বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ৩১

0
627

#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ৩১
#লেখা: ইফরাত মিলি

মানুষের চেতনা কি কিছুক্ষণের জন্য বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে? পারে বোধহয়। এই যে মিহিককে সে বুকে জড়িয়ে রেখেছে, এটা তার নিজ চেতনায় করা কোনো কাজ নয়। তার চেতনা বশীভূত হয়েছে কিছুর দ্বারা। তা না হলে সে কখনোই মিহিককে বুকে টেনে নেওয়ার স্পর্ধা দেখাতে পারতো না। নিজ চেতনায় জাগ্রত হয়ে উঠলেই শ্রাবণ বিব্রত, বিভ্রান্ত অনুভব করলো। এমন বিব্রত, বিভ্রান্ত অনুভব জীবনে তার দ্বিতীয় কোনোদিন হয়নি। মিহিককে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা পিছু হটে এলো সে।
মিহিক বিস্ময়ান্বিত ডাগর চোখ জোড়া মেলে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। ওই দৃষ্টি তাকে লজ্জা দিচ্ছে, বুকে ভয়ের জন্ম দিচ্ছে, হৃদয় করছে তোলপাড়। কী বলা উচিত এখন? শ্রাবণের মুখে লজ্জার চিত্র। মস্তিষ্কে কোনো শব্দের আগমন ঘটছে না। শব্দহীন মস্তিষ্ক তাই মুখকে করে রেখেছে রুদ্ধ। কিছুক্ষণ সংশয় মন খানা নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকলো না। চলে গেল সে। রুমে দন্ডায়মান রেখে গেল তোলপাড়, আনন্দ আবহমান একটি মন। যে মনে আজকের এই ঘটনাটুকু সুন্দরতম স্মৃতি হয়ে জমা পড়ে রবে।

হৃদপিণ্ডের লাফ-ঝাঁপ তড়িৎ গতি সম্পন্ন। লাইব্রেরি রুমে প্রবেশ করে শরীর ছেড়ে দিলো দেয়াল ঘেঁষে রাখা ইজি চেয়ারে। বুকের বাঁ পাশে এক হাত রেখে হৃদয়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার বৃথা চেষ্টা প্রয়োগ করলো। শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো। এসব কী হচ্ছে তার সাথে? এটা কীভাবে করলো? মস্তিষ্কে সব কিছু প্যাঁচ খেয়ে যন্ত্রণার চাদর মেলে দিচ্ছে। দুই হাত দিয়ে মাথার চুল খামচে ধরলো। পাগল হয়ে যাচ্ছে কি সে? এই লজ্জিত মুখ কোথায় লুকাবে? কীভাবে দাঁড়াবে মিহিকের সামনে গিয়ে? অসহ্যকর আত্মগ্লানিতে ছেয়ে যাচ্ছে মাথার উপরের আকাশ। না, এটা ঠিক হয়নি। কেন হলো এমনটা? বুকের ভিতরে আবৃত হৃদয়কে বাইরে নিয়ে এসে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে ইচ্ছা হচ্ছে শ্রাবণের। আজকে যা ঘটলো তার জন্য হৃদয়ই দায় নয় কি?

