বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ দ্বাদশ
মম_সাহা
নীলা চড় মারা ব্যাক্তিটার দিকে তাকিয়ে বিষ্ময়ে হতবাক।তার খালামনি তাকে চড় মেরেছে।এতদিন কোনো খোঁজখবর নেই হঠাৎ করে এসেই চড় মেরে দিলো কোনো কারণ ছাড়াই।
নীলা এবার ভালো করে লক্ষ্য করলো।শুধু খালামনি না, খালামিন সাথে রাজ,দিয়া ওদের মা মৌ আপু, সোহা সবাই এসেছে।এদের সবার মাঝে শুধু মৌ আপুর চোখ টলমলে ভাব,নীলার জন্য খারাপ লাগা কাজ করছে আর বাকি সবার চোখে অগ্নি বর্ষন হচ্ছে।
নীলা বর্ণদের ফ্লাটের দিকে তাকিয়ে দেখলো বর্ণের পুরো পরিবারও রুমের বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছে। শুধু নীলা না তারাও অবাক বুঝাই যাচ্ছে।
নীলা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘খালামনি!! এসব আচরণের মানে কি?’
রেহেনা বেগম ক্ষুদার্থ বাঘের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লো নীলার উপর।আঙুল উঁচিয়ে চিল্লিয়ে বলল
-‘তুই না এত ভালো?তোর বাবা না তোরে নিয়ে এত গর্ব করে? সেই তুই কীভাবে ছেলে ঘুরিয়ে আবার সে ছেলেকে দিয়ে আমার দেবরের ছেলেকে মার খাওয়াস? তোর বাবার নীতি কথা এখন কই রে?মেয়ে যে ছেলে ঘুরাচ্ছে সেটা কি সে দেখে না এবার?’
খালার এমন ধরনের কথায় নীলার জেনো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।খালা যে উল্টাপাল্টা বুঝে এখানে এসেছে সেটা বুঝাই যাচ্ছে।বর্ণের পরিবারও ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।হয়তো তাদের কাছেও কিছু বোধগম্য হচ্ছে না।
নীলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তার খালামনিকে বলল
-‘ভিতরে আসো খালামনি তারপর সব খুলে বলছি।বাহিরে সিনক্রিয়েট করো না।’
এবার সোহা তেঁতে এগিয়ে এসে নীলাকে চড় মারার জন্য হাত উঠালে নীলা হাতটা ধরে ফেলে।এতক্ষণ সবটা মুখ বুজে সহ্য করেছিলো ভেবেছিলো সবটা ধীরে সুস্থে বুঝাবে।কিন্তু এরা তো লিমিন ক্রস করছে।
নীলার সোহার হাতটা ঝাড়া দিয়ে কর্কশ গলায় বলল
-‘একদম এ ভুল করবেন না সোহা আপু। এটা সরকারি গাল না যে খুশি এসে চড় মেরে যাবেন।বড় বলে ছেড়ে দিবো তেমন টা না।যদি ভুল আমার হতো এমন হাজারটা চড় খেতাম।কিন্তু বিনা দোষে একটা টোকা যে দিতে আসবে তার হাত মুচড়ে ভেঙে দিতে আমার এক সেকেন্ড সময়ও লাগবে না।’
এই কথা গুলো জেনো আগুনে ঘি ঢালার মতন কাজ করলো খালার বাড়ির সবার উপর।সোহা ফুলে উঠে বলল
-‘দেখেছো মা এই মেয়ে কত নিমকহারাম। এত না বোনের মেয়ের প্রতি টান।দেখেছো তার আচারণ? একে তো ভুল করেছে তার উপর কেমন বড় গলা।বড়দের সম্মান দেওয়ার লেশমাত্র নেই ওর মাঝে।’
রেহানা বেগমও রেগে উঠে বলল
