোথায়? শ্রাবণ তো বোধহয় সে না থাকলেই খুশি, শাশুড়িও বউমা’র মন ভালো থাকবে বলে কিছু বলেন না, শ্বশুরের কিছু বলার টাইমই বা কোথায়? কাজ নিয়ে থাকেন, না হয় বই পড়ে সময় কাটান। প্রথম যে আপত্তি করার তা করলো আষাঢ়। মিহিক বাবার বাড়িতেই যাচ্ছিল এখন। আষাঢ় পিছন থেকে ডেকে বললো,
“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
মিহিক থামলো। পিছন ফিরে তাকালো। আষাঢ়কেও তার কোনো একটা কারণে পছন্দ হচ্ছে না ঠিক। এই দুই ভাইয়েতেই তার অবজেকশন। বললো,
“বাড়ি যাচ্ছি।”
আষাঢ় এতক্ষণে মিহিকের কাছে এসে গেছে। বললো,
“তুমি কেন ও বাড়িতে যাবে? তুমি হলে ঘরের বউ, ঘরে থাকবে। তোমাকে যদি দেখার ইচ্ছা হয় তাহলে তোমার বোনেরা আমাদের বাড়িতে এসে দেখে যাবে। তুমি কেন যাবে?”
মিহিকের বেজায় রাগ হলো। চোখে মুখে তীক্ষ্ণ বিরক্তি ফুঁটিয়ে বললো,
“দেখো আষাঢ়, আমি কোথায় যাব, কোথায় যাব না এটা একান্ত আমার ব্যাপার। এখানে না তোমার কোনো কথা বলার অধিকার আছে, আর না তোমার ভাইয়ের।”
শ্রাবণ সিঁড়ি দিয়ে নামছিল, মিহিকের শেষ কথা শুনে সে দাঁড়িয়ে গেল।
আষাঢ় বললো,
“আমার কোনো কথা বলার অধিকার নেই সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু আমার ভাইয়ের তো অবশ্যই আছে। সে তোমার স্বামী।”
মিহিক হেসে ওঠে।
“স্বামী! হুম, তোমার ভাই তো মহান স্বামী। এমন মহান স্বামী সব মেয়েদের কপালে জুটলে তো মেয়েদের কপাল খুলে রাজ কপাল হয়ে যেত।”
মিহিকের কটাক্ষপূর্ণ কথা শুনে শ্রাবণ রাগে ফুঁসে উঠলো। তড়িৎ গতিতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বললো,
“কোথাও যাবেন না আপনি।”
শ্রাবণের গলায় বিশেষ জোর টের পাওয়া গেল। অধিকারের সাথে যেন কথাটা বললো সে। তার অধিকার পূর্ণ কণ্ঠ মিহিককে আরও রাগিয়ে তুললো। মিহিক কিছু বলার আগে আষাঢ় ভাইয়ের প্রতি অগাধ বিরক্ত হয়ে বললো,
“ব্রো, এটা কবে বন্ধ করবে তুমি? নিজের বউকে কেউ আপনি করে বলে? যেখানে আমি তুমি বলে সম্মোধন করছি, সেখানে তুমি আপনিতে পড়ে আছো? উফ, দারুণ বিরক্তিকর!”
আষাঢ় বিরক্তিতে আর কিছু বলতেই পারলো না। ভাই, ভাবির মাঝ থেকে সরে কারিবের ঘরের দিকে যেতে লাগলো। কারিব আর সে এখনই ময়মনসিংহর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে।
মিহিক কপাল কুঁচকে রাগিভাবে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ এই চাহনি দেখে বললো,
“কী? এমন করে দেখছেন কেন?”
মিহিক কটমট করে বললো,
“বিরক্তিকর লোক একটা!”
