বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ পঞ্চম
মম_সাহা
মেহমানে গমগম করছে হল রুম।মেয়ের বাড়ির মানুষ চলে এসেছে।সাথে মেয়েও এসেছে।এখানেই দুজন দুজনকে আংটি পড়াবে।
সবাই একসাথে আড্ডা দিচ্ছে কেউ বা মেহমান আপ্যায়ন করছে। এখানে অনুপস্থিত কেবল নীলা।আজিজুর রহমান বড় মেয়েকে পাঠিয়েছেন নীলাকে তৈরী করার জন্য।
এখন আংটি পড়ানোর সময়। সবাই অপেক্ষা করছে নীলার আসার জন্য। শুভ্রমের মা ই সবাইকে অপেক্ষা করতে বলেছে।এ নিয়ে সোহা বেশ রাগারাগি করেছে।তার ভাইয়ের অনুষ্ঠানে ঐ মেয়েকে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে।
সবার অপেক্ষার প্রহর শেষ করে নীলা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে।তার পড়নে নীল রঙের একটা জামদানি শাড়ি। খারাপ লাগছে না।তার কালো শরীরে,গোলগাল মুখে শাড়িটা বেশ মানিয়েছে।নিরুপমাও একই রকম সেজেছে।দুজনকেই সুন্দর লাগছে।
নীলা নেমে আসার সাথে সাথেই শুভ্রমের মা ছুটে এসে নিজের চোখের নিচ থেকে কাজল নিয়ে নীলার ঘাড়ে লাগিয়ে দিলো।আর কপালে চুমু দিয়ে বলল
-‘মাশাল্লাহ আমার মেয়ের জেনো নজর না লাগে।’
নীলা মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। কিন্তু ওদের মাঝেই সোহা মুখ বাঁকিয়ে ঠাট্টার স্বরে বলল
-‘ওরে কাজল দেওয়ার কি দরকার আম্মু, ওর পুরো রঙই তো কাজলময়।’
সোহার কথা থামতেই ড্রয়িং রুমে ছোটখাটো হাসির রোল পরে গেলো।ড্রয়িং রুমের ই উপস্থিত এক মহিলা হাসতে হাসতে বলল
-‘কাজলকে আর কাজল মাখানোর দরকার নেই।আপনি বরং ওর সাথের ফর্সা মেয়েটার কানের নিচে কাজল লাগিয়ে দেন।নজর লাগলে ওরই লাগবে।’
নীলার অপমানে গাঁ রি রি করে উঠে।টলমলে চোখে তাকায় বাবার দিকে।আজিজুর রহমান সবসময়ই বিচক্ষণ মানুষ।সে দু’কদম এগিয়ে এসে নীলার থুঁতনিতে ধরে মুখ উঠিয়ে মাথাটা নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে বলল
-‘আসলে কাজলের মূল্য জানেন না বলেই হাসছেন।অথচ কি সুন্দর এই কাজলই নিজের চোখের নিচে লাগাচ্ছেন নিজের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য। যার জন্য উপকার হচ্ছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করুন।আর ভালো জিনিস তো সবাই চেনে না এটা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির দোষ।আমার মেয়েদের রূপের দোষ না।আমার কাছে দুজনই তো সমান সুন্দর।’
দিয়া নাক ছিটকে আজিজুর রহমানকে বলল
-‘সরি টু স্য আঙ্কেল আসলে আপনার এত বড় বড় কথা বলা উচিত না।আফ্টার-অল আপনার মেয়ের গায়ের রঙের দিকেও তাকানো উচিৎ আপনার।কে নিবে তাকে?’
দিয়ার কথায় সাঁই জানালো সোহাও।
আজিজুর রহমান দিয়ার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-‘আমার মেয়েকে কে নিবে সেটা পরে চিন্তা করো।আগে চিন্তা করো তুমি কই যাবে?তোমার তো মনে হয় কোনো জায়গায় দু’দিন টিকে থাকার ও যোগ্যতা নেই।আর সোহা তুমি, আমার আফসোস হচ্ছে ভাইসাহেব তার সন্তানদের মানুষ করতে পারলো না।’
শুভ্রমের পরিবার মানে বাবা-মা, চাচা চাচী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেন।আজিজুর রহমান গলা পরিষ্কার করে বললেন
-‘আমার মনে হয় অনুষ্ঠান শুরু করা উচিত কাল বিলম্ব না করে।’
শুভ্রমের বাবাও মত দিলো। দুজন দুজনকে আংটি পড়ালো।আংটি পড়ানোর সময়ও শুভ্রম তাকিয়ে ছিলো একবার নীলার দিকে।নীলা চুপচাপ বাবার বুকে মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে।
আংটি পড়ানো শেষ কতক্ষণ আগেই।নীলা হল রুম থেকে দূরে বারান্দায় বসে আছে।নিরুপমা নীলার পাশে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে। নীলা তখনও অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।নিরুপমা বোনের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে কান্নামাখা কন্ঠে বলল
-‘মন খারাপ কেনো করে আছিস নীলু?আমার উপর রাগ করেছিস?’
