বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ তেইশ
মম_সাহা
আড্ডার আসর শেষ হয়েছে আরও ঘন্টাখানেক আগে।সবাই রাতের খাবার খেয়ে যার যার মতন ঘুমাতে চলে গেছে।আজ নিরুপমা আর নীলা এক ঘরেই ঘুমাবে।বাসায় মেহমান অনেক নিরুর রুম মেহমানদের দখলে।বর্ণ,নীড়,দিগন্ত,অহন,আবির সব ছেলে গুলো নিরুর রুমে শুয়েছে।
নিরুপমা আর নীলা শুয়ে আছে পাশাপাশি। দুজনের দৃষ্টি ফ্যানের দিকে নিবদ্ধ। হাজার রকমের ভাবনা দুজনের মনে।দুুজনের ভাবনার বিষয়ই এক সেটা হলো বিয়ে।নিরু ভাবছে তার সুন্দর বিয়ের কথা।নীলা ভাবছে তার বোনকে এই খারাপ চরিত্রহীন ছেলে থেকে বাঁচানোর কথা।
বেশ ক্ষানিকটা সময় চুপ থাকার পর নিরু ফ্যানের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে নীলাকে উদ্দেশ্য করে বলল
-‘আচ্ছা নীলু একটা কথা বলি নি তোকে।’
নীলাও আগের ন্যায় চেয়ে থেকে বলল
-‘বলো আপাই?’
নিরু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
-‘হিমাদ্রের সাথে প্রায় পনেরো বিশ দিন আগে দেখা হয়েছিলো আমার।’
নীলু অবাক হয়ে যায়। অবাক দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে
-‘কই দেখেছো তুমি তাকে? এত বছর পর কোথা থেকে আসলো সে?’
নিরু দৃষ্টি আগের ন্যায় রেখেই বলল
-‘সে নাকি এত দিন দেশের বাহিরে ছিলো।মাস খানিক আগেই এসেছে দেশে।ঐ দিন দেখা হওয়ার পর সে আমার কথা জিজ্ঞেস করে নি,না কুশলাদি বিনিময় করেছে।শুধু জানতে চেয়েছে তুই এখনো তার জন্য অপেক্ষা করে আছিস কি না।’
নীলা আগের ন্যায় অবাক ভাবটা বজার রেখে বলল
-‘ওমা আপাই আমি ওনার জন্য অপেক্ষা করবো কেনো?কে উনি?একটা বিশ্বাসঘাতক।’
নিরুপমা বোনের দিকে তাকায় তারপর বলে
-‘ তোকে ভালোবেসেছে সে নীলু।এটা কি তার দোষ?’
নীলু উঠে বসলো। তারপর কপাল কুঁচকে বলল
-‘সে কাউকেই ভালোবাসতে পারে নি আপু।না আমাকে ভালোবাসতে পেরেছে না তোমাকে।সে কেবলই বিশ্বাসঘাতক।নাহয় এতদিনের সম্পর্ক এত সহজে ভুলে বিয়ের আগের দিন এসে বিয়ে ভাঙতে পারতো?’
