#বিবর্ণ_জলধর,পর্ব: ৪৪(শেষ পর্ব)
#লেখা: ইফরাত মিলি
আষাঢ় বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলছে বারংবার। নতুন বউ নিয়ে কোথায় ঘুরে বেড়াবে রাঙামাটির এ কোণা থেকে ও কোণা, তা না, এখন অলিন্দের এক কোণাতে বসে আছে। পুরো দিনটাই মনে হচ্ছে মাটি করে দেবে এই বৃষ্টি।
আষাঢ়’রা এই মুহূর্তে আছে রাঙামাটির এক হোটেলে। হানিমুনে এসেছে তারা। শুধু সে আর নোয়ানা আসেনি। শ্রাবণ, মিহিক, কারিব, রুপালি, জুন, তিন্নি এরাও এসেছে। শ্রাবণ আর মিহিকেরও তো বিয়ের পর কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। কবির সাহেব তাই আষাঢ় আর নোয়ানার সাথে সাথে ওদেরও পাঠিয়েছে। বাকিরাও এসেছে ঘুরতে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে সকলেরই ঘোরাঘুরি বন্ধ এই মুহূর্তে। এখন ঘড়িতে সকাল দশটা বাজে। বাকিদের খবর জানে না আষাঢ়। একসাথে আছে শুধু সে আর নোয়ানা। বাকিরা কোথায় তা তার অজানা। সবার রুমও এক ফ্লোরে পড়েনি। সে এবং নোয়ানা আছে সেকেন্ড ফ্লোরে। শ্রাবণ-মিহিক এবং জুন- তিন্নি-রুপালি এরা পড়েছে থার্ড ফ্লোরে। আর কারিব একা পড়েছে ফার্স্ট ফ্লোরে। রুম নিয়ে কী এক বাড়তি ঝামেলা!
আষাঢ়ের চোখ নোয়ানার উপর পড়লো। অলিন্দের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নোয়ানা। হাত বাড়িয়ে আছে বৃষ্টির মাঝে। মেয়েদের কেন বৃষ্টি এত প্রিয় হয়? আষাঢ় আজও বুঝলো বিষয়টা। তার পাঁচ স্থায়ী গার্লফ্রেন্ডদেরও বৃষ্টি খুব প্রিয়। যদিও সেই পাঁচজন এখন আর তার গার্লফ্রেন্ড নেই।
নোয়ানাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখতে আষাঢ়ের ভালো লাগছে না। সে সাবধান করলো ওকে,
“ভিজে যাচ্ছ টিউলিপ, জ্বর আসবে। এদিকে এসো। ভিজো না।”
নোয়ানা একবার তাকালো, আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে হঠাৎ হাতে বৃষ্টির জমে থাকা পানি ছুঁড়ে মারলো আষাঢ়ের দিকে। পানি আষাঢ়ের মুখে গিয়ে ছিটকে পড়লো।
আষাঢ় চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে। বিরক্তিতে কুঁচকানো ভাবটা অতি প্রখর। নোয়ানা মুচকি হাসতে লাগলো আষাঢ়কে দেখে। আষাঢ় হাত দিয়ে পানি মুছে নিতে নিতে আপন মনে উচ্চারণ করলো,
“ডিসগাস্টিং…ডিসগাস্টিং!”
“ছাদে বৃষ্টি বিলাস করতে যাবেন হিমেল?” প্রশ্নটা হঠাৎ করলো নোয়ানা।
আষাঢ় কণ্ঠের বিরক্তি গোপন না করেই বললো,
“বৃষ্টি আমি পছন্দ করি না! যা পছন্দ করি না তা উপভোগ করার জন্য ছাদে যাব ভাবলে কী করে?”
নোয়ানার মুখ কালো হয়ে এলো স্বামীর প্রত্যুত্তর শুনে। আষাঢ় তা লক্ষ্য করে বললো,
“ছাদে যে এখন তোমার বোন-দুলাভাই নেই এর কোনো নিশ্চয়তা আছে? বাইনোকুলারটা সাথে থাকলে এখন এখান থেকে ছাদে উঁকি মেরে দেখতাম।”
“তারা এখন ছাদে?”
“জানি না। ধারণা করলাম। থাকার সম্ভাবনা আছে।”
নোয়ানা চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার হাত বাড়ালো বৃষ্টি ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে। পিছনে আষাঢ়ের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“উহ, ভালো লাগছে না। কখন থামবে এই বৃষ্টি? নিজের বউকে নিয়ে কি বাইরে ঘুরতে যাব না আমি? ঘরের ভিতর বসে থাকবো? কারিব কোথায়? একটা ছাতা প্রয়োজন আমার।”
বলতে বলতে আষাঢ় তাৎক্ষণিক কারিবের নাম্বারে ডায়াল করলো। কয়েকবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো।
“কোথায় তুমি? আমার জন্য একটা ছাতা কিনে নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি।”
“আষাঢ় ভাই, আমরা নিজেরাই ছাতাবিহীন বৃষ্টির কারণে মার্কেটে আটকা পড়েছি।” অসহায় শোনালো কারিবের গলা।
আষাঢ় কপালে ঈষৎ ভাঁজ ফেলে বললো,
“মার্কেটে আটকা পড়েছো? এই সকাল বেলা কোন মার্কেটে গিয়েছো? কারা আছে তোমার সাথে?”
