বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ চব্বিশতম
মম_সাহা
গায়ের হলুদের স্টেজের এখানটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সাজানো হয়েছে। কাল যা মেহমান এসেছিলো আজ তার দ্বিগুণ।মেয়েরা সব ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে মেহেদী দিচ্ছে।নীলা বাদে।সে এক সাইটে বসে আছে।একসময় মেহেদী তার প্রিয় বস্তু ছিলো কিন্তু সময়ের বিবর্তনে প্রিয় জিনিস গুলো অপ্রিয়ের খাতায় নাম লিখে।
একসময় সবসময় মেহেদী দিয়ে রাখা হাতটা আজ অনুষ্ঠানের দিনও খালি।সে মেহেদী দেওয়া ছেড়েছে আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে।সবে মাত্র ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে সে।উঠতি বয়সী যুবতী। মন তার বেশ দুরন্ত।টিনেজার বয়স আবেগে পরিপূর্ণ। ছুটির দিন বাবার কাছে বায়না করে মেহেদী আনিয়েছিলো।বেশ যত্ন করে মেহেদী দিচ্ছিলো তখনই কোথা থেকে তার দাদী এসে বলল
-‘এত সুন্দর মেন্দি টা তুই নিজের হাতে ক্যান লাগাছ ছুড়ি? মেন্দির রঙ আর তোর শইলের রঙ তো মিইল্যা যাইবো। এই রঙ লইয়া এত তিড়িং বিড়িং কেমনে করছ? আমরা এমন কালি হইলে নিজের ঘরে শরমে মুখ লুকাইতাম।’
সদ্য যৌবনে পা রাখা আবেগঘন কিশোরীর হৃদয় টা সেদিন দাদী বিশ্রী ভাবে ভেঙে দিয়েছিলো।কিশোরী প্রতিবাদ জানায় নি দাদীর কথায়। বরং খুব গোপনে চোখের জলটা মুছে সদ্য দেওয়া মেহেদী হাতটা কলের নিচে পানি ছেড়ে মুছে ফেলে।মেহেদী উপর দিয়ে চলে যায় সাথে চলে যায় কিশোরীর এক অতিপ্রিয় শখ।কিন্তু মেহেদীর যে রঙটা ছিলো সেটা উঠাতে বেগ পেতে হয়েছিলো তার।সাবান দিয়ে ঘষে চামড়া উঠে গিয়েছিলো।সেটার ক্ষত আজও রয়ে গেছে আর একটা ক্ষত রয়ে গেছে হৃদয়ে।রমনী খুব যতনে দাদীর দেওয়া ক্ষতটা রেখে দিয়েছে।
পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে কারো কথায় ধ্যান ভাঙলো তার।সামনে তাকিয়ে দেখে তার আপু কি সুন্দর হেসে হেসে মেহেদী দিচ্ছে।ফর্সা ধবেধবে হাতটা গাড়োঁ মেহেদীর রঙে জেনো আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে।
কোথা থেকে রাহাত এসে নীলার পাশে ধপ করে বসল।নীলা ঘাঁড় ঘুরিয়ে রাহাতের পানে চাইল।কি টানাটানা চোখ।কি সুন্দর তার মুখশ্রী। এই চেহারার মায়ায়ই তো সে ডুবেছিলো।কিন্তু অন্তরটা দেখার পর ঘৃণায় ভরে গেছে সব।
রাহাত নীলার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘সবাই মেহেদী দিচ্ছে তুই দিবি না?’
