#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ২৭
#লেখা: ইফরাত মিলি
আষাঢ়ের জ্বরের আজ দ্বিতীয় দিন চলছে। কে জানতো যে মিহিকের জ্বর ট্রান্সফার হয়ে তার শরীরে ছড়াবে! মিহিক এখনও অসুস্থ। কবির সাহেবের বাড়িতে এখন দুইজন জ্বরে আক্রান্ত রোগী। আষাঢ় বুঝতে পারছে না এত মানুষ থাকতে মিহিকের জ্বরটা তাকে কেন ধরলো? সে তো অন্যদের তুলনায় খুব কম ছিল মিহিকের কাছে। জ্বরে ধরতে হলো তো তার ভাইকে ধরার কথা। তা না হয়ে সে কীভাবে জ্বরে পড়ে গেল?
“আমি যদি জানতাম এই জ্বর আমার শরীরে ছড়াবে, তাহলে কখনো জ্বরে আক্রান্ত রোগীর আশেপাশে ঘেঁষতাম না আমি।”
আষাঢ়ের কণ্ঠে ক্ষোভ।
সে নিজের রুমে কম্বল জড়িয়ে শায়িত অবস্থায় আছে।
কারিব থার্মোমিটার দেখতে দেখতে বললো,
“জ্বর খুব একটা বেশি না আষাঢ় ভাই, অনেক কমে গেছে। সুস্থ হয়ে যাবেন দ্রুত। ভাগ্য ভালো যে মিহিক ভাবিকে ধরা পাজি জ্বরটা হুবহু ট্রান্সফার হয়ে আসেনি।”
“এত মানুষ থাকতে আমার সাথেই কেন হলো এটা?” আষাঢ়ের কণ্ঠ করুণ।
“আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম, কারো অসুস্থতা নিয়ে খুশি হওয়া ঠিক না। দেখলেন তো তার ফল।”
“থামো কারিব, তুমি এখনও বড্ড বোকা। কতবার বলবো যে ওটা সেরকম খুশি ছিল না? নোয়ানা কি আসবে না আমাকে দেখতে? বোনের জ্বর বলে তো কত এলো-গেল। কখন আসতো আর কখন যেত ধরতেই পারতাম না। এসে আমার সাথে একবার দেখা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। এখন আমি অসুস্থ ব্যক্তি, এখনও কি আমাকে দেখতে আসার প্রয়োজন বোধ করছে না সে?”
“ভাবি হয়তো জানে না আপনি অসুস্থ।”
“কেন জানবে না? এটা কি গোপন কোনো কথা যে জানতে পারবে না? অবশ্যই জানে। জেনে-শুনে আমাকে দেখতে আসছে না। মেয়ে মানুষ এত পাষাণ কী করে হয়?”
কারিবের মনটা দুঃখী হয়ে উঠলো। সে আষাঢ়কে আশ্বস্ত করে বললো,
“টিউলিপ ভাবি নিশ্চয়ই আসবে। আজ তো শুক্রবার, বিকেলের দিকে আসতে পারে আমাদের বাড়িতে।”
আষাঢ় খুশি হয়ে মৃদু হাসে। হাসিটা স্থায়ী রেখে বললো,
“সিনথিয়ার এত ঘন ঘন আমার রুমে আসা-যাওয়া পছন্দ হচ্ছে না আমার। তুমি কি ওর আসা-যাওয়া বন্ধ করতে পারো?”
“সেটা কী করে সম্ভব? উনি আপনার হবু বউ। আপনারই তো ওনাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই, সেখানে আমি কী করে তার আসা-যাওয়া বন্ধ করবো?”
