বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ ত্রিশ

0
1780

বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ ত্রিশ
মম_সাহা

দীর্ঘ আটচল্লিশ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখার পর জ্ঞান ফিরলো নীলার।নীলার অবস্থা বেশ শোচনীয়। তার ব্রেণ একবারেই ড্যামেজ হয়ে গেছে যে অপারেশন করা ছাড়া গতি নেই।নীলাকে বাহিরের দেশে নিয়ে যেতে হবে।

নীলা নির্জীব শুয়ে আছে হসপিটালের বিছানায়। নীলার জ্ঞান ফিরেছে বলে সবাই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গেলো তার কেবিনে।

রুমে অন্য কারো উপস্থিতি পেয়ে চোখ খুলে তাকায় নীলা।দেখে তার সামনে তার পুরো পরিবার, বর্ণ ওর মা,নীড়,তিমা আপু,মাসুদ ভাইয়া।

সবাইকে দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে মুচকি হাসে নীলা। নীলার হাসি দেখে সবার জেনো প্রাণ ফিরে এলো।নিরুপমা অনেক কষ্টে কান্না আটকে রেখেছিলো কিন্তু তার নির্জীব, নিষ্প্রাণ বোনটাকে দেখে আর কান্না আটকিয়ে রাখতে পারে নি।এতটুকু একটা মেয়ে কত কিছু সহ্য করলো।

নীলার অনেক কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে তবুও সে বেশ ধীর কন্ঠে বলল
-‘আপাই কাঁদছো কেন?আমি তো সুস্থ হয়ে গেছি।কেঁদো না আপাই।’

নীলার কথা শুনে নিরুপমা আরও ভেঙে পড়েছে।তার বোনটা জানেও না তার ভিতরে কত বড় রোগ নিয়ে বসে আছে সে।

আজিজুর রহমান বড় মেয়ের কান্নার কারণ বুঝতে পেরেছে।সে তার মেয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘নিরু এটা একটা রোগীর রুম। এখানে কান্নাকাটি করা মানায় তুমিই বলো?না রোগী এটা মানতে পারবে?’

নিরুপমা বাবার কথার ইঙ্গিত বুঝে অনেক কষ্টে নিজেকে চুপ করালো।তারপর ধীর গলায় বলল
-‘তুই এমন কেনো করলি নীলু?তুই যদি প্রথমে এসেই তোর ক্ষতটা দেখাতি তাহলে হয়তো এতটা ক্ষতি তোর হতো না।আর না বড়মায়ের ,,, ‘

বাকি কথা শেষ করার আগে বর্ণ নিরুপমাকে থামিয়ে দেয়। নীলা ভ্রু কুঁচকে বলে
-‘বড়মার কি হয়েছে আপাই? বলো আমাকে বড়মা কোথায়? তুমি চুপ হয়ে গেলে কেনো?’

আমজাদ আলী মানে রাহাতের আব্বু অবস্থা বেগতিক দেখে নীলার পাশে গিয়ে বসে।নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
-‘কিছু হয় নি তোমার বড় মায়ের।তুমি অসুস্থ হয়েছো তাই তোমার বড় মা অনেক চিন্তায় পড়ে গেছে। চিন্তায় চিন্তায় সে-ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।সেটাই নিরুপমা বলতে চেয়েছে।আর সত্যিই তো তুমি কেনো আগে এই দুর্ঘটনার কথা না বলে বিয়ে নিয়ে এত উঠেপড়ে লেগে ছিলে? তোমার কতটা ক্ষতি হয়েছে জানো?’

নীলা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘তখন আমার বেঁচে থাকার চেয়েও আপাইয়ের সুন্দর জীবনটা বেশি প্রয়োজন ছিলো।’

-‘আর তোরে যে আমাদের সবার প্রয়োজন সেটা জানিস না? এমন বোকামী কেউ করে?’