“জুন, তিন্নি আর রূপ খালা আছে সাথে। স্থানীয় আদিবাসীদের হাতে বোনা শাল এবং আরও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনতে এসেছে তারা। এর মাঝেই বৃষ্টি শুরু হলো।”
আষাঢ় ছোট করে উচ্চারণ করলো,
“ওহ…”
একটু পর বললো,
“ঠিক আছে হোটেলে ফিরলে দেখা করো আমার সাথে।”
আষাঢ় কল কেটে দিয়ে নোয়ানাকে বললো,
“তোমার বোন-দুলাভাই বোধহয় ছাদেই প্রেম করছে।”
“করবেই তো প্রেম। আপনার মতো তো আর তাদের বৃষ্টি অপছন্দ নয়।”
আষাঢ় চেয়ার ছেড়ে নোয়ানার পাশে এসে দাঁড়ালো। প্রশ্ন করলো,
“তোমার বৃষ্টি খুব পছন্দ?”
“খুব নয়, তবে আমি পছন্দ করি।”
“পছন্দ হলে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার তো এখন কর্টইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি বিলাস করা উচিত।”
বলে আচমকাই নোয়ানাকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো।
নোয়ানা বিস্ময়ে বলে উঠলো,
“এটা কী করছেন?”
“এখান থেকে কর্টইয়ার্ডে ফেলে দিই তোমায়। ভাঙা হাত-পা নিয়ে মনের সুখে বৃষ্টি বিলাস করো। ফেলে দিই?”
আষাঢ় রেলিংয়ের দিকে একটু এগোলেই নোয়ানা বললো,
“এই না…”
আষাঢ় হাসলো। নোয়ানা কঠিন গলায় বললো,
“ছাড়ুন, এরকম মজা ভালো লাগে না আমার। ভয় লাগে।”
আষাঢ় নামিয়ে দিলো নোয়ানাকে। নোয়ানা আষাঢ়ের পেট বরাবর আস্তে একটা ঘুষি মেরে রুমে চলে গেল। আষাঢ় ঘুষি মারা স্থানটা হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো,
“হাসব্যান্ডকে মেরেছো তুমি। তোমার নামে কেস করলে দু বছরের আগে ছাড়া পাবে না জেল থেকে।”
নোয়ানা রুমের ভিতর থেকে জবাব দিলো,
“স্ত্রীর সাথে বৃষ্টি বিলাস করতে ছাদে যাননি আপনি, আপনার নামে কেস করলে দশ বছরের আগে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আশা করতে হতো না।”
“তুমি কি অভিমান করেছো টিউলিপ?”
“রাগ করেছি।”
“আমার উপর কেন রাগ করবে? দোষটা কি আমার? দোষটা তো তোমার বোনের আর আমার ভাইয়ের। তারা দুজন আমাদের আগে ছাদটা প্রেম করার জন্য বুকিং করে ফেলেছে। এখন কি আমরা গিয়ে তাদের প্রেমের মাঝে ঢুকতে পারি? বড়োদের সাথে অন্যায় করা হয়ে যায় না তাহলে?”
“আপনার মুখ বন্ধ রাখুন হিমেল। শুনতে ভালো লাগছে না। আর আমার বোনের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে। সুতরাং সে এখন ছাদে নেই। আন্দাজের উপর কথা বলা বন্ধ করুন।”
আষাঢ় চুপ হয়ে গেল। বিয়ের পরও মেয়েটা একটু শুধরালো না। এখনও কঠিন আচরণ করে তার সাথে!
________________
“আপনাদের বাড়ির সব ছেলেরাই তো বিয়ে করে ফেলেছে মি. কারিব। আপনি বিয়ে-সাদি করবেন কবে?”
কারিব বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছিল, হঠাৎই তিন্নির প্রশ্নটা কানে এলো। সে দৃষ্টি নিয়ে এলো তিন্নির উপর। প্রশ্নটায় একটু বোকা বনে গেছে সে। তিন্নির পাশে বসা জুন ও রুপালির দিকে তাকালো একবার। সে কিছু বলার আগে তিন্নিই আবার বললো,
“আপনার আশপাশে তো মেয়ে আছে, একটু বিবেচনা করে দেখলেই পারেন। আপনাদের বাড়ির দুই ছেলেই তো আমাদের বাড়ি থেকে মেয়ে নিয়েছে। আপনার কি আমাদের বাড়িটা চোখে পড়ে না?”