আষাঢ় অসহায়ত্বের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
“ঠিক আছে, বাদ দাও।”
_______________
ঝিরিঝিরি বাতাস পরম আবেশে বয়ে যাচ্ছে। বাউন্ডারি ঘেঁষে থাকা পেয়ারা গাছ এবং ফুল গাছগুলো মৃদু তালে দুলে উঠছে। বিকেলের তাপহীন হলদে রঙা রোদ গায়ে মেখে মিহিক বসে আছে উঠোনে। তার এখনও জ্বর জ্বর ভাব। কিছুটা শীত অনুভব হওয়ায় একটা বাদামি রঙা শাল জড়িয়ে আছে গায়ে। খোলা চুল শালের বেরি বাঁধে বাঁধা পড়েছে। জ্বরের কারণে এ কদিনেই তার চেহারা মলিন হয়ে উঠেছে। এই মলিন মুখটার দিকে তাকিয়েই সবার মায়া হয়। শ্রাবণের মায়ার পালা দিন দিন বেড়ে চলেছে মিহিকের জন্য।
মিহিক আনমনা বসে আছে। শ্রাবণ গেট পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকে আনমনা মিহিকের দিকে তাকিয়ে রইল ক্ষণকাল। মিহিককে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করলো না তার। সে চুপচাপ বাড়ির অভ্যন্তরে চলে গেল।
মিহিকের আনমনা ভাব কাটলো শাশুড়ির আগমনে। শাশুড়িকে দেখে মলিন মুখে মুচকি হাসি ফোঁটালো সে। মলিন মুখের ওই হাসিটুকু ভারি মিষ্টি দেখালো। লায়লা খানমের খুব কষ্ট হয় মেয়েটার জন্য। মেয়েটাকে দেখে মনে হয় মেয়েটা ভালো নেই। এতদিন মিহিকের জ্বর বেশি থাকায় তিনি কিছু জিজ্ঞেস করেননি। আজ জিজ্ঞেস করবেন ভাবছে।
“কিছু বলবেন আম্মু?”
লায়লা খানম মিহিকের সম্মুখের চেয়ারে বসলেন। মিহিককে দেখতে লাগলেন তিনি। এই সরল চেহারার পিছনে না জানি কত দুরূহ কষ্ট লুকিয়ে আছে। তার ছেলেটার জন্য না জানি মেয়েটা মানসিক ভাবে কতটা কষ্ট পাচ্ছে!
শাশুড়ির এমন চাহনিতে বিব্রতবোধ হচ্ছে মিহিকের। হঠাৎ করে কী হলো তার শাশুড়ির? ব্যাপারটা ভালো ঠেকলো না মিহিকের কাছে। এখনই যে তাকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখে পড়তে হবে তা জানে। আর প্রশ্নে যে শ্রাবণ থাকবে তাও আঁচ করতে পারছে। মিহিক শঙ্কায় রইল তার শাশুড়ি কী থেকে কী প্রশ্ন করে বসে সেজন্য।
লায়লা খানম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর অতি নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমার ছেলেটাকে বিয়ে করে তোমার কি আফসোস হচ্ছে মিহিক?”
মিহিক বিস্ময়ে মুখ তুলে চাইলো শাশুড়ির দিকে। বিস্ময়ে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল অনর্গল শব্দটা,
“আম্মু!”
লায়লা খানম সম্মুখ থেকে উঠে মিহিকের পাশে এসে বসলেন। মিহিকের উষ্ণ হাত দুটো নিজের মুঠোয় এনে হাত বুলিয়ে বললেন,
“শ্রাবণের সাথে তোমার সম্পর্কটা ঠিক নেই, তাই না?”
মিহিকের ভিতরটা নড়বড়ে হয়ে উঠলো। হঠাৎ করে এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন শাশুড়ি আম্মু? মিহিক অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললো,
“হঠাৎ এরকম প্রশ্ন কেন করছেন আম্মু?”
লায়লা খানম প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তার চোখের দৃষ্টি নমনীয়। হাত বাড়িয়ে মিহিকের গালে স্নেহের পরশ বুলিয়ে বললেন,
“তুমি আর শ্রাবণ একসঙ্গে থাকছো তো?”
মিহিক বিস্ময়ে বিমূঢ়। এমন সব প্রশ্ন কতটা বিব্রতকর, সেটা শুধু সেই জানে যে এই প্রশ্নের সম্মুখে পড়েছে। শ্রাবণ কি কোনো গন্ডগোল করেছে? কিছু না হলে তো হঠাৎ করে তিনি এসব প্রশ্ন করতেন না! মিহিক শাশুড়ির মুখে দৃষ্টি রেখে বললো,
“আপনার এরকম কেন মনে হচ্ছে আম্মু? আপনার ছেলে কি কিছু বলেছে?”