ঘড়ির কাটা ঘুরতে ঘুরতে একটার ঘর ছুঁয়ে ফেলেছে। শ্রাবণ দোটানা মন নিয়ে লাইব্রেরি রুমেই অবস্থানরত। রুমে যাবে, কিন্তু মিহিক যদি এখনও জেগে থাকে? মিহিক জেগে আছে মনে হলে রুমে যাওয়ার ইচ্ছা বার বার দমে যায়। কিছুক্ষণ দোনা-মনা করে অবশেষে সে রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
ঝাপসা আলোয় পথ চলে রুমে পৌঁছলো। রুমের দরজা ভেজানো, মৃদু হাতে ঠ্যালা দিতেই খুলে গেল। লাইট জ্বলছে। ধারণা বলছিল মিহিক জেগে থাকবে, কিন্তু মিহিক ঘুমন্ত। শ্রাবণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক, মিহিকের মুখোমুখি হতে হলো না তার। রুমে প্রবেশ করে দরজা লক করলো। চোখ আপনা থেকে গিয়ে মিহিকের ঘুমন্ত মুখখানিতে নিবদ্ধ হলো। খাটের দিকে এগিয়ে এলো সে। ব্ল্যাংকেটটা মিহিক ফ্লোরে ফেলে রেখেছে। শ্রাবণ খাটের পাশে গিয়ে স্থির হলো। মেয়েটা বিছানার এক পাশে শুয়ে আছে। এ পাশটা উন্মুক্ত। মেয়েটা সব সময় বিছানার এক পাশে গিয়েই শুয়ে থাকে। এ পাশটা খালি রাখে। পুরো বিছানাই যখন তার নামে দেওয়া হয়েছে তখন এক কর্ণারে গিয়ে শুয়ে থাকার কী দরকার? মধ্যখানেই তো শুয়ে থাকতে পারে। শ্রাবণ বসলো। মিহিকের দিকে চেয়ে থেকে বললো,
“আমার সাথে সব কিছু অন্যরকম হচ্ছে মিহিক। এমন কেন হচ্ছে আপনি জানেন? এই অন্যরকম ব্যাপারটা কি আপনার জন্যই হচ্ছে?”

ঘুমন্ত মিহিক নিরুত্তর। শ্রাবণ চোখ সরিয়ে নিলো। বুক চেরা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি জানি এটা আপনার জন্যই হচ্ছে। আপনিই এর পিছনে দায়ী। এটা খারাপ লাগছে না। কিন্তু অসহ্য রকম একটা ছটফটানি অনুভব হয় হৃদয়ে।”
শ্রাবণ আবারও তাকালো মিহিকের দিকে,
“আপনার কি এরকম হয় না? না কি এটা শুধু আমার সমস্যা? আপনি আমার এরকম অনুভূতির সঙ্গী হলে ভালো হতো। কিন্তু আপনার হৃদয়ের অবস্থা তো আমি জানি না। আপনি আপনার হৃদয় সম্পর্কে বলেননি, আর আপনার হৃদয় পড়ার সাধ্যিও আমার নেই! হয় আমার মতো এমন?”

_______________

মিহিকের তন্দ্রা ভাঙলো ফজরের আযানের সাথে সাথে। চোখ খুলেই যা দেখলো, তাতে সে অভিভূত!
তার সম্মুখে, তার পাশে ঘুমিয়ে আছে শ্রাবণ! রুমে লাইট জ্বলছে। লাইট অফ করে ঘুমায়নি শ্রাবণ। লাইটের আলোয় স্পষ্ট শ্রাবণের ঘুমে বিভোর চেহারা দেখতে পাচ্ছে সে।
মিহিকের হৃদয় সহসা আর্দ্র হয়ে উঠলো। শেষমেশ মানুষটা তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়েছে! যদিও দুজনের মাঝে পার্শ্ববর্তী দূরত্বটা অনেক। শ্রাবণ মধ্যখানে অনেকখানি খালি জায়গা রেখে শুয়েছে। একেবারে বিছানার কর্ণারে গিয়ে এমনভাবে শুয়েছে যেন ও কাত ফিরলেই ধপাস করে পড়ে যাবে ফ্লোরে। মিহিক মুচকি হাসলো। এত কেন দূরত্ব রাখতে হবে মানুষটার? কাছে এগিয়ে এলো সে। একটা হাত বাড়িয়ে কি ছুঁয়ে দেবে ঘুমে বিভোর মুখখানি? ঘুম কি ভেঙে যাবে তার? ভাঙলে ভাঙুক।
মিহিক হাত বাড়িয়ে শ্রাবণের কপোল ছুঁয়ে দিলো। শ্রাবণের কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না, না ভাঙলো ঘুম। এমন আলতো ভাবে ছুঁয়েছে যে ঘুম ভাঙারও কথা নয়। মুচকি হাসিটা মিহিকের অধর থেকে সরছে না। আজকের সকালটা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এমন একটা সকালের প্রতীক্ষায় ছিল সে। যেখানে ঘুম ভেঙেই প্রথমে স্বামীর চেহারাটা দর্শন হবে। মিহিক আধো কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কে আগে প্রেমে পড়লো বলুন তো? মনে হচ্ছে আমিই প্রথম পড়েছি আপনার প্রেমে!”

