#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ২৫
#লেখা: ইফরাত মিলি
আকাশে কালো মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি হবে আজ। সিনথিয়া নির্নিমেষ তাকিয়ে রাতের আকাশে তারা খুঁজে যাচ্ছে। হাওয়ার বেগ কিছুটা টালমাটাল। বাতাসে তার চুলগুলো মৃদু হেলে উঠছে। আজ তার মা-বাবা ইন্ডিয়া ব্যাক করেছে। সে যাবে আরও পরে। অন্তত এক মাসের আগে যাচ্ছে না। আষাঢ়ের মন জয় করার প্রকট তিয়াস তার অন্তঃপানে। আষাঢ় কোন কারণে তার মনের এত গভীরে এসে গেছে জানে না সে। আষাঢ়ের মনোগভীরতায় আদৌ সে পৌঁছতে পারবে কি না সে বিষয়ে শঙ্কিত সে। সিনথি ছাদের কর্ণারে দৃষ্টি নিলো। ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখাপাত ঘটলো। আষাঢ় দাঁড়িয়ে আছে তার চক্ষু দৃশ্যপটে। কোন এক গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে। স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ডদের প্রতি ইদানিং কাল আষাঢ়ের আগ্রহ উঠে গেছে। স্থগিত হয়েছে তার স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ডের পালাক্রম। যার সাথে কথা বলছে সে স্থায়ী গার্লফ্রেন্ডদের একজন।
সিনথি মেয়েটার নাম মনে করার চেষ্টা করলো। কী নাম বলেছিল আষাঢ়? সু…হ্যাঁ, সুরাইয়া। ইরানি মেয়ে। আমেরিকার সিটিজেনশিপ।
সিনথি এখন ছাদে আছে আষাঢ়ের আহ্বানে। আষাঢ় নিজের সাথে ছাদে আসার আহ্বান জানিয়েছিল তাকে। এলো তো সাথে, কিন্তু তার হবু বর আসার পর ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজের গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। কথা বলার পালা কবে শেষ হবে তা সে-ই ভালো জানে।
সিনথি আষাঢ়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ছাদ থেকে পাশের ছোট্ট বাড়িটা দেখা যায়। কৃত্রিম আলো জ্বলছে। সিনথির ভাবনা জুড়ে বিস্তর ঘটালো নোয়ানা। নোয়ানা মেয়েটা তার প্রতিদ্বন্দ্বী। মেয়েটার প্রতি তার রাগ, হিংসা-বিদ্বেষ হওয়া উচিত। কিন্তু সে মেয়েটার প্রতি এ সকল মনোভাব উপলব্ধি করছে না। ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ আজব। আর চিরন্তন আজব পরিচয়ই বহনকৃত থাকবে বোধহয়। মেয়েটার প্রতি তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব গড়ে উঠবে না।
পাশে আষাঢ়ের উপস্থিতি টের পেয়ে পাশ ফিরলো সিনথি। আর তখনই আষাঢ়ের থেকে প্রশ্নটি পেল,
“কী দেখছো আমার ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি এবং আমার শ্বশুর বাড়ির দিকে তাকিয়ে?”
“তোমার শ্বশুর বাড়ি? হাসালে আমায়। কী দেখবো আর? বাইনোকুলার দিয়ে যা দেখার তা তো তুমি দেখো।”
“কোনো ছেলেকে দেখার প্রয়োজনে তোমার বাইনোকুলার লাগলে বলো, আমি কারিবকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবো ইন্ডিয়ায়। এটা আমি ফ্রি সার্ভিস দেবো আমার হবু বউকে।”
“তোমার ভিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই হবু বর। অনেক ছেলে আছে যাদের বললে দুইশ-তিনশ বাইনোকুলারে আমার ঘর ভরে যাবে।”
আষাঢ়ের ঠোঁটে তটস্থ হাসি। ডান হাত বাড়িয়ে হাত বুলিয়ে দিলো সিনথির মাথায়। নরম কণ্ঠে শুধালো,
“আমার হবু বউয়ের কণ্ঠে এমন ভারী ভারী কথা বড্ড মানায়। সব সময় এমন ভারী ভারী কথা বলবে।”
সিনথির মুখে তাচ্ছিল্য হাসি,
“সব সময় এরকম কথা বললে হজম করতে পারবে?”