নীলা রাহাতের থেকে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল
-‘না দিবো না।’
-‘কেনো দিবি না?অনেক বছর ধরেই তোর হাতটা বিবর্ণ হয়ে পড়ে আছে আজ একটু রাঙা।’
রাহাতের কথায় উপস্থিত সবাই নীলার দিকে তাকালো।সবাই কে এভাবে তাকাতে দেখে নীলা একটু বিব্রতবোধ করলো।মাথা নিচু করে বলল
-‘ যার নামের সাথে ট্যাগ লেগে গেছে যে সে “বিবর্ণ নীলাম্বরী” তার হাত একটু আধটু বিবর্ণা থাকলে তাতে এমন ক্ষতি নেই।’
আর কেউ কিছু বললো না।সবাই জানে নীলা মেহেদী পছন্দ করে না কিন্তু কেনো করে না সেটা একজন জানে সে হলো নিরুপমা। তাই আর নিরুপমা জোড় করে নি।জোড় করলে পুরোনো ঘাঁ বেঁচে উঠবে এছাড়া আর কোনো লাভই হবে না।
নীলা সন্তপর্ণে সবার মাঝ থেকে উঠে বাগানের দিক টাতে গেলো যেখানে গাঁয়ের হলুদের স্টেজ করা হয়। নীলার সেই তিন বছর আগের ভয় টা তাজা হয়ে উঠছে।আবার সেই সাজগোজ আবার সেই জম জমাট আয়োজন।এত সাজ সজ্জা।আর আবারও বর বিশ্বাসঘাতক।আবারও বিয়ে ভাঙলে তার দোষে ভাঙবে।
নীলার মাথা ব্যাথা করছে প্রচুর।তিনবছর যাবত রোগ পালছে।জানতে দেয় নি কাউকে।আজ মাথা ব্যাথা অতিরিক্ত জ্বালাতন করছে।ওষুধ খেতে হবে কিন্তু ওষুধও শেষ।মাথা চেপে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল নীলা।আচমকা তার সামনে এক গ্লাস পানি আর একটা ওষুধের পাতা এগিয়ে দিলো কেউ।
নীলা নিচের চিরপরিচিত ওষুধ টা কোনো পুরুষ নালী হাতের বন্ধনে দেখে অবাক হয়।অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলে।তার সামনে বর্ণ।
বর্ণ নীলাকে ওষুধটার দিকে ইশারা করে বলল
-‘আগে ওষুধ খান পরে সব ভাবনা চিন্তা। এত জরুরি ওষুধ আপনি আনান নি? কতটা ক্ষতি হয় সঠিক সময় ওষুধ না খেলে জানেন।তাও আনান নি।ধরুন।’
নীলা মাথা ব্যাথা কমানোর জন্য দ্রুত ওষুধের পাতা টা নিয়ে একটা ক্যাপসুল খেয়ে বাকি ওষুধটা ওরনার মাঝে গিট দিয়ে নিলো।
নীলার আচরণে ভ্রু কুঁচকে তাকায় বর্ণ।বেশ কৌতূহল নিয়ে সে জিজ্ঞেস করে
-‘আচ্ছা এত লুকোচুরি কেনো?’
নীলার এতক্ষণে হুঁশ ফিরলো।বর্ণ জানলো কীভাবে? সে তৎক্ষনাৎ বর্ণকে প্রশ্ন করলো
-‘আপনি কীভাবে জানলেন? আমি তো আপনাকে বলি নি।’
বর্ণ গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘প্রশ্নের পরিবর্তে প্রশ্নে সাজে না নীলাম্বরী। আমি প্রথম আপনাকে প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর দেন।এত লুকোচুরি কেনো অসুস্থতা নিয়ে?’
নীলাম্বরী আমতাআমতা করে বলল
-‘এটা সামান্য বিষয়।তাই কাউকে বলি নি।সেড়ে যাবে কয়েকদিন পর।’
-‘সিরিয়াসলি সেড়ে যাবে?আপনার ব্রেইনে ড্যামেজ দেখা দিয়েছে সাথে মাইগ্রেন সমস্যা। অতিরিক্ত চাঁপ নিলে আপনার ব্রেইন কাজ করা অফ করে দিবে তখন হয় আপনি সারাজীবনের জন্য পাগল হয়ে যাবেন বা কোমায় চলে যাবেন এমনি আপনার মৃত্যুও হতে পারে।আপনি জানেন এগুলো?’
