বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ২২

0
651

#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ২২
#লেখা: ইফরাত মিলি

মিহিকের ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ফ্লোরে নিজের বিছানা ঠিক করতে ব্যস্ত সে। তার ব্যস্তময় কাজ চেয়ার থেকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে শ্রাবণ। এখনও মিহিকের ফ্লোরে ঘুমানোর ব্যাপার একদম ভালো লাগে না তার। একদমই না। একটা মেয়ে কেন তার রুমে ফ্লোরে ঘুমাবে? মিহিকের তো কিছু হয় না এতে, কিন্তু সে তো এক অপরাধ বোধে হারিয়ে যায়। নিজেকে কুখ্যাত অপরাধী মনে হয়। মেয়েটা তাকে এমন একটা শাস্তি দিচ্ছে কেন? খাটে ঘুমানোর ব্যাপারে চুক্তি করে তাকে এই অপরাধবোধ থেকে টেনে তুললেই তো হয়। তা না করে এত জেদ কেন দেখাচ্ছে?

“আপনার এত জেদ কেন বলুন তো?”

ফ্লোরে বিছানার উপর বালিশ ছুঁড়ে রাখতেই শ্রাবণের প্রশ্ন শুনতে পেল মিহিক। কপালে মৃদু ভাঁজ ফেলে বললো,
“জেদ মানে কী?”

“আপনার ফ্লোরে ঘুমানোর ব্যাপার আমার মোটেই ভালো লাগে না। চারটা নতুন চাদর এনে দিয়েছি তো আপনাকে। আপনার দরকার পড়লে চারটা চাদর একই সাথে বিছিয়ে খাটে ঘুমান। তাও আমাকে আর অপরাধ বোধে ফেলবেন না প্লিজ!”

“আমি কী করবো সেটা আমি খুব ভালো বুঝি। আপনার থেকে জ্ঞান চাইছি না কোনো। আর আমাকে নিয়ে অহেতুক ভাবনা দেখাবেন না। এটা পছন্দ নয় আমার।”

শ্রাবণ বরাবরের মতো হতাশ। মেয়েটা একটা কথা শোনে না তার। এ কেমন বউ? চোখ ফিরিয়ে এনে নিজ কাজে মন দিলো সে। সকালে বাবা তাকে মিহিকের অন্য জায়গায় বিয়ে দেবে এ ব্যাপারে বললেও, পরে এ নিয়ে আর কোনো কথা ওঠেনি। শ্রাবণ এটা ভেবে স্বস্তি পাচ্ছে। বুঝতে পারছে, বাবা ওটা এমনি বলেছিল তখন।

শ্রাবণের মোবাইল সাইলেন্ট অবস্থায় বিছানায়। কেউ একজন কল দিচ্ছে। শ্রাবণের লক্ষ্য না হলেও মিহিকের লক্ষ্য হলো। বললো,
“আপনার গার্লফ্রেন্ড বোধহয় নক করছে আপনাকে।”

আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লো মিহিক। শ্রাবণ বলার সুযোগ পেয়ে বললো,
“আমাকে কে নক করছে সেটা কি আমি আপনার কাছে জানতে চেয়েছি? আমাকে কে নক করবে, কে করবে না সেটা আমি বুঝবো। আপনার দেখতে হবে না।”
ঘটাঘট কথাগুলো বলে চেয়ার ছেড়ে মোবাইলের কাছে এলো শ্রাবণ। মোবাইল হাতে নিয়ে বললো,
“আমার গার্লফ্রেন্ড নয়, ফ্রেন্ড। আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড হাসিব কল দিয়েছে। না জেনে কখনো কোনো কথা বলবেন না।”

“হাদারাম।” অস্ফুটে উচ্চারণ করলো মিহিক।

“কী বললেন?”

মিহিক জোরে বলে উঠলো,
“কপালটা পুরো পোড়া আমার। আপনাকে বিয়ে করে নিজেই নিজের কপালে গরম খুন্তি ছুঁইয়েছি।”

শ্রাবণের মুখ একটুখানি হয়ে গেল। কোথাও এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো সে। বেশিক্ষণ মিহিকের দিকে তাকিয়ে থাকার সাধ্যি হলো না। চোখ সরিয়ে নিলো। মন মিশিয়ে গেল কেমন এক তিক্ততায়।

শুনতে পেল আবারও মিহিকের গলা,
“আপনি কি সুন্দর হবেন না কখনো? অসুন্দর থাকবেন বলে পণ করেছেন?”

