বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ২৬

0
635

#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ২৬
#লেখা: ইফরাত মিলি

জানালা গলিয়ে ঢোকা সকালের ঝরঝরে রোদে বসে আছে আষাঢ়। তার বসার চেয়ারটি জানালার একেবারে দ্বার প্রান্তে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে অবলোকন করছিল একটা চড়ুই পাখিকে। চড়ুই পাখিটা উড়ে গিয়ে আবার বার বার ফিরে আসছিল। কিন্তু এবার যাওয়ার পর আর ফিরে আসেনি। আষাঢ়ের মন খারাপ হলো। পাখিটার আসা-যাওয়ার দৃশ্য তার ভালোই লাগছিল।
কারিব আষাঢ়ের অসন্তুষ্ট মুখখানি দেখছে। সে বসে আছে আষাঢ়ের সামনের চেয়ারে। তার আজকে গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। যাওয়া ক্যানসেল করেছে। ক্যানসেল করার বিশেষ কোনো কারণ নেই। এমনিই, আষাঢ় আছে বলে গেল না।
অনেকক্ষণ হলো দুজন চুপচাপ বসে আছে এখানে। কথার সূত্রপাত ঘটলো ফ্যামিলি ডক্টরকে বাড়িতে অনুপ্রবেশ করতে দেখে। তারা দুজন বসে আছে লিভিং রুমের জানালার কাছে। যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা গেল ডাক্তার শফিক আনোয়ার এসেছে।

আষাঢ় চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“বাড়িতে ডক্টর কেন কারিব? কার কী হয়েছে?”

“আমিও ঠিক জানি না আষাঢ় ভাই। মামা-মামি সবাইকে তো সুস্থই লক্ষ্য করলাম।”

শফিক আনোয়ার রুপালির সাথে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে। আষাঢ় উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“একবার গিয়ে দেখি চলো।”

গতরাতে মিহিক বুকের উপর পড়ে যাওয়ার পর শ্রাবণ অনুভব করেছিল মিহিকের শরীর খুব উষ্ণ। তার বুঝতে সমস্যা হয়নি যে এটা তীব্র জ্বরের ফল। মেয়েটার এত জ্বর অথচ একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি কাউকে। শ্রাবণ এও বুঝতে পারলো জ্বর জ্বর ভাব থাকার কারণে মিহিক দুই দিন বেশির ভাগ সময় বিছানায় শুয়ে ছিল। অথচ জিজ্ঞেস করলে বলতো, তার কিছু হয়নি, শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে বলে শুয়েছে। মেয়েটা আগে থেকে না বলে-কয়ে তার অবস্থা খারাপ করেছিল। জীবনে এতটা জ্বরে কাবু মানুষ দেখেনি সে। দিগভ্রান্ত অবস্থায় পড়েছিল সেই সময়। গভীর রাতে কী করবে, কাকে ডাকবে কিছু মাথাতে আসছিল না। হাত-পা কাঁপছিল যেন রীতিমতো। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পরও যখন মিহিক সাড়া দিলো না ভয় কামড়ে ধরলো তখন। মিহিককে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ছুটে গেল মাকে ডাকতে। আর কী-ই বা করবে। এত জ্বরে আক্রান্ত মানুষকে তো তার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। এমনিতেই তার বুক ভয়ে ধক ধক করছিল।
লায়লা খানম এসে দেখলেন মিহিকের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না। হাত রাখলে হাত যেন পুড়ে উঠছে। মিহিককে কোনো রকম সামলিয়ে ঔষধ খাওয়ালেন, জল পট্টি দিলেন।
ওদিকে দিগভ্রান্ত অবস্থার কারণে শ্রাবণের ফ্লোর বিছানার কথা মনে ছিল না। মা-বাবা দেখলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে, ভাবনাতে ছিল না একদম। প্রথম দিকে ফ্লোর বিছানার দিকে খেয়াল করেনি কেউ। শ্রাবণ চাইছিল বিছানাটা পা দিয়ে ঠেলে খাটের নিচে ঢুকিয়ে রাখবে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? লায়লা খানমের যখন খেয়াল হলো ফ্লোরে বিছানা পাতা, তখন কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,
“ফ্লোরে বিছানা কেন শ্রাবণ?”

