বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ২১

0
532

#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ২১
#লেখা: ইফরাত মিলি

“এটা কোন জায়গা? কোথায় নিয়ে এসেছেন?”

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আষাঢ়’রা এখন অনেক দূরে। নোয়ানা শুধু দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে একটা খোলা মাঠ। আশপাশে তেমন কোনো মানুষজন নেই। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের দিকে যাচ্ছে। নোয়ানা অস্থির হয়ে বললো,
“আমি বাড়ি যাব।”

আষাঢ় নোয়ানার কথা কানে তুললো না। বললো,
“আমি জানতাম…আমি জানতাম এটাই হবে।”

“কী হবে? কীসের কথা বলছেন?”

আষাঢ় এক পা সামনে এগিয়ে এসে বললো,
“ইদ্রিস খান, হাফিজা খান তোমার মা-বাবা নয়। তুমি যাদের কাছে থাকছো তারা আসলে তোমার চাচা-চাচি। তোমার বাবার নাম ইব্রাহিম খান।”

আষাঢ়ের কথায় নোয়ানার বুক ধক করে উঠলো। মাথার ভিতর ঝিমঝিম করে অসহ্য যন্ত্রণা মুহূর্তে ঝেঁকে বসলো মাথায়। নোয়ানা দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো।
আষাঢ় কাছে এগিয়ে এসে নোয়ানার দু হাতের বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো,
“স্টপ। স্টপ নোয়ানা। অনেক হয়েছে তোমার ড্রামা, এবার বন্ধ করো। টেল মি, কেন তুমি নিজের পরিচয় গোপন রেখেছো?”

নোয়ানা চোখ তুলে নিভু স্বরে বললো,
“কেন…কেন আমার সম্পর্কে এত জানতে চান? যেটা আপনাকে জানাতে চাই না সেটা কেন জানতে চান আপনি?”

“আমাকে জানতে হবে বলে আমি জানতে চাই। তুমি আজ সব বলবে আমায়।”

“বলবো না আমি।”

“অবশ্যই বলবে। বলো…” মৃদু চিৎকার করে উঠলো আষাঢ়।

নোয়ানা অনুভব করছে সে দুর্বল হয়ে পড়ছে। পা দুটো দাঁড়াতে পারছে না আর। কী করবে সে? বলে দেবে? নোয়ানার চোখ জল ঝরালো। বলে দেওয়াটাই সহজ মনে হচ্ছে। বলে দিলে হয়তো আষাঢ় তার প্রতি আর এমন থাকবে না।

নোয়ানার নিস্তব্ধতা দেখে আষাঢ় দুই হাতে আলতো করে গাল স্পর্শ করে নরম কণ্ঠে বললো,
“টেল মি টিউলিপ। কেন আগে তোমার দু চোখে এত বিষণ্নতা দেখতে পেতাম আমি? তুমি তো তোমার মা-বাবার সাথে ছিলে, তাহলে…”