শ্রাবণ আবার তাকালো। মন বলার শক্তি পাচ্ছিল না, কিন্তু শেষমেশ বললো,
“আপনি আমাকে বার বার অসুন্দর বলেন কেন? আমি সুন্দর।”

“আপনি সুন্দর নন। অসুন্দরের খোলস জড়িয়ে আছেন। অসুন্দরের খোলস সরে গেলে হয়তো আপনার সৌন্দর্য চোখে পড়বে। কিন্তু কথা হলো, এই অসুন্দরের খোলস সরবে কবে?”

শ্রাবণ তাকিয়ে রইল। মিহিকের প্যাঁচানো কথা বুঝতে সমস্যা হচ্ছে তার।
মিহিক শ্রাবণের বোকা-সোকা চেহারায় অটল তাকিয়ে থেকে বললো,
“আমি ধৈর্য ধরতে রাজি, কিন্তু এই ধৈর্যের ফল না নিয়ে ফিরতে রাজি নই!”

________________

গতকাল নোয়ানা গাড়ি থেকে নামার সময় বলেছিল,
“আর হ্যাঁ, আমি আমার পরিচয় গোপন রাখিনি। এটা কারো কাছে খুব একটা প্রকাশিত করতে হয় না দেখে প্রকাশ পায় না। তবে আপনার মা-বাবা জানে। আমি অনাথ, অনাথ বলে চাচা-চাচির কাছে থাকি এসব জানে তারা।”

আষাঢ় ধারণা করেনি তার মা-বাবা এ সম্পর্কে জানতে পারে। নোয়ানা বলেছে, তারপরও চাইছে একবার সরাসরি মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখবে। উঠোনে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর ঘরে ঢুকলো আষাঢ়। লিভিং রুমে লায়লা খানম, সিনথিয়া, জুন বসে চা খাচ্ছিল। আষাঢ় সিনথিকে গ্রাহ্য না করে মাকে ডিরেক্ট প্রশ্ন করলো,
“নোয়ানা যে ইদ্রিস আঙ্কলের মেয়ে নয় এটা তোমরা আগে থেকেই জানতে?”

আষাঢ়ের হঠাৎ এরকম প্রশ্নে বড়ো অবাক হলেন লায়লা খানম। বললেন,
“হ্যাঁ জানতাম। হঠাৎ করে এ প্রশ্ন কেন করছো? আর এ ব্যাপারে তুমি জানলে কীভাবে?”

“কারিব বলেছে।”

আষাঢ় সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। কারিব নিজে কি জানতো, তাকে জানাবে কী?

সিনথি সন্দিহান তাকিয়ে রইল আষাঢ়ের যাওয়ার পানে। মনে মনে একবার আওড়ালো,
‘নোয়ানা!’
“নোয়ানা কে আন্টি?” প্রশ্নটা লায়লা খানমকে করে ফেললো সিনথিয়া।

লায়লা খানম হাস্য মুখে উত্তর দিলেন,
“নোয়ানা হলো মিহিকের বোন। খুব ভালো, ভদ্র মেয়ে। তোমার সাথে তো পরিচয় হয়নি। কালকে পরিচয় করিয়ে দেবো।”

সিনথি প্রত্যুত্তরে হাসলো। হাসি ধরে রেখে তাকালো সিঁড়ির দিকে। মন কেন যেন বলছে আষাঢ়ের রিয়েল লাভের সাথে তার দেখা হতে চলেছে শীঘ্রই।

_______________

করিডোরে আষাঢ়ের দেখা হয়ে গেল মিহিকের সাথে। মিহিককে দেখে সে অনুমান করলো মিহিক বাবার বাড়ি যাচ্ছে।

“বাবার বাড়িতে যাচ্ছ?”

মিহিক থেমে বললো,
“হুহ।”

“তোমার মেজো বোন যে কাল রাত করে বাড়ি ফিরেছে জানো সেটা?”

“জানি। বান্ধবীর বাসায় ছিল। ফিরতে একটু রাত হয়েছে। কিন্তু তুমি খবরটা পেলে কোথায়?”

