#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ৪২
#লেখা: ইফরাত মিলি
আজ সিনথিয়ার চলে যাওয়ার দিন। এক ঘণ্টা পরই সে প্লেনে করে উড়াল দেবে ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে। তাকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত দিয়ে আসবে লায়লা খানম এবং শ্রাবণ। আষাঢ় যাবে না। সকল কিছু গোছগাছ করা শেষ। টুকটাক যা বাকি আছে তা গুছিয়ে নিচ্ছে। গতরাত থেকে হৃদয় পাথরের ন্যায় কঠিন রাখার চেষ্টায় আছে সে। কিন্তু কঠিন হৃদয়ে খানিকক্ষণ পর পরই কষ্ট আতশবাজির মতো গর্জে উঠছে। আষাঢ় সিনথিয়ার রুমে এসেছে কিছুক্ষণ হলো। সিনথিয়াকে দেখছে। মেয়েটার মুখে গাম্ভীর্য, অন্ধকার ছেয়ে আছে! কেন খারাপ লাগছে মেয়েটাকে এমন দেখতে? আষাঢ় বসা থেকে উঠে এগিয়ে এলো। সিনথিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“সব রকম চেষ্টা করেছিলাম যাতে তোমার মনে আমার জন্য কোনো অনুভূতি না আসে। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। সব জেনে শুনেও নিজের মনে জায়গা দিয়েছো আমায়। এতে আমার কোনো দোষ নেই। তাও স্যরি বলছি। স্যরি আমি!”
সিনথিয়া মলিন হেসে তাকালো,
“স্যরি বলার দরকার নেই। দোষ আমার। জানতাম তো তুমি নোয়ানারই থাকবে, তাও…”
কথা শেষ না করে দুই পাশে মাথা নাড়তে নাড়তে আষাঢ়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো সিনথিয়া। ব্যাগের চেন টেনে দিয়ে পিঠে নিলো ব্যাগটা। লাগেজ নামালো খাট থেকে। লাগেজ হাতে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে আবার থামলো। পিছন ফিরে আষাঢ়ের শ্যাম বর্ণের মুখটা দেখলো ভালো করে।
আষাঢ় বললো,
“তাকিয়ে থেকো না এরকম।”
“শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছি। বাধা দেওয়ার অধিকার তোমার নেই।”
“এরকম করে বলো না, নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।”
সিনথিয়া প্রত্যুত্তরে বিষণ্ন হাসলো।
“তোমার বিয়েতে দাওয়াত দিয়ো।” বললো আষাঢ়।
“তোমার বিয়ে না খেয়ে চলে যাচ্ছি, আমার বিয়েতে এমন করে দাওয়াত চাইতে পারো কী করে? তোমার তো লজ্জা নেই।”
আষাঢ় হেসে ফেললো। হাসিটা প্রাণবন্ত নয়। বললো,
“এই নির্লজ্জটাকে মনে রেখে শুধু শুধু নিজের মনকে কষ্ট দেবে না, বুঝেছো?”
সিনথিয়া কিছু বললো না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, এগিয়ে এসে আষাঢ়ের ডান হাত হাতে তুলে নিলো। আষাঢ়ের হাতে ওষ্ঠ্য স্পর্শ করে চোখে চোখ রেখে বললো,
“সেদিন যখন সকলের সামনে নোয়ানাকে বিয়ে করবে বলেছিলে, সেদিন রুমে এসে কেঁদেছিলাম আমি। আমি কিন্তু সহজে কাঁদি না।”
বলে তাকিয়ে রইল আষাঢ়ের চোখে। সিনথিয়ার ছলছল চোখ থেকে আষাঢ়ের দৃষ্টি নড়লো না। প্রথমে চোখ সিনথিয়াই সরিয়ে নিলো। আর এক দণ্ড দাঁড়ালো না এখানে। দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করলো।
আষাঢ় দাঁড়িয়ে রইল বিমূঢ় হয়ে। কিছুক্ষণ যেন সিনথিয়ার কথাটার ভাবনাতেই পড়ে রইল। এরপর পা বাড়ালো জানালার দিকে। একটা বড়ো করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে একটা কথাই আওড়াতে লাগলো, তার কোনো দোষ নেই। সত্যিই তো দোষ নেই। সিনথিয়া তো আগে থেকেই সব জানতো। নোয়ানার বিষয়টার পাশাপাশি অগণিত গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারও তার অজানা ছিল না। আষাঢ় দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে।
মোবাইলে কল এলো এর মাঝে। এই সময়ে কে কল দিতে পারে? হবে লিন্ডা অথবা জেনির মাঝে কেউ। আষাঢ় একেবারেই গায়ে লাগালো না। মোবাইল পকেটেই পড়ে রইল। মনেতেই শান্তি নেই গার্লফ্রেন্ডদের সাথে কী কথা বলবে!