বর্ণের কথায় নীলা মাথা উপর নীচ নামালো যার অর্থ সে জানে।বর্ণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘আপনি জেনেও এতটা ছন্নছাড়া।প্রোপার ট্রিটমেন্ট শুরু করছেন না এখনো?জেনেছেন কবে অসুস্থতার ব্যাপার টা?’
নীলা আগের ন্যায় মাথা নিচু করে বলল
-‘আজ থেকে দেড় বছর আগে।’
-‘তো সবাইকে জানান নি কেনো?কার কাছে গিয়েছিলেন ডাক্তার কাছে? ডাক্তার কি বলেছে? কেনো হয়েছে এমন টা?যার সাথে গিয়েছেন সে জানায় নি কেনো সবাইকে?’
নীলা টলমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘শুভ্রম ভাইয়ার সাথে গিয়েছিলাম।আজ থেকে প্রায় দেড়বছর আগে হঠাৎ কলেজে অসুস্থ হয়ে যাই।তখন ভাইয়া হসপিটাল নিয়ে যায়। মুখ নাক থেকে রক্ত পড়ছিলো।তারপর ডাক্তার সব জানায়।অতিরিক্ত টেনশন থেকে এমন হয়েছে।ডিপ্রেশনে ছিলাম বলে।আমিই ওনাকে হাতেপায়ে ধরে প্রমিজ করিয়েছি জেনো কাউকে না বলে।তখন সবে মাত্র আপুর ঝড় সামলে উঠেছিলো সবাই।আমি কিভাবে বলতাম এগুলো?আপনি প্লিজ কাউকে বইলেন না।আমি বিয়েটা মিটে গেলে সবাইকে বলবো।প্লিজ এই রিকুয়েষ্ট টা রাখুন।’
নীলার চোখ দিয়ে টপটপ জল পড়ছে।বর্ণ নীলার এ অবস্থা দেখে মায়া হলো সে কাউকে কিছু জানাবে না বলে আশ্বস্ত করলো।বর্ণ পরে গেলো আরেক ভাবনায়। সে যতটুকু জানে এই সমস্যা ডিপ্রেশন বা অতিরিক্ত চাঁপ থেকে এতটা বৃদ্ধি পেতে পারে না।নীলাকে হাই ডোজের কোনো ওষুধ খাওয়ানো হতো।যার কারণে এতটা ড্যামেজ হয়েছে।বর্ণও জানতে পারে সেদিন যেদিন নীলার হাতে এসিড পরার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ছিলো তখনই পরীক্ষা নীরিক্ষার পর ডাক্তার তাকে সবটা জানায়।কে নীলার এতটা ক্ষতি চায়?
__________
রাত আটটা। ছেলেমেয়ের এক সাথে হলুদ হবে দেখে বেশ বড় করে স্টেজ করা হয়েছে।মানুষজনে গিজগিজ করছে।এখন অবশ্য সবাই বাগানের দিকে।ওখানেই সব আয়োজন যেহেতু।
সবাই যার যার মতন জিনিসপত্র নিয়ে বাগানের দিকে চলে গেছে।এই পুরো বাড়িতে এখন শুধু হাতে গণা কয়েকজন আছে।কযেকজনের মাঝে নীলাও আছে।সে ঘুমিয়ে ছিলো।তাই উঠে সাজতে দেড়ি হয়ে গিয়েছে।
নীলা ঘুম থেকে উঠে নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। বেশ সুন্দর করে কেউ একজন তাকে মেহেদী দিয়ে দিছে।সাথে রাগও হয় তার সে পাঁচ বছর যাবত মেহেদী দেয় না কে এই কাজটা করেছে তার সাথে।
বাথরুমে গিয়ে বেশখানিকটা সময় ঘষে পরিষ্কার করে। কিন্তু মেহেদীর রঙ ততক্ষণে বসে গেছে।