তিন্নির কথায় কারিবের ভাবনা চিন্তা সব কেমন গুলিয়ে উঠছে। তিন্নির কথায় কেমন অস্বাভাবিক একটা গন্ধ পাচ্ছে সে। মেয়েটা ঠিক কি বলতে চাইছে? কারিবের ভিতরটা ক্রমশ জড়ো-সড়ো হয়ে আসছে।
তিন্নি বললো,
“মি. কারিব, আপনি কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে পারেন। যেহেতু আপনাদের বাড়ির ছেলেরা আমাদের বাড়ি থেকে দুই দুইটা মেয়ে নিয়েছে, সেহেতু আপনার অন্য কোথাও বিয়ে করাটা ঠিক বেমানান দেখায়। আপনারও ওনাদের মতো আমাদের বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করা উচিত। মানে আমাকে। যদি আপনার মনে হয় আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান, তাহলে বলতে পারেন। আমার কিন্তু কোনো আপত্তি নেই।”
বলে তিন্নি মুখ টিপে হাসলো। তার পাশাপাশি জুন আর রুপালিও হাসছে। তাদের দুজনের হাসির মাত্রা একটু বেশি।
কারিব হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। লজ্জায় মুখখানি একটুখানি হয়ে আছে। মনে পড়লো আষাঢ়ের বলা কথা। আষাঢ় অনেক দিন আগে একদিন কথায় কথায় বলেছিল,
‘ওই বাড়ির মেয়েরা খুব সাংঘাতিক কারিব। আমার আর ব্রোর কোনো উপায় নেই এই সাংঘাতিক মেয়েদের জীবন থেকে সরিয়ে ফেলার। কারণ, আমরা তাদের ভালোবাসি। কিন্তু তুমি প্লিজ এই ভুলটা করো না। ভুল করেও ওই তিন্নির প্রেমে পড়ো না তুমি।’
আষাঢ়ের কথাটার চিরন্তন সত্য ভাব আজ উপলব্ধি করতে পারলো কারিব। মিহিক আর নোয়ানা কীসের সাংঘাতিক? মিহিক কি জীবনে এমন একটা কথা বলতে পারতো? আর নোয়ানা তো এমন কথা মুখেই আনত না। কিন্তু এই তিন্নি…সবচেয়ে সাংঘাতিক মেয়ে তো এই তিন্নি!
কারিব পারলে এই মুহূর্তে বৃষ্টির মাঝ দিয়েই দৌঁড়ে হোটেলে চলে যায়। ইশ, এটা কেমন ধরণের কথা বললো মেয়েটা! লজ্জা, বিরক্তি, রাগ তিনটাই যেন পেয়ে বসলো কারিবকে। সে কাঁচুমাচু হয়ে বসে রইল।
হঠাৎ তিন্নির অট্টহাসির শব্দ শুনতে পেয়ে তাকালো।
কারিব তাকাতেই তিন্নি বললো,
“আমি তো মজা করছিলাম। সিরিয়াসলি নিলেন না কি?”
এ কথায় কারিব আরও বিব্রতকর অবস্থায় পড়লো। সত্যি এই বৃষ্টি তোয়াক্কা না করে তার দৌঁড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। সে আর বসলোই না এখানে, বসা থেকে উঠে অন্য দিকে চলে গেল। এই বৃষ্টি যে কখন থামবে কে জানে?
____________
শ্রাবণ এইমাত্র ঘুম থেকে জাগ্রত হলো। ঘুম থেকে উঠে আবারও ঘুমিয়েছিল। মেঘলা মেঘলা পরিবেশ দেখেই ঘুম ঘুম পাচ্ছিল তার। ঘুম থেকে উঠে আলহামদুলিল্লাহ এখন বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু রুমে মিহিককে দেখতে পাচ্ছে না। অন্যদের সাথে আছে? শ্রাবণ কল দিলো। কিন্তু মিহিকের মোবাইল রুমের ভিতরেই বেজে উঠলো। এই বিষয়টাতে সে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। মোবাইল যেখানে-সেখানে ফেলে রেখে কেন বাইরে যাবে? সাথে নেওয়া যায় না মোবাইলটা?