গার্লফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলা হচ্ছে না আজ বহুদিন হলো। এই যে কল দিয়ে পাচ্ছে না, সে রিসিভ করছে না কল, এতে গার্লফ্রেন্ডরা কী ভাববে সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সকল ভ্রুক্ষেপ হবে একেবারে বিয়ের পর। নিশ্চিন্ত মনে। আষাঢ় আবারও বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এতদিন সিনথিয়ার নামে থাকা রুম থেকে বের হলো।
_________________
ফজরের নামাজ পড়ে নোয়ানা আবার শুয়েছিল বিছানায়। কখন যেন চোখ লেগে আসায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙে সূর্য ততক্ষণে উদ্বেলমান। চোখ খুলেই আচমকা একটা মনুষ্যমুখ সামনে দেখতে পেয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল সে। কিন্তু চিৎকারের আগেই আষাঢ় তার মুখ চেপে ধরলো।
“শসস…চিৎকার করছো কেন? হবু বরকে দেখে চিৎকার করা আবার কোন ধরণের কাজ তোমার?”
নোয়ানা প্রথমে বুঝতে পারেনি এটা আষাঢ়। বেখেয়ালেই চিৎকার করে উঠছিল। আষাঢ়কে দেখে দারুণ বিরক্ত হলো। হাত সরিয়ে দিয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসলো। পাশে তাকালো। তিন্নি নেই। কখন ঘুম থেকে উঠলো?
“তিন্নি জুনের সাথে হাঁটতে বের হয়েছে।” শুধালো আষাঢ়।
নোয়ানা মুখ বিকৃত করে তাকালো। কাঠিন্য কণ্ঠে বললো,
“ভূতের মতো তাকিয়ে ছিলেন কেন আমার দিকে?”
“ভূত? কত মায়া নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম আমি, আর তুমি ভূ…”
“এখানে এসেছেন কীভাবে?” আষাঢ়ের কথার মাঝেই প্রশ্ন করলো নোয়ানা।
“কেন, তোমাদের বাড়িতে কি দরজার অভাব?”
“দরজা দিয়ে এসেছেন আপনি?”
“এলে সমস্যা কী?”
নোয়ানা কিছু বললো না, রাগে মুখ ফুলিয়ে রাখলো। আষাঢ় হেসে বললো,
“হবু জামাই, জামাই তো হয়ে যাইনি এ বাড়ির। যখন তখন তাই এ বাড়ির দরজা খোলা থাকবে না আমার জন্য। জানালা দিয়ে ঢুকেছি। জানালা তো খুলেই রেখেছে আমার উপকারী শালিকা।”
বলতে বলতে আষাঢ় বিশাল জানালাটা দেখিয়ে দিলো।
নোয়ানা বিদ্রুপ কণ্ঠে বললো,
“আগে গেট টপকে ঢোকা হতো আমাদের বাড়ি, আর এখন জানালা টপকে সোজা রুমের ভিতর ঢুকে যাচ্ছেন! চোরের খাতায় নাম লেখালে ভালো করতে পারবেন।”
“ছি, নিজের হবু বরকে চোরের খাতায় নাম লেখাতে বলছো? কেমন হবু বউ তুমি?”