শ্রাবণ ঘাবড়ালো না। জানতো এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া তার শিরোধার্য। গোছানো প্রশ্নের উত্তর খুব সুন্দর ভাবে দিলো সে,
“এটা মিহিকের কাজ। সন্ধ্যায় এখানে বিছানা করে শুয়েছিল। আমি বিছানায় বসে কিছু জরুরি ফাইল চেক করছিলাম। ভেবেছিল সে পাশে থাকলে আমার ডিস্টার্ব হবে। তাই এই কাণ্ড করেছে। আমি অবশ্য বলেছিলাম সে বিছানায় থাকলে সমস্যা হবে না কোনো। তাও সে আমার কাজ শেষ না হওয়া অবধি ফ্লোরে বিছানার উপর ছিল।”

কথা আগে থেকে সাজিয়ে রাখলেও বলতে গিয়ে কিঞ্চিৎ গলা কাঁপলো শ্রাবণের। মা-বাবা কথাগুলো বিশ্বাস গেল কি না বুঝতে পারলো না। মিহিককে নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে বিষয়টা সহজে এড়ানো গেল।
রাতের থেকে মিহিকের অবস্থা এখন অনেকটা ভালো। রাতে যে অবস্থায় ছিল তাতে শ্রাবণের আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছিল। রাতে তো কোনো কথাই বলছিল না মিহিক। এখন বলছে। তবে খুব অল্প পরিমাণ। কথা বলতে গিয়ে যেন তার অর্ধ শক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে। গতরাত থেকে শ্রাবণের কিছু একটা হয়েছে। মন কেমন করছে। বার বার মিহিকের তার বুকে ঢলে পড়ার দৃশ্যটি মনে ভাসছে। এমন অসুস্থ কেউ তার বুকে ঢলে পড়েনি কখনো। হৃদয় স্তব্ধ করে দিয়েছিল ওই ক্ষণটা। সারা রাত দু চোখের পাতা এক ছিল না। মিহিকের জ্বরে কাবু অসুস্থ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভোর হয়েছে। মিহিকের গোল মতোন ক্লান্ত মুখ দেখে শ্রাবণের মায়া অনুভব হয়েছে, অনুভব হয়েছে হৃদয়ে ব্যথা। এক বিষাক্ত ব্যথা তার হৃদয় কামড়ে ধরেছিল। এখনও সে ব্যথার যন্ত্রণা কমেনি। কাল রাতে সে মিহিকের এক হাত আঁকড়ে ধরে বলেছিল,
“আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন মিহিক।”

কথাটা হয়তো মিহিকের অবচেতন মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারেনি। যদি করতো তাহলে বুঝতো
তার স্বামী আসলেই তার প্রতি কেয়ারিং।

আষাঢ় ডাক্তারের পিছন পিছন এসে পুরো বিষয়টি পরিলক্ষিত করেছে। মিহিকের জ্বর এসেছে দেখে তার মনে খুশির হাজারো ঝিলমিলে প্রজাপতি ডানা মেলে দিলো। খুশিতে হাসি পাচ্ছিল। হাসি চেপে রেখে বেরিয়ে এলো ভাইয়ের রুম থেকে। তার পিছন পিছন কারিবও বের হলো। রুম থেকে বের হয়ে আষাঢ় আর নিজের হাসি চেপে রাখতে পারেনি। ফিক করে হেসে দিলো সে। কারিব আষাঢ়কে হাসতে দেখে অবাক সুরে বললো,
“আপনার ভাবির জ্বর এসেছে আর আপনি হাসছেন?”

“হাসবোই তো কারিব, ভাবির জ্বর এসেছে বলে আমি খুব খুশি। জ্বরটা বড়ো উপকার করলো আমার।”

কারিবের ওষ্ঠদ্বয় আলাদা হয়ে গেল,
“আপনি খুশি? একটা মানুষের অসুস্থতাতে আপনি কীভাবে খুশি হতে পারেন আষাঢ় ভাই? এত পাশবিক আচরণ কীভাবে সম্ভব?”