বান্ধবীর বাসায়? মনে মনে হাসলো আষাঢ়। তার সাজেশনই কাজে লাগিয়েছে ভীতু মেয়েটা। বললো,
“এই পুরো ঢাকা শহরের খবরাখবর জানি আমি। আর তোমার বোন তো এই আমার বাড়ির পাশে থাকে। তার খবর জানবো না আমি? মিথ্যাবাদী!”

“কী?” আষাঢ়ের শেষ কথায় ভ্রু কুঁচকে উঠলো মিহিকের।

“তোমাকে না। বাড়ির পাশের মেয়েটিকে বলেছি।”
হেসে চলে গেল আষাঢ়।

মিহিক বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। শেষে এসব কী বললো আষাঢ়?

___________________

বিকেলের মৃদুমন্দ হাওয়ার মাঝে ছাদে এক মনে বসেছিল শ্রাবণ। ধ্যান ভাঙলো রুমকির ফোনে। ফোন রিসিভ করতেই রুমকি ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
“ডিভোর্সের কাগজপত্র ঠিক করেছিস?”

প্রথমেই ডিভোর্সের কথা বলাতে বিরক্ত হলো শ্রাবণ। বিরক্তিটা না ঢেকেই বললো,
“না, কোনো কাগজপত্র ঠিক করিনি।”

“ঠিক করিসনি মানে? তুই ওই ডাইনিটার সাথে আর কতকাল থাকতে চাস? তোকে আমি পাঁচদিনের সময় দিয়েছি। আর তুই ডাইনিটাকে ডিভোর্স দেওয়ার ব্যবস্থাপত্র না করে নিশ্চিন্তে বসে আছিস?”

রুমকি ‘তুই’ করে বলায় শ্রাবণের রাগ তো হচ্ছেই, মিহিককে ‘ডাইনি’ বলায় রাগ আরও বেশি হলো। মানতে পারলো না। রাগী স্বরে বললো,
“ডাইনি কী? ডাইনি কেমন ভাষা? ওর একটা নাম আছে। ওর নাম মিহিক। মিহিক করে বলো।”

“বাহ! বউয়ের জন্য দেখছি দরদ একেবারে উতলে উতলে পড়ছে। এত দরদ বউয়ের জন্য?”

“হ্যাঁ এত দরদ। ফারদার আর কখনও ওকে ডাইনি বলবে না।”

“ও―বউয়ের জন্য তোমার ভালোবাসা বেড়ে গেছে এখন, তাই না? লাইলি-মজনুর প্রেম কাহিনী শুরু করেছো তুমি। তোমার বউকে ডাইনি বললে তোমার হৃদয়ে টান লাগে!”

রুমকির বলার ধরণ দেখে তিক্ত হয়ে উঠলো শ্রাবণ। বেশ রেগে গিয়ে বলে উঠলো,
“দেখো রুমকি, মাথা গরম করে দিয়ো না আমার।”

“তোর মাথায় আমি হটিস্টিক ভাঙবো বলদের বাচ্চা! তুই ওই ডাইনিটাকে ডিভোর্স দেওয়ার বদলে আমাকে এসে তোদের লাভ স্টোরি শোনাচ্ছিস? তোর হাত-পা ভেঙে দেবো আমি। টুকরো টুকরো করে ফেলবো তোকে। তুই…”

রুমকিকে আর বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো শ্রাবণ। সবকিছু বিষাক্ত লাগছে তার। এ কোন জায়গায় এসে ঠেকলো তার জীবন? পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। এই পরিস্থিতি থেকে কবে মুক্তি মিলবে? জীবন কবে আবার একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস নেবে?

_________________

সন্ধ্যার পর বাবার বাড়ি থেকে ফিরলো মিহিক। রুমে এসে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলো। পরিবর্তনটা হলো, বিছানায় আগে যে চাদর ছিল, এখন সেই চাদর নেই। একটা নতুন চাদর বিছানো। ভুল না হলে এটা শ্রাবণের আনা চার চাদরের একটা।
পিছনে দরজা খোলার শব্দ হলো। শ্রাবণ প্রবেশ করলো ভিতরে। মিহিক প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। শ্রাবণ মিহিকের চোখ জোড়াকে বুঝতে পেরে বললো,
“বিছানার চাদর চেঞ্জ করে দিয়েছি। চারটা চাদরই বিছিয়েছি। আজ থেকে আপনি উপরে শোবেন।”

মিহিক বিরক্ত চাহনিতে বললো,
“আপনাকে কে বলেছে এসব করতে? আমি তো বলেই দিয়েছিলাম, চাদর কেন, ম্যাট্রেস চেঞ্জ করে দিলেও আমি আপনার বিছানায় ঘুমাবো না। তাহলে এসব কেন করেছেন? কে বলেছে আপনাকে চারটা চাদর একসাথে বিছাতে?”