আষাঢ়ের মুখ থেকে হাসি সরে গোমড়ামুখো হলো। সিনথির মাথা থেকে হাত সরিয়ে অদূরে দৃষ্টি রেখে বললো,
“হজম করতে কষ্ট হলে তাও কষ্ট করে গিলে নেবো।”
সিনথির চোখে-মুখে অদ্ভুত ভাবমূর্তির চিত্রাঙ্কন। এ ভাবমূর্তির ভাষা শুধু সে নিজে পড়তে সক্ষম। হঠাৎই এক হাত দিয়ে আষাঢ়ের অন্যদিকে দৃষ্টি রাখা মুখটা নিজের দিকে ঘুরালো। তাৎক্ষণিক এক চমকিত প্রতিবিম্ব ফুঁটে উঠলো আষাঢ়ের চেহারায়। সিনথির ঘনপল্লব ঘেরা চোখ জোড়া আষাঢ়ের গোটা চেহারায় পর্যবেক্ষণ দৃষ্টি চালিয়ে বললো,
“তুমি খুব সুন্দর আষাঢ়।”
সিনথির এহেন কাজকর্মে আষাঢ় খানিক বিচলিত। সিনথির হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“জীবনে অনেক বার এই কথা শুনেছি মেয়েদের থেকে, নতুন কিছু থাকলে বলো।”
সিনথি সঙ্গে সঙ্গে রোবটের মতো বলে উঠলো,
“তুমি একটা আহাম্মক! একটা গাধা! কী দরকার ছিল প্রথম যেদিন এসেছিলাম সেদিন ওরকম করে মিষ্টি সুরে সালাম দেওয়ার? কী দরকার ছিল পরেরদিন সকাল বেলা রুমে গিয়ে গুড মর্নিং জানানোর এবং ওইসব কথা বলার? শোনো, আমি যে তোমার প্রতি লাভ ফিল করছি এর জন্য আমি দায়ী নই, তুমি দায়ী। দায়ভার মাথা পেতে নাও সসম্মানে।”
সিনথি আষাঢ়ের স্তব্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো ক্ষণকাল। তারপর মুখে ফুঁটালো এক নিভৃত মিটি হাসি। আষাঢ়ের গালে আলতো হাতের পরশ বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি আসলেই খুব সুন্দর আষাঢ়। নোয়ানা তোমার সাথে এরকম ব্যবহার করে ভুল করছে।”
বলে আরও ক্ষণকাল তাকিয়ে থাকলো। তারপর শেষ সময়ে প্রসন্ন হাসি ফুঁটিয়ে চলে গেল।
আষাঢ় তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে ঘোর সম্বলিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“সাইকো লেডি!”
বলে ভারী একটা শ্বাস ফেলে রেলিংয়ের দিকে ঘুরলো। বিড়বিড় করতে লাগলো,
“আহাম্মক? গাধা? সে কী পেয়েছে? আমাকে কী মনে করে? আমি আহাম্মক, গাধা? উহ, অসহ্যকর!”
গালে সিনথির ছুঁয়ে যাওয়া স্থানে হাত রেখে বললো,
“আসলেই পাগল সে।”
কিছু সময় কাটলো ছাদে। ঘড়ির কাটা গিয়ে এগারোটা পঁচিশের ঘরে হানা দিলো। এবার ফেরার পালা।
কয়েক ধাপ সিঁড়ি অতিক্রম করে নামার পরে অবাক হলো আষাঢ়। সিনথি সিঁড়ির একটা ধাপে বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে। ডান হাত দিয়ে বাম পায়ের গোড়ালি চেপে আছে।
“তুমি নিচে না গিয়ে এখানে বসে আছো কেন?”
সিনথি রাগী চক্ষু নিক্ষেপ করে বললো,
“তুমি কি অভিশাপ দিয়েছো আমায়?”
“অভিশাপ?”