________________

পরপর চার বার কলিং বেল বেজে উঠলো। রুপালি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো দরজা খুলতে। দরজা আসলে ভেজানো। আগন্তুক দরজায় ঠ্যালা দিলেই দরজা খুলে যেত। যাই হোক, দরজার কপাট খুলে দিতেই সুন্দরী এক মুখশ্রী নজরে এলো। মেয়েটার পরনে ওয়েস্টার্ন ড্রেস। খোলা চুলে কেমন একটা হেয়ার স্টাইল করেছে। মেয়েটা অপরিচিত, স্বাভাবিক অর্থেই রুপালি প্রশ্ন করে ফেললো,
“আপনি কে?”

মেয়েটা হেসে উত্তর দিলো,
“আমি সাদিয়া জামান।”

“কারে চান?”

“এটা হিমেলের বাসা না? হিমেল আছে?”

রুপালির চোখ স্ফূর্ত হয়ে উঠলো। আষাঢ়ের কথা কেন জিজ্ঞেস করছে এই মেয়ে? মন খচখচ করে উঠলো তার। মেয়েটার আগমনে বড়ো রহস্য রহস্য গন্ধ আছে। সে কোনো জবাব না দিয়ে সোজা দৌঁড় দিলো লায়লা খানমের রুমে।

কারিব এক প্রকার দৌঁড়াতে দৌঁড়াতেই এসে উপস্থিত হলো আষাঢ়ের রুমে। এত জোরে দরজাটা খুললো যে ভারি একটা শব্দ হলো ঘরময়। আষাঢ় এখনও ঘুমিয়ে আছে। তার ঘুমে ভাঙন সহজে ধরবে না। কারিব দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে এসে দুই হাতে আষাঢ়কে মৃদু ঠ্যালা দিয়ে ব্যস্ত গলায় বললো,
“আষাঢ় ভাই, ওঠেন…ওঠেন।”

ধাক্কার কারণে আষাঢ়ের ঘুমে ভাঙন ধরলো সহজেই। কিন্তু এই ভাঙনে কাজ হলো না। আষাঢ়ের ঘুম ভাঙলো ঠিকই, কিন্তু তার চক্ষু মুদিত রইল, জাগতিক হুঁশে ফেরানো গেল না তাকে। সে ডুবে রইল গলা পর্যন্ত ঘুম জলে। ঘুম আচ্ছন্ন কণ্ঠে বিড়বিড় করে উঠলো,
“ওহ কারিব, হোয়াট’স ইওর প্রবলেম ডিয়ার? কেন তুমি মাঝে মাঝে আমার ঘুমে বিরক্ত করো? বিরক্ত করো না প্লিজ। স্বপ্নে তোমার ভাবি আর আমি স্নো ফল জমা পথ দিয়ে হাঁটছি। স্বপ্নের মাঝে এভাবে ব্যাঘাত ঘটালে দুজনেই পা পিছলে পড়ে যাব। বিরক্ত করো না। পথটা শেষ হতে দাও।”

বিড়বিড় করে বললেও কারিব অনেক কথাই বুঝলো। এতে সে শান্ত হলো না। তার ভিতরে অশান্ত দুশ্চিন্তা। আবারও ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালো,
“ঘুমালে হবে না আষাঢ় ভাই। দ্রুত ওঠেন। ওদিকে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে।”