অতঃপর সে কল দিলো আষাঢ়ের কাছে। জানতে পারলো মিহিক ওদের সাথে নেই। কারিব, জুন, তিন্নি, রুপালি কোন মার্কেটে গিয়ে যেন আটকা পড়েছে। তাদের সাথেও মিহিক নেই। শ্রাবণ একটু দুশ্চিন্তায় পড়লো। এই বৃষ্টির মাঝে মিহিক কোথায় গেল? রুম থেকে বের হয়ে এদিক-ওদিক একটু খোঁজ চালালো। মিহিককে পেল না। শ্রাবণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। অকস্মাৎ ছাদের কথা মনে এলো। ছাদে থাকার সম্ভাবনা আছে মিহিকের? শ্রাবণ ব্যস্ত হয়ে ছাদে ছুটলো। ছাদে গিয়ে তার দুশ্চিন্তা কেটে গেল। মিহিককে পেয়েছে। তবে শ্রাবণ অবাক। মিহিক বৃষ্টিতে ভিজছে! বৃষ্টিতে ভিজলে না কি ওনার জ্বর আসে? একদিন একটুখানি বৃষ্টিতে ভিজে তার সাথে রাগ দেখিয়েছিল, সারাদিন-রাত শাল জড়িয়ে হেঁটেছিল, থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মেপেছিল অনেক বার। আর আজ ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছে, আজ কিছু হচ্ছে না? শ্রাবণ এ বিষয় নিয়ে কিছু বলবে না ঠিক করলো। কিছু বললে হয়তো মেয়েটা নিজের রুড আচরণ দেখাতে শুরু করবে। ঘুরতে এসে মুড খারাপ করার ইচ্ছা নেই। শ্রাবণ বৃষ্টির মাঝে রুফটপে পা রাখলো। মিহিক রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। সে পিছন থেকে মিহিককে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আপনার প্রথম হানিমুন কেমন লাগছে মিহিক?”
হঠাৎ কারো সংস্পর্শে এসে মিহিক প্রথমে চমকে গিয়েছিল। যখন বুঝলো প্রিয় স্বামী এসেছে, বললো,
“প্রথম হানিমুন মানে? আপনি কি আমাকে আবার বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন? যে
আমি অন্য স্বামীদের সাথে দ্বিতীয়, তৃতীয় হানিমুনে আসবো।”
“ছি, এমন কথা মুখে আনতে পারলেন? আমি আপনাকে আবার বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করবো কেন? আপনি তো আমার বউ। নিজের বউকে স্বামী কখনও অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়েছে শুনেছেন? আর আপনি কাউকে বিয়ে করতে চাইলেও তো সেটা হতে দেবো না আমি, হাত-পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো তাহলে আপনাকে।”
মিহিক হাসলো।
“ছাড়ুন।”
“না।”
“আমরা এখন ছাদে আছি। কেউ হুট করে এসে পড়লে খুব লজ্জা পাবেন তখন।”
শ্রাবণ ছাড়লো না, আরও ভালো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আপনার না বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে? কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন বৃষ্টিতে?”
“বেশিক্ষণ হয়নি।”
“বৃষ্টির মাঝে এই অচেনা পরিবেশে একা একা ছাদে আসলেন কেন? এটা কিন্তু মোটেই ঠিক করেননি। আপনার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হলে আমাকে ডেকে আনতেন।”
“স্ত্রীর প্রতি কি কেয়ারিং দেখাচ্ছেন?”
“কেয়ারিং, দায়িত্ব, ভয় যা খুশি মনে করতেন পারেন। আর কখনও একা একা কোথাও যাবেন না।”
“আচ্ছা।”
“আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি মিহিক।”
মিহিক অবাকপূর্ণ কণ্ঠে বললো,
“কী কথা?”
“গত পরশু রুমকির সাথে দেখা হয়েছিল আমার।”
মিহিক কথাটা শোনা মাত্রই শ্রাবণের হাত সরিয়ে দিয়ে তার দিকে ফিরে বললো,
“কেন দেখা করেছেন আপনি রুমকির সাথে?”
“আমি তো দেখা করিনি। দেখা হয়ে গিয়েছিল। এক ফ্রেন্ডের সাথে কফিশপে গিয়েছিলাম, সেখানে দেখা। ওর হাসব্যান্ডও সাথে ছিল।”
“কথা বলেছেন?”
“জিজ্ঞেস করেছিল কেমন আছি। উত্তর না দিলে বেয়াদবি হয়ে যায় না? ওর হাসব্যান্ডও তো ওর সাথে ছিল, সে কী ভাবতো?”
“হুম, বুঝেছি। তো এটা আবার আমাকে বলার কী আছে?”
“টুকটাক ব্যাপারগুলোও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে শেয়ার করা ভালো। কোনো কিছুই গোপন থাকা উচিত নয়।”
“কোত্থেকে শিখেছেন এই টিপস?”
“নিজেরই মনে হলো এটা।”
“তো আরও আগে বলেননি কেন? পরশু দিনের ঘটনা আজ কেন বললেন?”
“বলতে কেমন যেন লাগছিল।”
“কেমন লাগছিল?”
“ঠিক জানি না।”
মিহিক আর কিছু বললো না।
শ্রাবণের হঠাৎই বিষয়টা খেয়াল হলো। আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলো,
“ওহ, আমার মোবাইল মিহিক!”