“ছিলাম না আমি।” বলে উঠলো নোয়ানা।

থেমে গেল আষাঢ়। বিস্ময়-প্রশ্নবিত্ত চোখে কৌতূহল নিয়ে চেয়ে রইল।
নোয়ানা আষাঢ়ের হাত সরিয়ে দিলো। দু চোখ থেকে নামতে লাগলো অনর্গল অশ্রুধারা। নোয়ানা বলতে লাগলো,
“তোমার সাথে যখন আমার দেখা হয়েছিল, তখন আমি আমার মা-বাবার সাথে ছিলাম না। আসলে কী বলো তো, মানুষের জীবন খুব কঠিন এক ব্যাপার! এটা সুখের নিয়মে চলতে থাকলেও দুঃখে গিয়ে পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না। আমার জীবনটাও হঠাৎ করে মোড় পাল্টিয়ে সুখ থেকে দুঃখের দিকে ঠেলে দিলো আমায়। আমার জন্ম আমেরিকাতেই হয়েছিল। আমার কোনো ভাই-বোন ছিল না। মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় কতটা আদরে ছিলাম বুঝতেই পারছো? জীবন-যাপন খুব ভালো ছিল। ভালো মানে, অনেক অনেক ভালো।
কিন্তু এক উইন্টারে আমার জীবন ভালো থাকার খেই হারিয়ে ফেললো! সেদিন তুষারপাত ছিল। তখন আমার বয়স নয়। নিউ ইয়র্কে থাকতাম আমরা। রাতে মা-বাবা আমাকে বাসায় রেখে প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করতে গিয়েছিল সুপার মার্কেটে। সেদিন যদি তারা মার্কেটে না যেত, তাহলে আমার জীবনটা আজ অন্য রকম থাকতো। এরকম থাকতো না। আজও হয়তো আমি আমেরিকার মাটিতে নিজের মা-বাবার সাথে সুখের দিনগুলো কাটাতাম। কিন্তু ভাগ্যে পরিবর্তন আসলে সেটা রুখবার সাধ্যি কার আছে?
বাসার টিভিটা অহেতুক চলছিল। আম্মুরা মার্কেটে চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ হয়েছে। লিভিং রুমে বসে হোম ওয়ার্ক করছিলাম আমি। হঠাৎ টিভির নিউজে চোখ পড়লো। দেখতে পেলাম একটা মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। লাইভে অনেক মানুষের ছোটাছুটি, চিৎকার-চেঁচামেচি লক্ষ্য করছিলাম। দেখতে দেখতে মনে পড়লো মা-বাবা যে মার্কেটে গিয়েছে এটা সেই মার্কেট।
আমার পৃথিবী থমকে গিয়েছিল তখন। কিছু সময় স্থবির বসে রইলাম। ছোট ছিলাম তো তাই কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এক সময় দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে। বাইরে শীত ছিল প্রচুর, কিন্তু গায়ে একটা ওভার কোট চাপিয়ে বের হওয়ার খেয়ালও আমার ছিল না। মার্কেট খুব বেশি দূরে ছিল না। দৌঁড়েই গিয়েছিলাম। সাংবাদিক, ফরেনসিক, স্বেচ্ছা কর্মী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, মানুষ জনের ছোটাছুটি চারিপাশে। মানুষজনের চিৎকার-আহাজারিতে জায়গাটা বিভীষিকার প্রান্তর হয়ে উঠেছিল। আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। নেভানোর চেষ্টা চলছে সেই সাথে। আমি ভিড়ের মাঝে মা-বাবাকে খুঁজতে লাগলাম। মার্কেট থেকে কিছু মানুষ ভালোয় ভালো বের হতে সক্ষম হয়, আর অনেক মানুষ আটকা পড়ে ভিতরে। মার্কেটের ভিতর থেকে স্বেচ্ছা কর্মীরা আহত মানুষ নিয়ে ফিরছে। অনেকক্ষণ রইলাম ওখানে। মা-বাবাকে দেখতে পেলাম না কোথাও। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ মানুষ জনের ভিড় থেকে আমার খালামনি আর খালুকে দেখতে পেলাম। আমার খালারাও নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। আমাদের বাসার কাছাকাছিই ছিল। অগ্নি কাণ্ডের খবর পেয়ে তারাও এসেছিল দেখতে। আমাকে দেখে নানান প্রশ্ন করলেন। আমি সব বললাম তাদের। তারাও খুঁজতে লাগলো। এখানের ছোটাছুটিতে পাওয়া গেল না মা-বাবাকে। খালামনিরা আমাকে নিয়ে হাসপাতালে খোঁজ করতে গেল। খোঁজ পেলাম। মৃত অর্ধ পোড়া দুটো মানুষ। মা-বাবার অর্ধ পোড়া মৃত লাশ দেখার মতো ভয়াবহ দৃশ্য আর কী আছে এই পৃথিবীতে? জানি না আর কিছু আছে কি না, তবে আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ স্মৃতি ওটাই ছিল। সেদিন আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদলেও মনের হাহাকার মিটছিল না।”
নোয়ানার কান্নার বেগ বাড়লো।

