বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ নবম

0
3180

বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ নবম
মম_সাহা

নীলার বাবা-মা, বোন গ্রামে চলে গেছে পনেরো দিন অতিবাহিত হয়েছে।প্রথম কয়েকদিন নীলার বেশ খারাপ লাগলেও এখন সেটা আর লাগে না।বর্ণের পরিবার তার সাথে বেশ মিশেছে।সারাদিন তার এফ্লাট ওফ্লাট করে কেটে যায়। রান্নাবান্নাও করা লাগে না তেমন।এক বেলা নিজের রান্না খেলে তিন বেলা বর্ণের ঘরের থেকে খাবার পাঠায়। নীলা অবশ্য নিতে চায় না রাগ করে কিন্তু কে শুনে কার কথা।আবার বাড়ি থেকেও মা এখন প্রায়ই ফোন দিয়ে ওদের সাথে মিশতে বলে।নীলা এ কয়েকদিন ভার্সিটিতে যায় নি। ঠিক করেছে কাল থেকে আবার নিয়মিত যাবে।ভার্সিটির বন্ধুরা বেশ খোঁজখবর নিয়েছে। এখন টেবিল গোছগাছ করে বই গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে কালকের জন্য। হঠাৎ করে তার ডায়েরি থেকে একটা চিঠি পরলো।নীলা কতক্ষণ চিঠিটার দিকে তাকিয়ে সযত্নে তুলে নিলো।এই চিঠিটা তার মা তার টেবিলে রেখে গিয়েছিলো যাওয়ার দিন।নীলা জানতো না। তারা যাওয়ার পরের দিন বিকেলে টেবিল গুছানোর সময় এই চিঠিটা পায় সে।প্রথমে বুঝতে পারে না তার খালি ঘরে চিঠি আসলো কোথা থেকে। তারপর চিঠিটা খোলার পর সে বুঝতে পারলো এটা তার মা রেখে গেছে।সেখানে তার মা খুব সযত্নে লিখে ছিলো

আমার রাজকন্যা,
অবাক হচ্ছো তোমাকে এই নামে সম্বোধন করাতে? আমি তো মনে মনে এই নামেই ডাকি তোমাদের।তোমরা জানোই আমি তোমাদের বাবার মতন ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি না তাই বলে ভালোবাসি না তেমনটা না।তোমাকে এই চিঠিটা লিখেছি দুটো কারণে।প্রথম কারণ আমি কথা গুলো তোমাকে সামনাসামনি বলতে চাই নি কারণ এমন কিছু কথা আছে যা বাবা মা আর সন্তানদের মাঝে হওয়া শোভনীয় না,তবুও বলতে হচ্ছে কারণ তোমার এগুলো জানা প্রয়োজন।আসলে তুমি যে মনমরা হয়ে থাকো জানো তোমার বাবার উপর কি প্রভাব ফেলে এইসব?আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তোমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার তুমি সমাধান করতে পারবে।কিন্তু সেটা দিন গড়িয়ে ছয়মাসের মাথায় যখন এসে ঠেকলো তখন আর পারলাম না এই ব্যাপার একান্তই তোমার ব্যাক্তিগত ভেবে চুপ করে বসে থাকতে।তুমি ছয়মাসে হাত গনা দু বার বাড়ি এসে ছিলে আর মোট মিলিয়ে দুবারে সাতদিন বাড়িতে কাটিয়েছো।আর আমি ছ’মাস মানে একশ আশি দিনই বাড়িতে কাটিয়ে ছিলাম।তোমার বাবার সাথে ছিলাম।তুমি সাতদিনে হয়তো খেয়াল করো নি বা তোমার বাবা তোমাকে বুঝতে দেয় নি যে তোমার নিরবতা তাকে কতটা ভেঙে দিয়েছে।কত রাত সে ঘুমায় নি।কি নিয়ে জেনো সবসময় চুপচাপ থাকতো।গভীর ভাবনায় থাকতো।পরে একদিন জোড় করে জিজ্ঞেস করার পর সে মুখ খুলে বলল তার ছোট মেয়েনমর চুপচাপ হয়ে যাওয়া টা সে মানতে পারে নি।আমি বরাবরই তোমার বাবাকে শক্তপোক্ত দেখেছি।এই মানুষটার এমন রূপ মানতে কষ্ট হচ্ছিলো।আমি ওনারে বলেছিলাম তোমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে কিন্তু সে আমাকে কি বলেছে জানো? সে বললো “আফসা মেয়ে আমাদের বড় হয়েছে।সেটা মাথায় রাখতে হবে।ওর এমন সমস্যাই হয়েছে যে সেটা ও কারো সামনে প্রকাশ করতে পাচ্ছে না।নিজের ভিতরে রাখার কারণে কথার ভারে সে চুপচাপ হয়ে গেছে।আমাদের ওরে সময় দেওয়া উচিত। আকারে ইঙ্গিতে ইশারা করে বুঝানো উচিৎ যে আমরা ওর পাশে আছি।আমাদের উচিত নিজেদের মতন করে ওকে না জিজ্ঞেস করে ওর সমস্যা খুঁজে বের করা।” জানো সেদিন তোমার বাবার কথায় আমি বেশ মুগ্ধ হয়ে ছিলাম ভাগ্য করে বাবা পেয়েছো বটে।তোমার বাবার কথা অনুযায়ী তোমাকে সময় দিলাম।কিন্তু ছয়মাস সময়ও তোমার কম হয়ে গেলো আমাদের ভরসা করতে।যাক ওসব ব্যাপারে আর কিছু বলবো না।তোমার আর আমার কথা গুলো শুধু আমাদের দুজনের মাঝেই রাখবো তুমি নির্ভয় থাকো।কিন্তু শর্ত একটাই আমরা আমাদের আগের নীলাকে ফিরে পেতে চাই।অন্তত তোমার ঐ নিঃস্বার্থ বাবার কথাটা ভেবে মুভ অন করো।কালো, তিক্ত স্মৃতি মুচড়ে ফেলো পা দিয়ে।নেক্সট টাইম যখন বাড়ি যাবে তখন আমি ঐ আগের নীলাকে চাই।নিজের খেয়াল রাখবে।আর সবার সাথে মিশবে।