ভ্রুকুটি হলো আষাঢ়ের।
“দিয়েছো বোধহয়। তা না হলে কেন হঠাৎ সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে আমার পা মচকে যাবে? কেন আহত হবো আমি? দেখো, উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছি না।”
আষাঢ় কণ্ঠে বিরক্ত ঝরালো,
“এই শোনো, রাত এখন সাড়ে এগারোটা বাজে, ড্রামা বন্ধ করে ঘুমাও গিয়ে।”
“তোমার মনে হয় আমি ড্রামা করছি? সত্যি সত্যি আহত আমি। দাঁড়ানোর শক্তি নেই আমার।”
“ঠিক আছে, দাঁড়ানোর শক্তি না থাকলে এখানে বসে থেকে রাত পার করো।”
আষাঢ় পাশ কাটিয়ে যাওয়া দিলে সিনথি ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কেমন মানুষ তুমি? একটা মেয়েকে এখানে ফেলে রেখে চলে যাবে? নিষ্ঠুর!”
আষাঢ় সিনথির দিকে ফিরে বললো,
“তাহলে কী করবো আমি?”
সিনথির চোখ নত হয়ে এলো। লজ্জামাখা মুখখানি দারুণ সৌন্দর্যে মহিমান্বিত হলো। গলার স্বর মিষ্টি করে বললো,
“কোলে তুলে নাও।”
আষাঢ় ঘোর বিরোধিতা করে বললো,
“অসম্ভব! তোমাকে দেখতেই মনে হচ্ছে তুমি অনেক ভারী। একটা শুকনো-পাতলা ছেলে আমি। তোমার মতো ভারী একটা মেয়েকে কোলে তোলার মতো শক্তি আমার নেই।”
সিনথি চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
“একটা মেয়েকে কোলে তোলার শক্তি নেই তোমার? কেমন পুরুষ মানুষ তুমি?”
আষাঢ় হাসলো। অধরের বাম কোণে গিয়ে হাসির রেখাটা ঠিকরে উঠলো। বললো,
“আমি এমনই পুরুষ মানুষ।”
কথাটা বলে এগিয়ে এলো আষাঢ়। দুই হাত দিয়ে পাঁজাকোলে তুলে নিলো সিনথিকে।
সিনথি একটু ঘাবড়ে গেল। ধারণা ছিল না আষাঢ় তাকে কোলে তুলে নেবে। ঘাবড়ানো ভাব কেটে গেলে হাসলো সে। বললো,
“দায়িত্বশীল ছেলে তুমি। তোমাকে স্বামী হিসেবে পেলে ধন্য হতাম।”
আষাঢ় শুধু তুচ্ছ হাসলো। সিঁড়ি পার হয়ে নামতে লাগলো। সিনথি মুগ্ধতা নিয়ে আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে রইল এক ধ্যানে। আষাঢ় অবশ্য সিনথির দিকে তাকিয়ে নেই। তাকানো না থাকলেও বুঝলো সিনথি তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাই বললো,
“এভাবে তাকিয়ে থেকো না। তোমাদের মেয়েদের চোখ বড্ড খারাপ। নজর লাগলে সৌন্দর্য থাকবে না আর আমার।”
সিনথি হেসে বললো,
“চোখ দিয়ে ঝলসে দেবো তোমায়।”
আষাঢ় তাকালো সিনথির দিকে। বিরক্তি নিয়ে বললো,
“তোমাকে বিয়ে করবো না আমি।”
“তোমাকে করতে হবে না, আমি করবো। আমি বিয়ে করবো তোমাকে।”
আষাঢ় তাকিয়ে থাকতে পারলো না সিনথির দিকে। বিরক্তি ঝাপটে ধরলো। চোখ সরিয়ে নিলো সে। চলতে চলতে হঠাৎ বললো,
“তুমি এখন আমার কব্জায় আছো, ফেলে দেবো এখানে?”