আষাঢ় স্তব্ধ হয়ে গেছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে নোয়ানার কান্নারত মুখ। তার অনেক বছর আগের ঘটনা মনে পড়ছে। নিউ ইয়র্কে থাকার সুবাদে সেই অগ্নিকাণ্ডের খবর সেও জানে, এমনকি সেদিন সেই সুপার মার্কেটে সেও উপস্থিত ছিল। সাথে ছিল তার বিদেশি বন্ধু। আল্লাহর রহমতে তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। এই টিউলিপ কি না সেই আগুনের ছোবলে অনাথ হয়ে গেল!
আষাঢ়ের কিছু বলার শক্তি যেন নেই এই মুহূর্তে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে ব্যথিত কণ্ঠে বললো,
“তারপর? তারপর কী হয়েছিল?”

নোয়ানা কাঁদতে কাঁদতে কেমন অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো, পর মুহূর্তে মুখ ঢেকে গেল গাঢ় বিষণ্নতায়। বললো,
“যার জীবনে কষ্ট আসে তার জীবনে সব দিক থেকেই কষ্ট আসে, বুঝলে? না হলে মা-বাবার মৃত্যুর পর এতটা কেন কষ্টে থাকতে হলো আমার? এত দুর্বিষহ কেন হয়েছিল আমার জীবন? রাগে, দুঃখে, কষ্টে নিজের হাত নিজের কেন কাটতে হলো?”
অভিযোগ নোয়ানার।

আষাঢ় চমকে উঠলো। ভেবেছিল নোয়ানার হাত অন্য কেউ কেটে দিয়েছিল। যদিও সে নিজে একবার বলেছিল নোয়ানা নিজের হাত নিজে কেটেছে। কিন্তু ওটা নোয়ানার সামনে বলেছিল, নোয়ানার থেকে কথা বের করার জন্য। বলে উঠলো,
“তুমি নিজের হাত নিজে কেটেছো?”

নোয়ানা মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুহ্, নিজে কেটেছি। কী করবো বলো? দুঃখে, কষ্টে মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে।”

“কীসের এত দুঃখ ছিল তোমার? মা-বাবার মৃত্যুর পর কোথায়, কীভাবে ছিলে? তোমার চোখে-মুখে ওই বিষাদ…”