নীলার খারাপ লাগে। না চাইতেও রাগ হয় নিজের আপুর উপর।রাগে দুঃখে বলে ফেলে
-‘আমি ভাবতেও পারি নি আমার সুখের পথে কাটা হয়ে দাঁড়াবে আমারই আপুর সৌন্দর্য। আমি ভাবতে পারি নি এত গুলো লোকের সামনে আমার আপুর রঙের সাথে আমার রঙের তুলনা করে আমাকে হাসি ঠাট্টার খোরাক বানাবে মানুষ।’
কথা থামতেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরলো নীলার।নিরুপমার কষ্ট হচ্ছে।সে নিজের দু’হাতের মাঝে বোনের মুখটা আকড়ে ধরলো।অশ্রুভেজা কন্ঠে বলল
-‘আমাকে ক্ষমা করে দে না বোন।তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস না?আমি জানি খুব খারাপ লেগেছে তোর।আমি সাজ গোজ সব মুছে আসছি দাঁড়া।’
নিরুপমা এটা বলেই উঠঁতে নিলে নীলা ওর হাতটা চেঁপে ধরে।নিজের বোনের হাতটা তার মুখে চেঁপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।আর কাঁদতে কাঁদতেই বলে
-‘আপু গো ও আপু, আমার গাঁয়ের রঙ এভাবে আমার কাল হয়ে দাঁড়াবে আমি জানতামই না।আমার আল্লাহ যে এমন দুঃখ আমার কপালে লিখে রেখেছে আমি জানতাম না।বুকের ভিতর রক্তক্ষরণ কি হচ্ছে সেটা বুঝাতে যদি পারতাম তাহলে তুমি বুঝতে আপু।অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করে।’
নিরুপমা বোনকে বুকে জড়িয়ে নেয়।বোনকে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা তার জানা নেই।
দু’বোনের কথাবার্তার মাঝেই রাহাত হাজির হয়।এসেই নিরুপমার হাতটা ধরে বলে
-‘চলো না নিরু অনেক তো বোনের সাথে আড্ডা দিলে এবার আমাকেও সময় দেও।’
রাহাতের হঠাৎ আগমনে বিভ্রান্তে পড়ে যায় দুজনেই।নীলা নিরুপমার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে অন্য দিকে ঘুরে চোখের জল মুছে নিরুপমার দিকে তাকিয়ে বলে
-‘যাও না আপু।ভাইয়া এত বার করে বলছে যাও ঘুরে আসো।’
নিরুপমা না চাইতেও উঠে দাঁড়ায়। সামনে পা বাড়ানোর সময় ভুল বশত সে পিছলে যায় আর রাহাতের বা’হাতটা আকড়ে ধরে।রাহাত জোড়ে চিল্লিয়ে উঠে ব্যাথায়।নিরুপমা রাহাতের বা’হাতটা শক্ত করে মুঠ করে ধরে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল
-‘কি হলো তোমার?কি লাগলো?চিল্লিয়ে উঠলেন কেনো?’
রাহাতের ব্যাথায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।কেনো মতে নিরুপমার ধরে রাখা হাতটা ছাড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল
-‘আমার বা’হাতে প্রচুর ব্যাথা। তুমি ধরাতে সেটা আরও বেশি হয়ে গিয়েছিল।’
নিরুপমা তড়িঘড়ি করে বলল
-‘সরি সরি আমি বুঝি নি।কীভাবে ব্যাথা পেলে?’
রাহাত এখন চিন্তায় পড়ে গেলো কি বলবে ভেবে।কোনো মতে আমতা-আমতা করে বলল
-‘আজ বিকেলে পড়ে গিয়েছিলাম পিছলা খেয়ে। তখনই মচকে গেছে।’
নিরুপমা আতকে উঠে।তাড়াতাড়ি রাহাতকে তার পিছে আসতে বলে বকতে বকতে ফাস্ট-এইড বক্সের খোঁজে চলে যায়। রাহাত চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেই নীলা পিছু ডেকে উঠে।রাহাত কটমট দৃষ্টিতে তাকালে নীলা হাসি হাসি মুখ করে বলল
-‘নীলার সাথে কাহিনী করার ফল পেয়েছেন তো দুলাভাইই?’
