বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ পঁচিশ
মম_সাহা
নীলাকে স্টেজের পাশে আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার বান্ধবী পুষ্পা তাকে ডাক দেয় নীলু বলে।
পুষ্পার ডাকে সবাই নীলার দিকে ধ্যান দেয়।বর্ণ তার হাতের ক্যামেরাটা চ্যাক করছিলো।কিন্তু এক শাড়ি পড়া রমনীকে দেখে চোখ আটকে যায় তার।কি মায়াবী মুখশ্রী রমনীর।গোল ছোট্ট মুখটা ঘুমানোর ফলে ফুলে গেছে।চোখের পাপড়ি গুলো ভিজে একটার সাথে আরেকটা লেগে আছে।মনে হচ্ছে সে খুব বাজে ভাবে নিজের চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করেছে যার প্রমাণ স্বরূপ জল গুলো পাঁপড়িতে লেগে রয়েছে।তাদের ঝড়তে না দেওয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে।বর্ণ আনমনেই বলল-‘এই মায়াবিনী আমার রমনী।’
পুষ্পের ডাকে নীলারও ধ্যান ভাঙে। সে দিগন্তের ব্যাপারে গভীর ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে পরে।তাকে সবটা জানতে হবে।দিগন্ত কি কি জানে সব জানতে হবে।যে কোনো মতে বিয়েটা আটকাতে হবে।
পুষ্পা নীলাকে টেনে স্টেজে নিয়ে গেলো।রাহাতকে স্টেজের এক সাইডে বসানো হয়েছে আর নিরুপমাকে এক সাইটে বসানো হয়েছে। পুষ্প নীলাকে নিয়ে নিরুপমার পাশে বসিয়ে দিয়েছে।মানুষে ভরপুর চারপাশ।এখনো হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয় নি।
নীলা পাশে বসতেই বর্ণও নিরুপমাদের এখানে এসে দাঁড়ালো।তার রমনীকে মন ভরে দেখা হয় নি এখনো।রিংকুু বর্ণকে এখানে দাঁড়াতে দেখে বর্ণের পাশে লেগে দাঁড়ালো।বর্ণ নিজের পাশে রিংকুকে দেখে বেশ বিরক্ত ফিল করলো।
নিরুপমা নীলার দিকে তাকিয়ে বলল
-‘কিরে এমন মন মরা হয়ে আছিস যে?ঘুম কি এখনো ভালো মতন হয় নি?’
নীলা কোনো মতে হাসি ফুটিয়ে বলল
-‘হ্যাঁ আপাই ভালো ঘুম হয়েছে।’
অহন আর আবির নীলার বন্ধুরা বলে উঠল
-‘নীলু আজ তোকে কিন্তু বেশ সুন্দর লাগছে।নিরুপমা আপুর থেকেও বেশি।এই স্টেজে তোরও হলুদটা সেড়ে ফেললে ভালো হয় কি বলিস?’
নিরুপমা ওর কাজিনরা হেসে দেয় সাথে নীলাও।রিংকুর জেনো হজম হলো না নীলার প্রশংসা। সে ঠেঁস মেরে বলে উঠলো
-‘আরে ভাইয়া আপনারা বেশ ভালোই জোক্স মারেন তো।’
রিংকুর কথা থামতেই সবার হাসি থেমে যায়। আবির খোঁচা মেরে বলে
-‘আরে পিচ্চি তুমি তো এখনও কথা বলাই শিখো নি।কথা বলতে আসছো কেনো?আর এই প্রশংসা টা তখনই জোক্স হতো যখন তোমাকে বলা হতো।’
আবিরের কথার ধরণে আবার সবাই হেসে ফেলল।বর্ণ হাসতে হাসতে বলল
-‘রাইট বলেছো।’
এতক্ষণ যেমন তেমন বর্ণ বলাই রিংকুর অপমানে লাগলো।নীলাকে হাসতে দেখে আগুনে জেনো ঘি ঢালার মতন কাজ করলো।কি বলবে বুঝতে না পেরে ফুঁসতে শুরু করলো।হঠাৎ তার চোখ গেলো নীলার হাতের দিকে তারপর বাঁকা হেসে বলল
-‘বাহ্ নিলা আপু সকালে তো বেশ বড় বড় ভাষন দিলে মেহেদী নিয়ে এখন দেখছি দু হাত ভর্তি মেহেদী দেওয়া।’
নীলা এই ভয় টাই পাচ্ছিলো।আমতাআমতা করে বলল
-‘আমি দেই নি।ঘুম থেকে উঠে দেখি দুই হাত ভর্তি মেহেদী।কে দিয়েছে জানি না।’
রিংকু তাচ্ছিল্য হেসে বলল
-‘ হ্যাঁ হয়েছে হয়েছে বুজেছি।এখন ধরা পড়ে হাজার অজুহাত।’
নিরুপমা এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। এখন সে রিংকুর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল
-‘অজুহাত কি রে? তুই বেশি জানিস না? এত টুকু মেয়ে এত পাঁকা পাঁকা কথা কীভাবে বলিস? নীলা তো সত্যিই বলেছে। ও ঘুমিয়ে ছিলো যখন তখনই তো আমি ওর হাতে মেহেদী পরিয়ে দিয়েছি।তো ও জানবে কীভাবে?’