বলেই সে দৌঁড়ে ছাউনির নিচে চলে গেল। মিহিক চোখ সরু করে বিষয়টা দেখলো। দেখতে পেল শ্রাবণ পকেট থেকে মোবাইল বের করছে। মোবাইল এদিক-ওদিক উল্টে-পাল্টে কী যেন দেখলো খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ মিহিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি বলবেন না যে আমার পকেটে মোবাইল ছিল!”
“আজব তো! আপনার পকেটে মোবাইল আছে, কি নেই সেটা আমি কী করে বলবো? আমি কি আপনাকে বলেছিলাম বৃষ্টির মাঝে নামতে? মোবাইলটা পর্যন্ত খেয়াল রাখতে পারলেন না আপনি।”
মিহিকের কথায় যুক্তি খুঁজে পেল শ্রাবণ। হ্যাঁ, সেটাই তো, মিহিক কী করে জানবে তার পকেটে মোবাইল আছে, কি নেই? এ প্রসঙ্গে আর কিছু বলার না থাকায় বললো,
“অনেক বৃষ্টিতে ভিজেছেন, এবার রুমে চলুন।”
_________________
সাজেক! সাজেক শব্দটা নোয়ানার কাছে এক বিশেষ ভালো লাগার ছিল। অনেক আগেকার ইচ্ছা, সাজেক ভ্যালি ঘুরতে আসবে। অবশেষে ইচ্ছা পূরণ হলো। সাজেক আসার পথে আষাঢ় তাকে সাজেক সম্পর্কে এক গাদা ধারণা দিয়েছিল। চোখের দেখার কাছে ধারণাগুলো সব হালকা হয়ে গেছে। অথচ যখন শুনছিল তখন অনেক মনযোগ দিয়ে মুগ্ধতার সহিত শুনছিল। আসলে দেখার মুগ্ধতার কাছে শোনার মুগ্ধতা কিছুই নয়।
সাজেকে সর্বত্র মেঘ, পাহাড় আর সবুজ।
রুইলুই পাড়া থেকে ট্রেকিং করে কংলাক পাহাড়ে এসেছে ওরা। কংলাক সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া। এখানে আসার পথে মিজোরাম সীমান্তের বড়ো বড়ো পাহাড়, আদিবাসীদের জীবনযাপন এবং চারদিকে মেঘের আনাগোনা দেখেছে। যা এক দারুণ ভালো লাগার ছিল।
কংলাক পাহাড় চূড়ায় উঠতে হয়েছে পাথরখণ্ডের ভাঁজে ভাঁজে সরু পাহাড়ি পথে পা ফেলে। চূড়ায় ওঠার পথে নিচের দিকে তাকাতেই গা শিউরে উঠেছিল নোয়ানার। আর কারো এমন হয়েছে কি না জানে না। তবে সে ভয়ে আঁতকে উঠেছিল। আষাঢ় নোয়ানার আতঙ্ক ভাবটা বুঝতে পেরে হেসেছিল। বলেছিল,
“ভীতু মেয়ে!”
নোয়ানার খুব রাগ হয়েছিল তখন। কিন্তু কিছু বলেনি। বিপজ্জনক পথ মাড়িয়ে কংলাক পাড়ায় দাঁড়িয়ে নোয়ানা এতক্ষণের আতঙ্ক সব ভুলে গিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল কোনো এক স্বর্গরাজ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে। চারপাশের আকাশচুম্বী পাহাড়ে সবুজ বনানীর বুকে সাদা মেঘের ছুটে চলা কতই না মুগ্ধকর! লুসাই পাহাড়ও দেখেছে। কংলাক পাহাড় থেকে কিছুটা দূরে তাকালেই লুসাই পাহাড় দেখা যায়। যেখান থেকে কর্ণফুলী নদী উৎপন্ন হয়েছে।
নোয়ানার বার বার বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, আজ যেন এক স্বপ্নরাজ্য দেখে এসেছে সে। সত্যি সত্যি স্বপ্নরাজ্যের মতোই ছিল সবকিছু।
আষাঢ় অনেক ছবি-টবি তুলেছে কংলাক পাড়া থাকাকালীন। রিসোর্টে বসে সেসব ছবিই ঘাঁটছে এখন। নোয়ানা বসে আছে জানালার ধারে। আকাশের দিকে তাকিয়ে। আকাশ পরিষ্কার। নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। নোয়ানার আজ হঠাৎ নিজেকে একজন সুখী মানবী বলে মনে হচ্ছে। উপলব্ধিটা কয়েকদিন ধরেই একটু একটু করে জাগছিল মনে। আজ পুরোপুরিই জেগে উঠেছে। একটা নিশ্চিন্ত জীবনের মাঝ দিয়ে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে এখন। ভাবতে পারেনি কখনও এমন নিশ্চিন্ত একটা জীবনধারাও তার জীবনে আসবে। আষাঢ়ের ডাক আলতো করে কানে এলো,
“টিউলিপ!”