নিজের মায়ের কথায় নীলু মায়ের দিকে ঘুরে তাকালো।আফসানা রহমান এগিয়ে এসে বলল
-‘নীলু তুমি কি জানো না তুমি আমাদের কাছে কী?তোমাকে আমি বা আমরা কতটা ভালোবাসি।তোমার এত বড় বোকামী করাটা একদমই উচিত হয় নি।এখানে উপস্থিত প্রত্যেক টা মানুষ জানো কীভাবে ভেঙে পড়েছিলো?সবার কথা ভাবলে নিজের কথা ভাবলে না?’

আজিজুর রহমান তার স্ত্রীকে চুপ করিয়ে দিলেন।নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন
-‘আম্মু তোমার এখন কেমন লাগছে?আমরা কতটা চিন্তায় পড়ে গিয়ে ছিলাম জানো? এমনটা আর কখনোই করো না।’

নীলা মুচকি হেসে বলল
-‘আমার বাবাই তো শিখালো অন্যের খুশি নিজের খুশি আজ আবার বাবাই অন্য কথা বলছে? ইট’স নট ফেয়ার বাবা।’

নীলুর কথায় সবাই হেসে দিলো।সবাই নীলুকে দেখে দেখে বের হয়ে গেলো। শারমিন চৌধুরী নীলুর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায়। পুরো কেবিনে শুধু একজন উপস্থিত সে হলো বর্ণ।নীলু বেশ ক্ষানিক সময় বর্ণকে খেয়াল কর ছিলো।বর্ণ কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া করে নি।অবশেষে নীলা বাধ্য হয়ে ডাক দিলো
-‘ডাক্তার সাহেব।’

বর্ণ মুখ তুলে তাকায় নীলার মুখপানে।তার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে এ মেয়েটা এত কিছু সহ্য করছে বা ভবিষ্যতে করবে।তার বুক কাঁপছে।বরাবরই সে শক্তপোক্ত মনের অধিকারী। কিন্তু আজ তার কি দশা।এতটা ভেঙে সে কখনোই যায় নি।

বর্ণের কোনো হেলদোল না দেখে নীলা আবারও ডাক দিলো
-‘ডাক্তার সাহেব কথা বলবেন না?’

বর্ণের ধ্যান ভাঙলো।সে ধীর গতিতে নীলার পাশে এসে বসলো।নীলার হাতটা ধরতে নিয়েও আবার কোনো একটা কারণে সে নিজের হাতটা আবার পিছিয়ে নেয়।নীলা সবটাই খেয়াল করেছে।মুচকি হেসে সে ক্যানাল লাগানো হাতটা এগিয়ে বর্ণের হাতটা ধরলো।

বর্ণ খুব যত্ন সহকারে নীলুর হাতটা নিজের হাতের ভাজে আটকে নেয়।মনে হয় ছেড়ে দিলেই হয়তো তার নীলাম্বরীকে কেউ নিয়ে যাবে।

নীলাও ভরসা পায় এই হাতটার মাঝে।

_________

আজ চারদিন হলো নীলা নিজের ফ্লাটে এসেছে। হসপিটাল থেকে রিলিজ হওয়ার পরই নীলাকে নিয়ে তার পরিবার ঢাকা চলে আসে। নীলার ফ্লাটে তার বাবা মা চলে আসে।আর নিরুপমাকে বর্ণদের ফ্লাটেই তোলা হয়।

নীলার ক্ষত সেড়ে যাচ্ছে কিন্তু আরেকটা রোগ যেটা শরীরের ভিতরে সেটা ধীরে ধীরে তাজা হয়ে উঠছে।আজকাল বেশিরভাগ সময় নীলা নিজের রুমে শুয়ে থেকেই কাটায়।মাথা যন্ত্রণায় তার কিছু ভালো লাগে না।

