বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ একাদশ
মম_সাহা
আজ বেশ ভালোই আড্ডা দিয়েছে নীলারা।সাথে রঙও ছিলো।অহন একটু পর পর রঙকে পিচ্চি বলেছে আর রঙ মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। আজ শুভ্রমকে দেখে নি নীলা।শুভ্রম তাদের ইকোনমিকস ক্লাস নেই।আজ আসে নি। যাক এক হিসেবে ভালোই হয়েছে ওদের সামনে পড়তে হয় নি।আজ ক্লাশ দেরিতে শুরু হয়েছে সবার, তাই শেষও হয়েছে দেরিতে।
সবাই বের হয়ে যাচ্ছে।রঙ আর নীলা বের হবে এমন সময় নীলার ফোন আসে।সে রঙকে এগিয়ে যেতে বলে পিছে পিছে আসছিলো।
রঙ ফোন স্ক্রোল করে হাঁটছিল এমন সময় সে অনুভব করলো তার ওড়না কেউ টেনে ধরেছে।আৎকে উঠে রঙ।ওড়না টা বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে পিছু ঘুরে তাকায়। তারই ক্লাশমেট বদমাশ ছেলেটা তার ওড়না চেপে ধরেছে।সে আরও ভয় পেয়ে যায়। এই ছেলেটা প্রায়ই তার পিছে পরে থাকে।অসভ্যতা করে।আজ তো লিমিট ক্রস করে ফেলেছে।রঙ শক্ত কন্ঠে চোখ রাঙিয়ে ছেলেটাকে বলল
-‘ওড়না টা ছাড়ো।ভদ্রতা বজায় রেখে ভালোই ভালোই ওড়না টা ছেড়ে দেও।’
ছেলেটা ওড়নার মাথায় আরেকটু টান দেয়। রঙ ঘেমে গেছে।এই ছেলের অসভ্যতামির সীমা নেই।নীলা আপু টাও সাথে নেই।সে একা আরও ভয় পেয়ে যায়।চারপাশে ভার্সিটির ছেলেমেয়ে অনেক আছে কিন্তু কেউই কিছু বলছে না।ছেলেটার সাথে তার বন্ধু বান্ধবও আছে।
রঙ এবার ওড়নার মাথাটা ধরে কাপাঁকাপা কন্ঠে বলল
-‘প্লিজ ওড়না টা ছাড়ো অসভ্যতামো করো না।’
ছেলেটা বেশ মজা পেলো।হেসে বলল
-‘অসভ্যতামোর কি দেখলে রঙিন পাখি।তুমি আমার বুকের মাঝে বড্ড জ্বালাও। সামনাসামনি পাত্তা দেও না।তাই আজ পাত্তা পেতেই এসব করা।’
রঙ ভয় পেয়ে যায় ছেলেটা রঙের ওড়না জোড়ে টান দিবে এমন সময় পিছন থেকে কেউ একজন এসে ছেলেটার বাহু ধরে ঘুরিয়ে ঠাস করে চড় লাগিয়ে দেয়।
উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে যায়। রঙও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে নীলা আপু।সে তাড়াতাড়ি নীলার পাশে এসে দাঁড়ায়। কলেজে ঝামেলা হচ্ছে শুনে অহনেরাও ছুটে আসে।এসে নীলা আর রঙকে দেখে তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
নীলা চড় মারার পর ছেলেটাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। অবাক হয়েই বলে
-‘রাজ তুমি!’