আষাঢ়ের ধারণা ছিল মেয়েটা একটু ভয় পাবে, কিন্তু মেয়েটা হাসলো। বললো,
“দাও ফেলে।”
“ফেলে দিলে ব্যথা পাবে, হাড় ভাঙবে।”
“ভাঙুক, পরোয়া করি না। তোমার কাছ থেকে একটু-আধটু আঘাত প্রাপ্ত হলে মেনে নেবো আমি।”
আষাঢ় মেয়েটার কথাবার্তা শুনে বিস্মিত। মেয়েটা কিছুতেই দমে না। সে সহাস্যে বললো,
“থাক, সুন্দরী একটা মেয়ে এখানে পড়ে ব্যথা পাবে, সেটা মানতে আমার হৃদয়ে ব্যথা হবে। মাফ করলাম এবারের মতো।”
আষাঢ় সিনথিকে লিভিং রুম পর্যন্ত নিয়ে এলো। বাড়ির কাউকে এ মুহূর্তে দেখা গেল না। ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে না কি সবাই? সিনথিকে সোফার উপর বসিয়ে দিয়ে আষাঢ় যাওয়া দিলে সিনথি বলে উঠলো,
“এখানে নামিয়ে দিলে? ভেবে তো ছিলাম একেবারে রুম পর্যন্ত দিয়ে আসবে।”
আষাঢ় ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন তাকালো।
“একটু বেশিই আশা করা হয়ে যাচ্ছিল না?”
“হচ্ছিল না কি?” ফিচেল হাসলো সিনথি। তারপর হুট করে নিজের বাম চোখ টিপলো।
“আমার আম্মু-আব্বু যদি জানতো তুমি এমন, তাহলে জীবনেও তোমাকে আমার বউ করতে চাইতো না।”
“তারা না জেনে আমাকে তোমার বউ করতে চাইছে বলেই তো আমি ধন্য। তোমার মা-বাবাকে সম্মান জানাই আমি!”
আষাঢ় তাকিয়ে আছে। দু চোখে চাপা আক্রোশ। বিরক্তি আর ধরছে না। বিরক্তি, রাগ দুটোর পালাই ক্রমাগত ভারি হচ্ছে। এ মেয়েটাকে কোনো কথা দিয়ে দমানো যায় না। সহ্যের বাঁধ ছাড়িয়ে যায় মেয়েটা। সে দ্রুত গতিতে এসে ঝুঁকে পড়লো সিনথির দিকে। এমন কাজেও সিনথির ওষ্ঠ্য থেকে হাসির দল পালালো না। তারা চিরস্থায়ী।
আষাঢ় সিনথির দু চোখে দৃষ্টি বুলাতে বুলাতে চোয়াল শক্ত করে চাপা স্বরে বললো,
“তোমাকে সত্যিই বিয়ে করবো না আমি। ইউ আর অ্যা সাইকো। ইয়াহ, ইউ আর অ্যা ভেরি ডেঞ্জারাস সাইকো!”
সিনথি কিছু বললো না। শুধু তার হাসির রেখাটা আরও চওড়া হলো।
আষাঢ় কেটে পড়লো। দ্রুত পায়ে ছুটতে লাগলো নিজের রুমে। রুমের দরজা আটকে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিলো। দরদর করে ঘাম ছুটলো শরীর থেকে। সে ভেবে পাচ্ছে না, মেয়েটা আসলে কী? একটা এলিয়েন? উহ, মাথা ব্যথা করছে সিনথির চক্করে তার। ভাবতে চাইলো না ওসব নিয়ে। সিনথিকে কী করে যে কোলে করে সিঁড়ি বেয়ে নামলো সেটাই ভাবছে। মেয়েটাকে কোলে করে নামিয়েছে ভাবতেও গায়ে জ্বালা ধরে যাচ্ছে এখন। আষাঢ় মাথা থেকে আউট করে দিতে চাইলো সিনথিকে। পকেট থেকে মোবাইল করে কল করলো নোয়ানাকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো দেরিতে। ভেসে এলো ঘুম ঘুম আবেশী এক মেয়ে কণ্ঠ,
“হ্যালো!”
“যখন তুমি এমন ঘুম ঘুম কণ্ঠে কথা বলো না, হৃদয়ে ঝড় বয়ে যায় আমার। এই ঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় আমাকে। আমাকে লন্ডভন্ড করে কী পাও তুমি?”
নোয়ানার কণ্ঠ কঠিন হলো,
“আপনি?”