এখন চারদিকে সন্ধ্যা নেমেছে।প্রতিদিনের ন্যায় আজও নীলা শুয়ে আছে।হঠাৎ ই তার রুমে কেউ প্রবেশ করলো।নীলা ঘাঁড় ঘুরিয়ে দেখে তাে বাবা। নীলা বাবাকে দেখে উঠে খাটের সাথে ভর দিয়ে বসলো।

আজিজুর রহমান মুখে হাসি বজায় রেখে মেয়ের দিকে এগিয়ে আসলো।নীলাও বাবার হাসির পরিবর্তে হাসি ফিরিয়ে দিলো।আজিজুর রহমান মেয়ের পাশে বসে বলল
-‘কেমন আছে আমার আম্মাটা?’

-‘অনেক ভালো আছে বাবা।’

মেয়ের উত্তরে আজিজুর রহমান খুশি হওয়ার বদলে মনে মনে ব্যাথা অনুভব করলো।মেয়ে ভালো আছে বলছে ঠিকিই কিন্তু মেয়ে টা যে তার সত্যি ভালো নেই।

আজিজুর রহমানকে চুপ থাকতে দেখে নীলা হেসে বলল
-‘কি ভাবছো বাবা?’

আজিজুর রহমান জোড় করে মুখে হাসি টেনে বলেন
-‘কিছুই না মা।তুমি একা একা রুমে শুয়ে না থেকে একটু ড্রয়িং রুমে বসতে পারো তোমার আপাইয়ের সাথে কথা বলতে পারো সেটা করলে তোমার মন বেশ ফুরফুরা থাকবে।’

নীলা মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘হ্যাঁ বাবা তা তো পারি।কিন্তু মাথা ব্যাথার জন্য উঠতে পারি না।’

আজিজুর রহমান এবার কতক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলল
-‘আচ্ছা মা একটা সত্যি করে কথা বলো তো, সেদিন ঠিক কী কী হয়েছিলো?’

নীলা চুপ হয়ে যায়। এতদিন তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে নি।হয়তো অসুস্থতার জন্য।

আজিজুর রহমান মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে বলল
-‘মা তোমার মাথায় চাঁপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।যদি মনে না করতে পারো তাহলে মনে করারও প্রয়োজন নেই।’

নীলা কতক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
-‘আমার মনে আছে বাবা সব।সেদিন আমি পুলিশকে কল দিয়ে কথা বলার পর দেখি আমার দরজার বাহিরে কেউ ছিলো।আমি কে কে বলে সেখানে গিয়ে দেখি কেউ নেই।আমি আবার রুমের ভিতরে ঢুকতে নিলেই হঠাৎ কেউ আমাকে পিছন থেকে ছুড়ি মারলো।আমি পিছে ঘুরার আগেই আমার হাতে মনে হলো ইনজেকশন পুশ করলো।আমি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলাম।সে কি অসহ্য যন্ত্রণা। মনে হচ্ছিলো আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে।কিন্তু আপাইয়ের কথা মনে পড়তেই উঠে দাঁড়ালাম। তারপর তো সব জানো।আমি তার চেহারা আর দেখতে পারি নি।’

নীলা কথা বলতে বলতেই বেশ উত্তেজিত হয়ে গেলো।আজিজুর রহমান মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাত বুলালো মেয়ের মাথায়। নীলা উত্তেজিত হয়ে বলল
-‘বাবা তুমি আমাকে আমাদের বাড়ি নিলে না কেনো? আমাকে বড় মা দেখতে আসলো না কেনো? কই বড় মা? সবাই এখানে চলে আসছো কেনো? বড়মা আসে নি কেনো?’

আজিজুর রহমান ভড়কে যায় নীলাকে উত্তেজিত হতে দেখে।আফসানা রহমানও মেয়ের কন্ঠ শুনে ছুটে এসে মেয়েকে ছটপট করতে দেখে দিশেহারা হয়ে যায়। কতক্ষণ ছটফট করতে করতে একসময় জ্ঞান হারায় নীলা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here