“এই ‘হবু বর’ আর ‘হবু বউ’ কথা দুটো ফের আর বলবেন না, বিরক্ত লাগে শুনতে।”
“আমার তো লাগে না।”
“কিন্তু আমার লাগে। বলবেন না আর।”
আষাঢ় আচমকা নোয়ানার এক হাত ধরে টান দিয়ে সামান্য নিকটে নিয়ে এসে বললো,
“তাহলে কী বলবো? প্রেমিক পুরুষ হিমেলের প্রকৃত প্রেম?”
নোয়ানার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো।
আষাঢ় হঠাৎ নোয়ানার চোখে থমকে গিয়ে আঁতকে ওঠার মতো করে বললো,
“এটা কি টিউলিপ? তুমি কি চোখ দিয়ে আমাকে ভৎস করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছো?”
“পাগল!” বিরক্ত জড়ানো কণ্ঠে বললো নোয়ানা।
আষাঢ় হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“যাচ্ছি। জানি চাইছো যাতে আরও কিছুক্ষণ থাকি এখানে, কিন্তু সম্ভব না। আমার কাজ আছে।”
কথাটা বলে আষাঢ় কাছে এসে হঠাৎ ঝুঁকে পড়লো নোয়ানার দিকে।
নোয়ানা আঁতকে উঠে দূরে সরে গিয়ে বললো,
“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?”
“আংটি পরানোর পর হাতে একটা চুমু খাওয়া আবশ্যক, জানো না?”
“আংটি?”
প্রশ্ন করে হাতের দিকে তাকালো নোয়ানা। অনামিকায় একটা আংটি নিজের উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। শুনতে পেল আষাঢ়ের কথা,
“একটু বেশি দেরি করেই পরালাম। আসলে এমন ভাবেই চাইছিলাম পরাতে, যখন তুমি ঘুমিয়ে থাকবে। এমন করে কাউকে পরাতে দেখেছিলাম বোধহয়। মনে পড়ছে না। তুমি কি জানো এমন করে কে পরিয়েছিল নিজের প্রিয়তমার হাতে আংটি?”
নোয়ানা আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“জানি না। তবে আজ জানলাম। প্রেমিক পুরুষ হিমেল ইসলাম আমার হাতে আংটি পরিয়ে দিয়েছে, যখন আমি ঘুমাচ্ছিলাম।”
আষাঢ় হেসে বললো,
“অভিনয়ের খোলস তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছে বোধহয়।”
বলে জানালা দিয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবে চলে গেল।
নোয়ানা হাতের আংটিটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সেই রাতটার কথা মনে পড়লো। যেদিন আষাঢ় প্রথম আংটি পরিয়েছিল তার হাতে। নোয়ানা মনে মনে বললো,
“আপনার সাথে দেখা হওয়াটা এখন আর ভুল মনে হয় না হিমেল।”
________________
মিহিক গুনগুন করে গান গেয়ে ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শ্রাবণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছে ওকে। মিহিকের পরনে জলপাই রঙের একটা শাড়ি। সন্ধ্যা বেলায় হুট করে শাড়ি পড়েছে সে। আগে থ্রি পিস পরা ছিল। শ্রাবণের বিরক্ত লাগছে মিহিকের চুলগুলো। চুলগুলো খুলে রেখেছে। কেমন পাগল পাগল লাগছে শ্রাবণের কাছে। অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ থেকে বললো,
“চুল খোলা রেখে যে এরকম হাঁটছেন, ভূতেরা বাসা বাঁধবে তো আপনার চুলে।”
মিহিক হাঁটতে হাঁটতে একবার তাকালো শ্রাবণের দিকে। হাসলো। চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে বললো,
“ভূতেরা বাসা বাঁধলে আপনি ওদের পিটিয়ে বাসা ছাড়া করবেন। পারবেন না?”