“নাম না দেখে কল রিসিভ করো কেন? এরপর থেকে দেখে কল রিসিভ করবে। এখন এই কলারটা যদি আমি না হয়ে অন্য কেউ হতো? যদি ওই নাঈম হতো? তখন? তোমার ঘুম ঘুম কণ্ঠের ঝড়ে তো সে লন্ডভন্ড হয়ে যেত। তাকে সেরে তোলার খরচ দিতো কে? তোমার কাছে কি আর লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া কাউকে সারিয়ে তোলার টাকা আছে?”
আষাঢ় না দেখলেও ধারণা করতে পারলো নোয়ানা কল কেটে দিতে উদ্যত হয়েছে। সে তো চেনে নোয়ানাকে। তাই বলে উঠলো,
“এই না, কল কেটে দিয়ো না। তোমাকে একটা কথা বলার জন্য কল দিয়েছি। কথাটা শুনে তারপর কল কেটো।”
নোয়ানা কল কাটলো না।
আষাঢ় বুঝলো তার কথা শোনার জন্য নোয়ানা ধৈর্য ধরেছে। বললো,
“আজ আমি…না মানে এই মাত্র। এইমাত্র আমি সিনথিয়াকে কোলে করে সিঁড়ি বেয়ে নেমেছি।”
নোয়ানার বক্ষ মৃদু কম্পমান হলো। মুখ ফুঁটে বের হলো না একটি শব্দও।
আষাঢ় বলে চলেছে,
“যখন ওকে কোলে নিয়ে নামছিলাম তখন মনে হয়নি কাজটি ভুল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঘোরতর অন্যায় করেছি। করেছিই তো। করেছি না? আচ্ছা, তুমি কি খুব বেশি রাগ করেছো? আমি প্রমিজ করছি, আজকের পর থেকে সিনথিয়া কেন? তুমি ছাড়া আর কোনো মেয়েকে স্পর্শ করবো না। মিথ্যা বলছি না, সত্যি। কারো হাতও ধরবো না।”
“হাত কেন? হাত, পা, মাথা সব ধরে বসে থাকুন আপনি। এই ফালতু কথা বলার জন্য এত রাতে আমার ঘুম না ভাঙালেও পারতেন মি. প্লে-বয়।”
আষাঢ় হেসে ফেললো সশব্দে,
“সত্যি অনেক রেগে আছো তুমি। তবে মি. প্লে-বয় ডাকটি খুব সুমধুর শোনালো তোমার কণ্ঠে। এত হাইপার হয়ো না টিউলিপ। আচ্ছা, কীভাবে তোমার রাগ ভাঙাবো বলো? তোমাকে কোলে নিয়ে যদি পাঁচতলা সিঁড়ি বেয়ে উঠি তাহলে হবে?”
“আপনি আর ফোন করবেন না আমাকে।”
“হবে না? দশতলা তাহলে?”
“আপনি একটা বাজে মানুষ।”
“বাজে মানুষটাকে ভালো করার দায়িত্ব হাতে তুলে নাও তাহলে। দেখি কতটুকু পারো। পারবে বোধহয়, তোমার সেই ক্ষমতা আছে। ইতোমধ্যে স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ডদের উপর থেকে মন উঠিয়ে ফেলেছো আমার।”
“আপনি আমার সাথে এরকম করা বন্ধ করুন। আমি একটা সহজ-সরল স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে চাইছি।”
“আমিও স্বাভাবিক ভাবে তোমাকে আমার বউ করতে চাইছি। সতীনের সংসার করতে পারবে তুমি? ভাবছি, সিনথিয়াকে বিয়ে করার পর তোমাকে দ্বিতীয় স্ত্রী করবো। আর তোমাকে যখন বিয়ে করবো তখন, ভেরোনিকাকেও বাদ দিতে চাইছি না। ভেরোনিকাকে তৃতীয় স্ত্রী করবো। তারপর আরও ভালো দেখে কোনো এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে চার বিয়ে সমাপ্ত করবো।
ভেবে দেখো, আমার চার বিয়ে কিন্তু তোমার হাতে। তুমি সম্মতি দিলে চার বিয়ে পূর্ণ হবে আমার। ভালো করে ভেবে দেখো। এখন রাখছি। শুভ রাত্রি।”
আষাঢ় মিষ্টি সুরে ‘শুভ রাত্রি’ জানিয়ে কল কেটে দিলো। ফোনের অপর প্রান্তে থাকা নোয়ানা অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
“শালা পাগল!”