আষাঢ় আগের মতো বিড়বিড় করলো,
“হু সর্বনাশ! তোমার টিউলিপ ভাবি আমার হৃদয়ের সর্বনাশকারী। আমার হৃদয় হরণকারী। বাস্তবে এত কঠিন কেন সে? স্বপ্নে তো মোটেই এমন নয়। রোমান্টিক দেখাচ্ছে তাকে। সকল কথা হেসে হেসে বলছে।”

কারিবের এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে পাগল হয়ে যাবে। ওদিকে সর্বনাশী তান্ডবে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে, আর এদিকে আষাঢ় নিজের স্বপ্ন নিয়ে পড়ে আছে। সে আরও কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে বললো,
“ওঠেন, তাড়াতাড়ি ওঠেন। আপনার গার্লফ্রেন্ড এসেছে বাড়িতে।”

আষাঢ়ের চোখ জোড়া আচমকা খুলে গেল। কারিবের কথা কর্ণ থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছে তার। দ্রুত উঠে বসে বললো,
“কে এসেছে?”

“আপনার স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ড, সাদিয়া।”

“মিরপুর?”

“হ্যাঁ, মিরপুর।”

আষাঢ় রাগ, বিরক্তিতে মুখে আজব একটা শব্দ করে উঠলো। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে নেমে লম্বা পা ফেললো।

______________

“হিমেলের কাছে এসেছো…হিমেলকে কীভাবে চেনো তুমি? তোমাদের সম্পর্কটা কী?”
দুরুদুরু বুক নিয়ে প্রশ্ন করলেন লায়লা খানম। মন বলছে ভালো কিছু হতে চলছে না সামনে। সিনথিয়া, মিহিক বসে আছে তার সাথে, এই মেয়ে যদি এখন অপ্রীতিকর কিছু বলে তাহলে এই মুখ কোথায় রাখবে সে! মেয়েটা যদি বলে ফেলে সে আষাঢ়ের প্রেমিকা, তাহলে তিনি কী জবাব দেবেন সিনথিয়াকে? আষাঢ় এমন কেন করলো?

মেয়েটা লায়লা খানমের দুশ্চিন্তার কারণ মতো কিছুই বললো না। শুধু বললো,
“আগে হিমেল আসুক, ওর সাথে দেখা করা খুব প্রয়োজন আমার।”
একরাশ জড়তা মেয়েটার কণ্ঠে।

লায়লা খানমের চিন্তা হচ্ছে সেটা ঠিক, কিন্তু সে কৌতূহল থেকে পিছু হটতে পারেন না। সত্য থেকেও না। মেয়েটাকে আশ্বস্ত করে বললেন,
“তুমি বলো মা, কোনো সমস্যা নেই। আমার ছেলে আর তোমার মাঝে সম্পর্কটা কী? তোমরা কি বন্ধু, না কি…”
লায়লা খানমের কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো। মেয়েটা আষাঢ়ের প্রেমিকা এমন সংশয় যে শুধু তার হচ্ছে সেটা নয়। সিনথিয়া, মিহিক, রুপালি এদেরও সংশয় হচ্ছে। সিনথিয়া আসলে কনফার্ম এই মেয়ে আষাঢ়ের প্রেমিকা। সে তো আষাঢ়ের জীবনবৃত্তান্ত জানে। আর মেয়েটা যেভাবে এসেছে, এখন যেরকম করছে তাতে এ সন্দেহ যে কারোরই হবে। মিহিকও বলতে গেলে কনফার্মের আশেপাশে অবস্থান করছে। তার মনে বার বার একটা কথা বেজে উঠছে,
‘দুই ভাইয়ের এক ভাইও ভালো নয়। ভাই তো, একজনের খারাপ আরেকজনের মাঝে ট্রান্সফার একটু হলেও হবেই।’