হ্যাঁ রঙের ওড়না ধরেই রাজ টেনেছে।দুর্ভাগ্যবশত রাজ,দিয়া আর রঙ একই ক্লাশের।
রাজের প্রথমত চড় খেয়ে বেশ অবাক আর রাগ হয়েছে আর যখন চড় মারা ব্যাক্তিটা নীলা বের হলো তখন রাগ দশগুণ হলো।রাজ কিছু বলবে তার আগে দিয়াই নীলাকে এক হাতে ধাক্কা দিয়ে বলল
-‘হাউ ডেয়ার ইউ নীলা আপু?তোমার সাহস কি করে হয় রাজকে চড় মারার।ইউ থার্ড ক্লাশ গার্ল।’
নীলা দিয়ার আচরণে বেশ অবাক হলো।একটা মেয়ে হয়ে কিনা আরেকটা মেয়েকে অপমান করছে দেখেও কিছু বলছে না।নীলা ঘৃণা আসলো দিয়ার আচরণে।ঠাস করে দিয়াকেও চড় লাগিয়ে দিলো।
এতক্ষণে কলেজ ক্যাম্পাসে ভীড় জমে গেছে। শুভ্রমও কারো মাধ্যমে শুনেছে তার চাচাতো ভাইবোন বেয়াদবি করতে গিয়ে কারো হাতে চড় খেয়েছে।তাই সেও ছুটে এসেছে।কিন্তু এসে নীলাকে দেখে অবাক।
নীলা রাজের শার্টের কলার ধরে বেশ চিল্লিয়ে বলল
-‘তুমি মানুষ রাজ?তোমার সাথে তোমার নিজের বোনও তো দাঁড়িয়ে ছিলো এই কাজটা করার আগে নিজের বোনের দিকে তাকাতে,তোমার বোনের সাথে এমন করলে তোমার কেমন লাগতো ভাবতে তাহলে কখনোই এই কাজটা করার দুঃসাহস দেখাতে না।সেইম অন ইউ ম্যান। অবশ্য তোমারও বা দোষ কিসে তোমার সাথে তোমারই বোন এসব সাপোর্ট করে মেয়ে হয়ে তুমি তো ছেলেই।’
তারপর দিয়ার হাত শক্ত করে টেনে মাঝখানে এনে দাঁড় করিয়ে বলল
-‘এই যে তুমি,যে মেয়ে হয়েও আরেকটা মেয়েকে অসম্মান করেছিলে, এই তোমাকে চিনে রাখলো সবাই।কখনো উপরওয়ালা না করুক তোমার জামাটা কেও টেনে ধরলেও বাঁচানোর মানুষ পাবে না।কারণ সবাই দেখেছে ভরা ক্যাম্পাসে তুমিই এসব টানাটানি নিয়ে মজা করেছো।তার মানে তোমার কাছে এসব বেশ মজার কাজ।তুমি আমাকে থার্ড ক্লাশ গার্ল বললে না? আসলে থার্ড ক্লাশ গার্ল তো তুমি।থার্ড ক্লাশ মাইন্ড তোমার।ছিঃ।’
রাজ নীলাকে চোখ রাঙিয়ে আঙুল দেখিয়ে কিছু বলতে আসবে এর মাঝেই নীলা রাজের আঙুল টা হাতসহ মুচড়ে ধরলো।রাজ ব্যাথায় আহ্ করে উঠলো।
শুভ্রম রাজের পাশে এসে দাঁড়ালো কিন্তু কিছু বলার ভাষা পাচ্ছে না।কি ই বা বলবে।তার ভাইবোন যা লজ্জাজনক কাজ করেছে।সে মুখ দেখাবে কেমনে।আর তার উপর এই রণচণ্ডী নীলাকে দেখে আরও বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে।
বর্ণ আজ রঙকে নিতে এসেছিলো।ভেবেছিলো নীলার সান্নিধ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু কলেজ ক্যাম্পাসে ঝামেলা হচ্ছে দেখে ছুটে এসে দেখে তারই বোন,প্রেয়সীকে নিয়েই ঝামেলা চলছে।সে এগিয়ে এসে রঙকে জড়িয়ে ধরে।
শুভ্রম নীলাকে উদ্দেশ্য করে মাথা নিচু করে বলে
-‘ওদের হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি নীলাম্বরী। ওদের যথাসাধ্য শাস্তি আমি দিবো তুমি রাজের হাতটা ছেড়ে দেও।’
নীলা রাজের হাতটা দ্বিগুন শক্ত করে মুচড়ে ধরে শুভ্রমের দিকে রক্ত লাল চোখে তাকিয়ে বেশ জোড়ে বলল
-‘নারীর শরীর ছুঁতে বেশ মজা লাগে তাই না রাজ? তোমার ঘরেও তো নারী আছে সেটা ভুলে গেলে হবে? তোমার থেকে উৎসাহিত হয়ে কোনো কুলাঙ্গার যদি তোমার ঘরের নারীকেই ছুঁয়ে দেয় ভালো লাগবে তো?