নীলা অবাক হয়ে আপুর দিকে তাকালো।তারপর বিস্ময় ভরা কন্ঠে বলল
-‘আপাই তুমি জেনে শুনেও কেনো মেহেদী লাগিয়ে দিয়েছো?আমি তোমার থেকে এটা আশা করি নি।তুমি জানো মেহেদী আমার অপছন্দ তবুও এটা না করলে পারতে।’
আপুর প্রতি এক বুক অভিমান নিয়ে রমনী উঠে যেতে নিলেই আপু তার হাত ধরে ফেলে। তারপর শান্ত স্বরে বলল
-‘মেহেদী তোর কতটা অপছন্দ বা কতটা পছন্দ আমার সেটা ভালো করেই জানা আছে।পৃথিবীর মানুষ হাজার কথা বলবে।সেগুলো ধরে যদি নিজের শখ, আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়ে দিস তাহলে তুই বোকা ছাড়া আর কিছুই না।তুই যার উপর রাগ করে নিজের পছন্দের শখ বাদ দিয়েছিস খোঁজ নিয়ে দেখ সে জানেও না এসব।জানলেও তার এতে কিছু আসে যায় না।তাহলে কেনো সেক্রিফাইস করছিস?’
নীলা অবাক হয় বোনের কথায়। কতটা ভালোবাসে এ মানুষ গুলো তাকে। হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে রাহাতের ভাবনা।না বোনকে কোনো মতেই রাহাতের সাথে বিয়ে দিবে না।
নীলার ভাবনার মাঝেই কেউ তার কোলে কিছু রাখলো।নীলা অবাক হয়ে কোলে তাকাতেই দেখলো ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে গোলগাল তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বিহীন হাসি হাসছে।
নীলা অবাক হয়ে সামনে তাকাতেই দেখে তিমা আপু।সে তাড়াতাড়ি বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে উঠে তার তিমা আপুকে জড়িয়ে ধরলো।
তিমা হাসি মুখে জড়িয়েই বলল
-‘কিরে পরী আমাকে তো ভুলেই গেছিস।’
নীলা মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে বলল
-‘না টিমটিমপু তোমাকে ভুলি নি।তুমি তো আমার এখানে এই হৃদয়ে আছো।’
-‘হ্যাঁ কত হৃদয়ে রেখেছো বুঝাই যাচ্ছে। একটু খোঁজ খবর নেই।’
নীলা তিমার কথায় দাঁত দেখিয়ে একটা বেক্কল মার্কা হাসি দিলো। নীড় ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘ছোট আপু তুমি কি নামে ডাকলে ওনাকে? টিমটিমপু আবার কি?’
নীড়ের কথায় হেসে দিলো তিমা নীলাসহ সবাই। তারপর তিমাই বললো
-‘আমার নাম তিমা কিন্তু কাজিন সবাই ডাকে টিমটিম। আর নীলার বড় যেহেতু সেহেতু ওর আপু হই।মানে টিমটিম আপু ওটারই শর্ট ভার্সন টিমটিমপু।’
এমন উদ্ভট নাম শুনে হেসে দিলো সবাই।গায়ের হলুদ শুরু হবে বলে সবাই একে একে স্টেজ থেকে নেমে গেলো। নীলা তার কোলে তৃণ মানে তিমার ছেলেকে নিয়ে নামতে নিলে বর্ণ হাত বাড়িয়ে দেয়। নীলা আস্তে আস্তে বর্ণের হাত ধরে নেমে যায়। এই দৃশ্য দেখে দূর থেকে দুজন হিংসায় জ্বলে যাচ্ছে।একজন রিংকু আরেকজন রাহাত।আজকাল সে নীলাকে মানতে পারছে না অন্যের পাশে।
হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।রাহাতকে তার বাবা মা প্রথম হলুদ দিতে গিয়েছে আর নিরুপমাকে তার বাবা মা।
ততক্ষণে দিগন্তও চলে এসেছে। সবাই একসাথে বসে আছে।আগন্তুকের বুকে কামড় দিয়ে উঠছে।বিয়েটা তাহলে কি হয়ে যাবে?নীলা কি কিছুই করবে না?
