বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ উনবিংশ
মম_সাহা
নীলার পরিবারের সবাই চলে গেছে আজ পুরো একদিন হলো।সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর নীলা তৈরী হয়ে রঙদের সাথে ভার্সিটিতে যায়। সেখানে প্রতিদিনের মতন স্বাভাবিক কাটে। শুধু মাঝে শুভ্রম একবার কথা বলতে এসেছিলো নীলা এড়িয়ে গিয়েছে। নীলা বুঝতে পারে অহনের সাথে রঙের বেশ ভাব হয়েছে।এমনে সর্বক্ষণ অহন রঙের পিছু লেগে থাকলেও দুজন দুজনের বেশ খেয়াল রাখে।
নিজের আনমনেই হালকা হাসে নীলা।এর মাঝেই কলিং বেলের আওয়াজে ধ্যান ভাঙে। পড়ার টেবিল থেকে উঠে দরজা খুলে দেয়।
দরজার উপাশে বর্ণকে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে দেখে ভ্রু কুঁচকায় নীলা।নীলাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বর্ণ মুচকি হাসি দিয়ে বলল
-‘এত শীতে এই অসহায় ছেলেটাকে বাহিরে দাঁড় না করিয়ে ভিতরেও তো আসতে বলতে পারেন ম্যাডাম।’
নীলা নিজের বোকামি বুঝতে পেরে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। বর্ণ রুমে ঢুকে তার হাতে রাখা বক্স টা টেবিলের উপর রাখে।
বর্ণকে টেবিলের উপর বক্স রাখতে দেখে এগিয়ে আসে নীলা।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে
-‘আরে আন্টিরা না বাড়িতে নেই।বিকেলে কোন অনুষ্ঠানে গেলো তাহলে খাবার পেলেন কই?’
বর্ণ হাত ধুয়ে সোফায় বসতে বসতে বলল
-‘হ্যাঁ মা রান্না করে ফ্রীজে রেখে গেছিলো।এখন তো শীতকাল ঠান্ডা তরকারি খাওয়া অসম্ভব তাই মা আমাকে কল করে বলেছিলো বাসায় এসে খাবার গরম করে জেনো আপনাকে দেই।’
নীলা বর্ণ ও তার পরিবারের এত সুন্দর আচরণ দেখে মুগ্ধ হয়।নিজের মুগ্ধতা চেপে রেখে বলল
-‘আমি আরও ভাবছিলাম রান্না করবো আপনাদের জন্যও।’
বর্ণ হেসে বলল
-‘আপনার আর রান্না করার প্রয়োজন নেই তবে যদি এক কাপ কফি খেতে বলেন তাহলে আমি না করবো না।’
নীলা তড়িঘড়ি করে বলল
-‘আমি এখনই আনছি।’
নীলা কফি বানাতে চলে গেলো।বর্ণ পুরো ড্রয়িং রুম ঘুরে দেখতে লাগল।বেশ গুছানো দেখে ভালো লাগে বর্ণের।মেয়েটা এত গুছানো কখনই ছিলো না।আজিজুর রহমান বলেছিলো।সারা দিন দস্যিপনা করে কাটাতো।বাড়ি মাথায় উঠিয়ে রাখতো।বছর কয়েক যাবত হাজারো ঘটনা মেয়েটাকে নিস্তব্ধ করে দিয়েছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বর্ণ।সে চঞ্চল নীলাম্বরীকে দেখেনি।তবে সেই নীলাম্বরীর প্রেমেই সে পড়েছে।আজিজুর রহমান যখন তার ছোট মেয়েটার বর্ণনা দিচ্ছিলো তখনই সে কল্পনায় ঐ মেয়েটাকে নিজের মনের মণিকোঠায় ঠাঁই দিয়েছিলো।শেষে না পেরে সেই মানবীকে দেখতে চলে যায় তার বাড়িতে।কিন্তু দেখা আর হয় না।মানবীর পরিবর্তে বুক পকেটে লুকিয়ে মানবীর ছবি নিয়ে আসে।
এসব ভাবনার মাঝেই বর্ণের জন্য কফি নিয়ে হাজির হয় নীলা।বর্ণ হাসি দিয়ে নীলার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে আয়েশ করে বসলো।এখন শীতকালের মাঝামাঝি সময় তাই বেশ শীত পড়ে আর অবাক করা ব্যাপার হলো বৃষ্টিও হয় মাঝেমধ্যে। যেমন আজ হচ্ছে।
নীলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বর্ণ বলল
-‘দাঁড়িয়ে আছেন যে,বসুন।কফি খেতে খেতে আপনার সাথে কিছু কথা বলে নেই।’
নীলা বর্ণের কথা শুনে বর্ণের সামনের সোফায় গিয়ে বসলো।বর্ণ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল
-‘বাহ্ বেশ কফি বানান তো আপনি।বেশ খেতে হয়েছে।বৃষ্টির মধ্যে এমন একটা কফিরই অভাব বোধ করছিলাম।ধন্যবাদ।’
নীলা শুধু বর্ণের কথার পিঠে হাসি দিলো।আজও সে বাসায় একা আর তার সামনে একজন পরপুরুষ বসে আছে কিন্তু তার ভয় করছে না।যেখানে তার আপন মানুষ রাহাতকে এত ভয় পায় সে।পরক্ষণেই মনে পড়লো আপন বললেই কি সব আপন হয়ে যায়?