“পুরুষ মানুষ যদি নারীর শরীর ছুঁয়ার আগে নারীর মন একবার ছুঁয়ে দেখতো,,
তাহলে তারা বুঝতো পৃথিবীতে নারীর শরীরের চেয়েও কোমল কিছু আছে।”একবার মনটাই নাহয় ছুঁয়ে দেখো রাজ।’
কথা গুলো বলে রাজের হাতটা ঝাড়া মেরে ফেলে দিলো নীলা।ততক্ষণে রঙের কাছ থেকে সবটা শুনে বর্ণ রেগে অগ্নিশর্মা। ছুটে এসে রাজের কলার ধরে এলোপাতাড়ি মাইর দেওয়া শুরু করলো।
নীলা তাড়াতাড়ি বর্ণকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।নীলার বন্ধুরাও রঙের পাশে এসে দাঁড়ালো। অহন রঙের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-‘কিছু হয় নি রঙ।কেঁদো না আমরা আছি।’
এই স্পর্শে রঙের খারাপ অনুভব হয় না বরং ভরসা জাগে।
নীলা বর্ণের হাত ধরে টেনে দূরে সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না দেখে বর্নের সামনে গিয়ে দুই বাহু ধরে চিল্লিয়ে বলল
-‘বর্ণ স্টপ।স্টপ নাও বর্ণ।হি ইজ মাই কাজিন বর্ণ।প্লিজ স্টপ।’
বর্ণ থেমে যায়। এই নোংরা ছেলেটা নীলার কাজিন শুনে থমকে যায় বর্ণ।কাজিন হয়েছে তো কি হয়েছে, এই জন্য কি সে তার বোনের সাথে অসভ্যতামি করা জানোয়ারকে ছেড়ে দিবে।অনেক রাগ থাকলেও বর্ণ আর হাত তুলে না রাজের উপর। নীলার দিকে অগ্নি দৃষ্টি বর্ষন করে রাজের দিকে তাকিয়ে বলল
-‘মনে করিস না তোকে আমি ছেড়ে দিয়েছি। তোর সবটুকু ক্যারিয়ার যদি না ধূলোয় মিশাতে পারছি তাহলে বলিস।’
বর্ণ তার বোনের হাত টেনে।হন হন করে নিয়ে চলে গেলো।নীলাকে একবারও বললো না।নীলাও কিছু মনে করে না।তবে কষ্ট হয় বর্ণ তাকে ভুল বুজেছে বলে।
শুভ্রম সবাইকে ভীড় ছাড়তে বলে।সবাই চলে যায়। রাজ আর দিয়াকে গাড়ি করে বাড়ি পাঠাই।এখন কেবল নীলা তার বন্ধুবান্ধব আর শুভ্রম দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রম নীলার দিকে এগিয়ে এসে বলল
-‘সরি নীলাম্বরী, ওদের তরফ থেকে আমি সরি।ওরা এমন করবে ভাবতে পারি নি।’
নীলা নিজের ব্যাগ টা শক্ত করে ধরে শক্ত কন্ঠে বলল
-‘ভাবতে না পারার মতন তো কিছু না এটা।দিন দিন যে ওরা বখে যাচ্ছে সেটা সবাই বুজেছে একমাত্র আপনার পরিবারের মানুষ ছাড়া।এখনও সময় আছে হাল শক্ত করে ধরুন।’
শুভ্রম আরও কিছু বলতো।কিন্তু নীলাম্বরী গটগট পায়ে চলে যায়। হতাশার শ্বাস ছাড়ে শুভ্রম।
অন্যদিকে বেশ রেগে গাড়ি চালাচ্ছে বর্ণ।সে আজ নীলাম্বরীর সাথে বেশ খারাপ আচরণ করে ফেলেছে।রঙ সবটা খুলে বলার পর অপরাধ বোধে কুঁকড়ে খাচ্ছে তাকে।বাসায় গিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে।মেয়েটা তার বোনের জন্য ভরা ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ করলো আর সে কি না।
________
রাত আটটা।নীলা বাসায় ফিরেছে এক ঘন্টা আগে।কোনো মতে বর্নের মায়ের কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে ফ্লাটে এসে দরজা আটকে দেয়।বর্ণ তাকে ফ্লাটে ঢুকার সময় দেখে বেশ কয়েকবার পিছু ডাকে। সে না শোনার ভাব ধরে দরজা আটকিয়ে দেয়।
বাসায় এসে নীলা লম্বা একটা শাওয়ার নিলো।তারপর চুল আঁচড়িয়ে খাবার খেয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো।আজ বেশ ক্লান্ত লাগছে তার।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে চমকে উঠে নীলা।পরক্ষণেই ঐ ফ্লাট থেকে কেউ এসেছে ভেবে শ্বাস ফেলে।অনবরত কলিং বেলের আওয়াজে টিকতে না পেরে উঠে দাঁড়ায় সে।
রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে দরজা খুলতেই কিছু বুঝে উঠার আগেই সশব্দে চড় পরে তার গালে।
চলবে,,