নোয়ানা তাকালো। ঠিক সেই সময়ই ক্যামেরায় ক্লিক করে শব্দটা হলো। আষাঢ় ছবি তুলেছে। নোয়ানা হেসে বললো,
“ক্যামেরা ভর্তি কি সব আমার ছবিই?”
“এতগুলো মানুষ নিয়ে ঘুরতে গেলাম, সেখানে শুধু আমার বউয়ের ছবি কি তোলা যায়? সবার ছবিই আছে। তবে আমার আর কারিবের ছবি খুব একটা দেখতে পাচ্ছি না। তোমাদের সবার ছবি তুলতে গিয়ে আমরা দুই হতভাগা একেবারে অবহেলায় পড়ে রইলাম।”
কথাটা বলে নিজেই একটুখানি হাসলো আষাঢ়। দরজায় টোকা পড়লো এরই মাঝে। সাথে সাথে রুপালির কথা শোনা গেল,
“তোমরা দুইজন কি ডিনার করতে যাবা না?”
আষাঢ় রুমে বসে উত্তর দিলো,
“আমাদের দুজনের খাবার কি তুমি একা খেতে পারবে দাদি? তাহলে যেতাম না।”
“ঢংয়ের কথা বইলো না আষাঢ়, তাড়াতাড়ি আসো।”
আষাঢ় নোয়ানার দিকে তাকিয়ে মজা করে বললো,
“বুঝলে টিউলিপ, রুপালি দাদি আমাদের হিংসা করছে। আসার পর থেকেই দেখছি সে খিটখিটে আচরণ করছে আমাদের সাথে। আসল কথা হলো আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর সে তো একলা। তাই হিংসা করছে আমাদের।”
রুপালি দরজার ওপাশে দাঁড়িয়েই মেজাজ দেখালো,
“হুনো আষাঢ়, মনে যা আসবে তাই বইলা দিবা না বউয়ের সামনে। আমার মাঝে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ নাই। আর কখন তোমার লগে আমি খিটখিটে আচরণ করলাম?”
“এইমাত্রও তো করলে।”
“এখন কথা বলার মুড নাই আমার। খাইতে আসো তাড়াতাড়ি।” রুপালি কোনো প্রকার কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। তবে যেতে যেতে মনে মনে আষাঢ়ের উদ্দেশ্যে ‘খচ্চর’ শব্দটা উচ্চারণ করতে ভুললো না।
ডিনারের পর বাড়িতে ফোন দিয়ে সবাই-ই মা-বাবার সাথে কথা বললো। বাবার সাথে কথা বলে ফোন রাখার একটু পরই আষাঢ়ের মোবাইলে কারিবের কল এলো। কল রিসিভ করে অপ্রত্যাশিত একটা খবর শুনলো। একটা মেয়ে কারিবের কাছে কল দিয়ে তার কথা জিজ্ঞেস করেছে। এমনটা কখনও হয়নি। কারিবের মোবাইলে এর আগে কখনও এমন কল আসেনি। আর এখন যখন সকল গার্লফ্রেন্ড বিষয় স্টপ এমন সময় এটা ঘটলো। খবরটা পাওয়ার পরই আষাঢ় ব্যস্ত হয়ে ছুটেছে কারিবের রুমে। কিছুক্ষণ এ নিয়ে ঝামেলায় ছিল। মেয়েটা কে সেটা বের করতে হয়েছে। মেয়েটা ময়মনসিংহের। মেয়েটার সাথে দেখা হওয়ার কথা থাকলেও কখনও দেখা হয়নি। আষাঢ় নিজেই মেয়েটার সাথে দেখা করেনি। ইচ্ছা ছিল না দেখা করার। মেয়েটার নাম আফরিন। মনে আছে সব। মেয়েটার নাম্বার ব্লক দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেছে।
আষাঢ় যেমনভাবে গিয়েছিল নোয়ানা তাতে চিন্তায় পড়েছিল। রুমে চিন্তিত মুখ নিয়ে বসেছিল সে। আষাঢ় ফিরলেই জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে?”
“কিছু হয়নি। এক অতি স্বল্প সাময়িক গার্লফ্রেন্ড কল দিয়েছিল কারিবের ফোনে। মেয়েটা ঠিক কে সেটা জানলাম, তারপর ব্লক দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে চলে এসেছি।”
নোয়ানা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল। আষাঢ় জিজ্ঞেস করলো,
“কী?”
“এ যাবৎ সব মিলিয়ে কতগুলো গার্লফ্রেন্ড ছিল আপনার?”
“জানি না।”
“ছি!”
“…’ছি’ কেন?”