নীলার থেকে তৃণকে বর্ণ নিয়ে নেয়।শাড়ি পড়ে আরেকটা বাচ্চা ক্যারি করা নীলার জন্য কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠেছে বলে।বর্ণের কোলে তৃণ আর নীলা পাশে বসে আছে। তৃণের সাথে তারা দুজন মেতে উঠেছে।হঠাৎ ছবি ক্লিক করার শব্দে দুজনই সামনে তাকিয়ে দেখে নীড় ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তারপর চোখ টিপ মেরে চলে যায় সে।বর্ণ হেসে ফেলে ভাইয়ের কান্ডে।
বর্ণ বেশ মিশছে বাচ্চাটার সাথে। নীলাও অবাক বর্ণকে এতটা মিশতে দেখে। এর মাঝেই তিমা চলে আসে।হাসিমুখে বর্নের কাছে থেকে তৃণকে নেয় খাওয়াবে বলে।বর্ণকে নিজের ছেলের সাথে এতটা মেতে উঠতে দেখে তিমা নীলাকে জিজ্ঞেস করল
-‘কিরে নীলু বললি না তো এই ভাইয়াটা কে?’
নীলা কিছু বলার আগেই বর্ণ বললো
-‘আগে বলেন নীলা তৃণের কি হয়?’
তিমার স্বামী কবির পিছন থেকে হাসতে হাসতে বলল
-‘নীলা আমার ছোট বউ সে হিসেবে আমার ছেলের ছোট মা হয়।তা তুমি কি হও এবার বলো।’
বর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে তৃণের গাল টেনে বলল
-‘তবে আমি তৃণের ছোট বাবা হই।’
কথা বলে এক মুহূর্ত দাঁড়ায় নি বর্ণ।নীলা শুধু অবাকে হা হয়ে রইল।তিমা আর কবির মজা উড়াণো শুরু করে দিলো।
________
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে একটু আগে।সবাই বেশ ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে।শুধু ঘুমায় নি নীলা।একটু আগে রাহাতের সাথে তার বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে। রাহাত এখন উল্টো সুর গাইছে।সে নাকি নিরুপমাকে বিয়ে করতে পারবে না হেনতেন।এসব নিয়ে বেশ কথা হয়েছে দুজনের মাঝে।নীলা ছক কষছে বিয়ে ভাঙার। তার জন্য সবার আগে দিগন্তের সাথে কথা বলতে হবে।তাই সে এত রাতে দিগন্তকে ছাদে ডেকেছে।
নীলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। কিভাবে কাল কি করা লাগবে সব ছক কষা হয়ে গেছে।একটু আগেও তার ঘরে আরেকটা চিরকুট ছিলো। সেখানে সেইম হাতের লেখায় লিখা ছিলো
“একটা ভুল কতগুলো জীবন ধ্বংস করে দিবে।একটু নিশ্চুপতা নিরব করে দিবে তার কাছের মানুষদের।এবার মুখ খোলার পালা নীলা।”
এসব ভাবাচ্ছে তাকে।এসব ভাবনার মাঝেই পিছন থেকে দিগন্ত বলে উঠল
-‘বনু ডাক ছিলে কেনো?’
নীলার ধ্যান ভাঙে।পিছে ফিরেই বলে
-‘একটা সত্যি কথা বলবে ভাইয়া?’
দিগন্ত ভ্রু কুঁচকে ফেলে
-‘হ্যাঁ বলো।’
নীলা শান্ত স্বরে বলল
-‘গায়ের হলুদের লিখাটা তুমি লিখেছো?আর একটু আগে যে হুডিটা পড়ে ছিলে সেটাও কি তোমার?’
নীলার প্রশ্নে দিগন্ত সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো।কিন্তু নীলার কাছে সব ঝাপসা হয়ে গেলো।মাথায় জেনো আকাশ ভেঙে পড়ার মতন অবাক হয়েছে।তার মানে সব উত্তর তার সামনেই ছিলো?কাল তাহলে অজানা কিছু ঘটতে চলেছে।’
চলবে