লায়লা খানমের এমন সংশয় হচ্ছে সেদিন রাত থেকে, যেদিন মিহিকের প্রচন্ড জ্বর। শ্রাবণ তাদের ডেকে এনেছিল। ফ্লোরে বিছানা দেখে তার এমনটাই মনে হয়েছিল। শ্রাবণ আর মিহিক এক সঙ্গে থাকছে না। একজন খাটে, আরেকজন ফ্লোরে থাকে। লায়লা খানম এবারও মিহিকের প্রশ্নের প্রত্যুত্তর দিলেন না। আগের মতো নরম কণ্ঠে শুধালেন,
“আমার ছেলে যদি এখনও পাগলামি করে থাকে, তাহলে তুমি আমাকে নির্দ্বিধায় বলো মা। আমি এর যথাযথ ব্যবস্থা নেবো।”
মিহিক জানে না হঠাৎ এমন কথা কেন বলা হচ্ছে তাকে। সে অজানার ভিতর থেকেই জবাব দিলো,
“আমি জানি না আপনি কেন হঠাৎ এসব বলছেন, কিন্তু আমার আর শ্রাবণের মাঝে সব কিছু ঠিক আছে।”
লায়লা শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করলেন,
“তাই?”
মিহিক শাশুড়ির হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করে বললো,
“হ্যাঁ। ছেলেটা তো আপনাদের, সে কি একটা ভুলে অনড় থাকতে পারে? শ্রাবণ ঠিক আছে। আর আমাদের সম্পর্কের মাঝেও কোনো সমস্যা নেই।”
লায়লা খানম স্বস্তি অনুভব করলেন। স্বস্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তার অধরে হাসি ফুঁটলো। বললেন,
“সব ভালো থাকলেই ভালো মা। তুমি থাকো এখানে, আমি ভিতরে যাচ্ছি।”
লায়লা খানম চলে গেলেন। সে চলে যাওয়ার একটু পরই গেটে একটা শ্যামবর্ণের মেয়ে মুখ উঁকি দিলো। মিহিক সহাস্যে বললো,
“তিন্নি এলো না?”
নোয়ানা গেট পেরিয়ে ঢুকে জবাব দিলো,
“ও আর জুন তো কোথায় গেল।”
___________________
নোয়ানা কিছুক্ষণ বোনের সাথে সময় কাটিয়ে বাড়ি যাচ্ছিল। মিহিক রুমেই রয়ে গেল। কষ্ট করে আর এগিয়ে দিতে নামলো না। নোয়ানা দ্রুত পায়ে লিভিং রুম পেরিয়ে যাচ্ছিল। আষাঢ়ের সাথে তার কোনো ভাবে দেখা হয়ে যাক চায় না। কিন্তু পিছন থেকে কারিবের ডাকে থামতে হলো,
“এই যে শুনুন।”
নোয়ানা দাঁড়ালো।
“কিছু বলবেন কারিব ভাই?”
কারিব কাছে এগিয়ে এসে বললো,
“আষাঢ় ভাই অসুস্থ, আপনি জানেন না?”
নোয়ানা যে একেবারে জানে না সেটা বলা ভুল হবে। জানে কিঞ্চিৎ। কিন্তু ধরা দিলো না। বললো,
“না তো, উনি অসুস্থ?”
“হুম, জ্বর এসেছে কাল বিকেলের দিকে। ধারণা করা হচ্ছে আপনার বোনের জ্বর খানিক তার শরীরে ট্রান্সফার হয়েছে।”
“ওহ, ওনাকে বলবেন শরীরের প্রতি যত্ন নিতে, আমি
আসছি।”
“যাচ্ছেন মানে? দেখা করবেন না আষাঢ় ভাইয়ের সাথে? উনি অসুস্থ আর আপনি দেখা করছেন না তার সাথে, সেজন্য তার মন খারাপ। আপনি প্লিজ তার সাথে গিয়ে একবার দেখা করুন।”
“আসলে আমার এখন ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে। বলবেন পরে এসে দেখে যাব তাকে।”
কারিব ছাড় দিলো না। নানান কথার মাধ্যমে নোয়ানাকে দমিয়ে রেখে পাঠিয়ে দিলো আষাঢ়ের সাথে দেখা করতে। আষাঢ় নিজের রুমে। স্বয়ং রুমে এসে দেখা করা নোয়ানার কাছে মোটেও ঠিক মনে হলো না। তবুও এলো। আসলে হঠাৎ তার মনে হলো অসুস্থ আষাঢ়কে একবার দেখে যাওয়া উচিত। মানুষের মন আজব। আর তার মনের আজব কারখানা আষাঢ়কে ভেবেই চলে। আষাঢ়ের থেকে দূরে থাকতে চাইলেও সে ব্যর্থ হয়। এই আষাঢ়কে দেখতেই ইচ্ছা হয় তার। নোয়ানা দ্বিধা-সংকোচ নিয়ে হাত বাড়ালো দরজার দিকে।
দরজা খোলার শব্দে আষাঢ় এপাশ ফিরলো। অর্ধ খোলা দরজায় নোয়ানার মুখ দেখে বললো,
“ও মা! পূর্ণ চাঁদটা দেখি আজ একেবারে আমার রুমে এসে উঁকি দিয়েছে। আহ, কী সৌভাগ্য আমার!”