“যে নিজের গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যাটাও জানে না সে কতটা খারাপ হতে পারে সেটাই ভাবছি।”
“এখন এসব ভেবে কোনো লাভ নেই। আর আমি মোটেও খারাপ নই।”
“নিজেকে নিজে খারাপ বলে এমন লোক খুব কম।”
“তার মানে তোমার ধারণা, আমি খারাপ?”
“আমি সেটা বলছি না।”
“বলার কিছু বাদও রাখোনি।”
ক্ষণিকের জন্য নীরবতা দেখা গেল। নীরবতা ভঙ্গ করে আষাঢ় বললো,
“চলো, রিসোর্টে বসার জন্য যে নাইস প্লেসটা আছে ওখানে যাই।”
“আমার ইচ্ছা নেই।”
আষাঢ় নোয়ানাকে হাত ধরে উঠিয়ে বললো,
“আমি বললে ইচ্ছা না থাকলেও ইচ্ছা তৈরি করে নিতে হবে।”
রিসোর্টের এদিকটায় বসার জন্য খুব সুন্দর ব্যবস্থা রেখেছে। জায়গাটা খুব সুন্দর। ওদিকে তাকালে পাহাড় দেখা যায়। রাতের বেলা দেখা সম্ভব না। আষাঢ় আর নোয়ানা জায়গাটা থেকে অনেক দূরেই থমকে দাঁড়ালো। বসার আসনে দুইজনকে বসা দেখা যাচ্ছে। ওটা যে শ্রাবণ আর মিহিক সেটা সহজেই বোঝা গেল। তারা দুজন কি প্রেম করছে এখানে?
নোয়ানা বললো,
“চলুন ফিরে যাই।”
বলে যাওয়ার জন্য পিছনে ঘুরলেই নোয়ানার হাতটা শক্ত করে টেনে ধরলো।
“কোথাও যাব না আমরা।”
“মানে?”
“যেখানেই যাই সেখানেই দেখি তোমার বোন-দুলাভাই প্রেম করার জন্য আগে থেকে জায়গাটা বুকিং করে রেখেছে। এটা তো মানা যায় না। আমাদেরও তো একটা অধিকার আছে।”
“মানে কী? কোথায় কোথায় দেখলেন তাদের? আমি তো দেখলাম না। আপনি এখন ডিস্টার্ব করবেন তাদের?”
“তারা ডিস্টার্ব ফিল করলে আমার কিছু করার নেই।”
আষাঢ় নোয়ানাকে জোর করে টেনে নিয়ে এলো শ্রাবণ, মিহিকের কাছে। আষাঢ় এসেই বললো,
“তোমরা দুজন কী শুরু করেছো? নিজেরা প্রেম করতে গিয়ে যে অন্যদের প্রেমে ডিস্টার্ব করছো সে দিকটা খেয়াল রাখছো না কেন?”
মিহিক শ্রাবণের কাঁধে মাথা রেখে বসে ছিল। মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে বললো,
“কী বলছো এসব?”
“এই জায়গাটা আমাদের।”
শ্রাবণ বললো,
“কী হয়েছে তোর? কীসের জায়গা তোর? কী বলছিস?”
“এই জায়গাটা পাঁচদিন আগে বুকিং দিয়ে রেখেছি আমি। অন্যের বুকিং করা জায়গায় এরকম বসে থাকতে পারো না তোমরা। এটা অন্যায়। তোমরা চলে যাও এখান থেকে।”
নোয়ানার মনে হলো আষাঢ় পাগল হয়ে গেছে। সে ডাকলো,
“হিমেল, এদিকে তাকান।”
আষাঢ় তাকালে বললো,
“ওদিকে আরও সুন্দর জায়গা আছে, আমরা সেখানে যেতে পারি। সেখানে চলুন।”
“কিন্তু…”
“চলুন।”
আষাঢ়কে মানানো গেল। নোয়ানার কঠিন মুখের সামনে সহজেই মানিয়ে গেল সে। মিহিক আর শ্রাবণের উদ্দেশ্যে বললো,
“ঠিক আছে, টিউলিপ বললো বলে জায়গাটা শুধু তোমাদের জন্য ছেড়ে দিলাম।”
শ্রাবণ হঠাৎ বললো,
“টিউলিপ কী? অনেক দিন শুনেছি এই টিউলিপ! এটা তো একটা ফুলের নাম।”
আষাঢ় হেসে বললো,
“ফুলের নাম কি মানুষের নাম হওয়া বারণ? নিজে কেন তাহলে বাংলা মাসের নাম নিয়ে বসে আছো?”