“খালামনির কাছে ছিলাম। মা-বাবার মৃত্যুর পর খালামনি আরেক কষ্ট হয়ে জীবনে ঢুকেছিল আমার। আমাকে নিজের সাথে রাখার কথা বললেন। আর এটা বলে আমাদের টাকা-পয়সা সবকিছু নিজে আত্মসাৎ করলো। তার কাছে আমাকে রাখলো ঠিক, কিন্তু দাসীর মতো করে রাখলো। প্রথম প্রথম কয়েকদিন ভালো আচরণ থাকলেও, পরে আর মোটেই ভালো ছিল না। অনাথদের আসলে তেমন কেউ হিসেবে ধরে না! আমাকেও ধরেনি। যেখানে নিজের মেয়ের মতো করে রাখার কথা ছিল, সেখানে থাকলাম কাজের লোকের মতো। নানান কাজ করাতো। যেগুলো আমার অত ছোট থাকতে পারার কথা নয় সেগুলোও করাতো। রান্না করতে হয়েছে, বাজার করতে হয়েছে, ঘর পরিষ্কার করতে হয়েছে, আরও অনেক কিছু। কখনো বা রান্না খারাপ হওয়ার কারণে স্কুলে যাওয়ার সময় ভাতের বাটি ছুঁড়ে মেরেছে। এসবের সাথে গালি, মারধর তো ফ্রি। একবার মারধরের কারণে হাত ভেঙে গিয়েছিল আমার। সে বার প্রচণ্ড যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্টে মনে হচ্ছিল মরে যাই। এক উঁচু ভবনের ছাদে গিয়ে ফিরে এসেছিলাম আবার। ওখান থেকে ঝাঁপ দিলে মৃত্যু নিশ্চিত না হলেও অর্ধ মৃত্যুর মুখে চলে যেতাম। আমার এমন দুর্বিষহ জীবনের মাঝেই তোমার সাথে দেখা হয়েছিল আমার। ভীতু ছিলাম কি না, তাই কেঁদেও ফেলেছিলাম প্রথম বার তোমার সামনে। ফার্স্ট মিটের পর তোমার সাথে আবার দেখা হলো লাইব্রেরিতে। নাছোড়বান্দা ছেলে ছিলে একটা, ত্যাদড়ও বটে। তবে তোমাকে আমি ভয় পেতাম। ঠিক তোমাকে না, তোমার প্রশ্নকে। যখন তুমি প্রশ্ন করতে, আমার মুখটা সব সময় এমন বিষণ্ন থাকে কেন? কী হয়েছে আমার? আমার মুখে এই দাগ কীসের? তোমার এই প্রশ্নগুলোকে আমি খুব ভয় পেতাম। এড়িয়ে যেতে চাইতাম তোমাকে। নিজের এমন খাপছাড়া জীবন সম্পর্কে কী করে বলি কারো কাছে?
তোমার কাছে নিজের সম্পর্কে কিছু বলা ছিল আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। লজ্জা, হীনমন্যতা সব কিছুই কাজ করতো তোমার বেলাতে। আমি কিছুতেই চাইতাম না আমার এই জীবনের কথা তুমি জেনে যাও। তাই বার বার তোমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তোমাকেও এড়িয়ে যেতাম। আমার কোনো ফ্রেন্ড ছিল না। তেমন কেউ মিশতো না আমার সাথে, বা বলতে পারো আমি নিজেই মিশতে জানতাম না তখন। সব সময় ব্যস্ততা এবং ভয় ঘিরে রাখলে কারো সাথেই স্বাভাবিক হওয়া যায় না ঠিক। কিন্তু তুমি আগ বাড়িয়ে ভাব দেখাতে আসতে আমার সাথে। এটা-সেটা বলে মাথা খারাপ করে দিতে। মনে মনে তোমাকে ‘ব্যাড বয়’ বলে সম্মোধন করতাম আমি। কিন্তু আজব! দেখতে দেখতে এই ব্যাড বয়টিকেই আমার ভালো লেগে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল আমেরিকার মাটিতে তুমি একমাত্র আমার আপন কেউ। এ কারণে তোমাকে এসব কথা জানাতে আরও বেশি হীনমন্যতা বোধ হতো। অথচ তুমি প্রত্যেকবার দেখা হলে আমার সম্পর্কে জানতে চাইতে। তাই এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখতাম না আমি।