-‘একদমই ঠিক সোহা।এই মেয়েকে দেখে আমি অবাক হচ্ছি।এতদিন আমার বাড়িতে থেকে আমারই নুন খেয়ে বেইমানী করছে।এতটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ নেই এর মাঝে।তোর বাবা না এত বড় বড় কথা বললো সেদিন? আমরা নাকি আমাদের ছেলে মেয়েকে শিক্ষা দিতে পারি নি। তা তোর বাবা তোরে কি শিক্ষা দিলো রে নীলু?সামান্য কৃতজ্ঞতা বোধও তো নেই তোর মাঝে।যাদের নুন খেলি তাদের পিছেই ছোবল মারলি।’
বর্ণ এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করেছিলো।ভেবেছিলো সে কিছু বললে হয়তো জিনিসটা খারাপ দিকে যাবে কিন্তু এখন না বললে না ই হবে।বর্ণ এগিয়ে এসে ওদের উদ্দেশ্যে বলল
-‘এক্সকিউজ মি, আমার মনে হয় পারিবারিক সমস্যা রুমে গিয়ে মিটানো ভালো।আর এক্সাক্টলি আপনারা যেটাকে ইস্যু করে এখানে এসেছেন সেই পুরো ঘটনা না জেনেই এত রিয়েক্ট করছেন।পুরোটা জানলে লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা পাবেন না।’
রেহানা বেগম বর্ণের দিকে তাকিয়ে বলল
-‘তুমি কে এসব বলার হ্যাঁ?’
পিছন থেকে দিয়া বলে উঠলো
-‘এটাই তোমাদের কালা পরীর হিরো।এই হিরোরে দিয়েই রাজকে মার খাইয়েছে তোমাদের নীলু।’
দিয়ার বলার ভঙিতে ঘৃণা লেগে উঠলো বর্ণের।এতটুকু মেয়ের কথা বার্তার ধরন কি বিশ্রি।বর্ণ দিয়াকে কিছু বলতে যাবে তখনই রাজের মা ছিঃ ছিঃ করে উঠে বলল
-‘নীলা এই তোমার বাবার শিক্ষা? মেয়ের নাগরের সাথেই বাসা ঠিক করে এমন একা মেয়েকে রেখে গেছে।ছিঃ ছিঃ। এইজন্যই বুঝি আমাদের বাসা ভালো লাগে নি? তা ছিলে তো এতদিন ঐ বাসায়। লজ্জা লাগলো না ঐ বাসারই ছেলেকে এভাবে সবার সামনে মারতে?’
নীলার জেনো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।তার শিক্ষা,রূপ সব কিছু নিয়ে বলেছে তা নাহয় মেনে নিবে তাই বলে চরিত্র নিয়ে এসব কথা বলবে।নীলা ঘৃণিত দৃষ্টিতে রাজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-‘আপনাদের বাড়িতে খেয়েছি,থেকেছি বলে সেই কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে এখনো আপনাদের এসব জঘন্য কথা শুনে যাচ্ছি।আর আমার বাবার শিক্ষায় বড় হয়েছি বলেই এখনো আপনারা এসব বলেও অক্ষত আছেন।আর বার বার বলছেন যে আপনাদের বাড়িতে থেকেছি আপনাদের টা খেয়েছি সেই ভুলটা একটু শুধরে নেন।আপনাদের বাড়ি থাকা খাওয়ার খরচ হিসেবে আমার বাবা বেশ মোটা অঙ্কের একটা এমাউন্ট প্রতিমাসে আপনাদের দিতো।সে সূত্রে আমি আমার বাবার টাকায় খেয়েছি আপনাদের টা না।’
রেহানা বেগমের জেনো বেশ অপমানে লাগলো টাকার কথা টা।সোহা তাচ্ছিল্য স্বরে বলল
-‘একে তো বেলেল্লাপনা করেছে এই মেয়ে তার উপর আবার বড় বড় কথা। বাপের টাকার ফুটানি দেখাচ্ছো তুমি?’