নিরুও এবার উঠে বসলো শান্ত স্বরে বলল
-‘ভালোবাসা কখন কার প্রতি হুট করে জেগে যায় তা কেউ জানেনা নীলু।সে যা করেছে তা হয়তো খারাপ করেছে কিন্তু একবার ভাব সে কিন্তু তার ভালোবাসার কথা টা সাবলীল ভাবে স্বীকার করার সাহস পেয়েছে।’
নীলা এবার তাচ্ছিল্য করে বলে
-‘সাবলীল ভাবে প্রকাশ করেছে না ছাই।এত ভালোবাসা দেখেই সে এই অব্দি আমাদের সামনে দাঁড়ানোর সৎ সাহস পায় নি।এই নমুনা।’
-‘নারে নীলু সৎ সাহস না।ওর সৎ সাহস ছিলো বলেই সে বিয়ের আগেরদিন এসেও কিছু না ভেবে নিজের ভালোবাসার কথা টা মুখ ফুটে বলতো পেরেছিলো।আসলে সে এতদিন আমাদের সামনে আসে নি চক্ষু লজ্জায়। যতই হোক এত বছরের সম্পর্ক ছিলো আমাদের কিভাবে সে মুখ দেখাতো।আর জানিস নীলু কারো সাথে অনেক বছর থাকলে তুই না চাইতেও তার প্রতি একটা মায়া সৃষ্টি হবে।সেই মায়া তোকে ছাড়তে দিবে না তাকে।বুঝলি তো নীলু এই মায়াই মাঝে মাঝে কাল হয়ে দাঁড়ায়।’
নীলা বোনের কথাতে পর পর অবাক হচ্ছে। আপাই তাকে এসব বলছে কেন? ঐ বিশ্বাসঘাতকে এত সহজে ক্ষমা করে দিলো আপা? নীলু এবার শান্ত এবং শক্ত কন্ঠে বলল
-‘যাই বলো আপাই এই মানুষটা ক্ষমার যোগ্য না।এত সহজে ক্ষমা করো না আপু।সবাইকে ক্ষমা করা উচিৎ না।বিশ্বাসঘাতকদের তো না-ই।’
নিরু এবার স্বস্তির শ্বাস ফেলল মনে হয়।তারপর হাসি মুখে বলল
-‘এই কথাটা তুইও মনে রাখিস বোন সবাইকে ক্ষমা করা উচিৎ না।বিশেষ করে যে তোর জীবনকে নরক করে দিয়েছে।’
নীলা গভীর ভাবনায় ডুবে যায় নিরু ততক্ষণে শুয়ে পরে।
তখন মধ্য রজনী। আকাশে বেশ ঝকঝকে একটা চাঁদ জায়গা জুঁড়ে আছে।শীতকালীন সময় কুয়াশা তাই চারপাশে।নীলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বোনের তখনের কথা গুলো তার ঘুম কেড়ে নিতে যথেষ্ট ছিলো।গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো সে।এতদিন পর বোনের প্রাক্তন কেনো আসলো? চিরকুট কার দেওয়া? লেখা গুলো বেশ পরিচিত।কার লেখা এগুলো?তাহলে কি হিমাদ্রি এসব করছে?
ভাবতে ভাবতে নীলার চোখ হঠাৎ রাস্তার মাঝে যায়। সে খেয়াল করলো কুয়াশার ধোঁয়াতে ঝাপসা একজন দাঁড়িয়ে আছে বুজা যাচ্ছে
নীলা অবাক হয়ে গেলো।এত রাতে এত শীতের মাঝে কে এভাবে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। নীলা ভালো করে দেখার জন্য ছুটে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে আসে।এতক্ষণ জমজমাট বাড়িটা এখন ঠান্ডা। ঘুমে তলিয়ে আছে সব।নীলা সবধানে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো।
বাহিরে ভীষণ ঠান্ডা।নীলা রাস্তার মাঝে এসে দাঁড়ালো।অদ্ভুত বিষয় হলো দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটা এখন আর নেই। পুরো রাস্তা খালি।মাঝে মাঝে হিমশীতল বাতাস এসে নীলার শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে।নীলার এবার ভয় করতে শুরু করে।ঝোঁকের বসে এত রাতে তার বাহিরে বের হওয়া ঠিক হয় নি।হিমাদ্রি এ শহরে যেহেতু এসেছে তার মানে এখানে সে ই ছিলো।যদি নীলাকে একা পেয়ে খারাপ কিছু করে।