“কারিব, তুমি বুঝতে পারছো না। চিন্তা করে দেখো। আমার ভাবি অসুস্থ। আর আমার ভাবি কে? তোমার টিউলিপ ভাবির বোন। বোন অসুস্থ। বোনকে দেখতে আসবে না টিউলিপ? অবশ্যই আসবে। আর বোনকে দেখতে আসলে আমার সাথেও দেখাটা হয়ে যাবে। এবার বুঝতে পেরেছো আমার হিসেবটা?”

কারিব খুশি হতে পারলো না। আষাঢ়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ফুঁটলো না তার অধর কিনারায় হাসির রেখাপাত। শুকনো বদনে বললো,
“আপনার হিসেবের তারিফ করছি, কিন্তু তাই বলেও আপনার একজনের অসুস্থতা নিয়ে খুশি হওয়া উচিত নয়। আপনার ভাবীর জ্বর এসেছে, আপনার দুঃখ প্রকাশ করা উচিত।”

“বোকা ছেলে! এটা ঠিক যে ভাবির জ্বর এসেছে বলে আমি খুশি, দারুণ খুশি। তাই বলে এটা সেরকম খুশি নয়। এটা অন্যরকম খুশি। চলো এখন।”

“চলো মানে? কোথায় যাব?”

“মার্কেটে। ভাবীর জ্বরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে হবে না?”

“বুঝলাম না আষাঢ় ভাই। ভাবির জ্বরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা… মানে কী এটার?”

আষাঢ় কারিবের প্রশ্নে কর্ণপাত না করে বললো,
“আচ্ছা, কোন ফুল ভালো হবে বলো তো? গোলাপ? না কি কৃষ্ণচূড়া?”

“গোলাপ দেন।”

“উহু, আমার মনে হচ্ছে কৃষ্ণচূড়া দিলে ভালো হবে।”

কারিব ইতস্তত কণ্ঠে বললো,
“শুভেচ্ছা জানাবেন…কৃষ্ণচূড়া দিলে কেমন না?”

“এটাই ভালো হবে। আমার ভাইয়ের প্রিয় ফুল।”

__________________

অফিসে যাওয়ার মন নেই, তবুও রেডি হতে হচ্ছে। রেডি হওয়ার ফাঁকে পিছন ফিরে বার বার দেখছে মিহিককে। মিহিকের আঁখি জোড়া মুদিত। ঘুমাচ্ছে। মেয়েটার হঠাৎ জ্বর আসার উৎস খুঁজে পাচ্ছে না শ্রাবণ। আগের চেয়ে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরালো সে। চুলগুলোয় আরেকবার চিরুনি চালানোর সময় শুনতে পেল পিছনে মিহিকের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর,
“অফিস যাচ্ছেন?”

শ্রাবণ পিছন ঘুরে প্রলুব্ধ কণ্ঠে বললো,
“ওহ, জেগে গেছেন আপনি?”

“জেগেই ছিলাম আমি।”

শ্রাবণের বাক বন্ধ হয়ে গেল মিহিকের কথার ঝঞ্ঝায়। মিহিক ক্ষণকাল চেয়ে থেকে দুর্বল কণ্ঠে বললো,
“কাছে আসুন।”

শ্রাবণ এগিয়ে গেল। মিহিক বসতে বললে বসলো পাশে।
“কিছু বলবেন?” প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবে এসে গেল শ্রাবণের মুখে।

মিহিকের চোখ দুটি লাল। মুখে ক্লান্তি ছেপে আছে। লাল চোখ দুটো শ্রাবণের চোখে নিবদ্ধ করে বললো,
“বলতে তো চাই অনেক কিছু, কিন্তু বললে আপনি বুঝবেন না। আপনি খুব বোকা শ্রাবণ।”

‘বোকা’ শব্দটা শ্রাবণের আত্মসম্মানে এসে আঘাত হানলো না। বোকা বলার জন্য মিহিকের উপর হলো না কোনো রাগ বোধ। বরং এক তিক্ত অপরাধ বোধে ছেয়ে গেল তার ভিতর। এই কথায় কেন এই অপরাধ বোধের আগমন বোঝা কঠিন। তার মনে সব সময়ই একটা অপরাধ বোধ ছেয়ে থাকে। কখনো বা চাপা, কখনো বা মিহিকের কথায় এটা জ্বলে
ওঠে। মিহিকের কথার প্রত্যুত্তর দেওয়ার কোনো শব্দ, বাক্য খুঁজে পেল না শ্রাবণ।

মিহিক নিরুত্তর শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে থাকে কীয়ৎক্ষণ। ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি ফুঁটে ওঠে। হাত বাড়িয়ে শ্রাবণের একটা হাত মুঠোয় তুলে নেয়। হাতটা কপালে ঠেকিয়ে বললো,
“আমি অসুস্থ বলে আপনার খারাপ লাগছে শ্রাবণ?”