দোটানা, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুহূর্ত। কেউই আর কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষণ বাদে সিঁড়িতে দ্রুতগামী পদধ্বনির শব্দ পুরো লিভিং রুমের নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে তুললো। সবার চোখ পড়লো আষাঢ় আর কারিবের দিকে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠায় আষাঢ়ের মুখ ক্লান্ত। কিন্তু তার ক্লান্ত চেহারাটা ঢাকা পড়েছে বিরক্ত, আর ক্রোধের ছায়ায়। তার মুখ দেখলে বিরক্ত আর ক্রোধই সবার চোখে পড়বে। চোখ জোড়া দাবানলের ন্যায় ক্ষিপ্ত।
আষাঢ়কে দেখে সাদিয়ার ঠোঁটে হাসি ফুঁটলো। ওই হাসি আষাঢ়ের কাছে বিষ তুল্য। সে লিভিং রুমে নেমে সোজা সাদিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। কোনো ভণিতা ছাড়াই, নিজের বিরক্তি আর ক্রোধ না ঢেকেই দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“আমার সাথে চলো সাদিয়া।”

সাদিয়া বসা থেকে দাঁড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,
“হিমেল…”

এ তো ডাক নয়, সয়ং তীর এসে কান ছিদ্র করে দিচ্ছে। আষাঢ় আগের মতোই ভণিতাহীন বললো,
“চুপচাপ চলো। আমি তোমাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছি না।”

পরিস্থিতি এমন যে কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। সবটা কান দিয়ে ঢুকে মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছে শুধু।

সাদিয়াকে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আষাঢ়ের মেজাজ চরমে উঠলো। সাদিয়াকে টেনে নেওয়ার মতো কাজ সে আসলেই করতে চায়নি। কিন্তু সে উপায়হীন। সাদিয়ার এক হাত শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে নিলো। নিজ সঙ্গে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
সবাই থ হয়ে ঘটনাটা অবলোকন করলো। যা হচ্ছে সব মাথার উপর থেকে ধোঁয়াশার মতো অতিবাহিত হচ্ছে। শুধু সিনথিয়ার মাঝে তেমন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য হচ্ছে না।
এদিকে কারিবের অবস্থা বেগতিক। মনে হচ্ছে হাত-পায়ে কাঁপন উঠবে তার। হঠাৎ তিন জোড়া বিস্ময়ে ঢাকা চোখ তার উপর এসে পড়লো। সে ঘাবড়ে গেল। গলা শুকিয়ে এলো। উপায়ন্তর না পেয়ে সেও প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
আষাঢ় বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় এনে সাদিয়ার হাত ছেড়ে দিলো। রাস্তায় তেমন মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ছে না। সে রাগে কটমট করে বলে উঠলো,
“আর ইউ ক্রেজি? আমার বাসায় এসেছো কেন তুমি? কোথায় পেয়েছো আমার বাসার ঠিকানা? কে দিয়েছে তোমায়?”

সাদিয়া আষাঢ়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো,
“হঠাৎ করে তুমি এমনভাবে উধাও হয়ে গিয়েছিলে কেন হিমেল? কত বার কল করেছি তোমায়। কিন্তু কোনো সংযোগ পাচ্ছিলাম না। কোথায় থাকো কিছু জানি না। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম আমি।”

“আর তুমি এভাবে আমার বাড়িতে এসে আমায় পাগল করে দিয়েছো। দেখতে পাচ্ছ, আমি কেমন উন্মাদের মতো ছটফট করছি? বলো কোথায় পেয়েছো আমার ঠিকানা? বলো সাদিয়া।”

আষাঢ়ের এই কণ্ঠ, এই ব্যক্তিত্ব অপরিচিত সাদিয়ার কাছে। তার হঠাৎ ভয় করছে আষাঢ়কে। সে গটগট করে সব বলে দিলো,
“আমি অনেক খোঁজ করেছি তোমার। অবশেষে এই এলাকায় বসবাসরত এক আত্মীয়র কাছ থেকে তোমার ঠিকানা মিললো। আমার সে আত্মীয় চেনে তোমাকে। সে-ই বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে।”

“ড্যাম ইট! তোমার আত্মীয়র নাম কী?”