ওদিকে খালার ফ্যামিলিতে রোজ এক নিয়মে চলতো আমার কষ্টের জীবন। বকা-মারধর কোনো কিছু বাদ ছিল না। সে বার প্রচন্ড ঝগড়া-ঝাটি, মারধরের পরিমাণও বেশি ছিল। রাগে, কষ্টে নিজের হাতের শিরা নিজেই কেটে ফেলেছিলাম তাই।
হাত কাটার পর যখন তোমার সাথে দেখা হয়েছিল, সেদিন মনে হলো তোমার সাথে আমার দেখা সাক্ষাৎ হওয়া ঠিক না। আমি নিজের সম্পর্কে কোনো দিনও বলতে পারতাম না তোমাকে। লজ্জা, হীনমন্যতাবোধ তো ছিলই, আর সেই সাথে মনে হতো তুমি আমার এমন জীবন সম্পর্কে জানতে পারলে আমাকে ঘৃণা করবে। ঘৃণার কথাটা কেন মনে হতো জানি না, তবে মনে হতো। সেদিনের পর তাই একেবারে তোমার সামনে পড়া বন্ধ করে দিলাম।
এদিকে আমাকে বাংলাদেশ পাঠানোর কথাবার্তা চলতে লাগলো খালার ফ্যামিলিতে। কারণ আমার হাত কাটার ফলে আমাকে নিয়ে একটু ভয় ঢুকে গিয়েছিল তাদের মনে। ভেবেছিল সুইসাইড-টাইড করতে পারি আমি। যদি সুইসাইড করি তাহলে তাদের ঝামেলার শেষ থাকবে না। তাই ঠিক করলো কিছু টাকা নষ্ট হলেও আমার মতো আপদকে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেবে। আর টাকা যেটা নষ্ট করেছে সেটা তো আমার পাপার টাকাই ছিল। আমাকে বাংলাদেশ পাঠাতে তো পাপার ইনকামের টাকার এক ক্ষুদ্র অংশ ব্যয় হয়েছে মাত্র। বাকিটা তো পড়েই রয়েছে তাদের কাছে।
আমি আসলে আমার বাবার দিকের কোনো আত্মীয় স্বজনকেই ভালো করে চিনতাম না। বাবার সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। অতীতে কী বিষয় নিয়ে যেন ঝামেলা হয়েছিল। এত কিছু জানি না আমি ঠিক। তো আমার খালা আমার চাচা-চাচিদের সাথে যোগাযোগ করলেন আমাকে বাংলাদেশ পাঠানো নিয়ে। আমার চাচাদের বলেছিল, আমাকে কেন তারা একারা দেখভাল করবে? চাচাদেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে, আমাকে বাংলাদেশ নিয়ে গিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করুক।
আমাকে বাংলাদেশ পাঠানোর কথা ওঠায় চাচা আমার সাথে ফোনে কথা বলেছিল। তখন আমি খালার কাছে জীবন-যাপন নিয়ে কিছু কিছু বিষয় বলেছিলাম আমার চাচাকে। এসব শুনে চাচা নিজেই আমাকে বাংলাদেশ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আবার বাংলাদেশে বসবাসরত আমার নানা-নানি’ও আমার চাচাদের অনুরোধ করেছিলেন যাতে তারা আমাকে নিজেদের কাছে এনে রাখে। কারণ, নানা-নানি অনেক কিছুই জানতেন। আমার নানা-নানি ভালোই ছিল। বাংলাদেশ এসে আমি তাদের দেখতে পেয়েছিলাম। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছিলেন। তবে এখন তারা মৃত।
খারাপ বলতে আমার জীবনে যারা ছিল তারা হলো, আমার খালা, খালু, আর দুই কাজিন। চাচাদের কথা কী আর বলবো। চাচার সাথে যখন কথা হয়েছিল তখন কেন যেন মনে হয়েছিল আমি চাচাদের কাছে গেলে এখনকার থেকে ভালো থাকবো। খালাদের থেকে ভালো রাখবে তারা আমায়। আলহামদুলিল্লাহ! যতটা আশা করেছিলাম তার থেকে এখন অনেক ভালো আছি। এতটা আশা যোগ্য ছিল না আমার। তবে দিন শেষে একটা কথা মনে করতেই হয়, আমি খালাদের অত্যাচারিত, বিতাড়িত এক মেয়ে, আর চাচাদের বাড়িতে একজন ‘আশ্রিতা’!”