“কী?” শ্রাবণের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল।
মিহিক উত্তর দিলো না। যাওয়ার জন্য ঘুরলে শ্রাবণ বললো,
“আপনাকে না যেতে নিষেধ করলাম।”
মিহিক দাঁড়ালো। পিছন ঘুরলো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার। শ্রাবণের দিকে এক পা এগিয়ে এসে গলার স্বর নিচু করে বললো,
“সেটাই তো, তুই কেন নিষেধ করবি আমায়? তুই কে আমাকে নিষেধ করার? স্বামীর অধিকার দেখাতে চাচ্ছিস আমার সাথে? প্রকৃত স্বামী হয়ে তারপরই অধিকার দেখাতে আসবি।”
বলে মিহিক যাওয়ার জন্য আবার ঘুরলো। পা বাড়াতে নিলেই শ্রাবণ পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো। মিহিকের রাগ আরও বাড়লো। সে আবার পিছন ফিরে তাকালো। আর তখনই হাতে টান পড়লো। শ্রাবণ তাকে টেনে রুমে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। এটা ভেবে শান্তি যে টেনে নিয়ে আসার সময় আশেপাশে কেউ ছিল না। কেউ দেখেনি ব্যাপারটা।
“আপনার সাহস তো কম না, আপনি আমাকে ঘোড়ার মতো টেনে নিয়ে এসেছেন?”
“কোথাও যেতে পারবেন না আপনি আজ। সারাদিন বাড়িতেই থাকবেন।”
“আমাকে এই কথা বলার কে তুই?”
“না হই আপনার কিছু, তাও শুনতে হবে। তবে আপনার মুখের তুই ডাকটা আমি আর শুনবো না। মোটেই সহ্য করবো না আর এটা। এরপর আর কখনও আমাকে তুই করে বলবেন না।”
মিহিক নির্বাক তাকিয়ে রইল। শ্রাবণ মিহিকের হাত ধরা ছিল। ছেড়ে দিলো। মিহিকের থেকে কয়েক পা দূরে সরে গিয়ে বললো,
“আপনার যেতে হবে না, আপনার বোনেরাই আসবে আজকে। আমাদের বাড়িতে আজকে দাওয়াত ওদের।”
__________________
ময়মনসিংহ গিয়ে আবার ব্যাক করছে কারিব, আষাঢ়। নোয়ানা আজকে তাদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে আসবে খবরটা পেয়েছে আষাঢ়। জুন ফোন করেছিল। ওর সাথে কথায় কথায় বিষয়টা জেনেছে। কারিব এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। আষাঢ় আসলেই নোয়ানার প্রতি একটু বেশি ইন্টারেস্ট বাকি স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ডের তুলনায়। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কী জানি! আজকাল সে বুঝতে পারছে না আষাঢ়কে। তবুও প্রিয় মানুষটার সব কথা পালন করে যাচ্ছে নিয়ম মেনে।
“আপনি যে ময়মনসিংহ এসে গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা না করে ঢাকা চলে যাচ্ছেন, এটা কি ভালো হলো? কত আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল মেয়েটা বলুন তো!”
আষাঢ় সিটের সাথে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে আছে। চোখ না মেলে সে কারিবের কথার উত্তর দিলো,
“আমার আসল আশা আমার বাড়িতে আসবে কারিব, আর আমি তাকে ফেলে রেখে ময়মনসিংহ পড়ে থাকবো? কখনোই না। সে নিজ থেকে কখনও তো কাছাকাছি আসেই না, আজ বাড়িতে আসছে। তাকে কাছে টেনে নেওয়ার দায়িত্ব তো আমার।”
“আপনি হঠাৎ নোয়ানার প্রতি এত ইন্টারেস্ট হলেন কেন? এই ব্যাপারটা আমি এখনও বুঝতে পারছি না আষাঢ় ভাই। আমাকে কি একটু ক্লিয়ার করে বলবেন?”