ইতি তোমার
মা।

হঠাৎ দমকা বাতাসে ধ্যান ফিরলো নীলার।সে ভাবতে ভাবতে আধাঁর নেমেছে চারদিক।এই শীতকালেও বোধহয় বৃষ্টি আসবে।বাহিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।নীলা চিঠিটা যত্ন করে আবার ডায়েরির ভাজে রেখে গেলো।

জানালা গুলো শক্ত করে আটকিয়ে দিলো। বারান্দার দরজা আটকানোর সময় কালো গোলাপের চাড়াটার উপর নজর পড়লো তার।

যাওয়ার দিন সকালে বাবা কোথা থেকে জেনো একটা কালো গোলাপের চাড়া এনেছিলো। নীলার হাতে দিয়ে বলেছিলো
-‘এটা আমার তরফ থেকে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার তোমার জন্য।’

নীলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।কারণ তার বাবা এর চেয়ে দামী উপহার তাকে দিয়েছিলো কিন্তু কখনোই মূল্যবান বলে নি।তাহলে এই ফুলের চারাকে মূল্যবান বলছে কেনো।বাবা যেহেতু কিছু বলেছে তার মানে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।আর সেই কারণ বাবা বাদে কেউ বলতে পারবে না।তাই সময় নষ্ট না করে নীলা তার বাবাকে বলল
-‘আচ্ছা বাবা এর আগেও তো তুমি আমাকে এর চেয়ে মূল্যবান উপহার দিয়েছো অনেক কিন্তু কখনো তো এভাবে বলো নি।’

আজিজুর রহমান মেয়ের কথায় মুচকি হাসলেন।তারপর গাছটাাে বারান্দায় একপাশে সুন্দর করে রেখে বললেন
-‘মূল্যবান অর্থ জানো আম্মু?টাকা বেশি মানেই উপহার মূল্যবান না।দামি আর মূল্যবান মিলিয়ে ফেলো না আম্মু।মূল্যবান মানে এমন কিছু যেটার বিকল্প তুমি পাবে না।এখন হয়তো বলতে পারো এগাছের বিকল্পে তুমি আরেকটা গাছ আনতে পারবে।তাহলে আমি বলবো হ্যাঁ আনতে পারবে ঠিকই কিন্তু এগাছ তোমাকে প্রতিনিয়ত যে শিক্ষা দিবে সেটা হয়তো অন্য কোনো গাছ দিতে পারবে না।’

নীলা অবাক হলো। একটা গাছ তাকে কি শিক্ষা দিবে? অবাক হয়েই সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল
-‘বাবা, গাছ আমাকে কীভাবে শিক্ষা দিবে?’

আজিজুর রহমান এগিয়ে আসেন।একটু হেসে বলে
-‘এটা কি গাছ জানো আম্মু? এটা কালো গোলাপ গাছ।এটা যখন তুমি যত্ন করবে,পানি দিবে,সাড় দিবে এটা তোমাকে তখন একটা কালো গোলাপ উপহার দিবে।আর যখন তুমি তোমার চোখের সামনে একটা কালো গোলাপকে ফুটতে দেখবে তখন তুমি মুগ্ধ হবে আর নিজেই মনে মনে বলবে কালো জিনিসের সৌন্দর্য ঠিক কতটুকু।কালো মানেই যে নিকৃষ্ট, অসুন্দর তেমনটা না।কালো মানেই কয়লা না কালো গোলাপও যে হতে পারে সেটা তুমি বুঝবে।’

বাবার কথায় মুগ্ধ হয় নীলা।সেদিন থেকেই এই গাছটার যত্ন নেয় মে নিয়মিত। হঠাৎ বজ্রপাতে ধ্যান ভাঙে নীলার।তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে গোলাপের চারাটা রুমে নিয়ে আসে যদি ঝড়ে পরে যায় সে ভয়ে।সেও যে কালো জিনিসের সৌন্দর্য নিজ চোখে দেখতে চায়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here