শ্রাবণ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো,
“একদমই পারবো না। আপনার জন্য শুধু শুধু ভূতের সাথে শত্রুতা করবো কেন?”
মিহিক তেড়ে এলো শ্রাবণের দিকে,
“পারবেন না? ঘাড় মটকে দেবো আপনার।”
“মনে তো হচ্ছে ভূত আপনার চুলে নয়, আপনার মাথায় বাসা বেঁধেছে।”
“কী বললেন?”
“কাল বাদে পরশু আপনার বোন আর দেবরের বিয়ে, আজকে দিনেই আপনাকে ভূতে ধরতে হলো! ভূতেরা বোধহয় আপনার মাধ্যমে বিয়ে এনজয় করতে চাইছে।”
“আপনি আমার রাগ বাড়াবেন না।”
“বাড়ালে কী হবে?”
“তুই-তোকারি শুরু করবো।”
“তাহলে মুখ সেলাই করে দেবো।”
“এত বড়ো সাহস?”
“সাহসের কী দেখেছেন?”
“আপনার সাহস দেখতেও চাই না আমি। রুমকি আজ এসেছে না বাবার বাড়িতে? ওর কাছে গিয়ে সাহস দেখান।”
“কথার মাঝে রুমকিকে টানার অভ্যাসটা পাল্টান। ভালো লাগে না এটা।”
মিহিক ভেংচি কেটে দূরে সরে পড়লো।
শ্রাবণের মেজাজে পরিবর্তনের আভা লেগেছে। গুমোট একটা ভাব জমলো। খবর পেয়েছিল আজ বিকেলে, রুমকি না কি বাড়িতে এসেছে স্বামী নিয়ে। খবরটা রুপালি দিয়েছিল। শ্রাবণ চায় রুমকির সাথে তার আর একটা সেকেন্ডের জন্যও দেখা না হোক কখনও। শ্রাবণ আর ছাদে থাকতে পারলো না। নেমে এলো ছাদ থেকে। করিডোরে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল লিভিং রুমে কী যেন আলোচনা চলছে মা আর বাবার মধ্যে। রুপালিও আছে সাথে। বিয়ে সংক্রান্তই আলোচনা হবে। শ্রাবণ রুমে ঢুকে গেল। তার হাতে আপাতত কোনো কাজ নেই। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। হঠাৎ বেড সাইড টেবিলের উপর ফোনটা বেজে উঠলো। শ্রাবণ হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা আনলো। আননোন নাম্বার দেখে কুঁচকে উঠলো ভ্রু। তার কাছে খুব একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে না। শ্রাবণ কল রিসিভ করবে না ভাবলো। কিন্তু কী ভেবেই আবার রিসিভ করে ফেললো।
“হ্যালো!”
“কেমন আছো?”
পরিচিত কণ্ঠটা চিনতে শ্রাবণের খুব একটা কষ্ট হলো না। এই কণ্ঠ তার পরিচিত। মধ্য থেকে অনেকদিন না শোনায় মরীচিকা ধরেছে আর কী! শ্রাবণের মনে ক্রোধের একটা নহল ক্রমশ উন্মোচিত হতে লাগলো। সে চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিলো,
“ভালো আছি।”
“মনে আছে আমায়? আমি তো ভেবেছিলাম বউয়ের প্রেমে দিওয়ানা হয়ে আমাকে ভুলে যাবে।”
“ভুলেই গিয়েছি। চিনি না।”
শ্রাবণ কথাটা বলেই কল কেটে দিলো। সাথে সাথে নাম্বারটা এড করলো ব্লকলিস্টে। ক্ষণকাল তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে রইল। এতদিন পর আবার সেই মানুষটার সাথে কথা হলো তার, যাকে কি না প্রথম প্রেম বলে জানতো। হুহ, এটা রুমকি ছিল!
(চলবে)