“তুহিন রহমান।”

আষাঢ় কারিবের দিকে তাকালো,
“তুহিন রহমান কে?”

কারিব চেনে। জবাব দিলো,
“শপিং মলের মালিক। বিরাট শপ তার।”

“আমি চিনি না অথচ সে আমায় চিনে বসে আছে। আর চিনে এতবড়ো সর্বনাশ করলো আমার। পারলে ব্যাটার শপ উঠিয়ে নিতাম আমি।”
আষাঢ় সাদিয়ার দিকে মনোযোগ দিলো,
“শোনো সাদিয়া, যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোমার সাথে একটা রিলেশনশিপ ছিল আমার। কিন্তু ওটা সেরকম কোনো গুরুতর রিলেশনশিপ ছিল না। আমাদের শুধু ইনস্টাগ্রামে কথা হতো। দেখা হয়েছিল মাত্র দুই দিন। মাত্র দুই দিনের দেখায় তোমার নিশ্চয়ই আমার জন্য পাগল হয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাও হয়েছো। খুঁজতে খুঁজতে বাসা পর্যন্ত চলে এসেছো। এটা ঠিক করোনি। আজকাল রিলেশনশিপের এমন বিচ্ছেদ অহরহ হচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি চাইছি না এটা নিয়ে তুমি ঝামেলা করো। এমনিতেই যে ঝামেলা করেছো তা সামাল দিতে দিতে আমার খবর হয়ে যাবে। তুমি প্লিজ চলে যাও। ভিতরে একটা মেয়েকে দেখেছো? সাদা ড্রেস পরা? ও আমার হবুবউ। ভীষণ সুন্দরী না? হ্যাঁ, ভীষণ সুন্দরী। ওর সাথে আমার বিয়ে আর মাত্র দশদিন পর। এমন সময় তুমি ঝামেলা করো না। কত মানুষের বছরের পর বছর করা প্রেমের সম্পর্কও টেকে না, সেখানে আমার করা কাজটা কোনো কাজই নয়। আমি প্রতারণা করিনি তোমার সাথে। বলতে পারো আমি তোমায় আগাম একটা প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করেছি। পরবর্তীতে
যখন তোমার ব্রেকআপ হবে, তখন তুমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকবে এটার কারণে। তখন আমাকে মনে পড়বে তোমার। ভাববে, হিমেল ছেলেটা আসলেই আমার উপকার করেছে। কী বলেছি বুঝেছো?”

“কিছু বুঝিনি। শুধু বুঝলাম তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করছো।”

“আরে পাগল মেয়ে, আমি কি এখন তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি? প্রত্যাখ্যান তো করেছি সেই অতীতেই। তুমি কখনও আমার ভালোবাসা ছিলে না। আমি কি একবারও বলেছিলাম আমি তোমাকে ভালোবাসি? বলিনি। যে তোমাকে ভালোবাসেনি তার জন্য পাগল হয়ে ঝামেলা করো না। আর এমনিতেও আমি মানুষটা কিন্তু ভালো নই। এমন ছেলেকে কোনো মেয়েই লাইফ পার্টনার হিসেবে চাইবে না। হ্যাঁ, দুজন আছে অবশ্য যারা আমাকে লাইফ পার্টনার হিসেবে চায়। কিন্তু ওটা ব্যাপার না। আমি যে পরিমাণ খারাপ তাতে কোনো মেয়ে বিয়ে করবে না আমায়। এমন একটা মানুষের জন্য পাগলামি করবে তুমি? করো না। লক্ষ্মী মেয়ের মতো বাসায় চলে যাও।”

কারিব কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আষাঢ়ের কথা শুনছিল এবং মুগ্ধ হয়ে দেখছিল মানুষটাকে। মানুষটা কি আর সাধেই তার এত প্রিয়? কীভাবে মেয়েদের মানিয়ে ফেলে কে জানে! কত সুন্দর করে বুঝ দিয়ে ঠিকই সাদিয়া নামক সর্বনাশকে তাড়িয়ে দিলো। হ্যাঁ, সাদিয়াকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে আষাঢ়। মেয়েটা এমনিতেই বেক্কল, আর অধিক কৌতূহলী। তা না হলে কি এরকম করে বাসা খুঁজে চলে আসে?
আষাঢ় কারিবের দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি দিয়ে বললো,
“কী কারিব? কেমন?”