নীলাকে গভীর ভাবনায় মগ্ন থাকতে দেখে বর্ণ গলা পরিষ্কার করে বলল
-‘আচ্ছা নীলা রাহাতকে আপনি ভালোবাসতেন বা ভালোলাগতো মানলাম রাহাত তো আপনাকে তেমন নজরে দেখে না তাই না? তাহলে আপনার প্রতি ওনার এমন আচরণের কারণ কি?’
নীলা চুপ হয়ে থাকে।সে জানে বর্ণের কৌতূহল না মিটলে বর্ণ প্রশ্ন করবে।তাই সে ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল
-‘আসলে রাহাত ভাইয়া আমাকে ভীষণ অপছন্দ করেন তাই এমন করে।’
বর্ণ কফির কাপটা টেবিলে রাখে।তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘ঠিক আছে, একজন মানুষের আরেকজন মানুষকে অপছন্দ হতেই পারে তাই বলে এমন আচরণ করবে? সে যদি সামান্য কারণে আপনার সাথে এমন আচরণ করতে পারে তাহলে আপনার বোন বিয়ের পর সুখী থাকতে পারবে?’
নীলা চুপ করে থাকে।কি বা আর বলার আছে।তার হাত পা বাঁধা।অনেক কিছু করার থাকলেও সে কিছুই করতে পারবে না।
বর্ণ নীলাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল
-‘নীলা ভেবে দেখুন সবটা।আমার মনে হয় আপনার পুরো ব্যাপার টা পরিবারের মানুষকে জানানো উচিৎ।রাহাতের এসব ব্যবহারের কথা জানানো উচিৎ সবাইকে।’
নীলা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘এবার বিয়ে নিয়ে আবার এমন কিছু হলে আমার বোনটা যে মরে যাবে।’
বর্ণ নীলার কথায় অবাক হয়ে তাকায়। তারপর বিষ্ময়মিশ্রিত কন্ঠে বলল
-‘আবার এমন কিছু হলে মানে? আমি ঠিক বুঝি নি আপনার কথা।’
নীলা মাথা নিচু করে বলল
-‘আপুর এর আগেও একটা বিয়ে ভেঙে ছিলো।’
বর্ণ অবাক হয়ে বলে
-‘কেনো?’
নীলা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলল
-‘আমার কারণে।’
বর্ণ ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘আপনার কারণে মানে বুঝি নি।একটু পরিষ্কার করে বলেন।’
নীলা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগের কথা। আপু একটা ছেলেকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসতো।আর ছেলেটাও নাকি আপুকে বেশ ভালোবাসতো।তারপর আপু তাদের ভালোবাসার কথা আমাদের পরিবারের সবাইকে জানায়।তখন আমি সবে ঢাকা এসেছি অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে।বাবা জানালো বাড়ি যেতে হবে আপুর বিয়ের কথাবার্তার জন্য।
আমি বাড়ি গেলাম।সেদিন আপুকে ঐ ছেলের পরিবার দেখতে এলো।আমিও ঐ ছেলেকে প্রথম দেখলাম।আপুকে ওনারা পছন্দ করলেন।বিয়ের কথা পাঁকা হলো একমাস পর।এর দুদিন পরে আপু আমাকে নিয়ে গেলো ঘুরতে ওনার সাথে তার হবু স্বামীও ছিলেন।বেশ মজা করলাম।
এরকম আরও দু একবার ঘুরেছিলাম ওদের সাথে। তারপর সে ছেলে আমাকে প্রায়ই কল দিতো।প্রথম প্রথম নরমালি কথা বললেও পরে তার কথাবার্তা কেমন জেনো হতে লাগল।এরপর যত পারি তত তাকে ইগ্নোর করছিলাম।’
এত টুকু বলে থামল নীলা।বর্ণের জেনো পরের টুকু শোনার জন্য তড় সইছিলো না।সে সঙ্গে সঙ্গে বলল
-‘তারপর? তারপর কি হয়েছিলো?’
নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-‘তারপর আমি আমার আপুর সুখের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম নিজের অজান্তেই।
বিয়ের দু’দিন আগে ছেলে আমার বাড়ির লোককে জানালো সে আপুকে না আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে।আপু তার কেবল মাত্র মোহ ছিলো।আপুকে বিয়ে করবে না।বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে আমাকে করবে।
বিয়ের আর মাত্র দুদিন।আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভরপুর ছিলো।এমন ঘটনায় পুরো বাড়িতে ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছিলো।আমি থমকে গিয়ে ছিলাম।আপু এটা শোনার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।আপুর যখন জ্ঞান ফিরে ততক্ষণে সে মানসিক ভারসাম্যহীনে পরিণত হয়।সবটা আমার জন্য। আমি জানতামও না আমার অজান্তেই আমার আপুর এত বড় ক্ষতি আমি করে ফেলেছি।’
নীলা কান্নায় ভেঙে পড়ে।বর্ণ কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।বেশ কিছুক্ষণ পর নীলাকে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল
-‘নিরুপমাকে দেখে তো এমন মনে হয় না।তাহলে?’
নীলা হেঁচকি থামিয়ে বলে
-‘সে ঘটনার পর দীর্ঘ পাঁচমাস আপুর চিকিৎসা চলে।তাই আপু এখন ঠিক আছে।আসলে সে ঘটনা টা মানতে পারে নি।এত বড় বেঈমানীর স্বীকার হবে সে ভাবতে পারে নি। এরপর আত্মীয় স্বজন সবাই আমার গায়ে অলক্ষীর ট্যাগ লাগিয়ে দেয়।ছিঃ ছিঃ করে সবাই। আমি নাকি অপয়া।
কিন্তু তখন আমার সাপোর্ট হয়ে দাঁড়ায় আমার পরিবার।আমার বাবা-মা আমার বড় বাবা।এমনকি আমার মানসিক ভারসাম্যহীন আপুও।আপু তো ঠিক হয়ে যায়। সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। স্বাভাবিক হতে পারি নি আমি।খেয়াল করলাম ধীরে ধীরে চুপ হয়ে গেছি আমি।এরপর থেকে গুটিয়ে নিলাম নিজেকে।পরিবারের কেউ আমায় এ নিয়ে দোষ দেয় নি কিন্তু আমার দোষীর কাঠগাড়ায় আমি নিজেকে রেখেছি।আজও আমি দোষী।
যেখানে আপুর একটা বিয়ে ভাঙার দোষ আমার ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছি সেখানে আবারও আপুর আরেকটা বিয়ে আমি কীভাবে ভাঙতে দেই।আর এই বিয়েটা ভাঙার চেষ্টা করলে আরও বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে আমার আপুর।এত ধাক্কা নেওয়ার ক্ষমতাও আমার পরিবারের নেই।’
বর্ণ নির্বাক হয়ে যায়। তাহলে মেয়েটা এভাবেই তার চঞ্চলতা হারিয়ে ফেলেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।উঠে চলে যায় নিজের ফ্লাটে।
নীলার পুরোনো ক্ষত আবার তাজা হয়ে উঠে।নিজেকে পাগল মনে হয়। কীভাবে আপুর আবার ক্ষতি সে করবে।বিয়ে ভাঙলেও ক্ষতি বিয়েটা হলেও ক্ষতি। কি করবে সে?
চলবে