“আমি আপনার জন্য কষ্ট করে বিছানাটা ঠিক করে দিলাম আর আপনি এভাবে আচরণ করছেন?”

“হ্যাঁ, করছি। আমি ঘুমাবো না আপনার বিছানায়। আপনার বিছানায় আপনি ঘুমান।”

শ্রাবণের রাগ হলো। রাগের পরিমাণও যেই সেই নয়। হঠাৎ করে মিহিকের একহাত চেপে ধরে, টেনে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। মিহিক উঠতে চাইলে দুই কাঁধে হাত দিয়ে বাঁধা দিয়ে বললো,
“আপনি আজ থেকে বিছানাতেই ঘুমাবেন। দ্যাটস ফাইন্যাল। এর বাইরে আর একটা কথা হবে না।”

মিহিক কিছু বলতে চাইলে শ্রাবণ থামিয়ে দিয়ে বললো,
“উহু, একটা কথাও বলবেন না। যখন বলেছি বিছানায় ঘুমাবেন, তখন বিছানাতেই ঘুমাবেন। আপনি আমার ভালো রূপটাই দেখেছেন শুধু, খারাপ রূপটা দেখেননি। কথা না শুনলে চড় খাবেন।”

শ্রাবণের কথা বাকরুদ্ধ করে দিলো মিহিককে। সে শুধু অবিশ্বাস্য ভাবে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। শ্রাবণ কীয়ৎক্ষণ থেকে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

মিহিকের দম যেন এতক্ষণ বদ্ধ অবস্থায় ছিল, শ্রাবণ বেরিয়ে যেতেই প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিলো সে। শ্রাবণ কি তার সাথে অধিকার দেখাচ্ছে? এমনিতে তো স্বামীর দায়িত্ব পালনে অষ্টড়ম্বা, অধিকারের বেলায় তো ঠিকই…মিহিকের বেজায় রাগ হলো। লোকটা আসলেই ভালো নয়। অসুন্দর!

_________________

রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর শ্রাবণ বাইরে গিয়েছিল। ফিরেছে অনেক দেরিতে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা-টাড্ডা ছিল। রুমে এসে মিহিকের জেদ প্রত্যক্ষ করতে হবে ভাবেনি। মেয়েটা এত জেদি! এরকম জেদ আর সহ্য হচ্ছে না তার। মেয়েটা তার কথা না শুনে সেই ফ্লোরে বিছানা পেতে ঘুমিয়েছে। সে কষ্ট করে মেয়েটার জন্য চার চারটা চাদর বিছালো বিছানায়, আর মেয়েটা কি না তার পরিশ্রমকে গ্রাহ্যই করলো না! অপমান বোধ হলো শ্রাবণের। আজকে আবার মিহিক ঘুমিয়েছেও তাড়াতাড়ি। টেবিলে চোখ পড়তে দেখতে পেল স্লিপিং পিলের পাতা পড়ে রয়েছে। শ্রাবণ এগিয়ে গেল সেদিকে। পাতাটা তুলে নিয়ে বিড়বিড় করলো,
“এত রাগ যে রাগের জন্য ঘুম আসবে না বলে স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়েছে?”

শ্রাবণ তাকালো মিহিকের দিকে। এই মুহূর্তে তার না রাগ হচ্ছে মিহিকের প্রতি, আর না লাগছে কোনো বিরক্তি। মিহিকের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললো সে। আনমনা হাসি বলে যেটাকে আর কী। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে থামলো সে মিহিকের কাছে। হাঁটুতে ভর করে বসে মিহিকের ঘুমন্ত মুখখানিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
“আপনার এত রাগ-জেদ কেন মিহিক? আপনার মতো এত রাগী আর জেদি একটা মেয়ে আমার বউ হবে ভাবিনি। এত কঠিন কেন আপনি? নরম আচরণ পাবো কবে আপনার থেকে? আপনার রাগ-জেদের আচরণ ছাড়া ভালো আচরণও দেখতে চাই আমি।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here