নীলা দুহাত বুকের মাঝে গুঁজে হেসে বলল
-‘হ্যাঁ সোহা আপু আমি বাপের টাকায় ফুটানি দেখাচ্ছি।কি বলেন তো আমার বাপের টাকাই কিন্তু আপনার মতন এমন বেলেল্লা একটা মেয়েকে শ্বশুর বাড়ির ভাত খাওয়াতে পেরেছে।টাকার জন্য শ্বশুরবাড়ির লোক লাথি মেরে বের করে দিছিলো আপনাকে তখন আমার বাপই আপনাকে ঐ বাড়ির ভাত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে।ভুলে গেলেন সেই কথা? কৃতজ্ঞতা বোধ তো আপনারও নেই।’
নীলার কথাতে আচ্ছা জুতোর বাড়ি পড়েছে ওদের গালে।নীলা স্বাভাবিক হয়ে তার খালামনিকে বলল
-‘খালামনি আমার মনে হয় তোমরা পুরো একটা ভুল কাহিনীর উপর ভিত্তি করে এখানে আমাকে অপমান করতে এসেছো।ভিতরে এমে ঠান্ডা মাথায় কথা বলো।’
রেহানা বেগম এবার বেশ জোড়ে নীলাকে ধাক্কা লাগিয়ে দিলো।যার ফলস্বরূপ নীলা লোহার গেটের সাথে বারি খেয়ে মাথা ফেটে রক্ত ঝড়া শুরু করলো।বর্ণ তাড়াতাড়ি ছুটে আসলো সাথে তার মা আর ফুপুও।মৌ এতক্ষণ চুপ থাকলেও আর পারলো না।সোহাকে টেনে সরিয়ে ভেতরে গিয়ে নীলাকে ধরলো।
নীলার ততক্ষণে বেশ রক্তে বের হয়ে গেছে।খালামনির আচারণ বাহ্যিক যতটা না আঘাত করেছে তার থেকে বেশি আঘাত করেছে ফেতরটা।বর্ণের মা, ফুপু,মৌ নীলাকে ধরে নিয়ে সোফায় বসালো।ততক্ষণে শক্ত একটা পুরুষ নালী কণ্ঠ শোনা গেলো। সে পুরুষ বলছে
-‘ছিঃ মা তোমরা কতটা নিচে নেমেছো যে বাড়ি বয়ে এসে একটা মেয়েকে মারতে তোমাদের হাত কাঁপলো না।’
সবাই ফিরে তাকালো সেই দিকে।শুভ্রম ততক্ষণে নীলার ড্রয়িং রুমে হাজির হলো।শুভ্রমের পিছে পিছে রেহানা বেগম, সোহা সবাই আসলো।
শুভ্রম এগিয়ে এসে নীলার মাথাটা ধরতে নিলে বর্ণ আটকিয়ে দেয়। শুভ্রম হাতটা সরিয়ে আনে।
রেহানা বেগম বুঝতে পারে নি এমন কিছু হয়ে যাবে।সে এমন ব্যাথা পাওয়ার জন্য ধাক্কা দেয় নি।
শুভ্রম তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল
-‘তুমি তোমার দেবরের ছেলেমেয়ের কথা শুনেই একটা মেয়েকে মারতে চলে আসলে? আদৌ ওরা কতটুকি সত্যি বলছে তা যাচাই-বাছাই করে নিতে।সত্যি টা জানলে মুখ লুকানোর জায়গা তো পাবে না আম্মু।এবার বলো তো রাজ আর দিয়া ঠিক কি বলেছে তোমাদের? ফাস্ট টু লাস্ট সবটা বলো।’
রেহানা বেগমের এখন মনে হচ্ছে সে নিশ্চয়ই ভুল বুঝে এখানে এসেছে। তাকে সত্যি টা বলা হয় নি।
রেহানা বেগম কিছু বলছে না দেখে মৌ ই এগিয়ে এসে বলল