নোয়ানা রুমের ভিতরে পা রেখে বললো,
“শুনলাম আপনি না কি অসুস্থ?”
“সেটা কি আমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না? সুস্থ সবল থাকলে কি আর এসময় এভাবে ঘরে শুয়ে থাকতাম?”
নোয়ানা কোনো উত্তর দিতে পারলো না।
আষাঢ় বললো,
“অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে এসে দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে কি হবে? কাছে এসো।”
নোয়ানা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। একটু নড়লো না পর্যন্ত।
আষাঢ় আবার বললো,
“আরে এসো।”
নোয়ানা না চাইতেও এগিয়ে গেল আষাঢ়ের দিকে। আষাঢ় বিছানার পাশে অবশিষ্ট জায়গা দেখিয়ে বললো,
“বসো।”
নোয়ানা বিনা বাক্যে বসলো। মনে হচ্ছে আষাঢ় যেন তাকে মন্ত্র পরিয়ে রেখেছে।
আষাঢ়ের ঠোঁটে মুচকি হাসি লেগে আছে। ঠোঁটে মুচকি হাসি আর গলায় মিষ্টতা ঢেলে বললো,
“জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখতে এসে শুধু বসে থাকলেই কি হবে? হাত বাড়িয়ে কপালটাও তো একটু ছুঁয়ে দেখতে হবে প্রিয়তমা!”
বলতে বলতে আষাঢ় নোয়ানার একটা হাত নিয়ে নিজের কপালে ঠেকালো।
নোয়ানা অনুভব করলো আষাঢ়ের কপাল খুব উষ্ণ। আষাঢ় তার হাতটা ধরে রেখেছিল কিছু সময় নিজের কপালে, সেটা খেয়াল হতেই দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নিলো। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“হুম, আপনার বেশিই জ্বর আছে। যত্ন নিবেন। আশা করছি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন। আমি যাচ্ছি এখন।”
নোয়ানা চলে যেতে পা বাড়ালো। দু কদম সামনে এগোলেই আষাঢ় পিছন থেকে বললো,
“আম্মু অনেক জল পট্টি দিয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। জ্বর সেই আগের মতোই আছে। কপালের উষ্ণতা কমেনি একটুও। আমার বিশ্বাস, তুমি যদি আমার জন্য কিছু করো তাহলে কপালের উষ্ণতা এরকম আর থাকবে না। আমাকে ছেড়ে জ্বর ছুটে পালাবে। তুমি কি কিছু করবে আমার জন্য?”
নোয়ানা দাঁড়িয়ে গেলেও পিছন ফেরেনি। না ফিরেই বললো,
“কী করবো আমি?”
“আমার কপালে একটা চুমু খাও।”
নোয়ানা বিরক্তি, তিক্ততায় চোখ বুজে ফেললো। তার হৃদস্পন্দন কম্পিত।
“তুমি আমার কপালে চুমু খেলে আমার জ্বর থাকবে না আর। এটা আমার বিশ্বাস।”
নোয়ানা কিছু বললো না। বন্ধ আঁখি জোড়া খুলে দ্রুত পদে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
আষাঢ় হাসলো। প্রায় দুই মিনিট পর রুমে কারিবের প্রবেশ ঘটলো। আষাঢ় শোয়া থেকে উঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসে বললো,
“তোমার টিউলিপ ভাবির মুখটা কি তুমি ভালো করে দেখছো কারিব?”
“ভালো করে বলতে কী বোঝালেন আষাঢ় ভাই?”
“আমার টিউলিপের মুখে কি লজ্জাভাব ছিল?”
কারিব মনে করার চেষ্টা করে বললো,
“না, কোনো লজ্জা লজ্জা ভাব তো আমার চোখে পড়েনি। ওনাকে তো স্বাভাবিক দেখলাম।”
আষাঢ় একটু চমকালো,
“স্বাভাবিক ছিল? কিন্তু আমি যা বললাম তাতে তো ওর লজ্জা পাওয়ার কথা!”