“ছেলে না হলে নির্ঘাত আপনার প্রেমে পড়তাম।”

আষাঢ় হেসে ফেললো কারিবের কথায়। কারিবও হাসলো। হাসতে হাসতেই বললো,
“আপনি অনন্য আষাঢ় ভাই। অন্যরকম এক ক্ষমতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন।”

“এটা প্রশংসা না কটাক্ষ বুঝতে পারছি না কারিব। আমার ক্ষমতা তো মেয়ে ভোলানো। এটা কি প্রশংসার যোগ্য?”

“নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।”

আষাঢ় জোরে হেসে উঠলো। কারিবও আষাঢ়ের সঙ্গ দিয়ে হেসে উঠেছিল, কিন্তু গেটের কাছে নোয়ানার মুখটা দেখে তার হাসি থেমে গেল। আষাঢ়কে বললো,
“আষাঢ় ভাই, ভাবি দাঁড়িয়ে আছে।”

আষাঢ় গেটের দিকে তাকালো। উচ্চ হাসিটা নম্র হয়ে এলো। সে দৌঁড়ে নোয়ানার কাছে গেল।

“কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছো টিউলিপ ফুল? দেখতে পাইনি তো তোমায়। গেটের এখানে না দাঁড়িয়ে থেকে আরেকটু বাইরে নেমেই তো দাঁড়াতে পারতে।”

নোয়ানার বিরক্তবোধ হলো,
“সেটা আমি বুঝবো। ওই মেয়েটা কে ছিল?”

“সাদিয়া? কে হতে পারে ধারণা করো।”

“ইচ্ছা নেই ধারণা করার।”

নোয়ানা চলে যেতে পা বাড়ালো। আষাঢ় বলে উঠলো,
“দাঁড়াও।”

নোয়ানা থামলো। নিজ থেকে পিছন ফিরতে হলো না, তার আগেই আষাঢ় হাত ধরে টান দিয়ে নিজের দিকে ফেরালো। একটু ঝুঁকে, দুই জোড়া চোখ মিলিত করে বললো,
“ওই মেয়েটা কেউ ছিল না, কেউ না। এখানকার হস্তক্ষেপ তো শুধু তোমার।”
একটা হাত বুকের বাঁ পাশে নিয়ে বললো আষাঢ়।

নোয়ানা আষাঢ়ের চোখে শিথিল দৃষ্টি স্থায়ী রেখে বললো,
“কিন্তু আমি আপনার ওই স্থানটি ত্যাগ করতে চাইছি। ওই স্থান থেকে আমাকে বর্জন করুন। এটা সবদিক থেকে ভালো হবে।”

আষাঢ় হাসলো। হাসি আর সরলো না ঠোঁট থেকে। বললো,
“আমাকে হাসিয়ো না নোয়ানা। স্বপ্নে তুমি দারুণ সুন্দর ছিলে। বাস্তবে তাহলে কেন তুমি এমন? এটাই বোধহয় পার্থক্য বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝে। স্বপ্নে খুব দুষ্টুও ছিলে তুমি। দুষ্টু মেয়ের মতো চুমু খেয়ে বসেছিলে আমার ঠোঁটে। ইশ, কী লজ্জাটাই না পেয়েছিলাম আমি তখন! অমন ভাবে চুমু খাওয়া উচিত হয়নি তোমার। যে লজ্জা পেয়েছি তার শোধ দেবে কীভাবে?”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here