শ্রাবণ বিচলিত হলো। তটস্থ কণ্ঠে জবাব দিলো,
“হ্যাঁ, লাগছে।”

মিহিকের ম্লান হাসি সুপ্ততা ছড়ায়,
“আপনি ভালো। একটু বোকা আছেন, আর একটু অসুন্দর। কিন্তু আপনি ভালো।”

“আমি অসুন্দর নই।”

শ্রাবণের কথায় মিহিক হেসে ফেলে। ক্ষণস্থায়ী হাসিটা সরিয়ে নিয়ে বললো,
“আমি সুন্দর বানাবো আপনাকে, কোনো চিন্তা নেই।”

শ্রাবণ তাকিয়ে রইল। হতবুদ্ধি চাহনি।

রুমের দরজা খুলে গিয়ে দেখা গেল আষাঢ়ের মুখ। তার পিছনে কারিবকেও আবিষ্কার করা গেল। আষাঢ় দরজা খুলেই বলে উঠলো,
“ওপস স্যরি, রোমান্টিক ক্ষণে ঢুকে গেলাম। আজ একদম নক করতে খেয়াল ছিল না।”

মিহিক বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করলো। সরিয়ে দিলো কপাল থেকে শ্রাবণের হাত।
শ্রাবণের এই মুহূর্তে ঘাবড়ানোর কথা ছিল, কিন্তু আজবভাবে সে ঘাবড়ালো না। এ ব্যাপারে সে নিজেই অবাক। আষাঢ় ভিতরে প্রবেশ করলো। প্রবেশ করলো কারিবও। আষাঢ় প্রসন্ন হাসি উপহার দিলো।

“জ্বর কেমন?”

“আগের থেকে ভালো।” উত্তর দিলো মিহিক।

আষাঢ় এগিয়ে এসে মিহিকের হাতে কিছু কৃষ্ণচূড়া ফুল গুঁজে দিয়ে বললো,
“তুমি আমার বড্ড উপকার করলে ভাবি। উপকার করার সৌজন্যে এই ছোট্ট শুভেচ্ছা তোমার জন্য।”

আষাঢ়ের কাণ্ড-কলাপ আর তার কথা শুনে মিহিক, শ্রাবণ দুজনই অবাক। মিহিকের ভ্রু বিস্ময়ে কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। শ্রাবণ বললো,
“উনি কী উপকার করেছে তোর?”

“করেছে ব্রো, করেছে। কী উপকার আপাতত সেটা গোপন থাক। জ্বরের জন্য শুভকামনা ভাবি।”
কথাটা বলে আষাঢ় হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল।
শ্রাবণ মাথা-মুন্ডু কিছু বুঝলো না। কারিবকে প্রশ্ন করলো,
“ও কী বললো এসব?”

“আমিও কিছু বুঝতে পারছি না শ্রাবণ ভাই। তার মাথায়ও বোধহয় আপনার মতো অন্য ধারার গন্ডগোল দেখা দিয়েছে।”
কারিবও দাঁড়ালো না। চলে গেল।
শ্রাবণের ঘোর কাটলো মিহিকের কথায়,
“আপনারা দুই ভাই এত পাগল কেন?”

“একটু আগে বোকা বলেছেন, এখন আবার পাগল বানিয়ে দিলেন?”

“যারা বোকা হয়, তারা পাগলও হয়।”

মিহিক চোখ বুজলো। কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না তেমন। গায়ের জ্বর যেন আবার বেড়ে যাচ্ছে। অনেকটাই কমে এসেছিল। শ্রাবণ মিহিককে চোখ বুজতে দেখে আর বললো না কিছু। অসুস্থ একটা মানুষের সাথে কি আর তর্ক করা সাজে?