কারিবের মুখে এবার একটু দুষ্টু হাসি খেললো। হাসিটা স্থায়ী রেখে বললো,
“কেন আষাঢ় ভাই? আপনি কী বলেছেন টিউলিপ ভাবিকে? যাতে তার লজ্জা পাওয়ার কথা ছিল?”
আষাঢ় উত্তর দিলো না। মুখে মুচকি হাসি ফুঁটিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। বসা থেকে আবার শুয়ে পড়ে কপালের উপর ডান হাত ফেলে বললো,
“জ্বরের সময় কপালে কখনো কোনো মেয়ের চুমু কি খেয়েছো কারিব?”
কারিবের হাসি আরও চওড়া হলো,
“ভাবি কি আপনার কপালে চুমু খেয়েছে?”
আষাঢ়ের মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। চেহারা দুঃখী করে বললো,
“না কারিব, তোমার টিউলিপ ভাবি আমার কপালে চুমু খায়নি। তবে আমি চুমু খাওয়ার আবদারটা তুলে ছিলাম তার কাছে।”
কারিবও চেহারা কালো করে ফেলে দুষ্টুমি করে বললো,
“ওহ! দুঃখজনক! আমি কি অন্য কোনো মেয়ের ব্যবস্থা করবো? আপনার হবু বউকে ডেকে আনবো? তিনি একটা চুমু খেয়ে দিতেন আপনার কপালে।”
“না কারিব। অন্য কোনো মেয়ে নয়। আমার কপালে শুধু তোমার ভাবি চুমু খাবে। আর তোমার ভাবির কপালেও শুধু আমার ঠোঁটের ছোঁয়া থাকবে। অন্য কারো না।”
কারিবের মুখে হাসি দেখা গেল। আষাঢ়ের কণ্ঠ শোনা গেল ফের,
“তোমার ভাবি বোধহয় বিয়ের আগে আমাকে চুমু-টুমু খাবে না। ভাবছি বিয়েটা অতি শীঘ্রই করে নিয়ে চুমুটা আদায় করে নেবো।”
কারিবের লজ্জাবোধ হলো। আষাঢ়ের মুখে কোনো কথা আটকায় না। তার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। না হলে এরকম একটা বিষয় নিয়েও এভাবে বলতে পারে? কারিব বিষয়টাকে ঢাকতে বললো,
“আপনি কিছু খাবেন? নিয়ে আসবো কিছু?”
কারিব ব্যর্থ হলো, বিষয়টা ঢাকতে পারলো না। আষাঢ় একই বিষয়ে অটল,
“হুম খাবো। তোমার ভাবির একটা চুমু।”
কারিবের মনে হলো আষাঢ়ের মতো এত নির্লজ্জ মানুষ সে আর দ্বিতীয়টি দেখেনি। আষাঢ়ের মাথায় মগজ বলতে যে বস্তুটি থাকার কথা সেটা যেন শূন্য। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর কী থেকে কী শুনতে হবে সেজন্য কারিব দ্রুত জায়গা ত্যাগ করলো।
আষাঢ় সিলিংয়ের দিকে অন্যমনস্ক তাকিয়ে থেকে হাসতে থাকলো মিটিমিটি।
এক সময় বলে উঠলো,
“ওই নাঈম ছেলেটা একেবারে অসহ্যকর!”
_________________
আকাশের উন্মুক্ত বক্ষে কিছু সন্ধ্যাতারা টিমটিম করে জ্বলছে। মিহিক নামাজ শেষ করে আকাশে তারা দেখছিল। মাথায় এখনও হিজাব। রুমের লাইট অফ করে রেখেছিল। শ্রাবণ মসজিদ থেকে ফিরে রুম অন্ধকার দেখে বললো,
“আপনি কি আমার রুমটাকে ভূতের রাজ্য বানাতে চান মিহিক?”
মিহিক পিছন ফিরলো। শ্রাবণ ততক্ষণে লাইট অন করে দিয়েছে। সে মুচকি হেসে বললো,
“হুম, ভূতের রাজ্য বানাবো আপনার রুমকে। তারপর নিজে ভূত হয়ে আপনার ঘাড় মটকে দেবো।”
“এত পাশবিক কাজ?”
মিহিক প্রত্যুত্তরে হাসলো। শ্রাবণও হাসতে হাসতে ওয়ার্ডোবের দিকে এগিয়ে গেল। টুপিটা রাখলো। মিহিক জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কি আপনার আম্মুকে কিছু বলেছেন?”
প্রশ্নটা আগে করা হয়নি শ্রাবণকে।
“কেন? কী বলবো আম্মুকে?”