“সকল ফুলই সুন্দর হয় কারিব। তবে কিছু কিছু ফুল বিশেষ থাকে। টিউলিপ ফুল আমার বিশেষ পছন্দনীয়। সে আমার বিশেষ।”
কারিবের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। নোয়ানাকে দেখার পর থেকে আষাঢ় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলছে। আর এই টিউলিপ ফুল কী জিনিস? এই ফুলটাতে কী বিশেষত্ব আছে? নোয়ানার নাম্বারও ‘টিউলিপ’ লিখে সেভ করেছিল আষাঢ়। কারিব বেশ রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছে। সে আবদারের সুরে বললো,
“প্লিজ আষাঢ় ভাই, এমন করবেন না। আমাকে ক্লিয়ার করে বলুন একটু। এত কঠিন করে বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। সহজ করে বলুন একটু।”
আষাঢ় হাসলো। বন্ধ আঁখির হাসিটা যেমন সুন্দর লাগলো, তেমনি আবার অদ্ভুতও দেখালো। সে মিষ্টি সুরে বললো,
“কারিব! মাই ডিয়ার! জানতে পারবে সব। বুঝতে পারবে সব। তুমি আমার অন্যতম পছন্দের মানুষ। আমার সর্বক্ষণের সাথি। তোমার কাছ থেকে এটা লুকিয়ে রাখা যায় না।”
কারিবের মুখ চকচক করে উঠলো। তার মনে আসল ব্যাপারটা জানার একরাশ তৃষ্ণা। সে আমোদপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তাহলে এখনই বলে দেন, রহস্য রাখবেন না আর।”
আষাঢ় চোখ খুললো। সিটে হেলিয়ে দেওয়া মাথাটা সোজা করে বসলো। কারিবের দিকে সব মনোযোগ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
“ইদ্রিস খান আমাদের পাশের বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে দুই বছর চলছে, তাই না?”
কারিব ভেবেছিল আষাঢ় সহজভাবে এখনই সবটা বলে দেবে তাকে। যখন বললো না তখন মন খারাপ হলো। মন খারাপের বিজ্ঞাপন বাইরে ছাপতে না দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ।”
“এর জন্যই আমি আগে যখন বাংলাদেশ এসেছিলাম, তাদের দেখতে পাইনি।”
“হুম।”
“ইদ্রিস খান আমাদের কোম্পানিতে কাজ করেন কত বছর ধরে?”
কারিব একটু ভাবনাগ্রস্ত হয়ে বললো,
“চার বছর হলো…হ্যাঁ, চার বছরই হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে আপনি মেয়ে রেখে মেয়ের বাবার পিছনে কেন পড়লেন?”
আষাঢ়ের থেকে উত্তর পায় না কারিব। উল্টো নিজে প্রশ্নের মুখে পড়ে।
“ইদ্রিস খান আগে বিদেশ ছিলেন, এমন কিছু জানো?”
কারিব এ সমস্ত প্রশ্নের মানে বুঝতে পারছে না, তাও উত্তর দিয়ে গেল,
“এটা তো আমি ঠিক জানি না আষাঢ় ভাই। তবে মনে হয় না বিদেশ গিয়েছিলেন। আপনি কেন জানতে চাইছেন এটা?”
আষাঢ় নিঝুম হয়ে গেল। তার কাছে ব্যাপারটা ধোঁয়াশা পূর্ণ। এই ধোঁয়াশা কাটিয়ে স্বচ্ছ হতে পারছে না তার ভাবুক মন। খানিক নীরবতা পালন করে বললো,
“ইদ্রিস খান এবং হাফিজা খানের তিন মেয়ে। মিহিক, নোয়ানা, তিন্নি তাই তো?”
“হ্যাঁ, তাই। এটা তো আপনি জানেন।”
কারিব বিস্ময়ের সুতোতে জড়িয়ে যাচ্ছে। আষাঢ়কে রহস্যপূর্ণ লাগছে তার। আষাঢ়ের এই রূপ প্রথম দেখছে। গোয়েন্দাদের মতো কেমন প্রশ্ন করলো আষাঢ়।
আষাঢ় চিন্তিত। নিজের চিন্তিত ভাবকে কারো সামনে প্রকাশ করা পছন্দনীয় নয় তার। মনে চিন্তা স্থায়ী রাখলেও মুহূর্তে সে বাইরে চিন্তার রেশ কাটিয়ে নিলো। দীর্ঘ এক হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“ছাড়ো এসব। ময়মনসিংহকে মানানোর দায়িত্ব কিন্তু তোমার। ওকে বলবে, আজ একটা জরুরি কাজের জন্য আমরা আটকে গেছি। কাল অথবা পরশু মিট করবো।”
কারিব কিছু বললো না। গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগলো চুপচাপ। আষাঢ় আশা দেখিয়ে আশা পূরণ করলো না। মনোক্ষুণ্ণ তার!