নীলা আবার নিজের বাসার দিকে ছুট লাগায়।দুই পা আগাতেই নীলার উড়ণা পিছ থেকে কেউ টেনে ধরে।নীলার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে।পিছে তাকানোর সাহস অব্দি তার হয় না।পিছে তাকিয়ে কি দেখবে না দেখবে সেটার জন্য সে আদৌও প্রস্তুত না।
নীলার এতক্ষণ মানুষের ভয় করছিলো কিন্তু হঠাৎ করে বাড়ির ঝোঁপের দিকে নজর গেলো।ঝোঁপের পিছে কবরস্থান। নীলার কলিজা শুকাচ্ছে।পিছনে দাঁড়ানো কে? মানুষ নাকি অন্য কিছু।
হাজারও ভাবনা চিন্তা নিয়ে নীলা পিছে তাকালো।সে পিছে তাকিয়ে অবাক।তার উড়ণা টা পাশের একটা গাছের মরা ডালের সাথে আটকিয়েছে।নীলা স্বস্তির শ্বাস ফেলল।গাছ থেকে উড়ণা টা ছাড়িয়ে বাড়ির ভেতরে আসলো।এসে তাড়াতাড়ি নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো।একটু আগের কথা ভাবতেই বুকটা ধক করে উঠে।কি দুঃসাহসিক কাজই না করতে গেছিলো।
_______
কানের সামনে অনবরত ফোনের রিং এর শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো নীলার।সে পাশ ফিরে নিজের ফোনটা হাতে নিলো।দেখে না তার ফোন আসেনি।এবার ঘুম চোখে উঠে দাঁড়ায় সে।হাতরে সোফার উপর একটা মোবাইল পায়।মোবাইলা ঠিক চিনতে পারে না সে।
এর মাঝেই ওয়াশরুম থেকে বের হয় নিরু।নীলার হাতে ফোন দেখে বলে
-‘কিরে দিগন্তের ফোনটা মনে হয় রেখে গেছে তাই না?’
নীলা চোখ কঁচলে বলে
-‘দিগন্ত ভাইয়ার ফোন? কিন্তু এ রুমে কেনো?’
নিরু চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল
-‘আরে ও গোসল করতে আসছিলো।তখন হয়তো রেখে গেছে।কল বাজছে তো দিয়ে আয়।’
নীলা বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করে দিগন্তের খোঁজে বের হলো।দিগন্তকে পেয়েও গেলো।বাগানের সাইটে হলুদের স্টেজ সাজাচ্ছে।নীলা ঘুম চোখে গিয়েই দিগন্তকে ডাক দিলো
-‘ভাইয়া তোমার ফোন।’
দিগন্ত তড়িঘড়ি করে নীলার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো।ফোনটা নেওয়ার সময় আবছা একটি ছবি দেখলো ফোনে।বেশ চেনা লাগছে ছবিটা।কিন্তু তন্দ্রার কারণে ঠিক আঁচ করতে পারছে না।
নীলা যখন স্টেজ থেকে ফিরতে নিবে তখন বড় করে লেখা আজ নিরুপমার গাঁয়ের হলুদ লেখাটা চোখে পড়লো।লেখাটা দেখে নীলার ঘুম উবে গেলো।চিরকুটের লেখার আর এই লেখাটা একবারে সেইম।নীলা উচ্চস্বরে বলল
-‘এই লেখাটা এখানে কে লাগিয়েছে?’
দিগন্ত ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘বনু আমি লাগিয়েছি।কিন্তু কেনো?’
নীলা আর কিছু বলবে তার আগে বর্ণ নীলাকে ডাক দিলো ততক্ষণে দিগন্তেরও ডাক পড়ায় দিগন্ত চলে গিয়েছে।নীলার এখন সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে।দিগন্ত চিরকুট দিয়েছে? দিগন্ত জানলো কিভাবে সব? ফোনের ছবিটা চেনা চেনা লাগছে।হঠাৎ নীলার মনে পড়লো ছবিটা কার।নীলা আনমনে বলল ” মৌ আপি” নীলা গোলক ধাঁধাঁর মাঝে পড়ে গেছে।সবটা করছে কে?
অন্য দিকে আগন্তুক ফোনের মানুষটার সাথে ছক করছে।বিয়েটা কীভাবে ভাঙা যায়।
চলবে