রাহাত কতক্ষণ ফোস ফোস করে চলে যায়। নীলা হেসে ফেলে।হাসতে হাসতে চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরে।মুখ ঢেকে ফেলে নীলা।শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
আজিজুর রহমান দরজায় দাঁড়িয়ে সবটাই দেখেন।সে আসে না থামাতে মেয়েকে।তার মেয়ে যে কোনো কারণে ভিতরে ভিতরে ভেঙে যাচ্ছে সে জানে।কাঁদুক,কান্না করলে ভিতরের ভারী ভারী ভাবটা কমবে।কষ্ট টা বের হয়ে যাবে।
______
রাত এগারোটা। সবাই খাওয়া দাওয়া করেছে শুধু নীলার পরিবার আর শুভ্রমের পরিবার বাদে।মেয়ে পক্ষ চলে গেছে কিন্তু সোহা থেকে গেছে।
শুভ্রমের মা আজিজুর রহমানের সামনে এসে বলল
-‘তখনকার ঘটনার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি ভাই সাহেব।আসলেই আমি আমার সন্তানদের মানুষ করতে পারি নি।ওদের রাগ খাবারের উপর দেখাবেন না।খেয়ে নেন না ভাই।’
আজিজুর রহমান শক্ত ও প্রখর ব্যাক্তিত্বের মানুষ। সে গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘দেখেন রেহানা আপা আমি ঐ কথা আর তুলতে পারবো না।আর আমার সত্যিই এ বাড়ির ভাত গলা দিয়ে নামবে না।আমি এখনই চলে যাবো।’
সবাই আজিজুর রহমানকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু সে তার কথায় অনড়।নীলা এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো।আজিজুর রহমান মেয়ের কাছে গিয়ে বলল
-‘আম্মা চলো বাহিরে গাড়ি দাঁড় করানো আছে।’
নীলার সাথে সাথে উপস্থিত সবাই অবাক হলো।শুভ্রম উঠে এসে বলল
-‘খালু নীলাকে কোথায় নিবেন?ওর ভার্সিটির ক্লাশ চলছে এখন।আর ক’দিন আগে তো বেড়িয়ে আসল।আবার কেনো যাবে।’
রেহানা বেগমও শুভ্রমের কথায় সাঁই জানিয়ে বলল
-‘হ্যাঁ ভাই সাহেব নীলু যাবে কেনো? এমন করবেন না ভাই সাহেব।’
আজিজুর রহমান শক্ত কন্ঠে বলল
-‘প্রথমত আমার মেয়ে কোনো ফেলনা না যে এসব কথা শুনেও তাকে এবাড়িতে পরে থাকতে হবে।আমার মেয়ের আত্মসম্মান এত ঠুনকো না যে তা ধূলিসাৎ করে কারো বাড়িতে পরে থাকতে হবে।’
সবার খারাপ লাগছে।শুধু সোহা,দিয়া ও রাজ খুশি হয়েছে।তারা এমনেতেও নীলাকে পছন্দ করে না।
মৌ আজিজুর রহমানের সামনে এসে বলল
-‘হ্যাঁ আঙ্কেল নিয়ে যান ওরে।কখনো শুনেছেন খারাপ জায়গাতে ভালো কিছুর কদর দেওয়া হয়?আমাদের বাড়িটাও এমন।এরা এত উশৃংখল হয়ে গেছে যে বলার বাহিরে।ভালো থাকিস নীলু।’
রেহানা বেগম বোনের জামাইয়ের কাছে সুযোগ না পেয়ে বোনের কাছে যায়। নীলার মাকে বলে নীলাকে রেখে যেতে।নীলার মা কতক্ষণ নীলার দিকে তাকিয়ে তারপর নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে বলে
-‘আপা তুমি তো আমাদের ভরসা রাখলে না।তাহলে কীভাবে ভাবছো আমার মেয়েকে আবারও আমি এখানে রেখে যাবো।যেখানে ভরা বাড়িতে আমার মেয়ে এমন হেনস্তা হয় সেখানে খালি বাড়িতে ওরে আরও কি কি শুনতে হয় আল্লাহ মালুম।আমার সত্যিই লজ্জা লাগছে আমার বোনের ছেলেমেয়েদের জন্য। আসি আপা ভালো থেকো।’
নীলা নিজের মায়ের এমন কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। মা বরাবরই একটু আলাদা বাবার থেকে। কিন্তু আজ মায়ের লুকায়িত ভালোবাসা দেখে কার নিজেকে সব থেকে ভাগ্যবতী মনে হলো।
নীলাম্বরী বেড়িয়ে আসলো আত্মসম্মান বাঁচাতে আরও একটা মায়া কাটিয়ে। শুভ্রমের খারাপ লাগছে।শূণ্য লাগছে বুকের বা’পাশ।কিন্তু রমনীর ফিরে দেখার সময় নেই।
চলবে,,,,,