আষাঢ়ের ফোন বেজে উঠলো। কলারের নামটা দেখে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির রেখাংশ ফুঁটলো। তার প্রিয় স্থায়ী পাঁচ গার্লফ্রেন্ডের ভিতর সবচেয়ে প্রিয় এবং মিষ্টি গার্লফ্রেন্ডটি ফোন করেছে। ভেরোনিকা!
আষাঢ় কল রিসিভ করে বললো,
“হ্যালো ডার্লিং! হাউ আর ইউ?”
“আমি ভালো নেই সুইটি। তোমাকে ভীষণ পরিমাণ মিস করছি। কবে আসবে তুমি? ইউ নো, আমার ফ্রেন্ডসরা ওয়াশিংটন ডিসি ভ্রমণে গিয়েছিল। তুমি নেই বলে আমি ওদের সাথে যাওয়ারও আগ্রহ পাইনি। প্লিজ, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আমি তোমার শূন্যতা অনুভব করছি। প্লিজ বেবি, কাম ক্যুইকলি।”
“ডোন্ট ও্যরি মাই লাভ, আমি এসে তোমাকে ওয়াশিংটন ডিসি ঘুরতে নিয়ে যাব। কিন্তু অন্তত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, বাংলাদেশে আমার ছয় মাস পূর্ণ না হওয়া অবধি আমি আমেরিকা ফিরবো না। আমার ড্যাড চাইছেন আমি দীর্ঘ সময় থাকি এবার। তুমি তো জানো আমি আমার ড্যাডকে কতটা মান্য করি।”
“ইয়াহ, আই নো। বাট, তুমি বুঝতে পারছো না হিম, আ…”
“হিমেল ইসলাম সব কিছুই বুঝতে পারে ভেরোনিকা। জানি আমাকে ছাড়া দীর্ঘ ছয় মাস কাটাতে তোমার কষ্ট হবে। তোমার মতো আরও অনেকের কষ্ট হচ্ছে। হয়তো তুমি একটু বেশিই কষ্ট পাচ্ছ। আমি কথা দিচ্ছি আমেরিকা ফিরে তোমাকে বেশি সময় দেবো। ওয়াশিংটন ডিসির পাশাপাশি ক্যালিফোর্নিয়া ঘুরতে নিয়ে যাব।”
আষাঢ়ের পাঁচ গার্লফ্রেন্ডই একটু ভ্রমণ প্রেয়সী। ভ্রমণের কথা শুনলে তারা একটু নরম হয়। ভেরোনিকাও হলো কিছুটা। খুব দ্রুত কথার পরিসমাপ্তি ঘটলো ভেরোনিকার সাথে। কথা শেষ হলে কারিবকে বললো,
“একই সাথে পাঁচ স্থায়ী গার্লফ্রেন্ড লালন-পালন করা খুব কষ্টের কাজ কারিব। তুমি কখনও আমার পথ অবলম্বন করো না। সুন্দর জীবন তাহলে আর সুন্দর থাকবে না।”
আষাঢ়ের কথাটা অহেতুক। আষাঢ় জানে এটা। কারিব তার সাথে এইসব মেয়ে বিষয়ক ব্যাপারে সঙ্গ দিলেও, কারিবের যে মেয়েতে কোনো আগ্রহ নেই তা সে ভালো করে জানে। কারিবের না কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে, আর না ছিল কখনো। ভবিষ্যতে কারিবের কোনো গার্লফ্রেন্ড হবে কি না সে ব্যাপারে সে দ্বিধান্বিত।
_________________
আষাঢ় একদম রেডি। গোসল সেরে রেডি হয়ে নোয়ানার অপেক্ষায় বসে ছিল সে। করিডোরে দাঁড়িয়ে সে এই মুহূর্তে নিচে লায়লা খানমের সাথে বাকরত নোয়ানাকে দেখছে। নোয়ানা আর তিন্নি কিছুক্ষণ হলো তাদের বাড়িতে এসেছে। তিন্নি নোয়ানার সঙ্গে নেই, সে মিহিকের কাছে রুমে চলে গেছে। নোয়ানাও যাবে কিন্তু লায়লা খানম কী কথা উঠিয়ে যেন তাকে থামিয়ে দিয়েছে। কথা বলা শেষ না হলে তো সে যেতে পারবে না। মাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালো আষাঢ়। না চাইতেও মা তার