বেশ বিরক্ত নিয়ে নীলা তৈরী হলো।শুনেছে বিকেল বেলা দাদীও এসেছে।সাথে তিমা আপুও এসেছে।দাদী বেশিলভাগ সময় হাবিবা ফুপির বড় মেয়ে তিমা আপুর বাড়িতে থাকে।তার বড় আদরের নাতনি।আর দাদী আলাদা থাকেন। গ্রাম সাইটে তার বাড়ি আছে কাজের লোক আছে।দাদা দাদী সেখানেই থাকে।শহর তাদের পছন্দ না।
নীলা জানে এই মেহেদী রাঙা হাত নিয়ে দাদীর সামনে গেলে আবার একটা কথা শুনতে হবে।মন খারাপ নিয়ে তৈরী হলো নীলা।আজ শরীর টাও বেশ খারাপ ছিলো।
বাসন্তী রাঙা একটা শাড়ি পড়ে বড় চুল গুলো খোপা করে সেখানে ফুল লাগিয়ে দিয়েছে। আর কপালে টিপ কানে ঝুমকো সাজ শেষ।
সবাই এখন অনুষ্টানের কাছে।নীলা নিচে নেমে দেখে কয়েকজন মহিলা তার দাদী ফুপুসহ কথাবার্তা বলছে।নীলা চলে যেতে নিলে আফসানা রহমান ডেকে বলল
-‘নীলু এই মিষ্টি গুলোও নিয়ে যা।’
নীলা মিষ্টি নিয়ে যেতে নিলে তার দাদী মনোরমা বেগম বলল
-‘এই এই কালা মিষ্টি কই নেছ? কালা রঙ অশুভ।এত শুভ অনুষ্ঠানে এগুলা নিবি না।আক্কেল জ্ঞান নাই তোর?’
নীলা হতভম্ব হয়ে যায়। আফসানা রহমান রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বলল
-‘আম্মা আমিই দিছিলাম ওর কোনো দোষ নেই।নীলু দিয়ে যা মিষ্টি টা।’
হাবিবা খানম ঠেস মেরে বলল
-‘তা আম্মা কালা মিষ্টি নিতে না করলে আর তোমার নাতনি যে যাচ্ছে সেখানে। অশুভ হবে না এখন?’
হাবিবা খানমের কথায় নীলার অপমানে লাগে।আনমনেই জল এসে পড়ে চোখে।পিছন থেকে দিগন্ত বলে উঠে
-‘নীলা বনু যাচ্ছে সেটা শুভই হবে তবে আম্মা তুমি যেও না।কারণ তোমার হৃদয়ের চেয়ে কালো তো আর কিছু নেই।’
ছেলের কথায় ফুঁসে উঠলো হাবিবা খানম। দিগন্ত নীলার হাত ধরে বাগানের দিকে নিয়ে গেলো।তারপর ওকে দাঁড় করিয়ে বলল
-‘একদম মন খারাপ করো না বনু।তুমি আামাদের ছোট্ট পরী কত সুন্দর লাগছে মাশাল্লাহ। তুমি থাকো এখানে আমি যাচ্ছি।’
নীলা ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘কোথায় যাচ্ছো?’
দিগন্ত চরে যেতে যেতে বলল
-‘কালকের ডেকরেশনের ফুল গুলো সমস্যা হয়েছে নতুন ফুল আনতে যাচ্ছি।’
নীলা আচ্ছা বলে ঘুরতে নিয়ে কিছু একটা ভেবে পিছে ঘুরে তাকালো।দিগন্তের শরীরের হুডিটা চেনা চেনা লাগছে।স্মৃতি চাঁপ দিতেই সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা মনে পড়লো যেদিন রাহাত তার সাথে অসভ্যতামি করতে চেয়ে ছিলো তখন যে ছেলেটা বাঁচিয়ে ছিলো ওর গায়ে সেইম হুডি ছিলো।
নীলা একে একে সব হিসেব মিলাতে ব্যস্ত।তাহলে সব করছে দিগন্ত?
চলবে,,