বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ চতুর্দশ
মম_সাহা
ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। আফসানা রহমানের এমন রণচণ্ডী রূপ দেখে কেউই কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।
নীরবতা ঠেলেই নীলা বলে উঠলো
–‘আমি চাচ্ছি না মা এ ব্যাপারটা আরও বড় হোক।’
নীলার কথায় অবাক হলেন ড্রয়িং রুমের সবাই।শুধু একজন বাদে সে হলো আজিজুর রহমান।আফসানা বেগম অবাক নয়নে মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন
–‘তুমি কি বলছো ভেবে বলছো তো?তোমাকে বাড়ি বয়ে এসে মেরে যাবে আর তুমি তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিবে না সেটা কেমন কথা হলো নীলু?তুমি তো জানো অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দুজনই সমান অপরাধী। তবুও এসব ভিত্তিহীন কথা কেনো বলছো?’
নিরুপমাও মায়ের কথায় সমর্থন করে বোনকে বলল
-‘ঠিকই তো নীলু।সব জায়গায় সবাইকে ভালোমানুষি দেখাতে নেই।আর সব থেকে বড় কথা ওরা ভালো মানুষির যোগ্য না। তুই মায়ের কথায় রাজি হয়ে যা বোন।এর একটা শক্ত বিহিত করা প্রয়োজন।’
নীলা বাবার বুক থেকে মুখ তুলে তাকাল। তারপর কিছু একটা ভেবে রাহাতের দিকে তাকিয়ে শক্ত চোখে তারপর তার বোনের উদ্দেশ্যে বলল
–‘না আপু সবার সাথে ভালো মানুষি আর দেখাবো না।আমি ভালো করেই জানি কারা ভালোমানুষির যোগ্য আর কারা না।সবার কাজেরই বিচার হবে তবে অন্য উপায়ে।’
নীলার কথার ভঙিতে রাহাত ভ্রু কুঁচকে ফেলে।বুঝতে পারে এখানের প্রতিটা কথা তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা।
আফসানা রহমান বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন
-‘তোমার কথার আগামাথা বুজছি না নীলু।ওদের একটা শাস্তি না দিলে আমার শান্তি মিলবে না।’
নীলা মায়ের দিকে তাকালো।তারপর ক্লান্ত স্বরে বলল
-‘আমি যেহেতু এ কথাটা বলেছি সেহেতু একটা কারণ আছে তাই না আম্মু?আগে আমার কথা টা শুনো।’
এবার রাহাতের বাবা আমজাদ আলী গম্ভীর কন্ঠে তার ভাই আজিজুর রহমানকে বললেন
-‘তুমি কিছু বলছো না কেনো আজিজ।নীলু মা তোমার কথা একমাত্র মন দিয়ে শুনে।তাই তুমিই বুঝাও ওরে।’
আজিজুর রহমান এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন
–‘নীলু কেনো না করেছে তা আমি হয়তো জানি।আর আমার মনে হয় নীলুর না টা যুক্তিযুক্ত।’
বর্ণের মা ততক্ষণে নাস্তা নিয়ে হাজির।নাস্তার ট্রে টা টেবিলের উপর রেখে।নীলুর মাথায় রেখে বুলিয়ে আজিজুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন
-‘কি বলছেন ভাই সাহেব।ওদের এত তাড়াতাড়ি এত সহজে ছেড়ে দেওয়া উচিত না।আমার মেয়েকে ওরা আঘাত করেছে ভুলে যাচ্ছেন কেনো সেটা?’
আজিজুর রহমান বিচক্ষণ মানুষ।সে মুচকি হেসে বললেন
–‘ছেড়ে কই দিলাম।ওদের শাস্তি নাহয় রিভেঞ্জ অফ ন্যাচারের ভিত্তিতে ছেড়ে দিলাম।’
বর্ণ এতক্ষণ সবটা চুপ করে শুনছিলো।এবার সে শান্ত স্বরে বলল
-‘স্যার আপনি যেহেতু কিছু বলছেন সেহেতু একটা কারণ আছে।কিন্তু আমরা সেটা কেউ ধরতে পারছি না।একটু যদি পরিষ্কার করে বলতেন।’
আজিজুর রহমান মাথা দুলিয়ে বললেন
-‘দেখো ওরা যা করেছে সেটা খুবই বিশ্রী একটা কাহিনী। ওরা হয়তো ভুলে গেছে আত্মীয়তা।কিন্তু আমাদের সেটা ভুলে গেলে চলবে না।থুতু যদি উপরের দিকে মারা হয় তাহলে সেটা নিজের দিকে এসেই পরে সেটা জানো তো? ওদের জেল হাজত নিয়ে কাহিনী হলে সেই কালি আমাদের শরীরে এসেও পড়বে।আর সব থেকে বড় কথা যখন এটা জানাজানি হবে যে একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের জন্য প্রতিবাদ করেছে বলে তার আপন মানুষও তাকে বাড়ি বয়ে এমে মারতে দ্বিধা বোধ করে নি তখন মানুষ রাস্তায় অন্যায় হলে আর প্রতিবাদ করতে যাবে না।খারাপ প্রভাব পড়বে এটা।’
উপস্থিত সবাই অবাক হলো।আসলেই তো তারা এভাবে ভেবে দেখে নি।
শারমিন চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন
-‘আপনি ঠিক বলেছেন ভাই সাহেব আমরা এভাবে ভেবেই দেখে নি।তবে এটার বিচার হবে না?’