“তাহলে আপনার আম্মু বিকেলে ওসব কেন জিজ্ঞেস করলো আমায়?”
শ্রাবণ কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে বললো,
“কী জিজ্ঞেস করেছে আপনাকে?”
মিহিক খুলে বললো সব। শ্রাবণ বুঝতে পারলো। সেদিন ফ্লোরে বিছানা দেখার কারণে তার মায়ের এই সংশয়। সংশয় রাখার কী দরকার? সেদিন সে এত সুন্দর করে মিথ্যা বুঝ দিলো, সেটা মেনে নিলেই তো হতো।
“কী হলো? কেন শাশুড়ি আম্মু আমাকে এ সমস্ত জিজ্ঞেস করলেন?”
শ্রাবণ আমতা করে বললো,
“আসলে, যেদিন আপনার জ্বর এসেছিল সেদিন আপনার ওরকম অবস্থা দেখে ফ্লোর বিছানার কথা একদম খেয়ালে ছিল না। আব্বু-আম্মুকে ডেকে আনার পর তারা ফ্লোরে বিছানা দেখেছিল। সেজন্যই হয়তো…”
“আপনি আস্ত গাধা!”
“কী?”
“আজকে আমার জন্য বেঁচে গেছেন আপনি, যদি সত্যি বলে দিতাম তাহলে হয়তো এতক্ষণে রাস্তায় থাকতেন।”
“সেটাই তো, সত্যি বলেননি কেন? এটা কি স্বামীর জন্য করুণা?”
“স্বামীর জন্য করুণা নয়, স্বামীকে ভালো করার সুযোগ।”
শ্রাবণ থমকে গেল। ইতস্তত বোধ হলো তার। খানিক সময় নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
“সেদিন তো বলেছিলেন আমি ভালো, আজ আবার খারাপ বলছেন?”
“খারাপ তো বলছি না। আপনি ভালো, কিন্তু আপনি বোকা। বোকামি ছাড়লে পুরো দমে ভালো হবেন। যাক গে, ইদানিং আপনার ফোনে কল আসা প্রায় বন্ধ কেন?”
শ্রাবণ ধরতে পারলো মিহিকের কথা। অন্যদিকে ঘুরে লঘু কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“জানি না।”
“গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলার জন্য মন কি আকুপাকু করে?”
শ্রাবণ ক্ষিপ্রভাবে আবার মিহিকের দিকে ঘুরে বললো,
“দেখুন, এ বিষয়ে আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাইছি না।”
“অবশ্যই কথা বলতে হবে আপনার। রুমকি আপনার গার্লফ্রেন্ড, আর আমি আপনার ওয়াইফ। আমাকে নিয়ে রুমকির কাছে জবাবদিহিতা না করতে হলেও, রুমকিকে নিয়ে আমার কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে আপনার।”
শ্রাবণ দমে গেল, চুপসে গেল। সবটা অনুধাবন করে মনে হলো, হ্যাঁ মিহিকের কথাটা তো ঠিক। সে উত্তর দিলো,
“আমার মন আকুপাকু করছে না, কিন্তু রুমকির সাথে কথা বলাটা জরুরি ঠেকছে।”
শ্রাবণের উত্তরে মিহিক শান্তি অনুভব করে হাসলো। শান্ত গলায় বললো,
“ধীরে ধীরে আপনি সুন্দর হয়ে উঠছেন শ্রাবণ। আমি আপনার সম্পূর্ণ সুন্দর রূপটা দেখতে চাই। কী বললাম বুঝলেন?”
শ্রাবণের চেহারাতেই মিহিকের কথার মর্মার্থ না বুঝতে পারার ছাপ। মিহিক বললো,
“বোঝেননি। যেদিন সুন্দর হবেন, সেদিন বুঝতে পারবেন। এত বেক্কল আর থাকবেন না।”
মিহিকের কথার মাঝ থেকে ‘বেক্কল’ শব্দটা খুব করে গায়ে লাগলো শ্রাবণের। চড়া গলায় বললো,
“আমি বেক্কল?”
“আপনি বেক্কল নন, আপনি বলদ।” কথাটা বলে মিহিক হাসতে লাগলো।
শ্রাবণের আরও বেশি রাগ হওয়ার কথা, কিন্তু তার বেশি রাগ না হয়ে, রাগ আরও কমে গেল। মিহিকের হাসিতে তার রাগ আর রইল না। বরংচ তারই কেন যেন হাসি পেতে লাগলো।
(চলবে)