বলে হাসতে হাসতে রিসোর্টের অন্য এরিয়ায় চলে এলো। এখানে সুবাসিত ফুলের গাছ আছে। গন্ধরাজের সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসের সাথে। একটা বেঞ্চি আছে বসার জন্য। আষাঢ় সেখানে বসলো। নোয়ানা বসলো না। সে দাঁড়িয়ে দূরের একটা আদিবাসী মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা একা একা বসে আছে ওখানে। ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। নোয়ানার মনে হলো মেয়েটা লুসাই নৃ-গোষ্ঠীর। নোয়ানা এক ধ্যানে কেন যেন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর আষাঢ়ের কণ্ঠ স্বরে সেই ধ্যান ভাঙলো,
“হঠাৎই আমার সিনথিয়ার জন্য খারাপ লাগছে নোয়ানা।”
নোয়ানা আষাঢ়ের দিকে চাইলো। এই প্রথম যেন আষাঢ়ের মুখে কোনো মেয়ের সম্পর্কে শুনে খারাপ লাগলো তার। মুখটা কালো হয়ে এলো। বললো,
“সিনথিয়াকে বিয়ে করলেই পারতেন তাহলে!”
আষাঢ় মুচকি হেসে তাকালো।
“হেই টিউলিপ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। সিনথিয়াকে হিংসা করো না তুমি। ওকে হিংসা করা উচিত নয় তোমার। ও খুব ভালো মেয়ে ছিল। এমনিতে ও খুব চঞ্চল। লুকিয়ে-চুরিয়েও কোনো কথা বলতো না। যা বলার সামনা সামনি বলে দিতো। জানো তো, আমি ওকে সাইকো বলতাম। কিন্তু ওর মনটা একেবারে ফ্রেশ। ও চাইলে কিন্তু যাওয়ার আগে একটা সিনক্রিয়েট করতে পারতো। কিন্তু ও কোনো রকম সিনক্রিয়েট করেনি, কোনো রকম অভিনয়ও করেনি। বরংচ সবার আগে ঘটনাটা মেনে নিয়েছিল। ওকে আমি সব সময়ই একটা ভালো মেয়ের স্থানেই জায়গা দেবো। এ নিয়ে তুমি হিংসা করো না ওকে।”
“আমি হিংসা করছি না। আগেই বলেছিলাম, আমার মাঝে হিংসা নেই।”
“কিন্তু আমি হিংসার গন্ধ পাচ্ছি। চাইছিলাম চার বিয়ে পূর্ণ করবো জীবনে। তোমাকে তো বিয়ে করে নিয়েছি ইতোমধ্যে। এরপর সিনথিয়া যখন বাংলাদেশ আসবে তখন ওকে বিয়ে করবো। ভেরোনিকাকেই বা বাদ দেবো কেন? ভেরোনিকাকে বিয়ে করলে, এরপর আরও একটা ভালো, সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করবো। কিন্তু তুমি যে হিংসুটে, মনে হচ্ছে না যে সতিনদের সাথে মিলেমিশে খেতে পারবে। তোমার জন্য চার বিয়ে পূর্ণ করার ইচ্ছাকে শিরশ্ছেদ করতে হবে বোধহয়।”
নোয়ানা মুখ আরও গম্ভীর করে বললো,
“এরকম মজা আরও একদিন করেছিলেন, এরকম মজাও কিন্তু আমি পছন্দ করি না।”
“তুমি তো কিছুই পছন্দ করো না। আচ্ছা, আমাকে পছন্দ তো তোমার? মুখে এই স্বীকারোক্তি আজ পর্যন্ত শোনা হয়নি আমার। আজকে শুনতে চাই, আমাকে ঠিক কতটা পছন্দ করো এবং ভালোবাসো?”
নোয়ানা বেঞ্চির অবশিষ্ট অর্ধাংশে বসলো। আষাঢ়কে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো। চোখের কোলে জল জমলো হঠাৎ। হৃদয় নিংড়ানো কথাগুলো মুখে আওড়ালো,
“আপনাকে আমি আমার জীবনের কষ্টের মতো ভালোবাসি হিমেল। আমার জীবনে কষ্ট যতটা, আপনার জন্য ভালোবাসাও ঠিক ততটা। আমি চাইছি আমার হৃদয়ে আপনার স্থানটা আরও বৃহত্তর হোক। এটা বিস্তীর্ণ হয়ে কষ্টের পরিমাণকে ছাপিয়ে যাক। এটা আমার কষ্টগুলো হালকা করে দিক, ঝাপসা করে দিক। আমি চাইছি পনেরো বছর বয়সী সেই কিশোর মুখটা আরও স্পষ্ট এবং রঙিন হয়ে উঠুক আমার মানসপটে। বাকি বাজে স্মৃতি অস্পষ্ট এবং বিবর্ণ হয়ে যাক। ভালোবাসি আপনাকে, আর ওই বাজে কষ্টগুলোকে ঘৃণা করি। জিতটা কীসের হওয়া উচিত এখন? ভালোবাসার না কি কষ্টের?”
আষাঢ় নোয়ানার মাথায় চুমু খেয়ে বললো,
“একটি সুখী ভালোবাসার!”
(সমাপ্ত)