-‘আমি বলছি ভাইয়া ওরা কি বলেছে।ওরা যখন বাসায় ফিরেছে ওদের এমন রক্তাক্ত অবস্থা দেখে সবাই জিজ্ঞেস করেছিলো এমন কি করে হলো।তখন দিয়া বলল রাজ নাকি একটা মেয়েকে পছন্দ করে।তাই সে প্রপোজ করেছিলো কিন্তু তখন নাকি নীলা এসে রাজকে চড় মেরেছে সাথে দিয়াকেও।তারপর নীলার প্রেমিককে ফোন করে এনে নাকি মার খাইয়েছে। আমার তখনই মনে হয়েছে ওরা সব মিথ্যা বলছে।কিন্তু ততক্ষণে চাচী মনি খারাপ খারাপ কথা শুনাতে শুরু করে মাকে তারপর মা রেগে বের হয়ে আসে সাথে সবাই। আর নীলাদের নতুন বাড়ির ঠিকানা তো আমরা জানতাম না সেটা দিয়া বলেছে।’
শুভ্রম দিয়ার দিকে ঘুরে গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘ঠিকানা কই পেয়েছিস দিয়া? ভালোই ভালোই বল।’
শুভ্রমের এমন কন্ঠ শুনে ভয়ে গুটিয়ে যায় দিয়া।কাঁপা স্বরে বলে
-‘আমি ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার সময় আমার এক ফ্রেন্ডকে বলে ছিলাম নীলা আপুর পিছে এসে জেনো ঠিকানা জেনে যায়।’
শুভ্রম টিকতে না পেরে ঠাস করে চড় লাগায় দিয়ার গালে।চিল্লিয়ে বলে
-‘ভার্সিটির কথাটা মিথ্যা কেন বললি? বল ইডিয়েট।’
শুভ্রমের চিৎকারে কেঁপে উঠলো পুরো ঘর।শুভ্রম তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-‘মিথ্যা টা শুনে তো অনেক কান্ড করলে এবার সত্যি টা শুনো।তোমাদের আদরের দুলাল ভার্সিটির ক্যাম্পাসে মেয়েটার উড়না টেনে ধরেছিলো।মেয়েটা ছাড়তে বলায় সে আরও জোড়ে টেনে ধরে।আর তখনই নীলা চড় মারে।আর মেয়েটার ভাই হয়ে ওনার রিয়েক্ট করাটা কি স্বাভাবিক ছিলো না?আর তোমরা ছিঃ।
সবার জেনো লজ্জা করছে।রেহানা বেগম কি বলবেন বুঝতে পারছেন না।নীলার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই বর্ণ হাত দিয়ে থামিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল
-‘এবার তো সবটা জেনেছেন? এবার চলে যান এখান থেকে আর কোনো নাটক করা ছাড়াই।প্লিজ।’
রেহানা বেগম কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীলা ব্যাথাতুর নয়নে শুভ্রমের দিকে তাকিয়ে বলল
-‘আপনি আজ আমার অনেক সাহায্য করেছেন আমি কৃতজ্ঞ।আর একটা সাহায্য করুন প্লিজ ওনাদের নিয়ে চলে যান।আমি জুতা মেরে গরু দানের মতন কিছু চাচ্ছি না এখানে প্লিজ।’
শুভ্রম ধমক দিয়ে সবাইকে বের করে দিলো। মৌ থাকতে চাইলেও নীলা তাকে পাঠিয়ে দিলো।শুভ্রম বর্ণের বাহুতে হাত দিয়ে ‘টেইক কেয়ার’ বলে চলে গেলো।
এত বড় একটা ঘটনা নীলার বাবাকে না জানলে হবে না ভেবে বর্ণের মা আজিজুর রহমানকে কল লাগালেন।
রঙও বর্ণের ছোট ভাইকে কল দিয়ে বাসায় আনালো।নীলার মাথা থেকে রক্ত ঝড়ছে এখনো।কাউকেই সে ধরতে দিচ্ছে না। বর্ণ ডাক্তার হয়েও ধরতে পারছে না।কারণ নীলা তার সাথে কোনো রকমের কথা বলছে না।বর্ণের খারাপ লাগছে।তার বোনকে বাঁচাতে মেয়েটা কত কি সহ্য করলো আর সে কি না মেয়েটাকে ভুল বুঝলো।
চলবে,
Didi er next part kobe asbe?
Er porer part kobe asbe didi?