নোয়ানা এতক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছিল, আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনার উচিত এই আশ্রিতা মেয়ের থেকে সব সময় দূরে দূরে থাকা। এটা আপনার জন্যও ভালো আর বাকি সবার জন্যও।”

আষাঢ় এতক্ষণ স্তব্ধ হয়েই নোয়ানার কথা শুনছিল। নোয়ানার শেষ কথায় একটু নড়েচড়ে উঠলো সে। বললো,
“আমি কী করবো, না করবো সেটা আমি ভালো বুঝবো। তোমাকে ভাবতে হবে না।”

আর কিছু বলতে পারলো না আষাঢ়। তার বুকের ভিতরটা কেমন কেমন করছে…না না ঠিক কেমন কেমন করছে না। জ্বলছে। তার বুকের ভিতরটা জ্বলছে। আষাঢ় হঠাৎ নোয়ানার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকালো।
চমকে উঠলো নোয়ানা।
আষাঢ় বললো,
“অবশেষে আমার জানার তৃষ্ণা মিটলো টিউলিপ। তোমার বিষাদ, বিষণ্নতা ঘেরা মুখের রহস্য জানলাম আমি। বিশ্বাস করো, কষ্ট হচ্ছে আমার। এত কষ্টে তোমাকে মানায় না। তবে তুমি যেন এই কষ্টতেই অতি সুন্দর। মানুষ হাসি দেখে প্রেমে পড়ে, আর আমি তোমার বিষণ্ন মুখ দেখে প্রেমে পড়েছিলাম। তবে এত কষ্ট তোমার জীবনে আসা ঠিক হয়নি। আমি বুঝতে পারিনি এত কষ্টকর ছিল তোমার জীবন।”

আষাঢ় কপাল সরিয়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো।

“এত কিছু মনে রেখেছো কী করে?”

আষাঢ়ের প্রশ্নে হাসলো নোয়ানা। তার অশ্রু শুকিয়ে গালে লেগে আছে। বললো,
“হয়তো এতকিছু স্পষ্ট ভাবে মনে রাখা সম্ভব নয়। তবে আমার মনে আছে। এটা আমার স্মৃতিতে ঝলমল অবস্থায় থাকে। কষ্টের স্মৃতিগুলো হয়তো এমনই, সহজে মন থেকে খসে পড়ে না। এই স্মৃতিগুলো সুখের হলে হয়তো বা অনেক কিছুই ভুলে যেতাম।”

“আমাকে চিনতে পেরেও না চেনার ভাণ করেছিলে কেন? প্রথম দেখাতেই আমি তোমাকে চিনে ফেলেছিলাম।”

“আমি প্রথম দেখাতে চিনতে পারিনি। তোমাকে ভুলিনি ঠিকই, কিন্তু এত বছর পর হঠাৎ তোমার সাথে এরকম করে দেখা হয়ে যাওয়ায় বুঝে উঠতে দেরি হয়েছে। প্রথমেই চেনা চেনা লাগছিল তোমায়, তবে তুমি কে সেটা ভাবতে ভাবতে রাতে গিয়ে উত্তর খুঁজে পেয়েছিলাম। সেদিন রাতেই বুঝতে পেরেছিলাম ওটা তুমি। আমার চেনা আমেরিকার হিমেল। আমি ভাবতে পারিনি তোমাকে আমি বাংলাদেশ দেখতে পাবো। কারণ, আমি জানতাম না তুমি বাংলাদেশি। তুমি আমেরিকা থাকতে কখনও বলোনি তুমি বাংলাদেশি।”

“জানতাম তো, চিনেও না চেনার অভিনয় করছো তুমি। বোরিং অভিনয় ছিল তোমার। কিন্তু না চেনার ভাণ করলে কেন?”

“চাইনি আগেকার নোয়ানা পরিচয় দিয়ে আপনার সাথে পরিচিত হতে। চেয়েছিলাম নতুন করে পরিচয় হোক। অতীতে পরিচিত হওয়া নোয়ানা, হিমেল অতীতেই পড়ে থাক। তাদের বর্তমানে টেনে এনে সৌন্দর্য নষ্ট করার কোনো দরকার নেই। তবে আপনি বুঝলেন না, আপনি অতীতটাকে টেনে নিয়ে এলেন। যে সকল বিষয় আপনাকে জানাতে চাইনি তা জেনে ছাড়লেন। আসলেই নাছোড়বান্দা আপনি। তবে এ নিয়ে আর আগ না বাড়ানোই ভালো। আপনি আমার আপুর দেবর, পরিচিত আঙ্কল-আন্টির ছেলে, বিদেশ থাকেন এসবই জানি আপনার সম্পর্কে। আমার কাছে এই পরিচয়েই থাকবেন আপনি। আর আপনিও ভুলে থাকার ভাণ করুন আমরা আগে থেকে পরিচিত ছিলাম।”