কথাটা বলে নোয়ানা হতবাক হয়ে গেল।
আজ পর্যন্ত কাউকে সে এমন করে বলেনি। আর যখন বললো তখন সেই মানুষটা আষাঢ় হলো? আষাঢ়কে সে ‘শালা পাগল’ বলেছে! ভাবা যায়?
__________________
কারো হাতের মৃদু ঠ্যালায় শ্রাবণের ঘুম ভাঙবো ভাঙবো করছে। ড্রিম লাইট এবং বেড সাইড টেবিলের উপর জ্বলতে থাকা ল্যাম্পশেডের আলোয় দেখা যাচ্ছে একটি মেয়ে শ্রাবণকে জাগ্রত করার চেষ্টায় আছে।
শ্রাবণের স্বপ্ন ক্যানভাসে এই মুহূর্তে রুমকির অস্তিত্ব ছিল। সে দেখছিল সকালের কাঁচা রোদ মেখে সে আর রুমকি লেকের পাড় ধরে হাঁটছে। রুমকি দুই হাত দিয়ে তার হাত জড়িয়ে রেখেছে। তাদের গন্তব্য উদ্দেশ্যহীন। তারা শুধু হাঁটছে। স্বপ্নে আরও ভালো কিছু বোধহয় আসতে চলছিল, কিন্তু ঘুমটা অসময়ে ভেঙে গেল। ঘুমের পর্দা ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে এলে জেগে উঠলো শ্রাবণ। বুক ধক করে উঠলো তার। ধড়ফড় করে উঠে বসলো। তার ঠিক পাশেই মিহিক বসে আছে। শ্রাবণ ল্যাম্পশেডের সোনালী আলোকচ্ছয় দেখতে পেল মিহিকের ক্লান্ত মুখ। ওই মুখে যেন হাজার বছরের ক্লান্তি ভিড় করেছে। ভীষণ দুর্বল একটি মুখ। ঘামে ভিজে একাকার। চোখ দুটো নিভু নিভু। চোখ মেলে আছে কি বুজে আছে বোঝা মুশকিল। মিহিকের থেকে ভাঙা ভাঙা অতি দুর্বল কণ্ঠ ভেসে এলো,
“প্লিজ, সাহায্য করুন! ভী…ভীষণ অসুস্থ বোধ করছি। মরে যাচ্ছি বোধহয়! সাহায্য করুন প্লিজ!”
শ্রাবণের বুক ভয়ে তোলপাড় হচ্ছে। ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তার বক্ষ পিঞ্জরে থাকা সমস্ত কিছু। দ্রিম দ্রিম একটা শব্দ হচ্ছে তার বুকে। মাথা ঘুরছে। সে একটুখানি মিহিকের কাছে এগিয়ে এসে এলোমেলো কণ্ঠে বললো,
“মি…মিহিক, কী হয়েছে আপনার? এরকম দেখাচ্ছে কেন আপনাকে?”
“প্লিজ, সাহায্য করুন!” মিহিকের অতি দুর্বল, ক্লান্তিগ্রাস কণ্ঠ। কথাটা বলার পরপরই সে ঢলে পড়লো শ্রাবণের বুকে।
শ্রাবণের হৃদপিণ্ড নিজের সকল কার্য গুটিয়ে হৃদস্পন্দন বন্ধ করে ফেললো ক্ষণকালীন সময়ের জন্য। শরীরে বয়ে যাচ্ছে ভয়ের স্রোতধারা। হাত পা হিম হয়ে এলো। দুরবস্থার উত্তপ্ত মরুভূমির মধ্যিখানে হুমড়ি খেয়ে পড়লো তার সকল চিন্তা-চেতনা। কম্পমান স্বরে ডাকলো,
“মিহিক…”
(চলবে)