_______________

“শ্রাবণ ভাইয়া কি তোমার সাথে এখনও ঝগড়া করে?”
মিহিকের দিকে কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে প্রশ্ন করলো তিন্নি। মিহিকের অসুস্থতার খবর পেয়ে সকালে এসেছিল তারা। বিকেলে বাসায় গিয়ে রাতে আবারও এসেছে।

মিহিক বললো,
“আরে না, তেমন কোনো ব্যাপার না। শ্রাবণ ভালো মানুষ। ঝগড়া করা তো দূর, ঝগড়া কীভাবে করতে হয় সেটাও বোধহয় সে জানে না।”

“কিন্তু তুমি যে বলেছিলে তাকে বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না আসলে তার ভিতরটা কেমন?”

“ওটা অন্য অর্থে বলেছিলাম।”

“কোন অর্থে?”

“জানতে হবে না তোকে।”

“আমি তো ভেবেছিলাম তার সাথে ঝগড়া করতে করতে তোমার জ্বর এসেছে।”

মিহিক তিন্নির কথায় হাসলো। হাসলো নোয়ানাও। রুমে শুধু মিহিক, নোয়ানা এবং তিন্নি আছে। একটু আগে আরও মানুষজন ছিল। হাফিজা, লায়লা খানম, রুপালি, আষাঢ়, সিনথিয়া, জুন। সবাই চলে গেছে। এবার তিন্নির মাঝেও চলে যাওয়ার একটা তাগিদ লক্ষ্যনীয় হলো। বললো,
“আমি জুনের কাছ থেকে একটু ঘুরে আসি।”

তিন্নি মিহিকের পাশ থেকে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এমন সময় দরজা দিয়ে প্রবেশ করছিল কারিব এবং আষাঢ়। কারিব আষাঢ়ের পিছনে ছিল। দরজার ভিতর থেকে তিনটা মানুষের আসা যাওয়ার দরুন দুর্ঘটনা বশত তিন্নির একটুখানি ধাক্কা লাগলো কারিবের সাথে। আষাঢ় ততক্ষণে দরজা অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করেছে। তিন্নি, কারিব জায়গাতেই স্থির হলো। ধাক্কা লাগায় তিন্নি চড়া গলায় বলে উঠলো,
“কী মিস্টার কারিব, চোখে দেখেন না?”

‘মিস্টার কারিব’ শব্দ দুটো ভালো লাগলো না কারিবের। মেয়েটা তাকে প্রথম পরিচয় থেকে মিস্টার কারিব বলে ডাকে। আর প্রথম থেকেই এই ডাকটা অপছন্দনীয় তার। সে অনেক বার বলেছে মেয়েটাকে তাকে ‘কারিব ভাই’ বলে ডাকতে। কিন্তু মেয়েটা ডাকবে না। ঘাড় ত্যাড়া মেয়ে।
কারিব কাঠ গলায় বললো,
“এই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি, তুমি চোখে দেখো না?”

তিন্নি অপ্রস্তুত বোধ করে। কিন্তু দ্রুত প্রত্যুত্তর করতে ভোলে না,
“এই জন্যই আপনাকে আমার পছন্দ নয়, আর পছন্দ নয় বলেই আপনাকে ভাই বলে ডাকি না। মানুষের সাথে আপনার আচরণ খুব বাজে। আপনার স্বভাব একেবারে ভালো নয়।”

তিন্নির কথা আষাঢ়ের কানে পৌঁছলো। আর পৌঁছনোতে সে কারিবেরও আগে তেড়ে এলো। কারিবের সামনে দাঁড়িয়ে কারিবকে আড়াল করে বললো,
“শোনো ভাবির ছোট বোন, কারিব আমার একান্ত প্রিয় মানুষ। ওর স্বভাব ভালো কি খারাপ সেটা আমি বুঝবো আর ও বুঝবে। তোমরা তিন বোন তোমাদের স্বভাব আগে ঠিক করো। তোমাদের কারো স্বভাবই ভালো নয়।”