“তাহলে নতুন করে জানা শোনার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু আমি কি শুধু আপুর দেবর, পরিচিত আঙ্কল-আন্টির ছেলে, বিদেশ থাকি এসবের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবো?”

নোয়ানা বুঝতে পারলো আষাঢ়ের কথাটা। বললো,
“হ্যাঁ, এসবের মাঝেই সীমাবদ্ধ। অতিরিক্ত করবেন না। সেটা ভালো হবে না। বাড়ি চলুন। বাড়ি ফিরতে হবে আমার। রাত হয়ে গেছে। এখনও বাড়ি না ফিরলে বাড়ির লোক খোঁজাখুঁজি শুরু করবে।”

আষাঢ় কথা না বাড়িয়ে বললো,
“চলো।”

গাড়িতে উঠে বসলো দুজন। নোয়ানার ফোন গাড়িতে সাইলেন্ট অবস্থায় ছিল। দেখলো চাচি, তিন্নি তাকে একাধিক বার কল দিয়েছে। নিশ্চয়ই খুব চিন্তায় পড়ে গেছে তারা, মেয়েটা এখনও বাড়ি ফিরছে না কেন?
নোয়ানা আষাঢ়কে বললো,
“বাড়িতে ফিরলে নানান প্রশ্ন করা হবে আমাকে। কোথায় ছিলাম জিজ্ঞেস করবে। বাড়িতে ফিরে কী উত্তর দেবো আমি?”

“বলবে যে, আমার সাথে ছিলে।”

“আপনার সাথে ছিলাম এটা বলবো? আমি কি পাগল? না কি বোকা?”

“আমার কথা যখন না-ই শুনবে, তখন জিজ্ঞেস করলে কেন আমাকে?”

“কারণ, সবটা তো আপনার জন্যই। আপনি এখানে নিয়ে না আসলে তো এমন হতো না। যথাযথ একটা উত্তর খুঁজে দিন।”

“মেয়েদের মিথ্যা বলতে পটু থাকতে হয়, বিশেষ করে যখন তারা প্রেমিকের সাথে ছিল এটা বাড়িতে বলতে পারবে না। মিথ্যা বলার প্র্যাকটিস করোনি কেন?”

“ক…কী বললেন? প্রেমি…”

“কোনো এক বান্ধবীর বাসায় ছিলে বলে ব্যাপারটা কাটিয়ে নিয়ো। আর হ্যাঁ, সে সময় যখন ‘তুমি’ করে বলছিলে শুনতে ভালো লেগেছিল। আপনি আপনি শুরু না করলেই পারতে।”

“আপনাকে আপনি করেই বলবো।”

“আপনি কেন? তুই করে বলো। সেটা শুনতে আরও ভালো লাগবে। প্রাণ জুড়িয়ে যাবে আমার।”

আষাঢ়ের কথায় নোয়ানার হাসি পেলেও হাসলো না।

আষাঢ় রাগ-বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“সিনথিয়া মেয়েটা বড্ড খারাপ। একদম ভালো নয়। কতটা ডেঞ্জারাস দেখা হলেই বুঝবে। সুন্দরী মেয়ে হয়ে কেন এত ডেঞ্জারাস হবে সে? অসহ্যকর!”

নোয়ানা বুঝতে পারলো না আষাঢ় কোত্থেকে কী বলছে। শুধু নীরব তাকিয়ে রইল সে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here