খুব বড়ো একটা উপকার করলো। এমন একটা সুযোগই চাচ্ছিল সে। নোয়ানাকে ওখানে কথায় আটকে দিয়ে খুব ভালো একটা কাজ করেছে তার মা। আষাঢ়ের ঠোঁটে মুচকি হাসি। নোয়ানাকে দেখছে যত্নশীল চোখ বুলিয়ে। নোয়ানার পরনে হোয়াইট-ব্লু জর্জেট থ্রি পিস। নাকের নোজপিনটা দূর থেকে দেখা সম্ভব নয়। তাও যেন সে দেখতে পাচ্ছে নোয়ানার নাকে ক্ষুদ্র নোজপিন জ্বলজ্বল করছে। কে বলবে এই মেয়েটা দশ বছর বয়সে তার মনে পছন্দ কুঠুরিতে এসে গিয়েছিল। মেয়েটার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলার দৃশ্য যে এখনও মনে গভীরভাবে লেপ্টে আছে। এতগুলো বছরে সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল মেয়েটাকে। তার খুব একটা মনে পড়েনি মেয়েটার কথা। কিন্তু এতবছর পর আবার দেখা হয়ে মেয়েটা তার মনে গাঢ়ভাবে বিঁধে গেছে। মেয়েটার প্রতি পুরোনো ভালোলাগা তার মনে ধীরে ধীরে শুভ্র-কোমল অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। বসন্তের শত সহস্র ফুলের সুঘ্রাণ মিশ্রিত নির্মল হাওয়া তার হৃদমাঝার ছুঁয়ে যাচ্ছে। আষাঢ় নোয়ানার উপর নিজের যত্নশীল দৃষ্টি স্থির রেখে অস্পষ্ট বলে উঠলো,
“টিউলিপ ফুল, তোমার সাথে দেখা হওয়া একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা, তবে এটা অতি সুমধুর। কেন আমাকে না চিনতে পারার ভাণ করে সুমধুর ব্যাপারটাকে তিক্ত করছো? এটা অন্যায় হচ্ছে। এই অন্যায়ের সাজা কী লিখবো আমি?”
লায়লা খানমের কথা বলা শেষ হলে নোয়ানা বোনের রুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। আষাঢ় সেটা লক্ষ্য করে করিডোর থেকে সরে নিজের রুমে ঢুকে পড়লো। দরজায় দাঁড়িয়ে নোয়ানার এখান অবধি আসার অপেক্ষা করতে লাগলো সে। ঠিক এমনটাই চাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরই তার কাঙ্ক্ষিত সময়টি এলো। টের পাচ্ছে নোয়ানা খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। নোয়ানা তাকে লক্ষ্য না করে সামনে হেঁটে যাওয়া দিলেই সে একটানে নোয়ানাকে নিজের রুমে নিয়ে এলো। দরজাটা চকিতে বন্ধ করে দিয়ে নোয়ানাকে দেয়ালে পিঠ ঠেকে দাড় করালো।
নোয়ানার আঁখি জোড়া রুদ্ধ। ভয়ে ঘন শ্বাস পড়ছে তার। বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে ভয়ের তান্ডবে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি তার প্রাণটা গেল। চোখ খুলে আষাঢ়কে হাস্যমুখে দেখে রাগ রাগ হলো, ঘৃণা হলো, আবার স্বস্তিও পেল সে। ধারণা করেছিল এমন একটা কাজ আষাঢ়ই করতে পারে। এ জন্যই তো তার মুখ থেকে একটা চিৎকার বের হতে হতেও, নীরব পড়ে রইল।
নোয়ানার রাগী- বিরক্তি প্রকাশ্য মুখটা দেখে আষাঢ় মিটি হাসি অধরে রেখে বললো,
“চাঁদ আমার বাড়িতে আসবে, অথচ আমার কাছাকাছি আসবে না এটা কি ভালো দেখায়?”