“আপনি…” তিন্নি তুমুল বেগে গর্জে ওঠা দিয়েও আবার নিভে গেল। চোখ গেল দেয়াল ঘেঁষে রাখা আর্মচেয়ারে বসা নোয়ানার দিকে। নোয়ানার চোখ-মুখ যেন তাকে চুপ করে যেতে বলছে। তিন্নি নিজেও ভেবে দেখলো, আষাঢ়ের সাথে ঝগড়া করা তার উচিত হবে না। শত হলেও তার দুলাভাইয়ের ছোট ভাই। তিন্নি শান্ত অথচ আক্রমণাত্মক ভাবে বললো,
“মিস্টার কারিব আপনার একান্ত মানুষ, আমরা তিন বোন আপনার একান্ত নই। তাই আমাদের স্বভাব ভালো কি খারাপ তাতে আপনারও নাক গলানো উচিত নয় দুলাভাইয়ের ছোট ভাই।”

তিন্নি ভেংচি কাটার মতো করে পাশ কাটিয়ে গেল। আষাঢ়ের ভিতরে একটা অবিশ্বাসের নিঃশ্বাস না পড়লেই নয়। সে দরজার কাছে থেকে সরে ভিতরে প্রবেশ করে বললো,
“তোমাদের ছোট বোন একটু বেশি ত্যাদড়।”

মিহিক চাপা রাগ স্বরে বললো,
“আমাদের বোন কেমন সেটা আমরা বুঝবো, সেই নিয়ে তোমাকে না ভাবলেও চলবে।”

আষাঢ় আর তিন্নিকে নিয়ে থাকলো না, আড় চোখে একবার নোয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হুম, ভাবছি আমি। কিন্তু আমি যদি ভাবনা থামাতে চাই তাও এ ভাবনা থামবে না। ভাবতে না চাইলেও ভাবনা এসে যাবে আমার মাঝে। তাই আমাকে ভেবে যেতে হবে। সে যেন এটা না ভাবে তার ভাবনা আমি থামিয়ে দেবো। তাকে ভাবতে আমার একটু বেশিই ভালো লাগে।”

আষাঢ়ের কথাগুলো যে নোয়ানার জন্য ছিল তা মিহিক বুঝতে না পারার কারণে মিহিকের কাছে কথাগুলো তালগোল লাগলো। কিন্তু নোয়ানা এবং কারিব সহজে ধরতে পারলো এটা। আষাঢ় মিহিকের মন থেকে তালগোল লাগাটা মুছে দিতে বললো,
“আমার ভাই এখনও আসেনি?”

“আসলে তাকে নিশ্চয়ই দেখতে পেতে?” বললো মিহিক।

বলার সাথে সাথে রুমের দরজায় শ্রাবণের মুখ দর্শন পাওয়া গেল। শ্রাবণ দরজাতেই থমকে গেল। রুমের ভিতর এত মানুষ থাকবে বুঝতে পারেনি। সে এতক্ষণ বাইরে ছিল। আসলে হঠাৎ করে তার রুমকির কথা মনে পড়েছিল। রুমকিকে সেই থেকে এখনও অবধি ফোনে পাচ্ছে না। এমনকি রুমকিকে কোথাও দেখতেও পাচ্ছে না। এলাকার ভিতর বা বাইরে কোথাও রুমকির সাথে এক সেকেন্ডের জন্য দেখা হয়নি। রুমকির বাড়ির সামনে দিয়ে খুব সময় নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে গেলেও কোথাও দেখা যায় না রুমকিকে। রুমকি এতটাই রাগ করেছে যে এভাবে ফেরারি হলো? রুমকির বাড়ির আশেপাশেই ছিল কিছুক্ষণ। সেখান থেকেই ফিরেছে। ভুলক্রমেও একবার দেখা পায়নি রুমকির। এতটা রাগ করছে কেন রুমকি? সেদিন কী-ই বা এমন হয়েছিল যার কারণে দিনের পর দিন এভাবে যোগাযোগ রাখবে না? রুমকি যোগাযোগ না করায় যে শ্রাবণের কষ্ট হচ্ছে তেমন না। খারাপ লাগছে তেমনও নয়। তার শুধু চিন্তা আর রাগ হচ্ছে। রুমকির এরকম রাগ কি অতিরিক্ত নয়?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here