আজিজুর রহমান হেসে বললেন
-‘বিচার হবে না কেন আপা।অবশ্যই বিচার হবে।কিছু বিচার সাথে সাথে করার দরকার নেই।রেখে দেন উপরওয়ালার নামে।মানুষ যা বিচার করুক না কেনো সেটা সামান্যই হয় কিন্তু উপরওয়ালা যদি বিচার করে তাহলে সে ভারী পরে যায়।তাই এত বড় কাজের বিচার আমি সামান্য মানুষের হাতে দিবো না।উপরওয়ালাই করবে এ বিচার।’
এবার সবাই সহমত পোষন করলো আজিজুর রহমানের কথায় তার পাশে বেশ অবাকও হলো তার বিচক্ষণতা দেখে।তার কথার ধরন বুঝিয়ে দেয় সবসময় ঝোঁকের বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না। বর্ণ বরাবরের মতন মানুষটার বচন ভঙিতে মুগ্ধ হলো। সাথে নীলার ভাবচিন্তা তাকে বেশ আকৃষ্ট করলো।
বর্ণের ভাই নীড় বলেই ফেলল
-‘স্যার আপনার মতন আমাদের ছোট নীলু আপুও বেশ বিচক্ষণ।’
উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো আর নীড়ের কথার সম্মতি দিলো।
শারমিন চৌধুরী সবার হাতে হাতে একটা করে নাস্তার প্লেট তুলে দিয়ে নীলার সামনে বসলেন।তারপর একটা নাস্তার প্লেট তুলে নিলেন।রুটি ছিড়ে নীলার মুখের সামনে ধরলেন।
শারমিন চৌধুরীর কার্যক্রমে উপস্থিত সবাই অবাক।শুধু একজন বাদে।তিনি হলেন আজিজুর রহমান। তার চোখ তৃপ্তিতে ছলছর করছে।আফসানা রহমান কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের খাবারে মন দিলো।
নীলা হা হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে তারপর খাবার মুখে তুলে নিলো।
ওদের খাওয়ার মাঝেই কেউ প্রবেশ করলো রুমে।সবাই দরজার দিকে দৃষ্টি দিতেই শুভ্রমকে চোখে পরলো।নীলার খাবার অটোমেটিক থেমে যায়। শুধু নীলার না সবার খাওয়া থেমে যায়।
শুভ্রম ধীর পায়ে ভিতরে এসে সালাম দেয়।আজিজুর রহমান ভদ্র ভাবে সালামের জবাব দিয়ে সুন্দর ভাবে হাসিমুখে বললেন
-‘বসো শুভ্রম।’
শুভ্রম ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো
-‘না আঙ্কেল বসতে আসি নি। আসলে নীলাকে দেখতে এসেছিলাম।কাল ওরা যা করলো তার জন্য আমি লজ্জিত।ক্ষমা করবেন আঙ্কেল।’
আজিজুর রহমান হাসি মুখ বজায় রেখেই বললেন
-‘তোমার পরিবার যা করেছে হয়তো সেটা লজ্জিত হওয়ার বিষয়ই।এতে আমি কিছুই বলবো না।কিন্তু তুমি যদি সময় মতন না আসতে তাহলে আরও বড় কিছু হতো সেই হিসেবে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।’
শুভ্রম মাথা নিচু করে বলল
-‘লজ্জা দিবেন না খালু।আমি ভাবতেও পারি নি সবার মানসিকতা এত নিচে নামবে।’
আফসানা রহমান শক্ত কন্ঠে বলল
-‘তুমি কি এখন কাটা ঘাঁতে নুনের ছিটা দিতে এসেছো শুভ্রম?’
শুভ্রম তরিঘরি করে বলল
-‘না খালামনি কখনোই না।আমি নীলাকে দেখতে এসে ছিলাম।’
আফসানা রহমান আর কিছু বললেন না।শুভ্রম নীলার দিকে তাকিয়ে বলল
-‘নীলা ভালো থেকো।আসছি আমি।’
শুভ্রম বের হয়ে গেলো।শুভ্রমের পিছে গেলো বর্ণও।শুভ্রম লিফটে উঠবে এমন সময় বর্ণ বলে উঠলো
-‘ও তো কখনোই নীলা ছিলো না। নীলাম্বরী ছিলো।তাহলে আজ হঠাৎ নীলা হলো কেন?’
শুভ্রম তাচ্ছিল্য হেসে বলল
-‘ও তো কখনোই আমার ছিলো না।নীলাম্বরী থেকে নীলা হওয়ার গল্পটা বেশ ব্যাথাতুর।’
বর্ণ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল
-‘আপনিও তো কখনোই আমার অপরিচিত ছিলেন না।না এত দূরের ছিলেন তাহলে আজ কেনো?’
শুভ্রম তাচ্ছিল্য হাসলো।তারপর বলল
-‘স্বার্থপর মানুষরা এমনই হয় বুঝলেন তো।তাদের সবকিছু প্রয়োজনে পরিবর্তন করে। যেটার ইতি টেনেছি ভিনদেশে সেটা নাহয় আর নাই তুললেন। ভালো থাকবেন আপনার নীলাম্বরীকে নিয়ে।আমি দেখতে এসেছিলাম।’
শুভ্রম লিফটে ওঠে গেলো।বর্ণ একটা হতাশার শ্বাস ফেললো।মানুষ কীভাবে এতটা বদলে যায়।চেনা সম্পর্ক গুলো কীভাবে এমন অচেনা পরিচয় পায়।দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে ভিতর থেকে।সাথে অতীতের কিছু যন্ত্রণা।
চলবে