নোয়ানা কাঠিন্য স্বরে বললো,
“আপনার এরকম আচরণ আমার মোটেই পছন্দ হলো না আষাঢ়।”
আষাঢ়ের ঠোঁট থেকে হাসি সরলো না। বললো,
“আমার আচরণ পছন্দ করতে হবে না, শুধু আমাকে পছন্দ করলেই হবে।”
“যেটা করলেন এইমাত্র, সেটা অন্যায়।”
“এরকম ছোট-খাটো অন্যায় করলে নিশ্চয়ই শাস্তি পাবো না আমি। কোনো গুরুতর অন্যায় তো করিনি। তোমাকে তো শুধু টেনে রুমে আনলাম, তোমার ঠোঁটে চুমু তো খাইনি।”
বলে আষাঢ় প্রশস্ত হেসে ফেললো।
নোয়ানার রাগ-বিরক্তির পরিমাণ বাড়লো। সে চোখ সরিয়ে নিলো আষাঢ়ের থেকে। খানিক সময় বিরতি নিয়ে বললো,
“কিছু বলতে চান?”
“বলতে তো চাই অনেক কিছু, কিন্তু তোমার শোনার ধৈর্য কই?”
“যখন জানেন শোনার ধৈর্য নেই, তাহলে বলতে আসেন কেন? যাচ্ছি আমি।”
নোয়ানা যাওয়া দিলে আষাঢ় আবারও টেনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে দাঁড়াতে বাধ্য করলো। নোয়ানা বলতে পারলো না কিছু। আষাঢ়ের সামনে এলে সে দুর্বল হয়ে পড়ে। ভিতরে দুর্বলতার ঝাপটা অনেক আগে এলেও, বাইরে সে ঝাপটার আভাস ধীরে ধীরে ফোঁটে।
আষাঢ়ের চোখ নোয়ানার চেহারা থেকে নেমে নোয়ানার বাম হাতে ঠেকলো। নোয়ানার বাম হাত নিজের হাতের মুঠোয় উঠিয়ে নিলো সে। তারপর অভাবনীয় একটা কাজ করলো। নোয়ানার হাতের ঠিক ক্ষত বরাবর ঠোঁটের আর্দ্র পরশ এঁকে দিলো।
এমন ঘটনায় নোয়ানা নিজের বাক হারালো। শুধু নেত্রতে গাঢ় বিস্ময়-ভীতি ঠিকরে উঠলো।
আষাঢ় নোয়ানার দিকে চোখ তুলে তাকালো। নোয়ানার বিস্ময়-ভীতি চোখ দুটিতে গভীর দৃষ্টি রেখে বললো,
“তোমার ভিতর কীসের কষ্ট, সেই কষ্টের পরিমাণ কতখানি আমি জানি না। তবে এটা জানার তীব্র ঝোঁক-আকুলতা আমার মাঝে। আগের বার এটা জানার সুযোগ ছিল না, কিন্তু এবার সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাই না আমি। আমি কি জানতে পারবো? জানার সুযোগ তুমি দেবে কি টিউলিপ?”
আষাঢ়ের মৃদু কণ্ঠের ‘টিউলিপ’ ডাকটা শুনে নোয়ানার অক্ষি জ্বলে উঠলো। হৃদয় বাজ খেতে লাগলো।
(চলবে)